ছবি: শাটারস্টক
যে বার্তাকক্ষ ‘চাঁদ ছুঁতে’ চেয়েছিল: বাজফিড নিউজের অনুসন্ধানী দলের উত্থান-পতন নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান
কখনো ভাবিনি একসঙ্গে এত টাকা হাতে পাবো। ২০১৮ সালে, অক্টোবরের এক বিকেলে আমি ব্যাংকে গিয়ে ১০,০০০ পাউন্ড ও কিছু মার্কিন ডলার তুলে আনলাম।
লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে গুহাসদৃশ আধুনিক একটি অফিসে বাজফিডের যুক্তরাজ্য শাখার সদর দফতর। আমি এখানেই অনুসন্ধানী দলের রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতাম। টাকা হাতে নিয়ে অফিসে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, কখন না আবার ছিনতাইয়ের শিকার হই। যখন পৌঁছালাম, আমরা সবাই সেই চকচকে টাকা ঘিরে, অবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কেউ তুলে ধরে দেখছিল, কেউ হাতে নিয়ে ছবি তুলছিল, কেউবা ভাঁজে ভাঁজে সাজিয়ে রাখা চকচকে নোটগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। আমাদের কাছে সব অবাস্তব মনে হচ্ছিল। আমাদের যে এত টাকা দেয়া হলো, এর পেছনে একটি পেশাগত কারণ ছিল। সহকর্মী কেটি বেকার ও আমি ক্যামেরুনের প্রত্যন্ত রেইনফরেস্ট অঞ্চলে, সেখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের স্টোরি সংগ্রহের জন্য রিপোর্টিং সফরে যাচ্ছিলাম।
সেদিন থেকে একটি প্রশ্ন কিছু সময়ের জন্য আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল: মাত্র ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণ প্রতিবেদকদের একটি দল অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য এত টাকা কীভাবে খরচ করতে পারে, এবং এতটা আনন্দের সঙ্গে? নিশ্চয়ই এই আনন্দ একদিন ফুরোবে?
বাজফিড নিউজ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১১ সালে । এর বছর খানেক পর অনুসন্ধানী দল তৈরির জন্য পুলিৎজার জয়ী সাংবাদিক মার্ক শুফসকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি গৎবাঁধা ধারার বাইরে কিছু একটা করতে চাচ্ছিলেন।
নিঃসন্দেহে কাজটি ছিল অত্যন্ত কঠিন, একটানা এবং দীর্ঘ সময় ব্যাপী। কিন্তু তিনি বড় স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি এবং কাজের মধ্যে আনন্দ খুঁজে নিয়েছিলেন।
মূল বিষয়টি হলো: আপনি সেরা সাংবাদিকতা তখনই করতে পারবেন যখন কাজে আনন্দ খুঁজে পাবেন, আর বিশেষ করে বন্ধুদের সঙ্গ পাবেন। নিরস অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কাছে বিষয়টিকে স্থূল ও নিছক ইচ্ছাপূরণের মতো মনে হতে পারে। তবে এটাই সত্যি। রিপোর্টিংয়ের চোরাবালিতে আটকে পড়াটা ক্লান্তিকর হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু বিশ্বস্ত ও যত্নশীল মানুষদেরকে পাশে পেলে সেটি অনেক সহজ হয়ে যায়।
একটি সত্যিকারের সহযোগিতামূলক সংবাদমাধ্যম
কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে, বাজফিডের অনুসন্ধানী দলের কাজের বিভিন্ন কৌশল সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। গর্ব করার মতো বিষয় ছিল, প্রকাশনায় কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছিল না। অনেক সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে প্রতিটি রিপোর্টারকে, বিভিন্ন সম্পাদকের কাছে থেকে যে রকম অযাচিত নাক গলানোর বিড়ম্বনা সহ্য করতে হতো, এখানে তার কিছুই ছিল না।
আর এখানে প্রথাগত নিম্নমূখী পদক্রম ছিল না। প্রত্যেকেই মনে করতেন, তাদের কথা বলার অধিকার আছে এবং আলোচনার টেবিলে সবাইকে কথা বলতে উৎসাহিত করা হতো। উর্ধ্বতনদের তোষামোদী এবং নিম্নপদস্থদের প্রতি রূঢ় আচরণ অনেক সংবাদমাধ্যমেই অলিখিত চর্চা হলেও এখানে তা ছিল পুরোপুরি নিষিদ্ধ।
শুফস এমনভাবে অনুসন্ধানী দলটি চালাতেন যেন মনে হতো এটি অর্ধেক জলদস্যু জাহাজ, আর অর্ধেক পারিবারিক ব্যবসা। এই কৌশল কাজ করেছিল। সবাই একে অন্যের জন্য অতিরিক্ত কাজ করতে প্রস্তুত ছিল, বাইলাইন ও সোর্স ভাগাভাগিতে কারো মনে কোনো হিংসা কাজ করত না। সহযোগিতামূলক পরিবেশ ছিল মানসম্পন্ন সাংবাদিকতার অনুঘটক।
প্রতি বছর আমাদের একটি শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন হতো। সেখানে পুরো অনুসন্ধানী দল, ২০ বা তারও বেশি সদস্য, পরের বছরের পরিকল্পনা আঁটতে নিউইয়র্কে উড়ে যেত। এটি আমাদেরকে সব দিক থেকে একটি দল, একটি বিভাগ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করেছিল। সেখানে রিপোর্টাররা একের পর এক আইডিয়া ছুঁড়ে দিতেন, রিপোর্টে ব্যবহারের জন্য একে অপরের কাছ থেকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সংগ্রহ করতেন, বা বিশেষ প্রকল্পের জন্য সম্ভাব্য সহযোগী খুঁজে নিতেন। আমার বিশ্বাস, এই পারস্পরিক বন্ধুত্ব আমাদের সফলতার পেছনে একটি বড় ভূমিকা রেখেছিল।
‘চাঁদ ছুঁতে’ ছুটে চলা
আর মানদণ্ডগুলোও সেভাবেই দাঁড় করানো হয়েছিল। রিপোর্টারদের আপাত দৃষ্টিতে অসম্ভব এবং যুক্তির সীমা ছাড়ানো সব স্টোরির পেছনে ছুটতে এবং সেগুলোর সমর্থনে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহে উৎসাহ দিতেন শুফস ও অন্যান্য সম্পাদকেরা। এমনকি এ নিয়ে আমাদের নিজস্ব ভাষা ছিল: মুনশট (চাঁদ ছোঁয়া)। প্রতিটি প্রকল্পের শুরুতে লক্ষ্য থাকে আমাদের সবচেয়ে সাধ্যমত উচ্চাভিলাষী, “সর্বোচ্চ” স্টোরিটি নিয়ে কাজ করা, আর সেই বিষয়গুলো খুঁজে বের করা। কার কাছে অকাট্য প্রমাণ থাকতে পারে আর কীভাবে সেগুলো খুঁজে পেতে পারি?
প্রকল্পটি কত দিন ধরে চলবে, সেটি নির্ভর করত দলের উচ্চাকাঙ্ক্ষার ওপর। এক কথায় স্টোরি শেষ হলে ডেডলাইন ঠিক করা হতো। রিপোর্টিংয়ে এমনভাবে যৌক্তিক উপসংহার টানতে হবে যেন কিছু বাদ না পড়ে। প্রকল্পের মাঝপথে আটকে যাওয়ার মতো নেতিবাচক দিক থাকলেও এই পদ্ধতিতে রিপোর্টাররা সবচেয়ে কঠিন স্টোরিগুলোর পেছনে ছুটতে পারতেন। কারণ তাঁরা জানতেন, অল্প সময়ের মধ্যে স্টোরি শেষ করার তাড়া নেই।
অর্থ (প্রায় ক্ষেত্রে) কোনো বিষয়ই নয়
এই কর্মপদ্ধতির মূল বিষয় ছিল সম্পদের যোগান, আর আমাদের সেটির অভাব ছিল না। তাহলে শুনুন, ভাল রিসোর্স সমৃদ্ধ সাংবাদিকতা কেমন হতে পারে। আমাদের দলে দুর্দান্ত সব নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং তারা বিশ্বের যে কোনো যায়গায় ভ্রমণ ও ডিজিটাল সুরক্ষার কৌশল নিয়ে পরামর্শ দিতে পারতেন। চাইলেই নিউজরুমের নিজস্ব ডেভেলপারদের পাওয়া যেত। আর ছিলেন বার্তাকক্ষের বিশেষজ্ঞ আইনজীবী যারা স্টোরির জন্য প্রাণপণ লড়াই করতেন।
শুনে অচেনা মনে হচ্ছে? আমার কাছেও তেমনই মনে হয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সংশোধনীর বাক স্বাধীনতার অধিকার দ্বারা সুরক্ষিত নয় এমন বেশিরভাগ সাংবাদিক প্রায়ই বলে থাকেন যে তাদের স্টোরিগুলো খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এমনকি অকাট্য সত্যি হলেও ঝুঁকিমুক্ত নয়।
আরেকটি বিষয় অনুসন্ধানী দলকে অনন্য করেছে, তা হলো এর বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। ২০১৪ সালে বাজফিড যখন যুক্তরাজ্যে অনুসন্ধানী প্রতিবেদকদের একটি দল নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়, আমি সেখানে যোগদানের জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলাম।
যুক্তরাজ্যে একটি অনুসন্ধানী দল গঠন করা দারুণ একটি পদক্ষেপ ছিল। সে সময়ে রাশিয়াকে হুমকি হিসেবে নিয়ে ক্রমবর্ধমান সচেতনতা বাড়ছিল, আর লন্ডন তখন মার্কিন পাঠকদের জন্য আগ্রহের আর্থিক ও আইনি বিষয়গুলোর ক্লিয়ারিং হাউস হিসেবে কাজ করেছিল। এটি বিশ্বের একটি প্রবেশদ্বার ছিল।
আমার জানামতে, প্রথমবারের মতো একটি মার্কিন সংবাদ সংস্থা আমেরিকার বাইরে একটি অনুসন্ধানী দল নিয়ে ঘাঁটি গেড়েছিল। এখন এটি একটি আদর্শ পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে — বাজফিড নিউজের সাফল্যের পর নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী দল গঠন করেছে।
যুক্তরাজ্যের সানডে টাইমসের সাড়াজাগানো রিপোর্টার হাইডি ব্লেককে যুক্তরাজ্য অংশের সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ত্রিশ না-পেরুনো বিস্ময়কর প্রভিতভাবান এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদক এমন কিছু তরুণ সাংবাদিকদের নিয়োগ দিয়েছিলেন, যারা শুফসের মতোই স্মরণীয় কিছু করতে মুখিয়ে ছিলেন।
ধামাকা দিয়ে শুরু
যুক্তরাজ্যের অনুসন্ধানী দলের প্রথম স্টোরিটি প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আমাদের কাছে তথ্য ছিল যে কনজারভেটিভ পার্টির বড় দাতা হিসেবে পরিচিত এক ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন ফোনকার্ড প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা পূর্ব লন্ডনের আশেপাশের পোস্ট অফিসে সন্দেহজনক নগদ টাকার ব্যাগ ফেলে যেত।
তারুণ্যের সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর রিপোর্টিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ হাতের মুঠোয় পেলে কীভাবে এমন একটি স্টোরি সাজাবেন? আমাকে বলতে দিন: শহরের আশেপাশে তাদের নগদ অর্থ সামলানোর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের ওপর এক সপ্তাহ-ব্যাপী নজরদারি অভিযান এবং তাদের অর্থ লেনদেনের চিত্রধারণ।
আমরা ছদ্মবেশ ধরছিলাম না – কখনও মিথ্যা পরিচয়ে কারো সাক্ষাৎকার নিইনি বা ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে প্রবেশ করিনি। তবে আমরা যে তাদের অনুসরণ করছি, আমরা চাইনি তা তাদের লোকেদের চোখে পড়ুক। এই কাজে আমরা দক্ষ ছিলাম না। তাই ধরা না পড়ে মানুষকে অনুসরণের উপায় শেখাতে আমাদেরকে একজন প্রাক্তন সামরিক গোয়েন্দা নিয়োগ দিতে হয়েছিল। আমরা গোপন রেকর্ডিংয়ের জন্য সরঞ্জামও কিনেছি। আর, হ্যাঁ, আমরা পরচুলা পরতাম।
প্রথমে ব্যর্থতা আসে। আমরা যে গাড়িগুলো অনুসরণ করতাম, সেগুলোর সঙ্গে তাল মেলাতে পারতাম না। কিন্তু যখনই প্রমাণ পেয়েছি, আমরা চলমান ঘটনা সম্পর্কে জানতে মাঠ পর্যায়ে আরও রিপোর্টিং করেছি। আমরা পোস্টমাস্টার, আর্থিক অপরাধ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে কোম্পানির আর্থিক হিসাব-নিকাশ বিশ্লেষণ করেছি।
আমাদের তখন গর্বের শেষ নেই। তবে স্টোরিটি প্রকাশের পর যেন কবরের নীরবতা নেমে আসে। প্রভাবশালী মূলধারার গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের মেজাজ খারাপ হয়েছিল। তবে ক্রমেই ক্ষমতার ভারসাম্য বদলাতে থাকে। একটা সময় ছিল, যখন কোনো বিষয় নিয়ে সাড়া ফেলতে হলে বড় প্রকাশনা সংস্থার মনোযোগ দরকার হতো। কিন্তু এই সাহসী, নতুন ডিজিটাল পরিসরে পাঠকেরা সরাসরি আপনাকেই খুঁজে নিতে পারেন।
আমরা স্টোরিটি আঁকড়ে ধরে ছিলাম, এবং শেষ পর্যন্ত এটি মূলধারায় এসেছে, বিশেষ করে “রাজনৈতিক অনুদানের” অজুহাত দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে তদন্তে ফরাসি সরকারকে সহায়তা দিতে ব্রিটিশ কর কর্তৃপক্ষের অস্বীকৃতি নিয়ে আমাদের রিপোর্ট মূলধারায় সাড়া ফেলেছিল। প্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েকজন কর্মী বর্তমানে ফ্রান্সে অপরাধমূলক অর্থ পাচারের জন্য বিচারের অধীনে আছেন।
বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তার
বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য উভয় দেশেই অনুসন্ধানী দল হিসেবে আমাদের খ্যাতি ছড়িয়েছে এবং আমাদের স্টোরিগুলো দুটি জর্জ পোল্ক অ্যাওয়ার্ড, দুটি ব্রিটিশ জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ড, একটি ন্যাশনাল ম্যাগাজিন অ্যাওয়ার্ড এবং তিনবার পুলিৎজার ফাইনালিস্ট অনার্স সহ বড় বড় পুরস্কার জিতেছে। দলটি অন্যান্য রিপোর্টারদের পরামর্শ ও সহায়তা দিয়ে সংবাদ মাধ্যমের জন্যও একটি রিসোর্স ছিল। আমাদের একজন ব্যবস্থাপকের সম্পাদিত জিনজিয়াং জেল ক্যাম্পের স্টোরিটি বাজফিড নিউজকে পুলিৎজার এনে দিয়েছে।
শিকাগোর এক পুলিশ অফিসারের অসদাচরণ নিয়ে মেলিসা সেগুরার লেখা একটি অনুসন্ধানী ধারাবাহিকের ভিত্তিতে ৩৭ জন কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে বা মুক্তিতে সহায়তা পেয়েছে, যাদের মধ্যে সাতজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হত্যা মামলা গণ খারিজের ঘটনায় বেকসুর খালাস পেয়েছে।
মস্কোতে ১০০ তলা ভবন তৈরির জন্য প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দৌঁড়ঝাপের গোটা দৃশ্যপট সামনে এনেছেন আমাদের দলের দুই সদস্য। আমরা পুল বয় জেরি ফলওয়েল জুনিয়রের কেলেঙ্কারি ফাঁস করেছি, এক কুখ্যাত পেশাদার খুনির প্রোফাইল তুলে ধরেছি যিনি ক্যালিফোর্নিয়ার সেন্ট্রাল ভ্যালিতে থাকতেন এবং হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, এনওয়াইপিডি-এর শৃঙ্খলাজনিত রেকর্ডগুলো প্রকাশ্যে এনেছি, ধর্ষণের আইন পরিবর্তনে রাজ্যের আইন প্রণেতাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছি এবং ইয়েমেনে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্তাদের চলমান হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তুলে ধরেছি।
যে স্টোরির জন্য আমি ১০,০০০ পাউন্ড তুলেছি? ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (ডব্লিউডব্লিউএফ) আমাদের প্রতিবেদনের পর স্বীকার করেছে যে বছরের পর বছর তারা আর্থিক তদারকিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযুক্তদের জন্য অর্থায়ন বন্ধ করেছে। সংরক্ষণ প্রকল্পগুলো কীভাবে আদিবাসী সম্প্রদায়ের ক্ষতি করতে পারে, তা নিয়েও অনুসন্ধানটি সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে।
আমাদের কিছু সেরা স্টোরি তৈরিতে আটলান্টিক মহাদেশজুড়ে একাধিক পক্ষের ব্যাপক সহযোগিতা ছিল— যেমন যুক্তরাজ্যে রুশ-যোগসাজশে মৃত্যু নিয়ে রচিত ধারাবাহিক “ফ্রম রাশিয়া উইথ ব্লাড” সর্বাধিক বিক্রিত বই ছিল।
আরেকটি বড় প্রকল্প ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি নথি ফাঁসের ভিত্তিতে করা, ফিনসেন ফাইলস। এই প্রকল্পের জন্য আমরা ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট (আইসিআইজে) ও গোটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব করেছি৷ এ ধরনের সহযোগিতামূলক প্রকল্পগুলো চালানো কঠিন, এবং চালিয়ে যেতে শক্তি লাগলেও এগুলোতে বিশ্বব্যাপী শত শত সাংবাদিকদের শক্তি ও সক্ষমতা কাজে লাগানো হয়।
সংবাদমাধ্যমে ভাঙন
দুর্ভাগ্যবশত, ফিনসেন ফাইলই ছিল আমাদের শেষ বড় প্রকল্পগুলোর একটি। ২০২২ সালের মার্চে কোভিড-১৯ মহামারির অল্প সময় পরই কোম্পানিটি ঘোষণা করেছিল যে অনুসন্ধান বিভাগ ও সংবাদকক্ষের অন্যান্য বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া হবে। পরের বছর কর্মী ছাঁটাই হয়েছিল। আর তারপর ২০২৩ সালের এপ্রিলে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা বিভাগ অর্থ সাশ্রয়ের জন্য পুরো বাজফিড নিউজ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। (বাজফিড নিউজের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তার খুঁটিনাটি জানতে এই সাইটের অসাধারণ, বিশদ মৌখিক ইতিহাসটি দেখুন।)
তবে সবকিছু বদলাতে শুরু করে, এরও আগে। পরবর্তী বছরগুলোতে, খরচ কমানোর চাপের প্রভাব ছিল এক কথায় ভয়াবহ। আগে সংবাদ মাধ্যমটিতে অনেক বেশি ব্যয় ও অনেক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল: ২০১৫ সালে বেশি মাত্রায় রিপোর্টিং ছিল সাফল্যের চাবিকাঠি, এবং কোম্পানিটি অন্তত আংশিকভাবে হলেও এই বিশ্বাসে বিনিয়োগ করেছিল যে রাজস্ব উঠে আসবে।
তবে ইন্টারনেট বদলে যাওয়ায় এবং বিজ্ঞাপনের অর্থ গুগল, ফেসবুক ও অন্যান্য বড় প্রযুক্তি কোম্পানির কাছে চলে যাওয়ায়, প্রতিবেদকদের বিশাল বহরকে টিকিয়ে রাখার খরচ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। প্রায় প্রতিটি ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমের জন্য একই গল্প প্রযোজ্য।
জোনাহ পেরেট্টি ও বাজফিড নিউজ নিয়ে অনেক কিছু লেখা হয়েছে আর এর বেশিরভাগই একটি মৌলিক সত্যকে এড়িয়ে গেছে: ২০১০ এর দশকে মনে হয়েছিল, ডিজিটাল সংবাদ কেবলই উর্ধ্বমূখী।
বাজফিডে আমার প্রাক্তন সহকর্মী অ্যালেক্স ক্যাম্পবেল বলেছেন, “আমার মতে, আমাদের সকল পাঠক ও রাজস্ব বড় সামাজিক যোগাযোগ প্লাটফর্ম থেকে আসবে মনে করে আমরা যে জুয়া খেলেছিলাম, তা দীর্ঘমেয়াদে কাজে আসেনি। আমরা যেখানটায় বাজি ধরেছিলাম, তাতে আমরা হেরে গেছি; এর জবাব হতে পারতো বাজি না ধরা, কিন্তু তাহলে আর অনুসন্ধানী দল হিসেবে আমাদের আট বা নয় বছরের দুর্দান্ত যাত্রাটি হতো না।”
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা থেকে সবসময় ব্যবসায়িক সাফল্য আসে না। যদিও তা পাঠকদের টানতে পারে, বা সদস্যদের আগ্রহ বাড়াতে পারে। আর মেধাস্বত্ত্ব সুসংবদ্ধভাবে গোছানো যায় ও বিক্রি করা যায়। তবে বাস্তবতা হলো প্রতিটি সংবাদমাধ্যমে অনুসন্ধানী রিপোর্টিং যতই সফল হোক না কেন, তা দিন শেষে তা আর্থিক লোকসানই বয়ে আনবে।
আমার দৃষ্টিতে, বাজফিডের নেতৃস্থানীয়রা সংবাদমাধ্যমটিতে একটি খাসা কাজ পেয়েছেন। বছরের পর বছর পেরেট্টি ও বাজফিডের নেতারা আমাদের সাংবাদিকতাকে সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত প্রত্যাশার পারদে ছেদ না আসা অবধি আমাদের কর্পোরেট কর্তারা সমর্থন দিয়ে গিয়েছিল। মামলা থেকে তারা পালিয়ে যাননি বা সহজ পথ বেছে নেননি। এটি ছিল দিনের প্রতি ঘণ্টায় সাংবাদিকতার সর্বোচ্চ প্রয়াস। অনুসন্ধানী রিপোর্টিংয়ের জন্য তাঁরা অনেক করেছেন, পুরো কোম্পানি জুড়ে সেই সমর্থন ছিল।
বাজফিড নিউজের একটি সমস্যা হলো, এটি ব্যবসাকে টেকসই করার কর্মপন্থা ঠিক করতে পারেনি। মানুষ অনেক সময় বাজফিড নিউজকে রকেট জাহাজ বলে থাকে: নিশ্চয়ই তারা আলো ছড়াত, তবে নিশ্চিতভাবে কেউই জানত না যে সংবাদমাধ্যমটি আপনাকে চাঁদে নিয়ে যাবে নাকি জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে দিবে। দেখা গেল, দুটিই হলো।
আরও পড়ুন
চীনা “গুগল ম্যাপ” ঘেঁটে জিনজিয়াংয়ের বন্দীশিবির অনুসন্ধান
প্রথাগত গণমাধ্যমের ডিজিটাল রূপান্তর: এশিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে যা শেখার আছে
ভুয়া তথ্য ছড়ানোর নেপথ্যে কারা – অনুসন্ধান করবেন কীভাবে?
টম ওয়ারেন বাজফিড নিউজের অনুসন্ধানী সংবাদদাতা, এবং দু’বারের পুলিৎজার ফাইনালিস্ট। তিনি ফিনসেন ফাইল নিয়ে রিপোর্ট করেছেন, ব্রিটেনে রুশ কার্যকলাপ নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন, ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সিতে পদ্ধতিগত ত্রুটি খতিয়ে দেখেছেন এবং দুর্নীতিগ্রস্থ একটি ব্যাঙ্কের ভেতরের গল্প তুলে ধরেছেন। বাজফিডে যোগদানের আগে, তিনি ব্রিটিশ জার্নালিস্ট অ্যাওয়ার্ডে নিউ জার্নালিস্ট অব দ্য ইয়ার হিসেবে ভূষিত হয়েছেন এবং ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের হয়ে কাজ করেছেন।