প্রবেশগম্যতা সেটিংস

লেখাপত্র

বিষয়

চিংড়ি চোরাচালান, হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ড, তামাক শিল্পের ক্ষতিকর প্রভাব: চীন, হংকং ও তাইওয়ানের ২০২৩ সালের সেরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:

২০২৩ সাল ছিল চীনের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য আরো একটি চ্যালেঞ্জিং বছর। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের ২০২৩ সালের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম সূচকে মোট ১৮০টি দেশের মধ্যে চীনের অবস্থান ১৭৯তম, যা তালিকায় সবার নীচে থাকা উত্তর কোরিয়ার ঠিক এক ধাপ ওপরে। চীনা কর্তৃপক্ষের তথ্য সেন্সরশিপ ও তথ্য বিকৃতির মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এ পরিস্থিতিতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চালিয়ে যাওয়াটা অত্যন্ত কঠিন। তাই একজন সম্পাদকের জন্য ২০২৩ সালের সেরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বাছাইয়ের কাজটি বেশ কঠিন ছিল। তবে নিচে বাছাই করা আটটি গল্পের মধ্যে চীন থেকে দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জায়গা করে নিয়েছে।

সৌভাগ্যবশত, ২০২৩ সাল জুড়ে চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরেও চীনা ভাষার বিভিন্ন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, আর ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনগুলো তৈরি হয়েছে চীনা সাংবাদিকদের হাত দিয়েই। চীনে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অবনতির কারণে আগামীতে এ ধরনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের সংখ্যা বাড়তে পারে। তাই, ২০২৩ সালে চীনা ভাষায় প্রকাশিত চারটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পাশাপাশি আমরা তাইওয়ান, হংকং ও সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনসহ বিবিসি ও ফিনান্সিয়াল টাইমস থেকে দুটি ইংরেজি-ভাষায় প্রকাশিত প্রতিবেদন এখানে অন্তর্ভুক্ত করেছি। নিঃসন্দেহে চীন নিয়ে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত আরো অনেক চমৎকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন রয়েছে, তবে এই তালিকার জন্য আমরা চীনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদেরকেই গুরুত্ব দিয়েছি যারা প্রতিবেদন তৈরিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার পাশাপাশি সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমাদের বাছাইকৃত চীন, হংকং ও তাইওয়ানের ২০২৩ সালের সেরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো এখানে তুলে ধরা হলো।

শাংসিতে খনি শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা

ছবি: স্ক্রিনশট, চায়না নিউজউইক

২০২২ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর উত্তর চীনের শাংসি প্রদেশে একটি বড় লোহার খনিতে ভূমিধসে তিনজন নিহত হয়। এ ঘটনার পর ধ্বসে পড়া খনিটিসহ স্থানীয় অন্যান্য খনিগুলো সংস্কারের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০২৩ সালে চায়না নিউজউইক (ইউএস নিউজউইকের সঙ্গে সংযুক্ত নয়) একটি গোপন নথি হাতে পায় যেখানে অভিযোগ করা হয় যে, শাংসির সেই খনি কোম্পানিতে দুর্ঘটনায় ৩০ জনেরও বেশি শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা গোপন করা হয়েছে।

চায়না নিউজউইকের প্রতিবেদকেরা শাংসি এবং চুংচিং প্রদেশ ঘুরে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে মোট ২০টি গ্রাম পরিদর্শন করেন। তাদের অনুসন্ধানে ২০০৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত একাধিক খনি দুর্ঘটনার কথা উঠে আসে, যেখানে অন্তত ১৭ জন খনি শ্রমিক মারা গেছেন, অথচ এগুলো নিয়ে আগে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। প্রতিবেদকেরা মৃত খনি শ্রমিকদের পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন, যাদের সাক্ষ্যগুলো দুর্ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার বিষয়টিকে নিশ্চিত করে। তাছাড়া প্রতিবেদনটি স্থানীয় লোহা-খনি শিল্প সম্পর্কে ধারণা দেয়: যেমন এলাকার একসময়ের সবচেয়ে বড় ঠিকাদার— সংগঠিত অপরাধে নেতৃত্বদানের জন্য যাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল— এবং তার অধীনস্ত ফোরম্যানরা খনির বেশিরভাগ চুক্তির দায়িত্বে ছিলেন।

অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরপরই, চীনের খনি নিরাপত্তা প্রশাসন খনিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় এবং দুর্ঘটনা নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর বিষয়গুলোকে মোকাবেলা করার জন্য দেশব্যাপী প্রচারণা চালায়। এরপর, খনি কোম্পানির নয়জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার সুপারিশ করা হয়।

চীন যেভাবে ইসলাম ধর্মকে মুছে ফেলছে

ছবি: স্ক্রিনশট, ফিনান্সিয়াল টাইমস

গম্বুজ ও মিনারের চমৎকার নকশার জন্য বিখ্যাত উত্তর চীনের বেইজিংয়ের দৌদিয়ান মসজিদ। ২০২৩ সালে এর মিনারগুলো ভেঙে গম্বুজগুলোকে গোলাকার আকৃতির প্যাগোডার আদলে বদলে ফেলা হয়। বর্গাকার আকৃতি দেওয়া হয় আরব-শৈলীর খিলানগুলোকে। গত পাঁচ বছরে চীনের শত শত মসজিদ এভাবে বদলে গেছে, সেই সঙ্গে দৌদিয়ান মসজিদের এ ধরনের রূপান্তর গোটা চীন জুড়ে বিশেষ এক প্রবণতাকেও তুলে ধরছে।

স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহার করে ফিনান্সিয়াল টাইমসের ভিজ্যুয়াল অনুসন্ধানে দেখা যায়, মসজিদ থেকে আরব-শৈলীর নকশাগুলো সরিয়ে প্রায়শই চীনা ঐতিহ্যবাহী নকশা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মসজিদ সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছে। নিংজিয়ার পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে করা স্যাটেলাইট বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ইসলামিক স্থাপত্যসহ ৯০ শতাংশেরও বেশি মসজিদের নকশার পরিবর্তন ঘটেছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ গানসুতে যা ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

চীনা সরকারের সিনিসাইজেশন (চীনিকরণ) নীতি পর্যবেক্ষণের জন্য, রিপোর্টিং দলটি অস্ট্রেলিয়ার স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট থেকে জিনজিয়াংয়ের মসজিদের ডেটাসহ বাইদু ম্যাপ, গুগল ম্যাপ এবং ওপেনস্ট্রিট ম্যাপের মাধ্যমে পাওয়া অনুসন্ধান ফলাফলগুলো জড়ো করে চীন জুড়ে ৪ হাজার ৪৫০টি মসজিদের লোকেশনের ডেটাসেট সংকলন করে। তারা মসজিদ শনাক্ত এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থাপত্য শৈলীর পরিবর্তগুলো ট্র্যাক করতে গুগল আর্থ স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে। যাতে দেখা যায়, ২ হাজার ৩১২টি ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর মসজিদের মধ্য থেকে ১ হাজার ৭১৪টির (৭৪ দশমিক ৩ শতাংশ) আরবি-শৈলীর নকশা ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সরিয়ে ফেলা বা পরিবর্তন করা হয়েছে।

চীনাদের ধূমপানে আসক্তি

ছবি: স্ক্রিনশট, ইনিশিয়াম মিডিয়া

গত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহারের হার ১১ শতাংশ কমেছে। তবে চীনে এই পতনের হার মাত্র ১ শতাংশ। বৈশ্বিক জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশের বসবাস চীনে হলেও বিশ্বব্যাপী মোট ধূমপানের প্রায় অর্ধেকই চীনে, যা বার্ষিক ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়নেরও বেশি এবং ৬৭টি দেশের সম্মিলিত মোট ধূমপানের হারকে ছাড়িয়ে গেছে। ধূমপানের ব্যাপকতা চীনে জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর পরিণতি ডেকে আনছে, যা ধূমপানজনিত মৃত্যুর প্রত্যাশিত বৃদ্ধির সঙ্গে ৭০০ মিলিয়ন অধূমপায়ীদেরও প্রভাবিত করবে।

ইনিশিয়াম মিডিয়া এই অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে: কেন চীনে ধূমপান রোধ করা এত কঠিন? এতে তামাক শিল্প ভূমিকা কী? আর এই একচেটিয়া ব্যবস্থায় তামাক চাষীরা কীভাবে টিকে থাকবে?

চীন ও দেশটির বাইরে তামাকের উৎপাদন, নিয়ন্ত্রণ ও বিক্রয় তত্ত্বাবধান করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না ন্যাশনাল টোব্যাকো কর্পোরেশন। ইনিশিয়াম মিডিয়ার অনুসন্ধানে দেখা গেছে এই কর্পোরেশনটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (ডব্লিউএইচও এফসিটিসি) কার্যক্রমে চীনের স্বার্থ ও প্রয়োজনগুলোকে প্রতিফলনের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই পালন করেনি, বরং চীনে এফসিটিসি নীতিমালা প্রয়োগে কৌশলগতভাবে কালক্ষেপন ও বাধা দেওয়ার পাশাপাশি তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও প্রভাব রেখেছে। সরকারের সক্ষমতা ও অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করলেও দেশটির জনস্বাস্থ্য নীতিকে দুর্বল করার পাশাপাশি শীর্ষ পর্যায়ের চীনা নেতাদের প্রভাবিত করেছে।

বেইজিংয়ের চাংফেং হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ড

ছবি: স্ক্রিনশট, কাইসিন

২০২৩ সালের ১৮ এপ্রিল বেইজিংয়ের চাংফেং হাসপাতালে মারাত্নক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ২৯ জন মৃত্যুবরণ করে এবং আহত হয় ৪২ জন। সরাসরি অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৩ মিলিয়ন ইয়েন (৫ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার)। আগুন লাগার কারণ হিসেবে চীনা কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের আইন বহির্ভূত সংস্কার প্রকল্প, দৈনন্দিন কাজ ও নির্মাণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা এবং জরুরী পরিস্থিতিতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের অসঙ্গতিগুলোকে দায়ী করেছে। এ ঘটনায় হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে জড়িত ও নির্মাণ সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিসহ ১২জনকে আটক করা হয়।

কাইসিনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি অগ্নিকাণ্ডের বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরে। সংবাদমাধ্যমটি অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান ও হাসপাতালের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলো ঘিরে পদ্ধতিগত পর্যালোচনা করে। দেখা যায় যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সম্পদ ও দায় অনুপাতে ক্রমাগত লোকসানের মধ্য দিয়ে গেলেও হাসপাতালটি সার্চ ইঞ্জিন বিজ্ঞাপনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খরচের মাধ্যমে অনলাইন মার্কেটিংয়ে প্রচুর পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে। তাছাড়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বেআইনিভাবে মূল ভবনের নকশা পরিবর্তন করার ফলে অগ্নি বিভাজন ও নিরাপত্তার জন্য দ্রুত সবাইকে সরিয়ে নেওয়ার কার্যক্রমগুলো গুরুতরভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। তাছাড়া অগ্নি নিরাপত্তার উপকরণগুলো তারা কখনো পরীক্ষা করে দেখেনি।

চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে হওয়া এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ওপর আলোকপাত করায় এই প্রতিবেদন অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিল। কাইসিনের রিপোর্টিং দলটি অনেকের সঙ্গে কথা বলে এবং অনুসন্ধানের মাধ্যমে আগুন লাগার কারণ ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক অবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বছরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই অনুসন্ধান পরিচালনা করে।

অনলাইন যৌন সহিংসতা বিক্রি

ছবি: স্ক্রিনশট, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস

একটি অস্বস্তিকর অনলাইন মার্কেটপ্লেস উন্মোচন করেছে বিবিসি, যেখানে পূর্ব এশিয়া জুড়ে গণ পরিসরে পুরুষ কর্তৃক নারীদের যৌন নিপীড়নের হাজার হাজার ভিডিও ফু্টেজ বিক্রি করা হয়। অবাক হলেও সত্য যে গ্রাহকেরা সেখানে নিজেদের চাহিদা মতো নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের ভিডিও দেখতে চেয়ে ‍অর্থায়ন করতে পারে। যার কেন্দ্রে রয়েছে “আঙ্কেল কিউ” নামে পরিচিত এক রহস্যময় ব্যক্তি, যাকে যৌন শিকারীদের গোপন নেটওয়ার্কটি মাস্টারমাইন্ড হিসাবে মান্য করে। গণপরিসরে নারীর ওপর যৌন নিপীড়ন চালানোকে জাপানে ডাকা হয় ‘চিকা’ নামে। চিকার কুখ্যাত ঘটনা আবিষ্কারের পাশাপাশি জাপানে এসে এ অনুসন্ধান একটি নাটকীয় দিকে মোড় নেয়।

এ ভিডিও অনুসন্ধানে বিবিসির সাংবাদিকেরা আঙ্কেল কিউয়ের আসল পরিচয় উন্মোচনের জন্য ওপেন সোর্স গবেষণা ও ছদ্মবেশ ধারণের মতো কৌশল ব্যবহার করেন। বিবিসির সাংবাদিক ও আঙ্কেল কিউ নাটকীয়ভাবে মুখোমুখিও হন। পরবর্তীতে আঙ্কেল কিউ জাপান ছেড়ে পালিয়ে যান। অনুসন্ধানটি চীনে উল্লেখযোগ্য মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং ব্যাপক আলোচিত হয়। দেশটির বিভিন্ন সরকারী মিডিয়া আউটলেটের পাশাপাশি পুলিশ বিভাগের উইবো অ্যাকাউন্টগুলো বিবিসির অনুসন্ধানটি সম্প্রচার করে, যা প্রতিবেদনের প্রভাব বৃদ্ধির পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে।

চীনে অস্ট্রেলিয়ান গলদা চিংড়ি চোরাচালান

ছবি: স্ক্রিনশট, দ্য রিপোর্টার

২০২০ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়ার ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে চীন, যার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে গলদা চিংড়ি আমদানিও। এর ফলে অস্ট্রেলিয়ার লবস্টারের নতুন বাজারে পরিণত হয় হংকং ও তাইওয়ান। তাইওয়ানে শুধু ২০২০ সালেই অস্ট্রেলিয়ান গলদা চিংড়ির আমদানি বেড়েছে ৪০০ টনেরও বেশি। দ্য রিপোর্টারের প্রতিবেদনে উঠে আসে, অস্ট্রেলিয়ার গলদা চিংড়ি চোরাচালান তাইওয়ানে রীতিমতো ক্রমাবর্ধমান শিল্পে পরিণত হয়েছে। কেননা তাইওয়ান থেকে এই গলদা চিংড়িগুলো পরবর্তীতে চীনের মূল ভূখণ্ডের নিকটবর্তী কিনমেন ও মাতসু দ্বীপে পাচার করা হয় এবং সেখান থেকে চীনা মাছ ধরার জাহাজে করে অবৈধভাবে চীনা শহরগুলোতে পরিবহন করা হয়।

প্রতিবেদন অনুসারে, অস্ট্রেলিয়ার গলদা চিংড়ি চোরাচালানে বড় অংকের লাভ আসে: ২০ কিলোগ্রাম গলদা চিংড়ির বাক্স আমদানি করতে ২৪ হাজার নতুন তাইওয়ান ডলার (৭৬৬ মার্কিন ডলার) খরচ হলেও চীনে পাচার করার সময় অর্থের অংক বেড়ে ৬৬ হাজার নতুন তাইওয়ান ডলার (২ হাজার ১০৬ মার্কিন ডলার) পর্যন্ত উঠতে পারে। তিনটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের এ সিরিজের মাধ্যমে, দ্য রিপোর্টার একটি চোরাচালান নেটওয়ার্ক উন্মোচন করে, এবং কিনমেন ও মাতসুতে চোরাচালান শিল্পের প্রসার বৃদ্ধির নেপথ্যে ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক কারণগুলোও পরীক্ষা করে।

সমুদ্রের নীচে ঝড়

ছবি: স্ক্রিনশট, দ্য রিপোর্টার

চীনা বালি ড্রেজিংয়ের জলযানগুলো তাইওয়ানের অদূরবর্তী দ্বীপগুলোর কাছে সমুদ্র থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে ২০০৫ সাল থেকে। জীববৈচিত্র্য গবেষকেরা অনুমান করছেন, তাইওয়ানের অংশ থেকে বছরে এক মিলিয়ন টন সামুদ্রিক বালি চুরি করা হয়েছে। দ্বীপের বাসিন্দাদের জন্য প্রতিদিন বালি উত্তোলনকারী অসংখ্য চীনা জাহাজ দেখতে পাওয়াটা নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, এই ড্রেজারগুলো, প্রাথমিকভাবে কিনমেন দ্বীপের চারপাশে জড়ো হয়। তারপর মাতসু ও পেঙ্গুর দ্বীপের কাছে সমুদ্রে বালি উত্তোলন করে। এটি শুধুমাত্র সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, পেঙ্গুতে মাছ ধরার কার্যক্রমকেও প্রভাবিত করেছে। এর ফলে ডোরাকাটা বেকফিশ বা ছুরি প্রজাতির মাছ ধরার পরিমান অর্ধেক এবং বার্ষিক গ্রুপার মাছ ধরার পরিমাণ কমে ৩০০ টন থেকে ৮০ টনে নেমেছে। গত ছয় বছরে, প্রায় ৩০ বারেরও বেশি বালি ড্রেজিং তাইওয়ান ও মাতসুর মধ্যে সমুদ্রের নীচের ক্যাবেল লাইনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে তৈরি এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে চিত্রিত করা হয়েছে চীনের বালি ড্রেজিং শিল্পের সরবরাহ চেইনকে। দেখা গেছে এ কার্যক্রমটি একটি নির্দিষ্ট ভূ-রাজনৈতিক প্যাটার্ন অনুসরণের পাশাপাশি বেইজিংয়ের নীতির সঙ্গে ওঠানামা করে। যদিও চীন ২০২০-২১ সালে বালি ড্রেজিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিল, তবে মহামারী পরবর্তী পরিস্থিতি সামলানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে সহজ করতে সামুদ্রিক বালির চাহিদা পুনরায় বেড়েছে। এ অবস্থায় চীন তার কঠোর অবস্থান ধরে রাখবে কিনা তা দেখার বিষয়।

রেড হিল উপদ্বীপে অবৈধ নির্মাণ

ছবি: স্ক্রিনশট, দ্য কালেক্টিভ

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুতে হংকং ১৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র বৃষ্টিপাতের সম্মুখীন হয়। প্রবল বর্ষণে রেড হিল উপদ্বীপের কম-ঘনত্বের ভিলা এলাকা জুড়ে ভূমিধ্বসের ঘটনা ঘটে যা এখানকার অবৈধ নির্মাণ ও সরকারি জমিতে দখলদারিত্বের বিষয়গুলোকে সামনে আনে।

আবাসন বিভাগ ও নগর পরিকল্পনা বোর্ড থেকে নথি সংগ্রহ এবং জায়গা পরিদর্শনের মাধ্যমে প্রতিবেদনটি তৈরি করে নতুন অলাভজনক অনুসন্ধানী আউটলেট দ্য কালেক্টিভ। এতে তারা একাধিক অননুমোদিত ভিলা নির্মাণের ঘটনা খুঁজে পায়, যার মধ্যে দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে সরকারি জমি দখল করে ভবন নির্মাণের মতো উদাহরণও বিদ্যমান। কবে থেকে শুরু হলো এসব অবৈধ নির্মাণ? অতীতে হংকং সরকার কীভাবে নিয়মের পরিপালন করেছিল? ৫০টিরও বেশি উপকূলীয় ব্যক্তিমালাধীন বাড়ির রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এর মধ্যে আটটি অননুমোদিত কাঠামো ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল আবাসন বিভাগ। দেড় বছর আগে জারি করা তিনটি আদেশের একটিও এখনও কার্যকর হয়নি।

অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরপরই হংকং সরকার ঘোষণা করে, রেড হিল উপদ্বীপে ৮৫টি উপকূলীয় ব্যক্তিমালিকানাধীন ভিলার মধ্যে ৭০টিই অননুমোদিত, ৪০টি সরকারি জমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে এবং ৩০টির বেশি উভয় অভিযোগে অভিযুক্ত। যাইহোক, সরকারের অতীত কার্যক্রমের সঙ্গে তুলনা করলে এই সমস্যা সমাধানে নেওয়া উদ্যোগের ফলাফল বেশ উদ্বেগজনক।


জোয়ি চি, জিআইজেএন এর চীনা ভাষা সম্পাদক। তিন বছর মিডিয়া ব্যবস্থাপনাসহ সাংবাদিকতায় তিনি দশ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। তিনি দ্য ইনিটশিয়াম মিডিয়ার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, যেখানে তিনি দৈনিক সংবাদ বিভাগটি ডিজাইন করেছেন এবং দল গঠন করেছেন।

ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে আমাদের লেখা বিনামূল্যে অনলাইন বা প্রিন্টে প্রকাশযোগ্য

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

Studio, headphones, microphone, podcast

সংবাদ ও বিশ্লেষণ

ঘুরে আসুন ২০২৩ সালের বাছাই করা অনুসন্ধানী পডকাস্টের জগত থেকে

নানাবিধ সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে প্রকাশিত হয়েছে সাড়া জাগানো কিছু অনুসন্ধানী পডকাস্ট। এখানে তেমনই কিছু বাছাই করা পডকাস্ট তুলে এনেছে জিআইজেএনের বৈশ্বিক দল।

সংবাদ ও বিশ্লেষণ সম্পাদকের বাছাই

চীন-পন্থী প্রচারণা, গুপ্তচরবৃত্তির সরঞ্জাম, সবুজ বিভ্রম: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ২০২৩ সালের সেরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

অনলাইনে প্রচারণা, ভুয়া তথ্য, নারী অ্যাক্টিভিস্টদের ওপর সাইবার হামলা, অবৈধভাবে খনন বা গাছ কাটা বিষয়ে পরিচালিত কয়েকটি অনুসন্ধান জায়গা করে নিয়েছে জিআইজেএনের সম্পাদকের বাছাইয়ে।

সংবাদ ও বিশ্লেষণ সম্পাদকের বাছাই

ব্যক্তিগত বন্দিশালা, ওয়াটার মাফিয়া, ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ: ২০২৩ সালে পাকিস্তানের সেরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও ২০২৩ সালে পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত হয়েছে সাড়া জাগানো কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। এমন ৮টি প্রতিবেদন জায়গা করে নিয়েছে জিআইজেএনের সম্পাদকের বাছাইয়ে।

সংবাদ ও বিশ্লেষণ সম্পাদকের বাছাই

ভারতের ২০২৩ সালের সেরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন: স্পাইওয়্যার বেচাকেনা, ভারতীয় ভূখণ্ডে চীনা দখলদারিত্ব ও বিষাক্ত কফ সিরাপ

নানাবিধ বাধাবিপত্তি ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ২০২৩ সালে ভারত থেকে প্রকাশিত হয়েছে সাড়া জাগানো কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, যেগুলো উন্মোচন করেছে ধোঁয়াশাপূর্ণ রাষ্ট্রীয় চুক্তি, শ্রম পরিস্থিতি, ঝুঁকিপূর্ণ ওষুধ, সীমান্ত দ্বন্দ্বের মতো বিষয়।