

জিআইজেসি২৩-র একটি প্যানেলে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করা প্রসঙ্গে কথা বলছেন কোরিয়া সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (কেসিআইজে-নিউজটাপা)-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদক মিউংজু লি। ছবি: জিআইজেএনের জন্য এলেন লিন্ডকুভিস্ট কার্সবার্গ
তথ্য অধিকার আইনে আবেদন: তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ জোরালো করবেন যেভাবে
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
অনুসন্ধানকে এগিয়ে নিতে অনেক সাংবাদিকই তথ্য অধিকার আইনের (ফোয়া বা আরটিআই) আশ্রয় নেন। কিন্তু আপনি আপনার তথ্য প্রাপ্তির অনুরোধকে পরবর্তী ধাপে উন্নীত করবেন কীভাবে?
১৩তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সের (জিআইজেসি২৩) একটি প্যানেলে দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল, সুইডেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক ও বিশেষজ্ঞরা ঠিক এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। বেশি তথ্য পেতে ফোয়ার মাধ্যমে তথ্যের জন্য অনুরোধ পাঠানো, তথ্যের উন্মুক্ত আর্কাইভ ঘাঁটা, কালিতে ঢেকে দেওয়া তথ্য বের করতে আনতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এবং যৌথ আরটিআই-নির্ভর অনুসন্ধানে নামা– এমন নানা বিষয় নিয়ে তারা কথা বলেছেন এবং তাদের কৌশল, পরামর্শ ও টুলগুলো তুলে ধরেছেন।
প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন কোরিয়া সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (কেসিআইজে-নিউজটাপা) এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদক মিউংজু লি, ডেটা এবং পাবলিক রেকর্ড সংগ্রহ প্রকল্প ডেটা ফিক্সারের পরিচালক লুইজ ফার্নান্দো টলেডো, অলাভজনক সহযোগী সংস্থা মাকরক ফাউন্ডেশনের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা আমান্ডা হিকম্যান এবং সুইডেনের দৈনিক সংবাদপত্র সিডসভেনস্কানের অভিজ্ঞ সাংবাদিক ম্যাটস অ্যামনেল।
তারা ফোয়া ও আরটিআইয়ের তথ্য ব্যবহার করে ব্রাজিলের সাবেক রাষ্ট্রপতির লাগামহীন খরচ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারী কর্মকর্তাদের নামীদামী রেস্তোরাঁয় ভোজনের ঘটনা উন্মোচন করেছেন এবং বার্তাকক্ষকে এমনভাবে সাজিয়েছেন যেন পুলিশ ও স্থানীয় সরকারের দৈনন্দিন নথি ঘেঁটে নতুন নতুন প্রতিবেদনের সন্ধান মেলে।
বিশেষজ্ঞদের যত পরামর্শ
ইংরেজি প্রবাদে আছে, “বুড়ো কুকুরকে নতুন কৌশল শেখানো যায় না”, কিন্তু তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগের বেলায় বিষয়টি এমন নয়। আপনি নবীন হোন বা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রবীণ, ফোয়া প্রয়োগের এই সুপারিশগুলো আপনার অনুসন্ধানে কাজে আসবে।
১.শুরুতেই এক হাজার নথি চেয়ে অনুরোধ জানাবেন না, বরং মাত্র ১০টির কথা জিজ্ঞেসা করুন (তারপর আপনার ফলো–আপ অনুরোধের সময় আরো কিছু নথি সম্পর্কে জানতে চান)। আপনার যদি মনেও হয় যে অনুসন্ধানের জন্য শত শত বা হাজার হাজার নথি প্রয়োজন, তবুও সেগুলো সম্পর্কে একবারে জানতে চাইবেন না, কারণ কর্মকর্তারা কাজটিকে সময়সাপেক্ষ মনে করে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় খুঁজতে পারেন। এক্ষেত্রে সুইডিশ রিপোর্টার অ্যামনেলের পরামর্শ হলো: প্রথমে অল্প কয়েকটি নথি চেয়ে অনুরোধ করুন এবং একবার তা হাতে পেলে, তারপর বেশি নথি চেয়ে বসুন; আপনার দ্বিতীয় অনুরোধটি প্রত্যাখ্যান করা হলেও সেক্ষেত্রে পূর্ববর্তী অনুরোধ মঞ্জুরের জের ধরে আপনার অগ্রসর হওয়ার একটা সুযোগ থেকে যাবে।
২. কালিতে ঢাকা নথি দেখে নিরুৎসাহিত হবেন না। বরং হাতে আসা নথিগুলোর মধ্য থেকে কোনো না কোনো সুক্ষ্ণ সূত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। প্রাপ্ত নথিতে কোনো অংশকে মুছে দেওয়া হয়েছে কিনা, তা খুঁজে বের করার প্রয়োজন হলে নিচের রিডাকশনস টুলগুলো সাহায্য নিন।
৩. বিশেষজ্ঞ ও বিশেষায়িত গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করুন। তথ্য অধিকার আইনে পাওয়া তথ্যে এমন অনেক কারিগরী তথ্য থাকতে পারে, যা বুঝতে আইন বা হিসাববিজ্ঞানের মতো নির্দিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের ব্যাখা নিতে হয় অথবা এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের শরণাপন্ন হতে হয় যাদের সেই বিষয় নিয়ে কাজের অতীত ইতিহাস রয়েছে। অনুসন্ধানে সহযোগিতার গুরুত্বকে ছোট করে দেখবেন না। প্যানেলের সবাই সাংবাদিকদের এই পরামর্শটি দিয়েছেন।
৪. আপনার তথ্যপ্রাপ্তির অনুরোধ বাতিল হলে হাল ছাড়বেন না। যদি আদালত পর্যন্তও যেতে হয়, তো যান। ফোয়া ও আরটিআই নাগরিকদের তথ্য প্রাপ্তির অধিকার দেয়। তাই যখন অসম্পূর্ণ তথ্য দেওয়া হয়, কিছু তথ্য দিতে অস্বীকার করা হয় বা অনুরোধে কোনও সাড়া না মেলে, তখন আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। অ্যামনেল সাংবাদিকদের স্মরণ করিয়ে দেন: এসব ক্ষেত্রে নৈতিক যুক্তি নয়, আইনি যুক্তি ব্যবহার করুন। তিনি বলেন, একজন বিচারক অভিযোগের বিপরীতে শুধু গণতন্ত্র, মানবাধিকার বা স্বচ্ছতার প্রতি আহ্বান নয়, পাশাপাশি বিচারিক ভিত্তি আছে কিনা তাও দেখতে চান।
৫. যত পারুন, সবার সঙ্গে শেয়ার করুন। দেশ ও দেশের বাইরে আপনার অনুসন্ধানের পরিধি প্রসারিত করতে স্থানীয় অলাভজনক স্বাধীন নিউজরুম এবং বৃহত্তর সংবাদ সংস্থার অংশীদার হোন। লুইজ ফার্নান্দো টলেডো তার ফোয়া অনুরোধের বিপরীতে আসা হাজার হাজার নথি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা ও অংশীদারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শেয়ার করেছেন। এই নথিগুলোতে ব্রাজিলের সাবেক রাষ্ট্রপতি জাইর বলসোনারোর শাসনামলে তিন বছর ধরে কীভাবে জনসাধারণের অর্থের অপব্যবহার করা হয়েছে সে সংক্রান্ত তথ্য ছিল। এই তথ্য থেকেই উন্মোচিত হয়, দেশটির সাবেক এই রাষ্ট্রপতি কীভাবে আইসক্রিম খেয়ে ও হোটেলে থেকে জনসাধারণের অর্থ উড়িয়েছেন। টলেডো বলেন, “রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা এড়ানোর সর্বোত্তম উপায়, পরস্পরের সঙ্গে জ্ঞান ভাগাভাগি করে নেওয়া।”
ফোয়া অনুরোধের কার্যকর হাতিয়ার ‘মাক–রকার’ টুলবক্স
প্রযুক্তি অন্যান্য অনেক কিছুর মতোই ফোয়া অনুরোধ এবং আরটিআই অনুসন্ধানের কাজগুলোকে অন্য স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। এছাড়া ফোয়ার মাধ্যমে তথ্য চেয়ে অন্য সাংবাদিকদের করা অনুরোধগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি কীভাবে তথ্য চেয়ে অনুরোধ করতে হয় এবং প্রাপ্ত উত্তরগুলোতে কোনো ধরনের সম্পাদনা করা হয়েছে কিনা তা যাচাই করতে হয় সে সম্পর্কিত বিভিন্ন উপায় বের করেছে।
মাকরক মূলত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি অলাভজনক সংস্থা, যারা মার্কিন এখতিয়ারভুক্ত অঞ্চলগুলোতে ফোয়ার মাধ্যমে অনুরোধ ফাইল করতে সহায়তা করে। তারা আন্তর্জাতিক ব্যবহারকারীদের জন্য আরটিআই সংক্রান্ত পরিষেবাগুলোর প্রসারেও কাজ করছে।
সংস্থাটির পরিষেবার মধ্যে অন্যতম পাবলিক রেকর্ডস রিকোয়েস্ট সার্ভিস, যেখানে খুবই সামান্য পরিমাণ অর্থের (সদস্যদের জন্য ২ থেকে ৪ মার্কিন ডলার) বিনিময়ে মাকরক আপনার হয়ে ফোয়ার মাধ্যমে তথ্য চেয়ে অনুরোধ পাঠায় কিংবা তাদের লাইব্রেরি ব্রাউজের অনুমতি দেয়। তাদের সমৃদ্ধ ফোয়া লগ আর্কাইভে আমেরিকার কেন্দ্রীয়, রাজ্য এবং স্থানীয় সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পাওয়া ৫৮ হাজার ৮১৯টি অনুরোধের তথ্য রয়েছে, এবং এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অন্য কোনো সাংবাদিক এরইমধ্যে তাদের কাছে আপনার অনুরূপ কোনো অনুরোধ করেছেন কিনা, এই আর্কাইভের নমুনা অনুরোধগুলোতে তা-ও খুঁজে পেতে পারেন।
মাকরকের যে ৪০টি টুল আছে, তার মধ্যে ডকুমেন্টক্লাউড অন্যতম। এখানে প্রাথমিক-উৎস থেকে পাওয়া লাখ লাখ নথি রয়েছে যা আপনি বিন্যস্ত, বিশ্লেষণ ও ব্যবহার করতে পারবেন। বিভিন্ন নিউজরুম এই নথিগুলো সেখানে জমা করেছে এবং মাকরক সেগুলো যাচাই করেছে। এমন আরো কিছু টুল রয়েছে।
- ব্যাড রিডাকশনস। ফোয়ার মাধ্যমে পাওয়া নথিটির কিছু অংশ কালিতে ঢাকা থাকলেও সেটির মর্মোদ্ধার করা সম্ভব হতে পারে। মুছে দেওয়া অংশ থেকে তথ্য বের করতে এই অ্যাড-অনটি ব্যবহার করে দেখুন। এর মাধ্যমে আগের টেক্সট পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে এবং আপনি সম্ভবত তা রিডাকশনের পরও পড়তে পারবেন।
- ওট্র্যানস্ক্রাইব। এটি টাইমস্ট্যাম্পের মতো প্লেব্যাক স্পিড ও ফিচার জুড়ে দিয়ে ট্রানস্ক্রিপশন প্রক্রিয়াটিকে সহজতর করে তোলে। ওট্রানস্ক্রাইব আপনাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অডিও থেকে টেক্সট বের করে এনে দেবে না, তবে উইসপারএআই ডকুমেন্টক্লাউড অ্যাড-অন আপনাকে ওপেনএআই-চালিত স্বয়ংক্রিয় ট্রানস্ক্রিপশন টুলে প্রবেশের সুযোগ দেবে।
- ট্যাবুলা স্প্রেডশীট এক্সট্রাকশন আপনাকে ফোয়ার মাধ্যমে পাওয়া যেকোনো টেবিলকে স্প্রেডশীট ফরম্যাটে বদলে দেবে।
আর অবশ্যই জিআইজেএনের রির্সোর্সগুলোর কথা ভুলবেন না
জিআইজেএনের সাইটে আপনি ফোয়া ও আরটিআই গ্লোবাল গাইড এবং রিসোর্স সেন্টারের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা টবি ম্যাকিনটোশের লেখা “ফোয়া দিস!” সিরিজ পাবেন। সেখানে বিশ্বজুড়ে তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার বিষয়ক নানা পরামর্শ, বিভিন্ন খাতে সরকারের ব্যয় এবং সরকারী তথ্যসংক্রান্ত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলোর উদাহরণ রয়েছে।
তথ্য অধিকার আইনে অনুরোধ প্রেরণ ও তথ্যপ্রাপ্তির জন্য কোনো সাংবাদিককে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে একতরফা যোগাযোগের দীর্ঘ হতাশাজনক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক সহকর্মীদের থেকে পাওয়া কৌশল ও টুল ব্যবহার করে রিপোর্টারেরা তাদের আরটিআই অনুসন্ধানের কাজগুলোকে এগিয়ে নিতে এবং ফোয়া সংক্রান্ত অনুরোধগুলোকে প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ ও সমন্বিত কার্যক্রমে পরিণত করতে পারেন।
কিন্তু মনে রাখবেন, জিআইজেসি২৩ প্যানেল মডারেটর এবং জিআইজেএনের বাংলা সম্পাদক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী যেমনটা বলেছেন: তথ্য অধিকার আইনে তথ্য পেতে “আপনাকে আকৃত্রিম ও অবিচল থাকতে হবে এবং উদ্ভাবনী হতে হবে।”
নীচে ফোয়া/আরটিআই অনুসন্ধানের ওপর জিআইজেসি২৩-এর সম্পূর্ণ প্যানেল আলোচনা দেখুন।