

সময়টা এমন, যেখানে সঠিক তথ্য ও ভুল তথ্যের অনুপাত (সিগন্যাল-টু-নয়েজ রেশিও) প্রায় সমান। অর্থাৎ সঠিক তথ্যের গতি যতটা বাড়ছে, ভুল তথ্যও প্রায় একই গতিতে ছড়াচ্ছে। ফলে কোনটা আসল আর কোনটা ভুয়া তা বোঝা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-ব্যবহার করে তৈরি কনটেন্ট শনাক্ত করা যায়—এই গাইডটি সাংবাদিকদের তা বুঝতে সাহায্য করবে। এখানে সাতটি আধুনিক শনাক্তকরণ পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে, যা প্রত্যেক সাংবাদিকের আয়ত্ত করা জরুরি।
বার্তাকক্ষের জন্য ভুল তথ্য মোকাবিলায় একজন সাহায্যকারী হিসেবে যে বিষয়টি আমার রাতের ঘুম কেড়ে নেয় তা হচ্ছে: প্রচলিত ফ্যাক্ট চেকিং দিয়ে সত্যতা যাচাইয়ে সাধারণত কয়েক ঘণ্টা লেগে যায়। সেখানে এআই ব্যবহার করে ভুল তথ্য তৈরিতে লাগে মাত্র কয়েক মিনিট।
ভিডিও দিয়ে বিভ্রান্ত করার কৌশল নতুন নয়। আধুনিক এআই আসার বহু আগেই ভিডিও ব্যবহার করে ভুল ধারণা ছড়ানো হতো। এমনকি পুরানো রেকডিং পদ্ধতির সীমাবদ্ধতাও বড় রকমের ভুল ধারণা তৈরি করেছে। যেমন, ২০০৩ সালে ঘটনা। শিশু পরিচালিকা হিসেবে কাজ করতেন ক্লাউডিয়া মুরো। তাকে প্রায় ২৯ মাস জেলে থাকতে হয়েছিল খারাপ মানের একটি নিরাপত্তা ক্যামেরার ভিডিওতে তার সাবলীল অঙ্গভঙ্গি ভুলবশত সহিংস আচরণ মনে হওয়ার কারণে। অথচ কেউ ভিডিওটি যাচাই পর্যন্ত করেনি।
২০২৫ সালের জানুয়ারির কথা। বাধ্য হয়ে লুকিয়ে থাকতে হয় যুক্তরাজ্যের শিক্ষক শেরিল বেনেটকে। কারণ একটি ভুয়া ডিপফেক ভিডিওতে তাকে বর্ণবাদী মন্তব্য করতে দেখানো হয়। আসলে তিনি কিছুই বলেননি।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বানানো ছবিতে দেখানো হয় বালেন্সিয়াগা ব্র্যান্ডের পাফার জ্যাকেট পরে আছেন পোপ ফ্রান্সিস প্রথম। ছবি: পাবলো হ্যাভিয়ার, মিডজার্নি
পোপ ফ্রান্সিস সাদা বালেন্সিয়াগা পাফার জ্যাকেট পরে আছেন— এই ভাইরাল ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাখো মানুষকে বিভ্রান্ত করে। পরে জানা যায় এআই দিয়ে তৈরি ছবিটি আসলে মিডজার্নির টেক্সট-টু-ইমেজ টুল দিয়ে বানানো হয়েছে। খুঁটিয়ে দেখলে ছবিটির বেশ কিছু অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ে। যেমন—পোপের বুকে ঝোলানো ক্রুশবিদ্ধ যিশুর লকেটটি অস্বাভাবিকভাবে জ্যাকেটের ওপরে ঝুলে আছে এবং চেইনের অর্ধেক জায়গায় সাদা জ্যাকেট দেখা যাচ্ছে। এআই-সৃষ্ট এ ছবিটি বানিয়েছিলেন পাবলো হ্যাভিয়ার। বাজফিড নিউজকে তিনি বলেন, “আমি শুধু ভেবেছিলাম, ব্যাপারটা দারুণ লাগবে যদি পোপকে মজার একটা জ্যাকেট পরানো অবস্থায় দেখানো যায়।”
কখনও কখনও এআই ব্যবহার না করেও বড় ধরনের ভুয়া কনটেন্ট তৈরি করা যায়। ২০১৯ সালের মে মাসে, হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির একটি ভিডিও ফুটেজের গতি ৭৫ শতাংশ কমিয়ে পিচ পরিবর্তন করে প্রচার করা হয়। গতি কমিয়ে সম্পাদনা করার ফলে মনে হচ্ছিল তিনি মাতলামো করছেন। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে, সিএনএনের সাংবাদিক জিম একোস্তা আর হোয়াইট হাউসের এক শিক্ষানবিশের আলাপচারিতার সম্পাদিত দ্রুতগতির একটি ভিডিও সংস্করণ শেয়ার করে হোয়াইট হাউস। যেখানে ওই শিক্ষানবিশের হাত নাড়ানোর ভঙ্গি বাস্তবের চেয়ে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক হিসেবে তুলে ধরা হয়।
সম্প্রতি আমি আমার মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতির সময় মাত্র ২৮ মিনিটের মধ্যে রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির ওপর একটি ভুয়া ভিডিও বানাই। যেখানে আপনি নিউজ অ্যাঙ্কার, বিক্ষুদ্ধ জনতা, বিক্ষোভের ফুটেজ, এবং কাল্পনিক একজন মেয়রের দেখা পাবেন । এটি তৈরিতে আমার মোট খরচ হয়েছে কত জানেন? আট ডলার আর ২৮ মিনিট। সম্পূর্ণ বানোয়াট একটি রাজনৈতিক সংকটের ফুটেজ—যা ডেডলাইনের চাপের মধ্যে থাকা ব্যস্ত সম্পাদকদের বিভ্রান্ত করতে পারতো।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, আমি দেখেছি একজন অভিজ্ঞ ফ্যাক্ট-চেকার আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এআই-সৃষ্ট একটি ছবিকে “প্রকৃত/খাঁটি” বলে চিহ্নিত করেছেন। কারণ ছবিতে ছয়টির পরিবর্তে পাঁচটি আঙুল দেখা যাচ্ছে। তাই বর্তমানে বিষয়গুলো ধরাটা আর এতোটা সহজ নেই।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শনাক্তের কঠিন বাস্তবতা এখন এমন: আগে ছবিতে থাকা যে ত্রুটিগুলো দেখে আমরা নিশ্চিন্ত হতাম তা চোখের সামনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রথম দিকে এআই ইমেজ জেনারেটর ব্যবহার করে আঁকা হাতগুলো বেশ খারাপ হতো —যেমন অতিরিক্ত আঙুল বা আঙুলের ওপর আঙুল থাকতো। এই ধরনের ত্রুটি দেখে বোঝা যেতো ছবিটি এআই দিয়ে আঁকা। ২০২৩ সালে যেমন “ট্রাম্প গ্রেপ্তার হয়েছে” এমন একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে। ভুল হাত আঁকার কারণে খুব সহজেই ছবিটিকে শনাক্ত করা যায়। কিন্তু ২০২৫ সালের মধ্যে, মিডজার্নি ও দাল-ই এর মতো বৃহৎ এআই মডেলগুলোর উন্নত সংস্করণ নিখুঁতভাবে হাত আঁকতে সমর্থ হয়। তাই এখন হাত দেখে এআই-সৃষ্ট ছবি শনাক্ত করাটা নির্ভরযোগ্য যুক্তি নয়। যারা এআই দিয়ে আঁকা ছবি শনাক্ত করতে চান, তাদের এখন আরও সূক্ষ্ম ও ভিন্ন বিষয় খুঁজতে হবে।
টেক্সট রেন্ডারিংয়েও (এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ফন্ট এবং অক্ষরকে স্ক্রিনে স্পষ্ট ও পড়ার মতো করে উপস্থাপন করা হয়) পরিবর্তন ঘটছে খুব দ্রুত। আগে এআইয়ের তৈরি করা প্রতিবাদ-পোস্টারে “STTPO THE MADNESSS” বা “FREEE PALESTIME”-এর মতো তালগোল পাকিয়ে যাওয়া লেখা দেখা যেত। এখনকার অনেক মডেল একেবারে নিখুঁত টাইপোগ্রাফি তৈরি করে দিতে পারে। ওপেন এআইয়ের মধ্যে বিশেষভাবে দালি-ই থ্রিকে নির্ভুল টেক্সট তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এদিকে মিডজার্নি, মিডজার্নি ভিসিক্স তাদের বাজারজাতকরণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে “accurate text” অপশন যুক্ত করেছে। তাই একসময়ের নির্ভরযোগ্য শনাক্তকরণ কৌশলগুলো এখন খুব বেশি কাজে লাগছে না।
আগে যেমন ওপরে-নীচে কান, অস্বাভাবিক অসম চোখ এবং দাঁতের গঠন দেখে এআই-সৃষ্ট ছবি কিনা তা চিহ্নিত করা যেত, এখন তা ক্রমশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারির দিকে আঁকা পোর্ট্রেট আকৃতির ছবিতে এমন সব শনাক্তযোগ্য ত্রুটি দেখা যেতো, কিন্তু বর্তমানে ওই একই প্রম্পটগুলো এমনভাবে মানুষের মুখাবয়ব আঁকে যা দেখে সহজে আর শনাক্ত করাটা সম্ভব হচ্ছে না।
এটি বার্তাকক্ষের জন্য বড় ধরনের বিপদের কারণ হতে পারে। ২০২৩ সালের শনাক্তকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষিত একজন সাংবাদিক তাই ভুল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এআই দিয়ে বানানো কনটেন্টকেও “প্রকৃত/খাঁটি” ছবি বলে দিতে পারেন। কারণ তিনি পুরানো পদ্ধতির কথা মাথায় রেখে ওই ছবিটি যাচাই করছেন। বর্তমানে এই ধরনের আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি বিপজ্জনক। এর চেয়ে বরং ছবিটি সম্পর্কে কোনো ধরনের মন্তব্য না করাটাই শ্রেয়।

এআই ব্যবহার করে তৈরি এ ছবিটি দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বন্যার পর এক মেয়েকে উদ্ধার করার দৃশ্য বর্ণনা করা হচ্ছে। ছবি: হেঙ্ক ফন এস
এ পর্যায়ে আমি ভাবতে বসি এই লেখার বাড়তি অংশ হিসেবে এআই কনটেন্ট যাচাই করার জন্য কোনো সহায়ক টুল বানানো যায় কিনা। তাই আমি বিশেষজ্ঞদের ইমেইল লেখা শুরু করি। বিজ্ঞানীরা আমাকে ফুরিয়ার ট্রান্সফর্ম, নিউরাল নেটওয়ার্কের কোয়ান্টাম মেকানিক্স, আর মানুষের চোখে ধরা না পড়া গাণিতিক সাক্ষর—এমন সব বিষয় সম্পর্কে বলেন, যার কথা আগে কখনও আমি চিন্তাও করিনি । একজন পদার্থবিদ আমাকে বুঝিয়ে দেন এআই ব্যবহার করে তৈরি ছবি, অডিও, বা ভিডিওতে থাকা অস্বাভাবিক বা অনাকাঙ্ক্ষিত দাগগুলো (এআইয়ের আর্টিফ্যাক্ট ) কেবল দৃশ্যমান ভুল নয়, এগুলো আসলে ফ্রিকোয়েন্সি ডোমেইনে থাকা এক ধরনের বিশেষ চিহ্ন, অনেকটা আঙ্গুলের ছাপের মতো।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। তাই একজন বিশেষজ্ঞ আমাকে সতর্ক করলেন, “নিজে কোনো টুল তৈরির চেষ্টাই করবেন না। কেননা এর জন্য প্রয়োজন জোরালো কম্পিউটিং পাওয়ার বা শক্তি (কম্পিউটার সিস্টেমের কার্য সম্পাদন, ডেটা প্রক্রিয়াকরণ এবং নির্দেশাবলী দক্ষতার সঙ্গে ও উচ্চ গতিতে সম্পাদনের সক্ষমতা) এবং পিএইচডি পর্যায়ের গবেষক দল। এই অবকাঠামো ছাড়া, আপনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবেন।”
বিষয়টা তখন আমার মাথায় আসে—এআইয়ের বিরুদ্ধে তাহলে তো এআই ব্যবহার করা যায়, কিন্তু ভিন্নভাবে? বিলিয়ন-ডলারের শনাক্তকরণ পদ্ধতি পুনরায় তৈরির বদলে, আমি বিদ্যমান এআই অবকাঠামো ব্যবহার করে মূল কাজটি করব।

এআই ব্যবহার করে বানানো একটি ছবির বিশ্লেষণ। যেখানে দেখানো হয়েছে বেলারুশের রাষ্ট্রপতি হাতে ফ্রাই কোণ ধরে আছেন। ছবি: হেঙ্ক ফন এস
এই চিন্তা থেকেই জন্ম নিয়েছে ইমেজ হুইস্পারার (শুরুর দিকের নাম ছিল ডিটেক্টএআইডটলাইভ)। এই টুল একদিকে বড় ভাষা মডেলের বিশ্লেষণ চালায়, অন্যদিকে গুগল ভিশন প্রসেসিং ব্যবহার করে। এতে রয়েছে বিশেষজ্ঞদের শেখানো পদার্থবিদ্যার নীতি আর কম্পিউটেশনের শক্তি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—বেশিরভাগ এআই টুলের মতো আন্দাজে উত্তর না দিয়ে, এটি যদি কোনো বিষয়ে অনিশ্চিত থাকে, তা আপনাকে জানিয়ে দেয়।
এটি বিশ্বের সেরা টুল হতে চায় না—বরং সবচেয়ে দক্ষতার সঙ্গে সত্যতা যাচাই করতে চায়।
সাত ধাপে এআই শনাক্তকরণ
এআই নির্মাতা এবং শনাক্তকারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছেই। নির্মাতারা বর্তমানে গতির সুবিধা পাচ্ছেন। কোন কনটেন্ট ডিপফেক কিনা তা শনাক্ত করাটা ক্রমশ ইদুর-বিড়াল খেলাতে পরিণত হয়েছে। কারণ ডেভেলপাররা প্রযুক্তি উন্নত করছে। ডিপফেক সঠিকভাবে শনাক্ত করতে হলে একাধিক শনাক্তকরণ পদ্ধতি একত্রিত করতে হয়। আর সবসময় সতর্ক থাকতে এবং মেনে নিতে হয় যে পুরোপুরি সঠিক শনাক্তকরণ সম্ভব নাও হতে পারে।
সাংবাদিকরা এখন আর ভুয়া না আসল তা চিহ্নিতের চেষ্টা করেন না। বরং যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে মূল্যায়ণ করেন এবং সম্পাদকীয় বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন।
যদিও সাংবাদিকতা সবসময় প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। যে কেউ ওয়েবসাইট বানাতে পারে—এমনটা যখন হলো তখন আমরা সূত্র যাচাই করতে শিখলাম। সবাই যখন সংবাদদাতা হওয়ার সুযোগ পেল, আমরা তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যাচাইয়ের নিয়ম তৈরি করলাম। বর্তমানে যেহেতু যে কেউই বিশ্বাসযোগ্য অডিওভিজ্যুয়াল বানাতে সক্ষম, তাই সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আমাদের এখন নতুন মানদণ্ড তৈরি করতে হবে।
ধাপ এক: শারীরিক ও বস্তুগত ত্রুটি: পরিপূর্ণতা যখন নিজেই একটি সংকেতের মতো কাজ করে
তিরিশ–সেকেন্ডে সত্যতা যাচাই (ব্রেকিং নিউজ): সময় কম থাকলে আর তাৎক্ষণিকভাবে সন্দেহজনক কিছু যাচাই করতে হলে প্রথমেই খেয়াল করুন—দৃশ্যটা কি “অতিরিক্ত নিখুঁত” লাগছে? যেখানে খুব পরিপাটি বা সাজানো-গোছানো থাকা সম্ভব নয়, সেখানে ম্যাগাজিনে যেমনটা ছাপা হয় তেমন নিখুঁত পরিপাটি ছবি/ফুটেজ দেখলে সন্দেহ করুন। যেমন—একজন প্রতিবাদীর মুখে নিখুঁত মেকআপ, দুর্যোগের কবলে পড়া কারও চুল পরিপাটি থাকা, বা কোনো রাজনৈতিক ঘটনার ছবিতে সবাইকে দেখতে যদি শৌখিন পেশাজীবিদের মতো মনে হয়—তাহলে এক মূহুর্ত সময় নষ্ট না করে সন্দেহ করুন।
১. বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা—এই ব্যক্তিকে কি ঘটনা অনুযায়ী অতিরিক্ত পরিপাটি বা নিখুঁত দেখাচ্ছে?
২. বিষয়বস্তুর মিল-অমিল—সংকট বা সংঘর্ষের দৃশ্যে ম্যাগাজিন প্রচ্ছদের মতো সুন্দর-নিখুঁত উপস্থাপনা কতটা মানানসই?
৩. ত্বকের অবস্থা যাচাই —যেখানে মানুষের ত্বকের স্বাভাবিক টেক্সচার থাকা উচিত সেখানে কি ঘষে-মেজে অতিরিক্ত মসৃণ করা দেখানো হয়েছে?৪. সামগ্রিক সাজসজ্জা মূল্যায়ন— পোশাক-চেহারা কি পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
পাঁচ মিনিটে প্রযুক্তিগত যাচাই (ভালো মানের গল্পের ক্ষেত্রে): এই গভীর পরীক্ষা এমন প্রযুক্তিগত খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করে যেগুলো কৃত্রিমভাবে তৈরি ছবিকে ফাঁস করে দেয়। আধুনিক এআই শারীরিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে এমন ছবি তৈরি করে যা অস্বাভাবিক রকমের নিখুঁত হয়। সত্যিকারের আলোকচিত্রে যেমনটা পাওয়া যায় না। কেননা বাস্তবে মানুষের মুখাবয়ব এমন নিখুঁত হয় না। যাপিত জীবনের ক্লান্তি থাকে, থাকে পারিপার্শ্বিক প্রভাব—যেগুলো এআই ঠিকঠাক নকল করতে পারে না।
১. মুখের অংশের ১০০% জুম করুন —মানুষের ত্বকের আকার-আকৃতি, রোমকূপ এবং ছোটখাটো অমিল খুঁজুন।
২. পোশাকের ভাঁজ পরীক্ষা— কাপড়ের স্বাভাবিক ভাঁজ, গঠন ও কুঁচকানো চিহ্ন আছে কিনা দেখুন।
৩. চুলের গোছা বিশ্লেষণ—আলাদা আলাদা চুলের রেখা দেখা যাচ্ছে কিনা, নাকি আঁকা/রেন্ডার করা মতো লাগছে।
৪. গয়না/আনুসাঙ্গিক জিনিসগুলো দেখতে কতটা বাস্তবের মতো লাগছে—এগুলো কি ত্রিমাত্রিক দেখাচ্ছে, নাকি কম্পিউটার গ্রাফিক্সের মতো চ্যাপ্টা।
৫. দাঁত পরীক্ষা—স্বাভাবিক কোনো খুঁত আছে কিনা, নাকি সব দাঁতই অস্বাভাবিকভাবে একইরকম নিখুঁত।
৬. সামগ্রিক নিখুঁততা যাচাই—সাজসজ্জার মাত্রা কি বাস্তব প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই?
গভীর অনুসন্ধান (উচ্চ–মানসম্পন্ন রিপোর্টিং): যেসব প্রতিবেদনে নির্ভুলতা যাচাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে এই পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ ছবিটিকে প্রমাণ হিসেবে ধরে গভীরভাবে পরীক্ষা করে। এর লক্ষ্য হলো একাধিক যাচাইয়ের ভিত্তিতে সম্ভাব্যতা নিরূপণ করা এবং বোঝা যে, যদি সম্পূর্ণভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নাও হয়, তারপরও যেন তথ্যভিত্তিক সঠিক সিদ্ধান্তটা নেওয়া যায়।
১. তুলনামূলক বিশ্লেষণ—একই ব্যক্তির অন্যান্য ছবি খুঁজে স্বাভাবিক ও কৃত্রিম নিখুঁততার মাত্রা তুলনা করুন।
২. প্রযুক্তি ব্যবহার—পেশাদার টুলস ব্যবহার করে পিক্সেল দেখে ত্বকের গঠন পরীক্ষা করুন এবং গাণিতিক প্যাটার্ন খুঁজুন।
৩. প্রেক্ষাপট যাচাই—অন্যান্য ছবির সঙ্গে তুলনা ও বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করুন এই ব্যক্তি সাধারণত দেখতে এমন নিখুঁত কিনা।
৪. পেশাদার ব্যক্তির পরামর্শ—উন্নত বিশ্লেষণের জন্য ডিজিটাল ফরেনসিক্স বিশেষজ্ঞ যেমন ফারিদ হানির সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
৫. বিভিন্ন দিক থেকে যাচাই—একই ঘটনার অতিরিক্ত ছবি বা ভিডিও সংগ্রহ করে ধারাবাহিকতা পরীক্ষা করুন।
৬. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তুলনা—একই সময়কাল ও প্রেক্ষাপটের প্রমাণিত ছবির সঙ্গে তুলনা করুন।
ধাপ দুই: জ্যামিতিক পদার্থবিজ্ঞানের নীতি লঙ্ঘন—এআই যখন স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করে

বাস্তবে তোলা একটি আলোকচিত্রের পাশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বানানো রেললাইনের ছবি। ছবি: হেঙ্ক ফন এস
বর্ণনা: এআই ছবিকে আলোকচিত্রীদের মতো নয় বরং কোলাজ শিল্পীদের মতো করে বানায়। এটি ভিজ্যুয়াল উপাদানগুলো বুঝতে পারে, কিন্তু বাস্তব দুনিয়ার আলো-ছায়া-দৃশ্য কিভাবে কাজ করে তার ওপর ভিত্তি করে জ্যামিতি ও পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো ধরতে পারে না। পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক ত্রুটিগুলো এআইয়ের পক্ষে ঠিক করা কঠিন। কারণ এর জন্য ত্রিমাত্রিক পরিসরে আলো কীভাবে কাজ করে—সে বিষয়ক বোঝাপড়া প্রয়োজন।
এআই-সৃষ্ট ছবিতে বাস্তব–জগতের পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ক সমস্যা: যদিও আমরা এখনও জেনারেটিভ এআই যুগের প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। (জেনারেটিভ এআই হলো এক ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যা টেক্সট, ছবি, সঙ্গীত, ভিডিও এবং কোডের মতো নতুন ও মৌলিক বিষয়বস্তু তৈরি করতে পারে।) এখনকার এআই-সৃষ্ট ছবিগুলো দৃশ্য অনুযায়ী আলো-ছায়ার প্রতিফলন যোগ করে। ওপেন এআইয়ের দাল-ই টু দিয়ে তৈরি ছবিতে যেমন ছায়াগুলো অসংগত, আলোর প্রতিফলন মেলেনি বা অনুপস্থিত, কিংবা প্রতিফলিত ছায়াগুলো সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে অবস্থান করছে।
অদৃশ্য বিন্দু বিশ্লেষণ: বাস্তবের ভবনগুলো উচ্চতা, দৈর্ঘ্য, গভীরতা, অবস্থান ও দুরত্বের নিয়ম (ল অব পারসপেকটিভ) মেনে চলে—সমান্তরাল লাইনগুলো দিগন্তরেখায় একটি বিন্দুতে মিলিত হয়। অথচ এআই প্রায়ই এমন ভাবে ভবনগুলো তৈরি করে যেখানে ছাদের রেখা বাম দিকে চলে গেছে, আর জানালার রেখাগুলো ডান দিকে। নিয়ম অনুযায়ী যা অসম্ভব। তাই বোঝা যায় এটি বাস্তবের কোনো ছবি নয় বরং অ্যালগরিদমিক সমাবেশ। বাস্তব ছবিতে কোনো দৃশ্য বোঝার জন্য অদৃশ্য বিন্দু (ভ্যানিশিং পয়েন্ট) গুরুত্বপূর্ণ। এআই-সৃষ্ট ছবিতে প্রায়ই এক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য দেখা যায়। এতে দেখা যায় রেখাগুলো ঠিক মতো অদৃশ্য বিন্দুর সঙ্গে মিলছে না।
ছায়ার মধ্যে মিল যাচাই: যেখানে আলো আছে, সেখানে ছায়া থাকবেই। কোনো বস্তু, তার ছায়া এবং আলোর উৎসের সম্পর্ক জ্যামিতিকভাবে সহজ হলেও কৃত্রিম ছবিতে তা সঠিকভাবে বানানোটা ভীষণ কঠিন। একক আলোর উৎসের দৃশ্য (যেমন সূর্যালোক), সব ছায়া উৎস থেকে দূরে থাকে। এআই প্রায়ই এমন ছবি দেখায় যেখানে সূর্য একমাত্র আলোর উৎস হিসেবে থাকার পরও একাধিক দিকে ছায়া ফেলছে, যা পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নিয়মের লঙ্ঘন।
গবেষণামূলক যাচাই: একাডেমিক গবেষণা এই ধরনের জ্যামিতিক ত্রুটি নিশ্চিত করেছে। আউটডোর ছবিতে গ্র্যাডক্যাম (এক ধরনের টুল, যা তুলে ধরে এআই ছবির কোন অংশকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে) বিশ্লেষণ ব্যবহার করে দেখা গেছে, যানবাহনের ছায়া ভিন্ন ভিন্ন দিকে পড়ছে এবং ভ্যানিশিং পয়েন্টের কাছে কাঠামো বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। আবার ইনডোর ছবিতে বস্তু ও ছায়ার মধ্যে অমিল এবং ঘরের মধ্যে জ্যামিতিক রেখার অসামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করা গেছে। এই ধরনের সূক্ষ্ম ত্রুটি শনাক্ত করাটা সহজ নয়। তাই প্রথমেই আপনাকে রেখাগুলো পর্যবেক্ষণ করার অভ্যাস করতে হবে।
তিরিশ–সেকেন্ডে সত্যতা যাচাই:
১. সরাসরি রেললাইনের যেকোনো ছবি খুঁজুন (গুগলে লিখুন: railroad tracks perspective)।
২. এমএস পেইন্ট বা যেকোনো সাধারণ ইমেজ এডিটরে ছবিটি খুলুন।
৩. লাইন টুল ব্যবহার করে দুইটি রেললাইন ধরে টেনে নিন, সেগুলোকে দিগন্তের দিকে বাড়ান।
৪. খেয়াল করুন, সেগুলো একটি বিন্দুতে গিয়ে মিলে গেছে কিনা—এটাই হওয়ার কথা।
বাস্তব ছবিটি দেখতে কেমন বা এটির সঠিক ভিজ্যুয়াল মানদণ্ড কী—আপনি জানেন। যা দিয়ে সত্যিকারের দৃশ্যটি কেমন হওয়া উচিত তা বুঝতে পারবেন।
পাঁচ মিনিটে প্রযুক্তিগত যাচাই (ভালো মানের গল্পের জন্য):
দৃশ্য অনুযায়ী পরীক্ষা:
১. ছবি থেকে একটি ভবন বেছে নিন।
২. যেকোনো ইমেজ এডিটর ব্যবহার করে ছাদের রেখা এবং জানালার সারি ধরে লাইন টেনে নিন।
৩. দেখুন ভবনের লাইনগুলো একটি বিন্দুতে গিয়ে মিলে যাচ্ছে কিনা।
৪. যদি একই ভবনের লাইন একাধিক ভ্যানিশিং পয়েন্ট তৈরি করে, তাহলে ধরে নিতে হবে ছবিটা এআই-জেনারেটেড।
ছায়া বিশ্লেষণ:
১. ছবিতে প্রথমে আলোর প্রধান উৎস চিহ্নিত করুন (যেখানে সবচেয়ে উজ্জ্বল আলো পড়েছে বা হাইলাইট রয়েছে)।
২. আলোর উৎস থেকে বস্তুগুলোর শীর্ষবিন্দু দিয়ে ছায়ার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত একটি কল্পিত রেখা টানুন।
৩. লক্ষ্য করুন, সব ছায়া একই দিকে যাচ্ছে কিনা।
৪. যদি ছায়ার দিকগুলো আলাদা হয় বা মিল না থাকে, তবে সেটা পদার্থবিদ্যার নিয়ম ভঙ্গ করছে — অর্থাৎ ছবিটি কৃত্রিমভাবে তৈরি বা পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
গভীর অনুসন্ধান (গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টিং):
আলোর প্রতিফলন যাচাই: যখন কোনো বস্তু সমতল পৃষ্ঠে (যেমন—পানি, কাঁচ, আয়না) প্রতিফলিত হয়, তখন বস্তু আর তার প্রতিফলনের মধ্যে সংযোগরেখা টানলে সেগুলো একটি নির্দিষ্ট ভ্যানিশিং পয়েন্টে এসে মিলবে।
১. ছবিতে কোন জায়গাতে প্রতিফলন পড়েছে তা খুঁজুন (যেমন—পানি, কাঁচ, আয়না)।
২. বস্তু ও তার প্রতিফলনের মধ্যে রেখা টানুন।
৩. দেখুন রেখাগুলো প্রতিফলিত পৃষ্ঠের কোণ বরাবর গিয়ে মিশছে কিনা।
৪. যদি প্রতিফলনের অবস্থানের মধ্যে অমিল চোখে পড়ে বা কোণগুলো না মেলে, তাহলে সেটি জ্যামিতিক ত্রুটি—অর্থাৎ ছবিটি কৃত্রিম হতে পারে।
ধাপ তিন: প্রযুক্তিগত ছাপ ও পিক্সেল বিশ্লেষণ — গাণিতিক ডিএনএ

২০০৪ সালে একজন মার্কিন সৈন্যের ডিজিটালি পরিবর্তিত ভাইরাল ছবি। ছবিতে কাঁধের ইউনিট প্যাচে “DOING THE WORK OF” লেখা এবং নীচে রাশিয়ান, জার্মান ও ফরাসি পতাকা। টুলের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে কোন অংশে সম্ভাব্য পরিবর্তন করা হয়েছে এবং পরিবর্তনের সম্ভাবনা কত। ছবি: হেঙ্ক ফন এস
বর্ণনা: এআই যখন কোনো ছবি তৈরি করে, তখন ফাইলের মধ্যে লুকানো কিছু সূত্র রেখে যায়। যাকে বলে গাণিতিক স্বাক্ষর—যা বিশেষ টুল দিয়ে শনাক্ত করা যায়। পিক্সেলের বিন্যাস এবং ফাইল কম্প্রেশনের মধ্যে এই সূত্রগুলো পাওয়া যায়। যা প্রমাণ করে ছবিটি সত্যিকারের ক্যামেরা দিয়ে তোলা নয় বরং এআই দিয়ে তৈরি—ঠিক যেন জৈবিক (ডিএনএ) প্রমাণ।
নাকের গড়ন শনাক্তকরণ: ক্যামেরায় ছবি তোলার সময় ছোটখাটো বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি তৈরি হয়—যেমন ধুলো বা আলোর ঝলকানির কারণে ছবিতে দেখা যাওয়া ছোট ছোট দাগ, যাকে বলে ক্যামেরা সেন্সরের ছোট ছোট র্যান্ডম স্পেক। এআই-সৃষ্ট ছবিতে এর পরিবর্তে অস্বাভাবিক রকমের নিখুঁত প্যাটার্ন দেখা যায়। বিশেষজ্ঞরা যখন এই প্যাটার্নগুলো বিশেষ সফটওয়্যার দিয়ে বিশ্লেষণ করেন, তখন তারার মতো কিছু আকৃতি দেখতে পান—যা বাস্তব ছবিতে কখনো দেখা যায় না। এগুলো অনেকটা পুরনো আমলের টেলিভিশনের পর্দায় দেখা ছোট ছোট এলোমেলো সাদা-কালো দাগ বনাম কম্পিউটার ব্যবহার করে তা নকল করার চেষ্টার মতো। কিন্তু নকল করার সময় লুকানো কিছু ছাপ তৈরি হয়—যা সঠিক টুল থাকলে সহজেই ধরে ফেলা যায়।
কপি–পেস্ট শনাক্তকরণ: এআই হোক কিংবা আমি আপনি যখন কোনো ছবির অংশ কপি করে অন্যত্র বসাই, তখন পিক্সেলের মধ্যে একধরনের অস্বাভাবিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ছবির মধ্যে এমন সব জায়গা তৈরি হয় স্বাভাবিক অবস্থায় যেখানে এতো মিল থাকার কথা নয়। এভাবে তৈরি হয় সন্দেহজনক পুনরাবৃত্তি, যা বিশেষ প্যাটার্ন বা গাণিতিক চিহ্ন হিসেবে ধরা যায়।
অস্বাভাবিক ধরণ বিশ্লেষণ: এআই-জেনারেটেড ছবিতে প্রায়ই এমন সব অস্বাভাবিক ধরন (কম্প্রেশন আর্টিফেক্ট প্যাটার্ন) দেখা যায়, যা ক্যামেরায় তোলা আসল ছবির ‘র ফাইল’এর মতো নয়। এতে বোঝা যায় ছবিটি অপটিক্যাল বা বাস্তব ক্যামেরায় তোলা নয়, বরং অ্যালগরিদমিক বা কম্পিউটার ব্যবহার করে তৈরি।
পেশাদার শনাক্তকরণ টুল: ট্রুমিডিয়াডটওআরজি-এর টুল দিয়ে সন্দেহজনক ছবি, ভিডিও বা অডিও পরীক্ষা করে বোঝা যায় কোনটা আসল এবং কোনটা ডিপফেক। সম্প্রতি তারা যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্পের গ্রেপ্তার দাবি করা ছবি এবং শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে দেখানো অন্য আরেকটি ছবিও শনাক্ত করেছে।
সন্দেহজনক ছবি বিশ্লেষণ করার আগে, সহজ কোনো ছবি দিয়ে অনুশীলন করুন:
১. আপনার ছবিটি ইমেজ ভেরিফিকেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট-এ আপলোড করুন।
২. টুলটি দেখাবে ছবিটি নকল হওয়ার সম্ভাবনা কত শতাংশ।
৩. যদি ছবির নকল হওয়ার সম্ভাবনা ৭০% বা তার বেশি হয়, তবে ছবির আরও খুঁটিনাটি যাচাই করুন।
১. ভিজ্যুয়াল টেক্সচার পরীক্ষা: ত্বক বা আকাশের মতো অংশে ১০০% জুম করুন। টেক্সচার মনোযোগ দিয়ে দেখুন—এটি কি বাস্তব জীবনের অমসৃণ বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরছে নাকি খুব মসৃণ এবং গাণিতিকভাবে নিখুঁত দেখাচ্ছে? বাস্তব ছবিতে স্বাভাবিক অমসৃণতা থাকে; এআই প্রায়ই নিখুঁতভাবে ছবি তৈরি করে যা সন্দেহজনক।
২. স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ টুল: ছবিটি ট্রুমিডিয়াডটওআরজিতে (একটি ফ্রি ওয়েবসাইট) আপলোড করুন। এই টুলটি ছবিটিকে এআই শনাক্তকরণ সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে, যা লুকানো গাণিতিক চিহ্নগুলো পরীক্ষা করে। এটি আপনাকে দেখাবে ছবিটির এআই দিয়ে তৈরির সম্ভাবনার শতকরা কত শতাংশ।
৩. ফাইলের লুকানো তথ্য যাচাই করুন: ছবির ফাইলের উপর রাইট-ক্লিক করে “Properties” (পিসিতে) বা “Get Info” (ম্যাকে) নির্বাচন করুন। মেটাডেটা দেখুন — এটি দেখায় কোন সফটওয়্যার ফাইলটি তৈরি করেছে এবং কখন। এআই-সৃষ্ট ছবিতে প্রায়ই এমন এডিটিং সফটওয়্যার টাইমস্ট্যাম্প বা টুল দেখা যায় যা ছবির দাবিকৃত সময় বা পরিস্থিতির সঙ্গে মেলে না।
৪. উপরের অংশের মসৃনতা বিশ্লেষণ: এটি টেক্সচার পরীক্ষার ধাপ থেকে আলাদা। এখানে আপনি ছবির ওপরের এমন অংশগুলো পর্যবেক্ষণ করবেন যেগুলো স্বাভাবিকভাবেই অমসৃন বা অগোছালো হওয়া উচিত—যেমন দেয়াল, কাপড় বা পানি। এআই প্রায়ই এই ধরনের পৃষ্ঠগুলোর ক্ষেত্রেও “এয়ারব্রাশ” করে বা পৃষ্ঠগুলোকে ঘষেমেজে অনেক বেশি মসৃণ করে দেখায়, অথচ বাস্তবে এ ধরনের ছবিতে ছোট ছোট উঁচু-নিচু দাগ, ভাঁজ বা ব্যবহারের কারণে তৈরি হওয়া অমসৃণতা দেখা যেত।
এই প্রতিটি ধাপ এআইয়ের ভিন্ন ভিন্ন ভুলগুলোকে সামনে আনে। তাই আপনার সিদ্ধান্তটি যে সঠিক তা নিশ্চিত করতে এই পরীক্ষাগুলো করার কথা ভাবুন।
গভীর অনুসন্ধান (গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টিং):
ফরেনসিক্যালি—এটি এক ধরনের বিনামূল্যের টুল, যা ছবির ভেতরে থাকা শব্দ বা নয়েজ পরীক্ষা করে। ছবির ভেতরের অদৃশ্য অংশগুলোকে ফ্রিকোয়েন্সি আকারে দেখাতে পারে।
ফ্রিকোয়েন্সি ডোমেইন বিশ্লেষণ —সাধারণত এআই-তৈরি ছবিতে থাকে, কিন্তু বাস্তব ছবিতে থাকে না; ছবির ভেতরে লুকানো এই ধরনের বিশেষ গাণিতিক নকশা বা প্যাটার্ন বের করে।
ধাপ চার: ভয়েস ও অডিও ত্রুটি —সিনথেটিক স্পিচ (কম্পিউটার বা এআই দিয়ে বানানো কণ্ঠস্বর) যখন নিজেই নিজের সত্য তুলে ধরে

ডোনাল্ড ট্রাম্পের কন্ঠ ব্যবহার করে তৈরি এআই-জেনারেটেড অডিও ডিপফেকের বিশ্লেষণ। ছবি: ইউটিউব, হেঙ্ক ফন এস।
বর্ণনা: কয়েক সেকেন্ডের অডিও থেকে যে কারো কণ্ঠ নকল করতে পারে ভয়েস ক্লোনিং প্রযুক্তি। কিন্তু কিছু চিহ্ন থেকে যায়—যেমন কথা বলার অস্বাভাবিক ভঙ্গি, আবেগের ঘাটতি, আর শব্দ উচ্চারণের সূক্ষ্ম তারতম্য। কণ্ঠস্বর খুব নিখুঁতভাবে নকল হলেও মানুষের আসল আবেগ ও স্বাভাবিকতা পুরোপুরি নকল করতে এআই আজও হিমশিম খায়।
অডিও প্রতারণার বাস্তব ঘটনা:
২০১৯ সালের মার্চে যুক্তরাজ্যের একটি এনার্জি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী তার “বসের” কাছ থেকে ফোন পান। ফোনে নিখুঁতভাবে জার্মান উচ্চারণ নকল করা হয়েছিল। নির্বাহীকে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেনের নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে অস্ট্রিয়ার একটি নম্বর থেকে সন্দেহজনক দ্বিতীয় কলটি আসায় ঘটনাটি ধরা পড়ে যে এটা মূলত এআই প্রতারণা। সম্প্রতি রাজনৈতিক পরামর্শক স্টিভেন ক্রেমার মাত্র ১৫০ ডলার খরচ করে একটি ডিপফেক রোবোকল তৈরি করেন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কণ্ঠ নকল করে বলা হয়, নিউ হ্যাম্পশায়ারের ২০২৪ সালের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থিতা নির্বাচনে ভোট না দিতে।
অডিও ফেকের গতি ও খরচ: ক্রেমারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তথ্যমতে, ওই ডিপফেক বানাতে ২০ মিনিটেরও কম সময় লেগেছিল এবং খরচ হয়েছিল মাত্র ১৫০ ডলার। কিন্তু ক্রেমার সিবিএস নিউজকে বলেন, এটি ছড়িয়ে তিনি “৫০ লাখ ডলার সমমূল্যের প্রচার” পেয়েছেন।
সন্দেহজনক কণ্ঠস্বরের লক্ষণ:
উদীয়মান প্রযুক্তি ও বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ে গবেষণা করেন লিন্ডসে গোরম্যান। এনবিসি নিউজকে তিনি বলেন, ডিপফেক অডিওতে চেনার মতো কিছু চিহ্ন থাকে। “বিশেষ করে কথার শেষের দিকে স্বর ও ছন্দ অস্বাভাবিক ও রোবটের মতো শোনায়। অডিওটি যে ভুয়া হতে পারে—এটি তার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত।”
- অস্বাভাবিক গতি — স্বাভাবিক বিরতি বা শ্বাস নেওয়া ছাড়া কথা বলা।
- একেবারে নিখুঁত উচ্চারণ — যেখানে সাধারণ কথায় ছোটখাটো ভুল বা ভাঙন থাকে।
- রোবটের মতো টোন বা স্বর ওঠানামা — কিছু শব্দ বা বাক্যে অস্বাভাবিক জোর।
- চারপাশ থেকে আসা স্বাভাবিক শব্দ নেই — যেমন শ্বাস, পেছনের শব্দ বা বাস্তবের আবহ।
- এমন শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করা যা ওই ব্যক্তি বাস্তবে কখনোই বলতেন না।
ভাষাগত যৌক্তিক ভুল:
একটি পুরোনো ডিপফেক ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, এআই বলেছে “pounds 35,000”, যেখানে স্বাভাবিক ইংরেজিতে হয় “35,000 pounds”। এই অস্বাভাবিক শব্দ গঠন থেকেই বোঝা যায় অডিওটি কৃত্রিমভাবে তৈরি।
তিরিশ–সেকেন্ডে সত্যতা যাচাই:
হিয়া ডিপফেক ভয়েস ডিটেক্টরটি দেখতে পারেন। এটি একটি সহজ ক্রোম প্লাগইন (মাসে ২০ বার ব্যবহার করা যায়)। ট্রাম্প ও বাইডেনকে নিয়ে তৈরি ভিডিও পরীক্ষায় এটি সফল হয়েছে।
এটি একটি ক্রোম এক্সটেনশন যা আপনার ব্রাউজারে চলা অডিওটি তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্লেষণ করে এবং বলে দেয় আপনি যে কণ্ঠস্বর শুনছেন, তা কি সত্যিকারের মানুষের কণ্ঠ নাকি এআই দিয়ে তৈরি।
এটি আসলে যা করে:
- আপনার ক্রোম ব্রাউজারে চলা ভিডিও বা অডিওর কণ্ঠস্বর বিশ্লেষণ করে।
- মাত্র এক সেকেন্ডের অডিও শুনেই প্রাথমিক ফলাফল জানিয়ে দেয়।
- যেকোনো ওয়েবসাইটে কাজ করে — সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, নিউজ সাইট, ভিডিও প্ল্যাটফর্ম সবখানেই।
- এআই ভয়েস সিন্থেসিস টুল দিয়ে বানানো মানবসদৃশ কণ্ঠস্বর শনাক্ত করতে পারে।
- একাধিক ভাষা নিয়ে কাজ করতে পারে।
- ব্রাউজ করার সময় তাৎক্ষণিকভাবে কাজ করে।
সতর্কতা: এই প্লাগইনটি প্রবাবিলিস্টিক অ্যালগরিদম (কম্পিউটার প্রোগ্রাম যা ফলাফল সম্পর্কে নিশ্চয়তা দেয় না, বরং সম্ভাবনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়) ব্যবহার করে, তাই সবক্ষেত্রে ১০০% নির্ভুল নাও হতে পারে।
পাঁচ মিনিটে প্রযুক্তিগত যাচাই (সাধারণ খবরের জন্য):
১. কণ্ঠের স্বাভাবিকতা যাচাই করুন/শুনুন — কথা বলার গতি ও উচ্চারণ কি মানুষের মতো লাগছে?
২. প্রাপ্যতা যাচাই — যে সময়ের কথা বলা হয়েছে, তখন কি সত্যিই এই ব্যক্তি এই বক্তব্য দিতে পারতেন?
৩. অনুভূতির সত্যতা পরীক্ষা —কন্ঠস্বরের আবেগ কি কথার বিষয়বস্তু ও পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই?
৪. জরুরি অডিও যাচাই — প্রয়োজন হলে অফিসিয়াল নম্বরে ফোন করে নিশ্চিত করুন।
৫. প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করুন — এমন প্রশ্ন যা শুধুমাত্র ওই ব্যক্তি জানতেন।
গভীর অনুসন্ধান (উচ্চ–ঝুঁকিপূর্ণ রিপোর্টিং):
- সম্পূর্ণ অডিও ফ্র্যাগমেন্টটি (অডিও ফাইলের ছোট অংশ বা টুকরো) ডাউনলোড করুন।
- এরপর নোট্টা.এআই-তে দিন এবং একটি ট্রান্সক্রিপ্ট তৈরি করুন।
- অপেক্ষার সময়, ক্লাউডে সেই একই ব্যক্তির পাঁচ-ছয়টি যাচাইকৃত অডিও ফ্র্যাগমেন্ট বা ট্রান্সক্রিপ্ট দিন।
- ক্লাউডকে নির্দেশ দিন সেম্যান্টিক বিশ্লেষণ (কথার অর্থগত বিশ্লেষ) এবং বিষয়বস্তু, বক্তব্যের প্যাটার্ন, ব্যাকরণ ব্যবহার, এবং কণ্ঠস্বরের টোন অনুযায়ী শ্রেণীবদ্ধ করতে।
- এরপর, আপনি যেটিকে ভুয়া মনে করছেন ওই অডিওর ট্রান্সক্রিপ্টটি আপলোড করুন এবং ক্লাউডকে অনুপাত ও অস্বাভাবিকতা যাচাই করতে বলুন।
ধাপ পাঁচ: সময় ও প্রাসঙ্গিক যুক্তি — এআই যখন গুরুত্বপূর্ণ ছবিটা বাদ দেয়

এআই দিয়ে বানানো এই স্থির চিত্রে জলবায়ু নিয়ে প্যারিসে ঘটে যাওয়া প্রতিবাদের ঘটনাটি খবর পরিবেশনের মতো করে উপস্থাপন করা হয়েছে। ছবি: হেঙ্ক ফন এস
বর্ণনা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দৃশ্যের ধরন বা ভিজ্যুয়াল প্যাটার্ন দেখে কনটেন্ট তৈরি করে, কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপট, সময় জ্ঞান বা পরিস্থিতির উপযোগিতা বোঝে না। ফলে তৈরি কনটেন্ট আলাদা করে দেখলে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়, কিন্তু গভীরভাবে খেয়াল করলে অসংগতিই ধরা পড়ে।
ইরান কারাগারের ভিডিও নিয়ে বিভ্রান্তি: উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি একটি ভিডিওতে দাবি করা হয় ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র ইরানের এভিন কারাগারে আঘাত হেনেছে। ভিডিওটি বানানো হয়েছিল ২০২৩ সালের একটি চলচ্চিত্রের ওপর ভিত্তি করে। যেখানে ভুল শনাক্ত করার কিছু সূত্র ছিল। যেমন ঋতু বিষয়ক অসঙ্গতি (গ্রীষ্মের ফুটেজে পাতা-শূন্য ঝোপঝাড়), সবকিছুর নিখুঁত উপস্থাপন—যা বাস্তবে অসম্ভব। আর সময় ঘিরে অবিশ্বাস্য অসঙ্গতি।
তিরিশ–সেকেন্ডে সত্যতা যাচাই: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দেখতে বিশ্বাসযোগ্য কনটেন্ট তৈরি করতে পারে, কিন্তু সময়, স্থান ও পরিস্থিতির মৌলিক যৌক্তিক সম্পর্কগুলো প্রায়ই এড়িয়ে যায়। ব্রেকিং নিউজ পরিস্থিতিতে আপনার নিজের উপলব্ধি ও জ্ঞানকে কাজে লাগান—যা পরবর্তী গভীর বিশ্লেষণের আগেই অযৌক্তিক বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে।
১. ঋতু/আবহাওয়া যাচাই — উদ্ভিদ, পোশাক বা আলো কি ছবিতে দেখানো সময় ও স্থানের সঙ্গে মেলে?
২. প্রযুক্তিগত সময়রেখা পরীক্ষা—এই সময়কাল অনুযায়ী কী ধরনের যন্ত্র, যানবাহন বা অবকাঠামো থাকা উচিত নয়?
৩. ভৌগোলিক দিক যাচাই—স্থাপত্য, চিহ্ন এবং চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ছবিতে দেখানো সময়ের সঙ্গে কতটা মিলে?
৪. উৎসের বিশ্বাসযোগ্যতা দ্রুত যাচাই— যে উৎস থেকে কনটেন্ট এসেছে, তা কী উন্নত মানের কনটেন্ট বানানোর ক্ষমতা ও সক্ষমতা রাখে?
পাঁচ মিনিটে প্রযুক্তিগত যাচাই (সাধারণ প্রতিবেদনের জন্য): এই পর্যায়ে গভীর বিশ্লেষণের মাধ্যমে ছবিতে দেখানো বিষয়গুলোকে যাচাইযোগ্য তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। আমাদের চারপাশের ঘটনার আবহ বোঝাটা এআইয়ের জন্য কঠিন, ফলে এমন কনটেন্ট তৈরি হয় যা ভিজ্যুয়ালি ঠিকঠাক মনে হলেও বাইরের তথ্যের সঙ্গে তুলনা করলে যৌক্তিকভাবে ভুল প্রমাণিত হয়।
১. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যাচাই — কোনো ছবি বা ভিডিওতে যে তারিখ আর জায়গার কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে আসলেই মিলে কিনা তা যাচাই করতে আবহাওয়ার তথ্য (আর্কাইভ করা ডেটা) যাচাই করুন।
২. স্থাপত্য ও বৈশিষ্ট্য যাচাই —যে বাড়িগুলো, চারপাশের চিহ্ন এবং অবকাঠামো দেখা যাচ্ছে সেগুলো সত্যিই ছবিতে দেখানো ওই স্থানে আছে কিনা নিশ্চিত করুন।
৩. সাংস্কৃতিক উপাদান পরীক্ষা — পোশাকের ধরন, আচরণ ও সামাজিক প্রেক্ষাপট ওই ভৌগোলিক/সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মিলছে কিনা দেখুন।
৪. টাইমলাইন মূল্যায়ন — গবেষণা করুন, দাবী করা ঘটনাগুলো একসাথে যৌক্তিকভাবে ঘটতে পারতো কিনা।
৫. সূত্রের ধরন বিশ্লেষণ —সাধারণ তথ্য প্রদানের পদ্ধতির সঙ্গে কনটেন্ট কীভাবে ছড়ায় তা তুলনা করুন।
৬. একাধিক দিক অনুসন্ধান — স্বাধীন উৎস থেকে একই ঘটনার অন্যান্য প্রমাণ খুঁজুন।
গভীর অনুসন্ধান (উচ্চ–ঝুঁকির রিপোর্টিং): গুরুত্বপূর্ণ খবরের ক্ষেত্রে, ছবিতে বা ভিডিওতে থাকা ছোট ছোট তথ্যগুলোকে ফরেনসিক ধাঁধার অংশ হিসেবে দেখুন। প্রতিটা তথ্যকে যাচাই করতে হবে, একাধিক সূত্রের সঙ্গে মিলিয়ে, যাতে সম্ভাব্যতার একটি মানচিত্র তৈরি করা যায়।
১. টাইমলাইন তৈরি করুন— দাবীকৃত ঘটনার বিস্তারিত ক্রোনোলজি তৈরি করুন এবং ছবিতে থাকা সব উপাদানের সঙ্গে তুলনা করুন।
২. ভৌগোলিক তথ্য যাচাই — স্যাটেলাইট চিত্র, রাস্তার ছবি এবং স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে অবস্থান নিশ্চিত করুন।
৩. মৌসুমী/পরিবেশ বিষয়ক ফরেনসিক —উদ্ভিদবিজ্ঞানী, আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় সূত্রের সঙ্গে পরামর্শ করুন যে, এই পরিবেশে ছবির এই বিষয়বস্তুগুলো কতটা মানানসই।
৪. সাংস্কৃতিক মিলগুলো খুঁজুন— কনটেন্টে দেখা আচার, পোশাক ও সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার নিন।
৫. প্রযুক্তিগত মিল বিশ্লেষণ— ছবি বা ভিডিওতে যে সব ডিভাইস, যানবাহন, অবকাঠামোর দেখানো হচ্ছে তা ওই সময় ও স্থানে সত্যিই উপস্থিত ছিল কিনা যাচাই করুন।
৬. উৎস অনুসন্ধান করুন— সম্পূর্ণ ঘটনার ইতিহাস অনুসন্ধান করুন এবং অনুরূপ প্রকৃত ঘটনার ধরনের সঙ্গে তুলনা করুন।
৭. বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেটওয়ার্ক — অবস্থান বা পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত স্থানীয় সাংবাদিক, একাডেমিক এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
৮. সম্ভাবনার তালিকা তৈরি — প্রতিটি যুক্তি বা উপাদানকে নম্বর দিন, আর সব মিলিয়ে কনটেন্ট আসল নাকি নকল তার একটি পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন তৈরি করুন।
ধাপ ছয়: আচরণগত ধরণ শনাক্তকরণ—এআই যখন মানুষকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে

এআই দিয়ে বানানো ছবি, যেখানে দেখা যাচ্ছে শহরের রাস্তায় প্রতিবাদকারীরা মিছিল করছে। ছবি: হেঙ্ক ফন এস
বর্ণনা: এআই মানুষের চেহারা নকল করতে পারে, কিন্তু মানুষের স্বভাবগত আচরণ, সামাজিক গতিবিধি এবং অভিব্যক্তিগুলো হুবহু নকল করতে পারে না। ফলে ভিড়ের দৃশ্য, দলবদ্ধ ছবি, বা ব্যক্তির আচরণে এমন সব অসঙ্গতি তুলে ধরে যা প্রশিক্ষিত কোনো পর্যবেক্ষক সহজেই ধরতে পারেন।
তিরিশ–সেকেন্ডে সত্যতা যাচাই (ব্রেকিং নিউজ): এআই দিয়ে বানানো ভিড়ের কোনো ছবিকে প্রথমবার দেখলে বাস্তব মনে হতে পারে, কিন্তু কিছু অস্বাভাবিক আচরণ চোখে পড়ে। তাই সংবাদ ব্রেক করার আগে দেখুন মানুষের আচার-আচারণ-অভিব্যক্তির সঙ্গে প্রকৃত ঘটনার কতটা মিল রয়েছে। নাকি শুধুই প্রোগ্রাম করা ডিজিটাল চরিত্রের মতো লাগছে।
১. ভিড়ের মধ্যে মিল পরীক্ষা — বেশিরভাগ মানুষের চেহারা, বয়স কি কাছাকাছি? তারা কি একই ধরনের পোশাক পরে আছে?
২. মনোযোগের প্যাটার্ন পরীক্ষা — সবাই কি একই দিকে বা ক্যামেরার দিকে তাকাচ্ছে, নাকি স্বাভাবিক ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে?
৩. তাদের আবেগ-অভিব্যক্তিগুলো কী আদৌও সত্য — মুখের ভাব, অভিব্যক্তিগুলো কি ঘটনার মেজাজ ও তীব্রতার সঙ্গে মিলছে?
৪. চলাফেরার বাস্তবতা —ছবিতে দেখানো মানুষগুলোকে কী কৃত্রিমভাবে সাজানো হয়েছে, নাকি একজন মানুষ থেকে আরেকজন মানুষের স্বাভাবিক দূরত্ব ও অবস্থান আছে?
পাঁচ মিনিটে প্রযুক্তিগত যাচাই (সাধারণ গল্পের জন্য):
এই বিশ্লেষণ মানব সমাজের আচরণ বোঝার ওপর নির্ভর করে। যেখানে দেখা যায় এআই কীভাবে বাস্তব জীবনের দলবদ্ধ আচরণ ও অভিব্যক্তি অনুকরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রকৃত ভিড় জটিল সামাজিক প্যাটার্ন প্রদর্শন করে, যা এআই সম্পূর্ণভাবে ধরতে পারে না, ফলে স্বাভাবিক মনে হওয়া ভিড়েও একই রকমের কৃত্রিমতা ধরা পড়ে। একটু খেয়াল করলে যা শনাক্ত করা সম্ভব।
১. জনসংখ্যাগত বৈচিত্র্য পরীক্ষা — বয়স, পোশাকের ধরন এবং জাতিগত বৈচিত্র্যগুলো ধারন করে এমন চিহ্নগুলো বাছাই করুন এবং কৃত্রিম মিলগুলোর সঙ্গে তুলনা করুন।
২. সামাজিক মিথস্ক্রিয়া বিশ্লেষণ— কথোপকথন, সম্পর্ক এবং দলীয় আচরণ চিহ্নিত করুন এবং দেখানো অবস্থানের সঙ্গে তুলনা করুন।
৩. পরিবেশের প্রতি প্রতিক্রিয়াগুলো যাচাই —আবহাওয়া, আলো, শব্দের মাত্রার সঙ্গে মানুষগুলো কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে?
৪. সাংস্কৃতিক আচরণ পরীক্ষা — সামাজিক নিয়ম, ব্যক্তিগত অবস্থান এবং মিথস্ক্রিয়ার ধরন কি ছবি বা ভিডিওতে দেখানো পরিবেশের সঙ্গে মিলে?
৫. ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি বিশ্লেষণ — বিভিন্ন মুখের অভিব্যক্তি এবং প্রকৃত আবেগগুলো যাচাই করুন, একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে কিনা বিশ্লেষণ করুন।
৬. চলাফেরার গতিবিধি মূল্যায়ন— মানুষগুলো যে যার মতো স্বাভাবিক গতিতে চলছে নাকি সবকিছু কৃত্রিমভাবে, একই রকম মসৃণভাবে করা হয়েছে?
গভীর অনুসন্ধান (উচ্চ–ঝুঁকিপূর্ণ রিপোর্টিং):
গুরুত্বপূর্ণ গল্পের জন্য, মানুষের আচরণকে নৃতাত্ত্বিক প্রমাণ হিসেবে দেখুন, যা সামাজিক ধরনের পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ দাবি করে। এই পদ্ধতিটি পরীক্ষা করে বের করা মানুষের জটিল মিথস্ক্রিয়ার সঙ্গে ছবিতে দাবি করা পরিস্থিতি হতে পারে কি না।
১. সামাজিক ভিড় বিশ্লেষণ —দাবিকৃত ঘটনার বিপরীতে দলের আচরণ বাস্তবসম্মত কিনা যাচাই করতে মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
২. সাংস্কৃতিক সত্যতা যাচাই—সামাজিক আচরণ, পোশাক এবং মিথস্ক্রিয়ার প্যাটার্ন যথাযথ কিনা দেখার জন্য আঞ্চলিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলুন।
৩. জনসংখ্যার সম্ভাব্যতা মূল্যায়ন — খুঁজে দেখুন, উপস্থিত মানুষগুলোর বয়স, লিঙ্গ, পোশাক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো কি সেই ধরনের পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবে দেখা যাচ্ছে কিনা।
৪. ব্যক্তিগত আচরণের ফরেনসিক বিশ্লেষণ—ব্যক্তিত্ব, সম্পর্ক এবং প্রকৃত আবেগের প্রতিক্রিয়াগুলো স্থির কিনা দেখার জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের বিশ্লেষণ করুন।
৫. পরিবেশগত অভিযোজন অধ্যয়ন— পরীক্ষা করুন জনসমাগম বা মানুষের প্রতিক্রিয়া আবহাওয়া, শব্দ, এবং স্থানীয় পরিস্থিতির সঙ্গে বাস্তব জীবনের পরিস্থিতির সঙ্গে মিলছে কিনা।
৬. ঐতিহাসিক তুলনা গবেষণা — একই অঞ্চলের বা সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ঘটে যাওয়া সত্যিকারের অনুরূপ ঘটনার প্রমাণিত ভিডিও বা ছবির সঙ্গে তুলনা করুন।
৭. বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নেটওয়ার্ক — নৃবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী এবং ওই অঞ্চলের সামাজিক গতিবিধি সম্পর্কে জানেন এমন স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
৮. সুক্ষ্ণ অভিব্যক্তিগুলো বিশ্লেষণ— বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিন, যাতে তারা মুখের অভিব্যক্তি পরীক্ষা করে বলতে পারেন প্রতিক্রিয়াগুলো আসল আবেগের প্রকাশ নাকি কৃত্রিমভাবে তৈরি।
৯. সামাজিক নেটওয়ার্ক বিশ্লেষণ — মানুষের মধ্যে সম্পর্কগুলো খুঁজে বের করুন, যাতে বোঝা যায় ভিড় বা দলের গঠন আসলেই স্বাভাবিকভাবে হয়েছে নাকি কৃত্রিমভাবে তৈরি।
ধাপ সাত: অন্তর্জ্ঞান দিয়ে ধরন শনাক্ত করা— প্রাচীন শনাক্তকরণ পদ্ধতি

এআই ব্যবহার করে বানানো একটি ছবির বিশ্লেষণ। যেখানে দেখানো হয়েছে বেলারুশের রাষ্ট্রপতি হাতে ফ্রাই কোণ ধরে আছেন। ছবি: হেঙ্ক ফন এস
বর্ণনা: কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের ফলে আমাদের মস্তিষ্কে স্বাভাবিকভাবে ধরন (প্যাটার্ন) চেনার সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই ধরনগুলো শনাক্ত করতে পারে প্রশিক্ষণ ডেটা আর অ্যালগরিদমিক প্রক্রিয়া থেকে। কোনো কিছু যদি মানুষের স্বাভাবিক উপলব্ধি বা প্রত্যাশার বাইরে চলে যায়, তখন আমাদের অন্তর্জ্ঞান বা ‘গাট ফিলিং’ প্রায়ই প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণের আগেই সবচেয়ে দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য সতর্ক সংকেত প্রদান করে।
বাস্তবের সফল ঘটনা: ২০১৯ সালের ভয়াবহ ঝড় হারিকেন ফ্লোরেন্সের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক “স্ট্রিট শার্ক” ছবিকে ব্যবহারকারীরা সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ছবিটি প্রযুক্তিগতভাবে নিখুঁত মনে হলেও দর্শকদের কাছে পরিস্থিতির সঙ্গে বেমানান লেগেছিল। তাদের অন্তর্জ্ঞান সঠিক প্রমাণিত হয় — রিভার্স সার্চে দেখা যায় ছবিটি ডিজিটালভাবে বসানো হয়েছিল। একইভাবে কোনো ফুটেজ যদি অস্বাভাবিকভাবে নাটকীয় লাগে অথবা কোনো “আকস্মিক” ঘটনার নিখুঁত ডকুমেন্টেশন যদি হঠাৎ পাওয়া যায় তাহলে অভিজ্ঞ সাংবাদিকরা সহজেই তা বুঝতে পারেন।
মজার তথ্য: দেখা গেছে, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই ধরনের হারিকেন ঝড়ের সময় এমন ভুয়া ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। তবে এর মধ্যে কেবল একটি উদাহরণই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল।
তিরিশ–সেকেন্ডে সত্যতা যাচাই: সংকট মুহূর্তে ধরনগুলো চেনার জন্য আপনার সহজাত সক্ষমতার ওপর ভরসা রাখুন। খেয়াল করুন—অপেশাদার কোনো উৎস যদি হলিউড মানের কনটেন্ট তৈরি করে ফেলে, অথবা অগোছালো কোনো ঘটনার নিখুঁত নথি হঠাৎ পাওয়া যায়—তাহলে তা সন্দেহজনক। আপনার সহজাত বিচার-বুদ্ধি প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণের আগেই অনেক সময় ভুলগুলো ধরে ফেলতে পারে।
১. প্রথম প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা — এটা কি বাস্তব মনে হচ্ছে, নাকি সাজানো? (মানুষের কৃত্রিম উপস্থাপনাকে ঘিরে যে অস্বস্তি হয়, যাকে “আনক্যানি ভ্যালি” বলা হয়, সেই অনুভূতির ওপর ভরসা করুন।)
২. উৎপাদন-খরচ নিয়ে সন্দেহ — অপেশাদার উৎস কি সত্যিই এতটা সিনেমাটিক মানের হতে পারে? (এখন মাত্র ৮ ডলারের খরচেই তৈরি করা যায় পেশাদার মানের রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির ভিডিও।)
৩. সময়ের সুবিধাজনক মিল পরীক্ষা — ঘটনার নিখুঁত নথি কি অস্বাভাবিক দ্রুততার মধ্যে হাজির হচ্ছে, যা সাধারণ রেকর্ডিংয়ের জন্য অস্বাভাবিক?
৪. আবেগ নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা — কনটেন্টটি কি আপনাকে তথ্য দেওয়ার বদলে আবেগকে উস্কে দ্রুত শেয়ার করানোর উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছে?
পাঁচ মিনিটে প্রযুক্তিগত যাচাই (ভালো মানের গল্পের জন্য:
আপনার অন্তর্জ্ঞান থেকে পাওয়া অনুভূতিগুলোকে কাজে লাগিয়ে পদ্ধতিগত যাচাই করুন। যখন মনে হয় কিছু ঠিক নেই, তখন সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করুন যে কোন কোন অংশগুলো বাস্তবের সঙ্গে মিলছে না। এভাবে যুক্তিসঙ্গত বিশ্লেষণ তৈরি করুন।
১. প্রেক্ষাপটের যৌক্তিকতা যাচাই — বাস্তব জ্ঞানের আলোকে পরিস্থিতিটি কতটা অর্থপূর্ণ?
২. উৎসের বিশ্বাসযোগ্যতা অনুসন্ধান —উৎসটি কি কনটেন্টের উৎকর্ষতা ও প্রাপ্তির জন্য উপযুক্ত?
৩. কাহিনীর সুবিধাজনক বিশ্লেষণ — গল্পগুলো কি বর্তমান রাজনৈতিক বা সামাজিক উত্তেজনার সঙ্গে অস্বাভাবিক রকমের নিখুঁতভাবে মিলে যাচ্ছে?
৪. প্রযুক্তিগত অসঙ্গতি নিরীক্ষা — মান, আলো বা অডিও কি দাবি করা পরিস্থিতির সঙ্গে মিলছে?
৫. ধরন লঙ্ঘনের তালিকা — নির্দিষ্ট অংশগুলো নথিভুক্ত করুন যেগুলো সন্দেহজনক মনে হয়েছে বা বাস্তবের সঙ্গে অসামঞ্জস্য।
৬. উৎস-কনটেন্ট অসঙ্গতি মূল্যায়ন — কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই অপেশাদার বা অজ্ঞাত উৎস থেকে আসা অত্যাধুনিক কনটেন্টকে সন্দেহের চোখে দেখুন।
গভীর অনুসন্ধান (উচ্চ–ঝুঁকিপূর্ণ রিপোর্টিং): গুরুত্বপূর্ণ গল্পের জন্য, আপনার অন্তর্জ্ঞান বা ‘গাট ফিলিং’ থেকে যাচাই করুন। আপনার কাছে যে বিষয়গুলো অস্বাভাবিক লাগছে, সেগুলো এবার পদ্ধতিগতভাবে পরীক্ষা করুন। এর মাধ্যমে আপনি সব উপাদান যাচাই করে প্রমাণভিত্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন।
১. অন্তর্দৃষ্টির ফরেনসিক বিশ্লেষণ — যে অংশগুলো অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে, তা লিখে রাখুন এবং দেখুন কেন তা অস্বাভাবিক লাগছে।
২. উৎপাদনের অসঙ্গতি পরীক্ষা — অপেশাদার বলে যা দাবি করা হচ্ছে, সত্যিকার অর্থে তা তৈরি করতে কত সম্পদ লাগতো, তুলনা করুন।
৩. প্রেক্ষাপট ঘিরে সত্যতা যাচাই — গল্পের ঘটনা বাস্তব জীবনের সঙ্গে মেলে কিনা দেখুন, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিন।
৪. আবেগ নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা— কনটেন্ট কি শুধু ভাইরাল হওয়ার জন্য তৈরি, নাকি সত্যি তথ্য দেওয়ার উদ্দেশ্য আছে?
৫. প্রযুক্তিগত অসঙ্গতির গভীর বিশ্লেষণ— ভিডিও বা অডিওর মান, আলো বা শব্দের মিল ঠিক আছে কিনা ফ্রেম-বাই-ফ্রেম দেখুন।
৬. উৎস্যের প্রমাণযোগ্যতা যাচাই — দাবিকৃত উৎসটি আসলেই এই কনটেন্ট তৈরি করতে পারত কিনা তা যাচাই করুন।
৭. গল্প নির্মাণে কৃত্রিমতা শনাক্তকরণ— গল্পটি কি স্বাভাবিকভাবে ঘটেছে, নাকি কৃত্রিমভাবে সাজানো হয়েছে?
৮. গল্পের ধরণ বুঝতে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ নিন—সন্দেহজনক অংশগুলো বুঝতে অভিজ্ঞ অনুসন্ধানীদের মতামত নিন।
৯. বিশ্বাসযোগ্যতার সীমা বিশ্লেষণ: যদি একাধিক অংশ অস্বাভাবিক বা ভুল মনে হয়, তা নথিভুক্ত করুন এবং ব্যাখ্যা দিন কেন তা যাচাই করার পরও বিশ্বাসযোগ্য নয়।
কখন আপনার অন্তর্দৃষ্টির ওপর ভরসা করবেন:
- যদি একাধিক অংশ অস্বাভাবিক মনে হয়, এমনকি আপনি সুনির্দিষ্ট সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে না পারলেও।
• বিশ্লেষণকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে কনটেন্টটি যখন তৎক্ষণাৎ আবেগকে উসকে দেয় ।
• যদি উৎস, সময় বা প্রেক্ষাপট যৌক্তিক প্রশ্ন তোলে।
• যখন কনটেন্টের প্রযুক্তিগত মানের সঙ্গে প্রস্তুতকারকের দক্ষতার অমিল পাওয়া যায়।
• যখন আপনার মস্তিষ্ক দেখে কনটেন্টের মান বা সময়ের মিল অস্বাভাবিক, যেমনটা আপনার পরীক্ষায় উঠে এসেছে। বাস্তবতা: নেই কোনও নির্ভুল সমাধান
শেষকথা: এআই শনাক্তকরণের এই সাতটি ধাপ ও পদ্ধতি— শরীরের গঠনগত ত্রুটি, পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম লঙ্ঘন, প্রযুক্তিগত ছাপ, কণ্ঠস্বরের অস্বাভাবিকতা, বিষয়বস্তুর সম্পর্কিত যৌক্তিকতা, আচরণের ধরণ, এবং অন্তর্জ্ঞান বা ‘গাট ফিলিং’। এগুলো সাংবাদিকদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি হিসেবে কাজ করে, যা স্বল্প সময়ের মধ্যে কনটেন্টের সত্যতা যাচাই করতে সাহায্য করে। পেশাদার শনাক্তকরণ পদ্ধতি এবং আধুনিক সম্পাদকীয় মানদণ্ডের সঙ্গে মিলিয়ে, আমরা আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতে পারি। সমস্যার মোকাবিলা করতে একই ধরনের কৌশল বা শক্তি ব্যবহার—অর্থাৎ মাছের তেলে মাছ ভাজার মতো। এইআই তৈরি কনটেন্ট শনাক্ত করতে এআইকে ব্যবহার করতে হবে এবং আমাদের সম্মিলিত বাস্তবতার যে অবশিষ্ট অংশটুকু এখনো আছে, তাকে সুরক্ষিত করতে সাহায্য করতে হবে।
ডাচ নাগরিক হেঙ্ক ফন এস ডেটার মধ্য থেকে গল্প খুঁজে বের করতে এআই ব্যবহার করছেন। যা তিনি অনুসন্ধানী গবেষণায় প্রয়োগ করেন এবং সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য টুল তৈরি করেন, যেমন সার্চউইসপারার (SearchWhisperer) এবং এআই রিসার্চার (AI Researcher)। বিশ্বের বিভিন্ন বার্তাকক্ষে তিনি প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট, অ্যাক্সেল স্প্রিংগার, বিবিসি এবং ডিপিজি। তিনি ডিজিটাল ডিগিংয়ের পরিচালক, যেখানে ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্সের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এআই। এছাড়াও তিনি পয়েন্টারের ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট-চেকিং নেটওয়ার্ক (আইএফসিএন) এবং ইউরোপিয়ান ফ্যাক্ট-চেকিং স্ট্যান্ডার্ডস নেটওয়ার্ক (ইএফসিএসএন)-এর পর্যালোচক হিসেবে কাজ করছেন।