প্রবেশগম্যতা সেটিংস

রিসোর্স

» গাইড

বিষয়

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা: অর্থের উৎস অনুসরণ

আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:

টাকা-পয়সা কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে—অর্থের এই গতিপথ অনুসরণ কিন্তু মোটেও সহজ কাজ নয়, বরং জটিল। তবে অর্থের বৈশ্বিক প্রবাহ অনুসরণের মাধ্যমে সাংবাদিক হিসেবে আপনি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গোপন সম্পদ ও  জটিল আর্থিক পরিকল্পনা—যেমন অর্থপাচার ও ঘুষ লেনদেনের মতো দুর্নীতিগুলো তুলে ধরতে পারেন। আর এ ধরনের দুর্নীতি ও অপরাধ করে কার কার পকেট ভারি হচ্ছে, খুঁজে বের করতে পারেন তাদেরও।

অনেক তরুণ সাংবাদিক মনে করেন, টাকা-পয়সার গতিপথ অনুসরণ করাটা খুব কঠিন, প্রায় অসম্ভব। আশার কথা, কাজটি মোটেও অসম্ভব নয়। আর বর্তমানে, সাংবাদিকদের জন্য অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি তথ্য পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

কিন্তু অর্থের গতিপথ কেন অনুসরণ করবেন? কারণ এর মাধ্যমে কালো টাকা কোথায় যাচ্ছে এবং কোথা থেকে আসছে তা জানা যায়। আর্থিক জালিয়াতি বা দুর্নীতির অপরাধ কিন্তু ভিকটিমলেস ক্রাইম (যেখানে কোনো ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ থাকে না) নয়। এর মূল্য দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। এর জন্য সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপে বাড়তি করের বোঝা কিংবা তাকে সেবা থেকে বঞ্চিত হতে হয়, কারণ ধনীরা টাকাগুলো লুটে নিয়েছে।

অর্থের গতিপথ তুলে ধরে কীভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদরা অপরাধীদের সঙ্গে হাত মেলান, কীভাবে বিস্তার ঘটে দুর্নীতির। শুধু বিলাসবহুল ভিলা বা ইয়টের মালিকানা নয়, বরং আরও চাঞ্চল্যকর গোপন সত্য সামনে আসে। এর মাধ্যমে উন্মোচিত হয় নেপথ্যে থেকে কারা কলকাঠি নাড়ছে, গোপন চুক্তি করছে। যেসব চুক্তির লক্ষ্য ছিল জনগণের সেবা করা, অথচ তা কীভাবে অপরাধীদের পকেটে যাচ্ছে।

অর্থের গতিপথ অনুসরণ করে সাংবাদিকরা দুর্নীতির মূল উৎসে পৌঁছাতে পারেন, যেমন অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা বা মাদক পাচার। কিন্তু এটি সফলভাবে অনুসরণের উপায়গুলো কী?

এ নিয়ে অনুসন্ধানে নামার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শব্দ জানা এবং অর্থ বুঝে নেয়াটা জরুরী। যেমন এজেন্ট (ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে লেনদেন বা কাজ করে যে), ফরমেশন এজেন্ট (নতুন কোম্পানি বা শেল কোম্পানি তৈরি করে), ইন্টারমিডিয়ারি (মধ্যস্থতাকারী, যাঁরা ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সংযোগ ঘটায়), অফিসার (কোম্পানির নামমাত্র কর্মকর্তা, যাদের নামে কোম্পানির কাগজপত্র করা হয়), বেনেফিশিয়াল ওনার (যাঁরা প্রকৃতপক্ষে কোম্পানি বা সম্পদের মালিক), ইউবিও (কোম্পানি বা সম্পদের প্রকৃত মালিক) এবং নমিনি (কথিত মালিক, কাগজপত্রে যাদের নাম দেয়া হয়, কিন্তু এরা প্রকৃত মালিক নন)।

প্রক্সি বা প্রতিনিধিদের অনেক সময় বৈধ কাজেও ব্যবহার করা হয়। তবে প্রক্সি ব্যক্তি বা কোম্পানির নাম ব্যবহার করে মূলত প্রকৃত মালিকদের পরিচয় গোপন রাখা হয়—আর এটাই আমাদের আগ্রহের বিষয়। প্রক্সি হিসেবে থাকা ব্যক্তিরা অনেক সময় জানেনই না যে তাদের পরিচয় ব্যবহার করা হচ্ছে। যা এক ধরনের পরিচয় চুরি। তবে বর্তমানে যোগ হয়েছে নতুনত্ব—অনেকেই স্বেচ্ছায় নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে প্রক্সি হিসেবে কাজ করছেন।

আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে কাজে নামার আগে আপনাকে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি সম্পর্কেও জানতে হবে। এটিও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। এর মানে, কোনো কোম্পানির পক্ষ থেকে আইনজীবী বা আইনি সংস্থার আনুষ্ঠানিক প্রতিনিধিত্ব করা। এরা অর্থ ও সম্পদ লুকানোর কাজে সহায়তা করতে পারে।

প্রথম ধাপ: আপনি যে ব্যক্তিকে নিয়ে অনুসন্ধান করছেন তাঁর একটি প্রোফাইল তৈরি করুন

অর্থের গতিপথ অনুসরণ করছেন মানে আপনি মূলত বিভিন্ন লোকের নাম খুঁজছেন। তাই আপনি আপনার অনুসন্ধানে যত বেশি নাম খুঁজে পাবেন, আপনার তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনাও ততই বেড়ে যাবে। বড় বড় কর্মকর্তারা খুব কম সময়ই নিজের নামে কোম্পানি রাখেন।

অপরাধী চক্রের সদস্যরা সাধারণত আইনজীবীদের আড়ালে লুকিয়ে থাকেন। আর দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী নির্বাহীরা প্রায়ই তাদের পরিচয় গোপন রাখতে প্রক্সি ভাড়া করেন।

অনুসন্ধানের শুরুতে যত বেশি পারেন ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিয়ে প্রকাশিত খবর সংগ্রহ করুন। আর পড়ুন। তবে সব খবরকেই চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করবেন না। যে দেশের মানুষটি নিয়ে আপনি কাজ করছেন, সেখানকার মিডিয়া আর্কাইভ দেখুন। কারণ অনেক সময় ওয়েবসাইট থেকে লেখা হারিয়ে যায়,বা সংবাদ সংস্থা বন্ধ হয়ে যায়। কিংবা ইন্টারনেট যুগ শুরুর আগের গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য হয়তো আপনার কাজে লাগতে পারে। যে ব্যক্তিকে নিয়ে আপনি অনুসন্ধানে নেমেছেন, তাঁকে নিয়ে প্রকাশিত সব লেখা পড়ুন। প্রতিটি নাম ও তথ্য লিখে রাখুন—হতে পারে কোম্পানি, কোনো সহযোগী ব্যক্তি, প্রক্সি, আইনজীবী, পরিবার, বন্ধু, শত্রু, জন্ম তারিখ, এমনকি বাড়ির ঠিকানা বা কাজের লোক বা আয়া। তবে সাংবাদিকদের কখনোই ধরে নেওয়া উচিত নয় যে অন্য মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যগুলো সম্পূর্ণ প্রমাণিত। মনে রাখবেন, এ কাজটি কিন্তু আপনার নিজেরই করতে হবে।

এ পর্যায়ে একটি স্প্রেডশিট তৈরি করুন। যেখানে আপনি নতুন যে সব তথ্য খুঁজে পাবেন তা লিখে রাখবেন। আপনি যখন অনলাইন ও অফলাইন রেজিস্টারে অনুসন্ধান চালাবেন, তখন এই ডেটাবেজটিকে প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করুন। নতুন নাম খুঁজে পাওয়ার সাথে সাথেই এখানে লিখে রাখুন। অনুসন্ধানের জন্য ডাকডাকগো (DuckDuckGo) এর মতো সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করাটা ভালো। কারণ আপনি কী তথ্য অনুসন্ধান করছেন, গুগল বা অন্যান্য জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিনের মতো এটি তা  ট্র্যাক বা সংরক্ষণ করে না। তাই আপনার সার্চ ইতিহাস গোপন থাকে।

ধাপ : সবগুলো অনলাইন ডেটাবেজ দেখুন

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে অর্থের উৎসগুলো অনুসরণ প্রসঙ্গে যদি বলা হয়, তাহলে আমরা রীতিমতো স্বর্ণযুগে বসবাস করছি। এর আগে কখনই ভৌগলিক সীমানা পেরিয়ে আর্থিক লেনদেন অনুসরণের এতোটা সুযোগ ছিল না। বৈশ্বিকভাবে কখনই এতো এতো সমৃদ্ধ ডেটাবেজ আমাদের ছিল না। বর্তমানে কেবল সুনির্দিষ্ট দেশভিত্তিক নিবন্ধন তালিকা নয়,  বৈশ্বিকভাবে সংকলিত ডেটাবেজ এবং ফাঁস হওয়া হাজারো নথি সাংবাদিকদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। তাই আমরা সবসময় চেষ্টা করি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যত বেশি সম্ভব তথ্য সংগ্রহের।

অনলাইন ও অফলাইন পাবলিক রেজিস্ট্রি যেমন কোম্পানির রেকর্ড, ভূমির মালিকানার দলিল, আদালতের নথি, লবির তালিকা ইত্যাদি থেকে আপনি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে পারেন। অনুসন্ধানের শুরুতে প্রথমে ওই দেশের কোম্পানি ও করপোরেট রেজিস্ট্রি, এরপর ওপেনকর্পোরেটস, কোম্পানিজ হাউজ, ওপেন ওনারশিপ রেজিস্টার ইত্যাদি দেখতে হবে।স্থানীয় ভূমি নিবন্ধন এবং আবাসন রেকর্ডও গুরুত্বপূর্ণ। আর ঠিকানাগুলো কিন্তু আমরা সবসময় গুগল ম্যাপে যাচাই করে দেখি। এভাবে আপনি সেখানকার অন্যান্য কোম্পানি ও আশেপাশের প্রতিষ্ঠানের তথ্য পেতে পারেন।

অনলাইন ডেটাবেজ যেমন সায়ারি, লেক্সিসনেক্সিস ও অরবিস আপনাকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে সক্ষম।যদিও এগুলো বেশ ব্যয়বহুল। তবে বার্তাকক্ষের জন্য অনেক সময় ছাড় পাওয়া যায়। আবার কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়, লাইব্রেরি বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কাছে এসব ডেটাবেজে প্রবেশের অনুমতি থাকে। সাংবাদিক হিসেবে আপনি তা ব্যবহার করতে পারেন।

আমরা কিন্তু কখনও অন্য দেশের ডেটাবেজগুলোতে অনুসন্ধান চালাতে ভুলি না।অনেক সময় কোনো প্রতিষ্ঠান অন্য দেশে “সিস্টার” বা “মাদার” কোম্পানি হিসেবে থাকতে পারে। স্থানীয় রেজিস্ট্রিতে শেয়ারহোল্ডার বা সুবিধাভোগী মালিক (বেনিফিশিয়াল ওনার) হিসেবে এসব কোম্পানির নামও পাওয়া যেতে পারে। এছাড়া, অন্য দেশ বা অফশোর অঞ্চলে একই বা অনুরূপ নামেও কোম্পানিগুলো নিবন্ধিত হতে পারে।

তাই অফশোর জগতের গুরুত্বপূর্ণ টার্মগুলো শেখা জরুরী। অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি তাদের সম্পদ লুকানোর জন্য এজেন্ট, মধ্যস্থতাকারী, নোমিনি এবং আইনজীবী ব্যবহার করেন। আইসিআইজে (আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস) অফশোর দুনিয়ার প্রচলিত টার্মগুলোর একটি তালিকা করেছে। সঙ্গে ছোট করে ব্যাখ্যাও জুড়ে দেয়া আছে।

অফশোর কোম্পানিতে অর্থ পাঠানোর বিপরীতে বেশকিছু সুবিধাজনক শর্ত থাকে। যেমন কর ফাঁকি, শিথিল নিয়ম-নীতি বা সম্পদ সুরক্ষা—এভাবে অপরাধীরা তাদের সম্পদকে সুরক্ষিত রাখে। অন্য উপায়ও রয়েছে। যেমন শিল্পকর্ম বা প্রাচীন জিনিস অতিরিক্ত দাম দিয়ে কেনা, যা অবৈধভাবে আয় করা অর্থের উৎস লুকানোর উদ্দেশ্যে করা হয়। অনেকে আবার ট্রাস্ট কোম্পানি খোলেন। যা যুক্তরাষ্ট্র ও অফশোর অঞ্চলগুলোতে বৈধ। কেউ আবার সম্পত্তি কেনেন। এর উদ্দেশ্যও একই—অবৈধ সম্পদ লুকানো এবং সেগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

রাজনীতিবিদ, ওলিগার্ক এবং অপরাধীরা প্রায়ই কোম্পানি, সম্পদ, বিলাসবহুল গাড়ি, ইয়ট বা জেট মালিক হিসেবে নিজেদের নাম ব্যবহার করেন না। এগুলো অন্য কোম্পানি বা ব্যক্তির নামে নিবন্ধিত থাকে। এ ধরনের জটিল মালিকানা কাঠামো বিশ্লেষণ করা কঠিন হলেও, আইসিআইজে এবং ওসিসিআরপির মতো সংস্থাগুলো সাংবাদিকদের অতিরিক্ত সহায়তা দিয়ে থাকে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে আপনি সাংবাদিক হিসেবে ব্যক্তি বা কোম্পানি সম্পর্কে অতিরিক্ত তথ্য চেয়ে অনুরোধ পাঠাতে পারেন। উভয় প্রতিষ্ঠানের কাছে সাংবাদিকদের ব্যবহারের উপযোগী অনলাইন ডেটাবেজও রয়েছে।

যেমন অফসোর লিকস ডেটাবেজে প্রায় ৮১০,০০০ অফশোর কোম্পানি, ফাউন্ডেশন এবং ট্রাস্টের তথ্য রয়েছে, যা প্যান্ডোরা পেপার্স, প্যারাডাইস পেপার্স, বাহামাস লিকস, পানামা পেপার্স এবং অফশোর লিকস অনুসন্ধান থেকে সংগৃহীত। আর আলেফ এমন একটি ডেটা প্ল্যাটফর্ম—যেটি অতীত ও বর্তমানের ঐতিহাসিক ডেটাবেজ, নথি, লিকস এবং অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের বিশাল আর্কাইভ একত্রিত করে।

পানামা পেপার্স প্রকাশিত হওয়ার প্রায় এক দশক পর এখনও ডেটাবেজ থেকে নতুন নতুন কাহিনী বেরিয়ে আসছে। এই ধরনের ডেটাবেজগুলোতে চোখ বুলাতে থাকুন। কারণ সব গল্প এখনও রিপোর্ট করা হয়নি।

ইউজার অ্যাকাউন্ট তৈরি করে কিংবা বেনামেও আপনি আলেফ ব্যবহার করতে পারেন। যদি আপনি একজন পেশাদার সাংবাদিক হন, তবে ওসিসিআরপি বন্ধু তালিকাভুক্ত হতে আবেদন করতে পারেন। যা আপনাকে আলেফের ডেটা ও নথি ব্যবহারের দারুণ সুযোগ এনে দিবে।

তথ্য অধিকার আইনে ফোয়া অনুরোধ পাঠানোর কথা ভুলবেন না। ১০০টিরও বেশি দেশ থেকে আপনি ফোয়ার মাধ্যমে তথ্য চাইতে পারেন। যা ব্যবহার করে, সাংবাদিকরা সরকারী ব্যয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন, সরকারের বাজেট খরচ এবং আরও অনেক তথ্য পেতে পারেন।

সামাজিক মাধ্যম থেকেও আর্থিক গোপনীয়তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাবেন। বিশেষ করে সম্পর্কটি যখন হয় স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুত্বের। এরা ব্যবসার সুবিধাভোগী (বেনিফিশিয়ারি ওনার) হতে পারেন এবং রাজনীতিবিদ ও অপরাধীদের পরিচয় গোপন রাখতে সহযোগীতা করতে পারেন।

অনলাইনের যুগে মানব সোর্সের পাশাপাশি অফলাইন ডেটাবেজও অতিরিক্ত তথ্য দিতে পারে। অফলাইন ডেটাবেজতার, যেমন আর্কাইভ, জমির রেকর্ড এবং লাইব্রেরি রেকর্ড অত্যন্ত কার্যকরী। অনেক দেশে অনলাইন সংস্করণ থাকার পরও আপনি যদি সশরীরে গিয়ে তথ্য অনুসন্ধান করেন, সেক্ষেত্রে অনেক বেশি তথ্য পাবেন।

মনে রাখবেন, আপনি যে ব্যক্তিকে নিয়ে অনুসন্ধানে নেমেছেন, তিনি যেখানে বসবাস বা কাজ করেন না কেন, তাঁর বাইরেও অন্যান্য দেশের পাবলিক রেকর্ড চেক করা গুরুত্বপূর্ণ। ওসিসিআরপির আইডি (OCCRP’s ID) ব্যবহার করুন, এখানে ১৮০টিরও বেশি দেশের রেজিস্ট্রির বৈশ্বিক সূচক এক জায়গায় পাবেন।

ধাপ : তথ্য  ডেটা বিশ্লেষণ

তথ্য ও ডেটা সংগ্রহের পর তা বিশ্লেষণ এবং অন্যান্য বিষয়গুলো যুক্ত করে সুপাঠ্য অনুসন্ধানী প্রতিবেদন  বানাতে হয়। এ কাজটি সাংবাদিকরা একা করেন না। তাদের সহযোগিতা করেন ডেটা বিশেষজ্ঞ, ডেভেলপার এবং প্রযুক্তি কর্মীরা। এরা অর্থের গতিপথ বুঝতে সহযোগিতা করেন।

কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করা জরুরি। প্রথমে কঠিন মনে হলেও, সঠিক প্রশ্ন করলে অনেক তথ্য বের হয়ে আসে। যেমন, কোম্পানির সম্পদ কী? তাদের অর্থ কোথা থেকে এসেছে? বড় কোনো দেনা রয়েছে কিনা? থাকলে কার কাছে?  যেমন, একটি কোম্পানি এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়েছিল। পরে জানা যায় তা রাষ্ট্রপতির জামাইয়ের সাথে সম্পর্কিত।

বড় আর্থিক পাওনাদারদের দিকে নজর দিন। অর্থাৎ, কোম্পানি পণ্য বা সেবা বিক্রি করেছে, কিন্তু অর্থ সংগ্রহ করেনি। এটি হয়তো দুর্বল ব্যবস্থাপনা হতে পারে। আবার হতে পারে অর্থ লুকানোর কৌশলও।

সম্পদ লুকানোর আরেকটি পদ্ধতি শেল কোম্পানিতে অর্থ পাঠানো। এসব কোম্পানির কোনো প্রকৃত ব্যবসা বা সম্পদ নেই। মূল কোম্পানি শেল কোম্পানিতে অর্থ পাঠায়, এরপর সেই অর্থকে ঋণ হিসেবে ফেরত নিয়ে কর ফাঁকি দেয়। শেল কোম্পানিকে এই অর্থ আর ফেরত দেওয়া হয় না।

ধাপ : সবসময় স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কাজ করুন

অর্থ কোনো সীমানা মেনে চলে না। আর লেনদেন পৃথিবীর যেকোনো জায়গাতে হতে পারে। তাই অন্যান্য দেশের সাংবাদিকদের সাথে কাজ করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা আপনাকে তাদের দেশের অতিরিক্ত তথ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করতে পারেন। স্থানীয় সাংবাদিকরা তাদের নিজ দেশের তথ্য অনুসন্ধানে দক্ষ এবং গভীর ধারণা রাখেন। তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণ যোগ করতে পারেন, যা গল্পটিকে আরও সমৃদ্ধ করে।

যদি নির্দিষ্ট কোনো দেশের সাংবাদিকদের সাথে আপনার পরিচয় না থাকেন, তবে ওসিসিআরপি, জিআইজেএন এবং আইসিআইজের অংশীদার তালিকা থেকে পেশাদার সাংবাদিক এবং তাদের সংবাদমাধ্যম খুঁজে নিতে পারেন। স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কাজ করলে সময়ও বাঁচে। তাঁরা হয়তো মাত্র কয়েক মিনিটেই প্রয়োজনীয় ডেটাবেজ খুঁজে পেতে সফল হতে পারেন। সাহায্যের জন্য যোগাযোগ করুন। মানুষ কিন্তু অধিকাংশ সময়ই সাহায্য করতে আগ্রহী থাকে।

ধাপ : অতিরিক্ত ডেটাবেজ

অর্থের উৎস অনুসন্ধানের চমৎকার উৎস হতে পারে আদালতের নথিপত্র। কারণ, ব্যবসায়িক বিরোধগুলোর নিষ্পত্তি এমনি এমনি হয় না। শুধুমাত্র নিজের দেশের মধ্যেই নয়, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো পরিচিত বিচারব্যবস্থার দিকেও নজর দিন। পেসার একটি অনলাইন ডেটাবেজ। যেখানে আদালতের মামলার পাবলিক রেকর্ড যেমন হলফনামা, প্রমাণাদি এবং আদালতে উপস্থাপিত অন্যান্য নথি পাওয়া যায়।যুক্তরাজ্যের আদালতের রেকর্ড তুলনামূলকভাবে সীমিত। তবে বেইলি (ব্রিটিশ এবং আইরিশ আইন সংক্রান্ত তথ্য ইনস্টিটিউট) সহজে অনুসন্ধানযোগ্য একটি ডেটাবেজ সরবরাহ করে। যেখানে যুক্তরাজ্যের আদালতের রায়গুলো পাওয়া যায়।

যদি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে চান বা সম্পদের উৎস খুঁজতে চান, তাহলে বাণিজ্য তথ্য বেশ কার্যকর হতে পারে। আমদানি ও রপ্তানি সম্পর্কে জানতে ইমপোর্টজিনিয়াস এবং ইউএনকমট্রেড ডেটাবেজগুলো পরীক্ষা করতে পারেন। নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আপনি কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানিকে পেয়েছেন—যা নিয়ে দারুণ একটি প্রতিবেদন হতে পারে এ কারণে আমরা এই ডেটাবেজগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করার সুপারিশ করি। যেমন, ওএফএসি এবং ওপেন স্যাঙ্কশনস।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস অফশোর অ্যালাটর্স। এই সংস্থাটি সন্দেহজনক বা বিপদজনক পরিস্থিতি চিহ্নিত করতে সহায়ক। এটি অফশোর এবং অনশোর আদালত, নিয়ন্ত্রক পদক্ষেপ, উপকরণ এবং অন্যান্য উৎস পর্যবেক্ষণ করে। এরপর, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে এবং এর সারসংক্ষেপ ইমেইলের মাধ্যমে পাঠায়।

ধাপ : প্রচলিত পথে না গিয়ে খানিকটা ভিন্নভাবে ভাবুন

প্যান্ডোরা পেপারস অনুসন্ধান ছিল দারুণ একটি যৌথ সহযোগিতামূলক কাজ। যা একটি অবৈধ আর্থিক ব্যবস্থা ঘিরে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছিল। এমন একটি ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলা হয়েছে, যার মাধ্যমে কেবল ধনীরাই সুবিধা পেত। এই প্রকল্পে সাংবাদিকদের কাজ করতে হয়েছিল সৃজনশীলতার সাথে।

প্যান্ডোরা পেপারস অনুসন্ধানে ১,৬০০ এরও বেশি শিল্পকর্মের কথা সামনে আসে। যেগুলো গোপনে ট্যাক্স হেভেনের (করস্বর্গ) মাধ্যমে লেনদেন করা হয়েছিল। শিল্পকর্ম সাধারণত টাকা লুকানো এবং তা বৈধ পথে প্রবাহিত করার কাজে ব্যবহার করা হয়। আইসিআইজে, ফিন্যান্স আনকভারড এবং ওয়ার্শিংটন পোস্ট মিউজিয়ামগুলোর এশিয়া সংগ্রহ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর মধ্যে ছিল ক্যাম্বোডিয়ান পুরাকীর্তি, যা সুপরিচিত এক শিল্প সংগ্রাহকের কাছে পৌঁছেছিল। প্রতিবেদকরা বই, মিউজিয়ামের ওয়েবসাইট, গ্যালারি ক্যাটালগ, আর্ট ব্লগ, এবং বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে শতাধিক খমের (Khmer) শিল্পকর্ম শনাক্ত করেছিলেন, যা ওই সংগ্রাহকের মালিকানাধীন ছিল বা তাঁর মাধ্যমে কেনাবেচা করা হয়েছিল। সাংবাদিকরা এসব শিল্পকর্মের আকার এবং অন্যান্য বিবরণ পরীক্ষা করছিলেন যাতে তাঁরা নিশ্চিত হতে পারেন শিল্পকর্মগুলো আসল কিনা।

অর্থের গতিপথ অনুসরণ করতে পারাটা দারুণ একটি দক্ষতার বিষয়। এর মাধ্যমে যে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো উঠে আসে, সেগুলো বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। কখনও কখনও অর্থ পাচার প্রতিরোধে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। কখনও আবার এ ধরনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে রাজনীতিবিদদের গোপন সম্পদের তথ্য উন্মোচিত হওয়ায় ফলে তাঁরা পদ হারান। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— এ ধরনের প্রতিবেদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে জনস্বার্থ রক্ষা—ওইসব জায়গাগুলোতে আলো ফেলা, যেগুলো আগে কেউ অনুসন্ধান করেনি।


মিরান্ডা প্যাট্রুসিচ ওসিসিআরপির সঙ্গে যুক্ত হন ২০০৬ সালে। এরপর ২০২৩ সালে প্রধান সম্পাদক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি বর্তমানে ছয়টি মহাদেশের পঞ্চাশের বেশি সম্পাদক নিয়ে গঠিত ওসিসিআরপির বৈশ্বিক সংবাদকক্ষের সম্পাদনার কাজের পাশাপাশি ওসিসিআরপির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এবং কনটেন্ট প্রস্তুতের কাজগুলো তদারকি করেন।প্যাট্রুসিক ওসিসিআরপির প্রথমদিকের কর্মীদের একজন। সারায়েভোতে প্রতিষ্ঠানের প্রথম ফ্যাক্ট-চেকার হিসেবে কাজ শুরুর পর গবেষক, প্রতিবেদক, প্রশিক্ষক এবং সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলকান অঞ্চলের কাজ তদারকি করতেন। ২০১৫ সালে অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও তাঁর বন্ধু খদিজা ইসমাইলোভাকে আজারবাইজানে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সেই ঘটনার পর আজারবাইজানের কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনের জন্য তিনি বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন।

জেলেনা কোসিক আইসিআইজের ট্রেনিং ম্যানেজার, পূর্ব ইউরোপীয় পার্টনারশিপ সমন্বয়ক এবং ডেটা রিপোর্টার। গত পাঁচ বছর ধরে তিনি আইসিআইজের বৈশ্বিক প্রকল্প— যেমন প্যান্ডোরা পেপার্স, সাইপ্রাস কনফিডেনশিয়াল, ফিনসেন ফাইলস, ডিফরেস্টেশন ইনক ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেছেন। জেলেনা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ২ হাজারেরও বেশি অনুসন্ধানী সাংবাদিককে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ওপর বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে এক্সিলেন্স সার্টিফিকেট, গ্লোবাল শাইনিং লাইট অ্যাওয়ার্ড এবং পশ্চিম বালকান ও তুরস্কের ইইউ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার। এছাড়া আইসিআইজের সাথে কাজ করার সময় বেশ কয়েকটি পুরস্কারসহ টম রেনার অ্যাওয়ার্ড, পুলিৎজার পুরস্কারের চূড়ান্ত তালিকায় স্থান করে নেন। পাশাপাশি নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন লাভ করেন।

 

 

ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে আমাদের লেখা বিনামূল্যে অনলাইন বা প্রিন্টে প্রকাশযোগ্য

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

BBC Africa Eye undercover investigation codeine cough syrup black market

পদ্ধতি পরামর্শ ও টুল

আন্ডারকভার রিপোর্টিং? আফ্রিকার অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু পরামর্শ

আন্ডারকভার রিপোর্টিং কৌশলগুলো কীভাবে কাজে লাগাবেন তা আরও ভালভাবে তুলে ধরার জন্য জিআইজেএন কথা বলেছে আফ্রিকার অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সঙ্গে। আন্ডারকভার রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে এই সাংবাদিকেরা যুগান্তকারী সব প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।

Aerial image of luxury villas in France

পদ্ধতি পরামর্শ ও টুল

ফ্রান্সসহ নানা দেশে জমি ও বাড়ি বেচাকেনা যেভাবে অনুসন্ধান করবেন

নিজ দেশে দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ পাচার করে অনেকেই জমি বা স্থাবর সম্পত্তি কেনেন ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। অনেক ক্ষেত্রেই এসব অর্থের উৎস ব্যাখ্যা করা যায় না। এবং সেগুলো হতে পারে বড় ধরনের দুর্নীতির ইঙ্গিত। এই লেখায় ধাপে ধাপে বর্ণনা করা হয়েছে বিদেশে এমন জমি ও বাড়ি কেনাবেচা নিয়ে অনুসন্ধানের কৌশল।

কেস স্টাডি পদ্ধতি সংবাদ ও বিশ্লেষণ

প্রশ্নোত্তর: ওসিসিআরপির চেক প্রতিবেদক পাভলা হলকোভা 

সংঘবদ্ধ অপরাধ, সরকারী দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান করার কারণে প্রায়ই হুমকির মুখে পড়েন চেক রিপাবলিকের অনুসন্ধানী সাংবাদিক পাভলা হলকোভা। তা সত্ত্বেও তিনি চালিয়ে গেছেন এসব অনুসন্ধান। এবং জিতেছেন অসংখ্য পুরস্কার। এই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন তাঁর অনুপ্রেরণা, চ্যালেঞ্জ, ও শিক্ষার কথা। পাশাপাশি নতুন অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্যও দিয়েছেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ।

অনুসন্ধান পদ্ধতি

যুক্তরাজ্যের সংসদ সদস্যদের সাথে নিয়ে টিবিআইজে যেভাবে ‘সাইলেন্সড স্টোরিজ’ উন্মোচন করেছে 

আমাদের চারপাশে দুর্নীতিসহ নানা কেলেঙ্কারির খবর চাপা পড়ে যায়। আসলে এসব খবর ধামাচাপা দিতে সংবাদমাধ্যমগুলোকে চাপ দেয় অভিযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো। টিবিআইজে কীভাবে সাংসদদের সঙ্গে জোটে বেঁধে চুপ করিয়ে দেওয়া প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করেছিল পড়ুন এই প্রতিবেদনে।