Aftermath of a missile strike on an apartment building in Kyiv. Image: Flickr
যুদ্ধাপরাধ অনুসন্ধানের ১৫টি পরামর্শ
গাইড রিসোর্স
রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে অনুসন্ধান
অধ্যায় গাইড রিসোর্স
শরণার্থী ইস্যু নিয়ে অনুসন্ধানের ৯ উত্তম চর্চা
অধ্যায় গাইড রিসোর্স
রাশিয়া নিয়ে অনুসন্ধান: জিআইজেএনের তাৎক্ষণিক টুলকিট
অধ্যায় গাইড রিসোর্স
যুদ্ধাপরাধ অনুসন্ধানের ১৫টি পরামর্শ
অধ্যায় গাইড রিসোর্স
ইউক্রেনের ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণে সাহায্য করবে যেসব রিসোর্স
অধ্যায় গাইড রিসোর্স
ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের নেপথ্যে থাকা মিথ্যা প্রচারণার গভীরে
সম্পাদকের নোট: আর্ন্তজাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর গত সপ্তাহে ঘোষণা করেছেন, তাঁর দপ্তর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ নিয়ে তদন্ত করার “যৌক্তিক কারণ” খুঁজে পেয়েছে।
এক সময় চলমান সংঘাত নিয়ে কোনো অনিয়মের অভিযোগ জানানো বেশ দুঃসাহসী ও প্রাণঘাতী হুমকির কারণ হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে ওপেন-সোর্স রিপোর্টিং কৌশলের কল্যাণে কাজটি এখন বেশ সহজ হয়ে গেছে। মোবাইল ফোনের উন্নত ক্যামেরার বদৌলতে যোদ্ধারা নিজেরাই এখন হাই-রেজোল্যুশন ডিজিটাল ছবি ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যম বা অন্যান্য সাইটে আপলোড করতে পারছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চমানসম্পন্ন স্যাটেলাইট ছবি ও ডিজিটাল টুলের সহজলভ্যতা, যার ফলে সহজেই অনলাইনে আপলোড করা বিপুল তথ্যভাণ্ডার আপনার হাতের নাগালে চলে আসে। এতে করে, যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটলে তা আরও বেশি অনুসন্ধানের সুযোগ পান রিপোর্টাররা।
সিরিয়ার যুদ্ধ ছিল এর প্রথম পরীক্ষা – এটি সেই সময়ে মানব ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যাপকভাবে নথিবদ্ধ যুদ্ধ ছিল এবং যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই তা অনলাইনে রিয়েল টাইমে ট্র্যাক করা হচ্ছিল। এখন ইউক্রেনে ঠিক একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তাই জিআইজেএন আমাকে ওপেন সোর্স টুল ও কৌশল ব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধ অনুসন্ধানের এই গাইড তৈরির দায়িত্ব দিয়েছে।
আমি একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা। সহিংসতা ও যুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন উন্মোচনে মাঠপর্যায়ের কাজের সঙ্গে ওপেন সোর্স কৌশলের সমন্বিত ব্যবহার নিয়ে আমার বিশেষায়িত জ্ঞান আছে। গত চার বছরে আমি বিবিসির জন্য অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান করেছি, যা লিবিয়া ও সিরিয়ায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ প্রকাশ্যে এনেছে। ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স কীভাবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ বদলে দিচ্ছে – এই বিষয়ে আমি পিএইচডি করেছি।
এখানে রইল যুদ্ধাপরাধ অনুসন্ধানের ১৫টি পরামর্শ:
১. যুদ্ধাপরাধের ধরনগুলোর সঙ্গে পরিচিত হোন
যুদ্ধাপরাধের প্রাথমিক সংজ্ঞা হলো, যুদ্ধে জড়ানোর নিয়মনীতি লঙঘন। এগুলো সাধারণত যুদ্ধের সময় সংঘটিত সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ। এমন ঘটনা বিচারের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার কোনও বিধি নেই, যার অর্থ, অপরাধের ঐতিহাসিক প্রকৃতি নির্বিশেষে দোষী ব্যক্তিদের বিচার করা যেতে পারে।
জেনেভা কনভেনশন যুদ্ধাপরাধের নতুন নতুন ধরনকে সংজ্ঞায়িত করেছে, বিচারের জন্য সার্বজনীন এখতিয়ার প্রতিষ্ঠা করেছে এবং এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের একটি বড় অংশ অন্তর্ভুক্ত করেছে। ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ দ্য রেড ক্রস (আইসিআরসি), আন্তর্জাতিক মানবিক আইন বা সশস্ত্র সংঘাতের আইনকে “একটি নিয়মের সেট” বলে সংজ্ঞায়িত করে “যা মানবিক কারণে সশস্ত্র সংঘাতের প্রভাবকে সীমিত করতে চায়”। এটি এমন ব্যক্তিদের রক্ষা করে যারা যুদ্ধের অংশ নন বা অংশগ্রহণ করছেন না; এবং এটি যুদ্ধের উপায় ও পদ্ধতিকে সীমিত করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠিত হয় যে চুক্তির বলে, সেই রোম সংবিধির ৭ এবং ৮ অনুচ্ছেদে, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের একটি বিশদ তালিকা রয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের চারটি ধরন হলো: গণহত্যা, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধের রীতিনীতি লঙ্ঘন এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে নথিবদ্ধ করা যেতে পারে এমন মূল বিষয়গুলো হল: বেসামরিক ব্যক্তি এবং সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না-হওয়া বেসামরিক-অবকাঠামোর ওপর হামলা; হাসপাতাল ও স্কুলের মতো সুরক্ষিত প্রতিষ্ঠানে হামলা; প্রথম সাড়াপ্রদানকারী কর্মীদের লক্ষ্য করে “ডাবল ট্যাপের” মতো নির্দিষ্ট ধরনের হামলা; ক্লাস্টার গোলার মতো নির্দিষ্ট নিষিদ্ধ অস্ত্র ব্যবহার; প্রতিপক্ষের যোদ্ধাদের মৃতদেহের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা ও আত্মসমর্পণের পরও ক্ষমা প্রদর্শন না করা; বেসামরিক মানুষের মৃতদেহকে অসম্মান করা; যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতা, লুণ্ঠন; নির্যাতন, যুদ্ধে শিশুদের ব্যবহার; এবং রাসায়নিক বা জৈব অস্ত্রের ব্যবহার। কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যের ওপর, এই ধরনের আক্রমণ যুদ্ধাপরাধ বলে বিবেচিত হতে পারে কিনা, তা মূল্যায়ন করতে আনুপাতিকতার নীতি ব্যবহার করা হয়।
২. উৎস জানুন
সামাজিক মাধ্যম হলো ছবির – বিশেষ করে সৈনিক এবং ফ্রন্টলাইন কর্মীদের আপলোড করা ভিডিও এবং স্থিরছবির – একটি সমৃদ্ধ উৎস, যা সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ফেসবুক গ্রুপ, টেলিগ্রাম, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক হলো সন্দেহের সাধারণ ক্ষেত্র, তবে দেশভিত্তিক সামাজিক মাধ্যম আরও ভালো। যেমন, রাশিয়ায় ভিকে (আগে যেটার নাম ছিল ভিকন্টাক্টে) নামের সামাজিক মাধ্যমে রুশ যোদ্ধাদের প্রোফাইল থেকে প্রচুর তথ্য মেলে। সাধারণত যোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের অনলাইন গ্রুপ বা নির্দিষ্ট মিলিশিয়া গোষ্ঠীর অনুসারীদের টেলিগ্রাম চ্যানেল থাকে, যা তথ্যের উৎস হিসেবে বেশ কাজের। আরও একটি উপায় হলো একই ব্যবহারকারীর একাধিক সামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্ট খুঁজে বের করা। কারণ এসব অ্যাকাউন্টের গোপনীয়তা সেটিংস অতটা কঠোর নাও হতে পারে। অধিকাংশ সময় যোদ্ধারা বুঝতেই পারেন না যে, তারা যুদ্ধাপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন অথবা এর পরিণতি নিয়ে তারা মাথা ঘামান না। তাই তারা এগুলো লুকোনোর ব্যাপারেও সতর্ক হন না।
বিবিসির হয়ে লিবিয়ার সংঘাত অনুসন্ধানে, আমি অপরাধীদের পাবলিক ফেসবুক প্রোফাইল এবং টুইটারে সংক্ষিপ্ত মৃত্যুদণ্ডের ভিডিওগুলোর মাধ্যমে উন্মোচন করেছি যে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির স্পেশাল ফোর্স ব্রিগেডের সদস্যরা বন্দী যোদ্ধা এবং বেসামরিক ব্যক্তিদের মৃতদেহ বিকৃত করেছে। তারা প্রমাণগুলোকে প্রোপাগান্ডা হিসেবে আপলোড করছিল এবং অনলাইনে তাদের সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতা উস্কে দিতে এটি ব্যবহার করছিল।
৩. যাচাই
অধিকাংশ সময় এই ভিডিওগুলো পাবেন বিচ্ছিন্ন উৎস থেকে, কারো ব্যক্তিগত সামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্ট থেকে নয়। ভিডিওতে যা দাবি করা হচ্ছে, ঠিক তাই দেখাচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার প্রথম ধাপ হলো ভিডিও মেটাডেটা টুল দিয়ে যাচাই করে নেওয়া। এরকম বেশ কিছু টুল আছে, যা আপনাকে সহায়তা করবে: ইনভিড, গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ, টিনআই, রেভআই, ইয়ানডেক্স, বাইদু, গুগল লেন্স, এক্সিফটুল, রেডফিন, অ্যামনেস্টি ভিডিও ভেরিফিকেশন, ও ট্রুলিমিডিয়া।
ভিডিওর সত্যতা একবার নিশ্চিত হলে পরবর্তী ধাপ হবে, সহায়ক প্রমাণ খুঁজে বের করা। অনলাইনে ভিডিওটির আরও মানসম্পন্ন কপি পেলে তাও ডাউনলোড করে রাখা উচিত, যেন সেখান থেকে সহজে চেহারা সনাক্ত করা যায়। এছাড়া একই ঘটনার বিভিন্ন দিক থেকে ধারণকৃত ভিডিও পাওয়া গেলে, সেগুলোও ঘটনা পুনর্নির্মাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
৪. সবকিছু সংরক্ষণ করুন
যাচাইয়ের পরবর্তী ধাপ হলো সংরক্ষণ। এই ধাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রাপ্ত উপকরণটি প্রাইভেট করে ফেলা হতে পারে অথবা আপলোডকারী নিজেই মুছে ফেলতে পারেন। সিরিয়া ও মিয়ানমারে সহিংসতা ও যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ মুছে ফেলার জন্য ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো দায়ী। অন্যথায় আর্ন্তজাতিক বিচারিক প্রক্রিয়ায় এগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হতে পারত। তাই যত দ্রুত সম্ভব প্রমাণ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা বা যোদ্ধাকে নিয়ে অনুসন্ধানের সময়, ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছু বা যোদ্ধার প্রোফাইল সংরক্ষণ করা বরাবরই সবচেয়ে ভালো অভ্যাস বলে বিবেচিত। যুদ্ধরতদের সামাজিক মাধ্যম প্রোফাইলের ক্ষেত্রে পুরো প্রোফাইল সংরক্ষণ ও সহযোদ্ধাদের খুঁজে পেতে তাদের বন্ধু তালিকা খুঁজে দেখা বেশ কাজে দেয়। কখনো যোদ্ধাদের নাম ও তাদের প্রোফাইল গোপন করা থাকলে সেগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাবলিক প্রোফাইল পাবেন, যা থেকে আপনি তাদের পরিচয় যাচাই করে নিতে পারেন।
সংরক্ষণের জন্য আমি হাঞ্চলি টুল ব্যবহার করি। এই টুল স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে এবং সময় বাঁচায়। এছাড়া অনলাইন আর্কাইভিংয়ের জন্য ওয়েব্যাক মেশিন বেশ কার্যকর। লিঙ্কগুলোকে লগ করে রাখতে আমি সাধারণত গুগল স্প্রেডশিট দিয়ে শুরু করি, তারপর হাই-রেজোল্যুশন ছবি বা ভিডিও ডাউনলোড করে রাখার জন্য আলাদা একটি ফোল্ডার তৈরি করি, এবং হাঞ্চলি ব্যাকগ্রাউন্ডে স্বয়ংক্রিংয়ভাবে ওয়েবপেজগুলো রিয়েল টাইমে সংরক্ষণ করতে থাকে।
৫. প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে মিলিয়ে নিন
মাঠ পর্যায়ে স্থানীয়দের সঙ্গে প্রমাণ মিলিয়ে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ, তবে প্রায়ই এই ধাপ নজর এড়িয়ে যায়। এটি পুরোপুরি ওপেন সোর্স রিপোর্টিং নয়, তবু সব কিছু যে কভার করা হয়েছে তা নিশ্চিত হতে আমি এই হাইব্রিড পদ্ধতি পছন্দ করি। এটি কখনও কখনও নতুন তথ্যের সন্ধান দেয়, যেমন প্রত্যক্ষদর্শীরা অনুসন্ধানকে শক্তিশালী করে তোলার মতো অতিরিক্ত খুঁটিনাটির যোগান দিতে পারেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিরিয়ায় তুর্কী সমর্থিত জঙ্গি সদস্যের হাতে একমাত্র কুর্দি নারী রাজনীতিক হারভিন খালাফের হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিবিসির আরেক অনুসন্ধানে আমরা সত্যিই একজন প্রত্যক্ষদর্শীর সন্ধান পাই। তিনি হত্যাকাণ্ডের পরপরই মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছিলেন এবং অনুসন্ধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ শূন্যস্থান পূরণ করেছেন।
৬. সনাক্তকরণ
ভিডিওতে কোনো নির্দিষ্ট যোদ্ধাকে যুদ্ধাপরাধরত অবস্থায় দেখা গেলে তাকে সনাক্ত করা খুব জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। পিমআইজের মতো চেহারা চিহ্নিতকরণ টুল বিশেষভাবে জরুরি, তবে রাশিয়া-ইউক্রেন অনুসন্ধানে সবচেয়ে কার্যকর ফাইন্ডক্লোন, যা নিয়ে নির্ভয়ে কাজ করা যায়।
লিবিয়ায় বিবিসির অন্য একটি অনুসন্ধানে এটি নির্ভুলভাবে কাজ করেছে এবং ওয়াগনারের প্রায় সব ভাড়াটে সৈন্যদের সনাক্ত করতে সহায়তা করেছে।
৭. দূর থেকে সামরিক চলাচল ট্র্যাক করা
মেরিন ট্রাফিক, ফ্লাইট রাডার টুয়েন্টিফোর এবং এডিএসবি এক্সচেঞ্জের মতো ট্র্যাকিং টুল দিয়ে দূর থেকে সামরিক গতিবিধি অনুসরণ করতে পারেন। যেখানে অস্বীকারের শঙ্কা আছে, সেখানে আইনভঙ্গের ঘটনাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে সহায়তা করতে পারে এই কৌশল।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো সামরিক কর্মকর্তা তার জেট থেকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে বোমাবর্ষণের ঘটনা অস্বীকার করলে ট্রান্সপন্ডার (রেডিও সংকেত গ্রহণ ও রূপান্তরের যন্ত্র) ডেটা হামলার সময়ের নির্দিষ্ট স্থান উল্লেখ করে তার দাবি প্রত্যাখ্যান করতে পারে। (নোট: বিমান চালক সম্ভাব্য অপরাধ সনাক্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে ট্রান্সপন্ডার বন্ধ করে রাখতে পারেন।)
৮. বিশেষায়িত বিশ্লেষণ: সামরিক শাখা
সহিংস পরিস্থিতিতে আইন লঙ্ঘনের ঘটনা অনুসন্ধানের সময় ক্যামেরায় অপরাধীদের দেখা গেলে আরও দুটি বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে: সামরিক পদবী ও অস্ত্র। পদবী চেনার দুটি উপায়: সামরিক পোশাকের প্যাচ এবং যানবাহনে ব্যবহৃত চিহ্ন। একটি নির্দিষ্ট সামরিক বাহিনীর আচরণের ধরন বুঝতে এগুলো বেশ সহায়ক, যার সাহায্যে বাহিনীর কোন পর্যায় থেকে যুদ্ধাপরাধের নির্দেশ আসছে, তা প্রমাণ করা সহজ হয়। একটি নির্দিষ্ট বাহিনীর সৈন্যেরা সহিংসতার ছবি বা ভিডিও ছাড়লে কখনো কখনো এটি দায়মুক্তির বিশেষ অবস্থা নির্দেশ করে। সামরিক প্রতীক নিয়ে উইকির পেইজটি বেশ কাজের।
বিবিসির জন্য লিবিয়ার যুদ্ধাপরাধ নিয়ে আমার করা অনুসন্ধানে, সহিংসতার ভিডিওগুলোতে আল সাইকা ব্রিগেডের প্যাচ বারবার দেখা গেছে। লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির একটি বিশেষ ব্রিগেড, আল সাইকা। এর প্রধান মাহমুদ আল-ওয়ারফেলির বিরুদ্ধে বেসামরিক মানুষ হত্যা ও হত্যার নির্দেশের মতো যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার ৩৩টি অভিযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ওয়ান্টেড তালিকায় তার নাম আছে। সমন জারির পরও তাকে এখনো গ্রেফতার করা হয়নি, যা মূলত দায়মুক্তির সংস্কৃতি নির্দেশ করে। এটিই আমাকে এই বাহিনীর অপরাধ অনুসন্ধানের দিকে ধাবিত করেছে।
৯. বিশেষায়িত বিশ্লেষণ: অস্ত্র
সতর্ক নজর রাখার আরেকটি মূল ক্ষেত্র হলো, অস্ত্র: কোন অস্ত্র, কোথায়, এবং কে ব্যবহার করছে। জাতিসংঘের একটি বিশেষ চুক্তিতে ক্লাস্টার গোলার মতো বেশ কিছু অস্ত্র আর্ন্তজাতিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ছোট ছোট অনেক গোলার সমন্বয়ে এ ধরনের বোমা তৈরি হয়, যা আকাশ থেকে ফেলার পর বিস্ফোরিত হয় এবং সাধারণ মানুষের ওপর এর প্রভাবও হয় ভয়াবহ। সিরিয়ায় এমন অস্ত্রের ব্যবহার নথিবদ্ধ হয়েছে এবং অতি সম্প্রতি ইউক্রেনে রুশ সামরিক বাহিনীকে বিএম-২১ গ্রেড রকেট ব্যবহার করতে দেখা গেছে। অস্ত্রের গতিবিধি ট্র্যাক করার বেশ কিছু ডেটাবেস আছে: জেনস্ ডেটাবেস, ইউনিভার্সিটি অব জেনেভা স্মল আর্মস ডেটাবেস, সিপ্রি এবং আর্মস ট্রেড ট্রিটি।
আরও কিছু ঘটনা আছে, যা নির্দিষ্ট অস্ত্র ব্যবহার এবং সার্বিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের দিকে ইঙ্গিত করে। লিবিয়ায় বিবিসির অন্য অনুসন্ধানে আমি ও আমার সহকর্মীরা দেখতে পাই যে, ২৬ জন নিরস্ত্র ক্যাডেটের ওপর হামলায় আরব আমিরাত পরিচালিত একটি চীনা ড্রোন ব্যবহৃত হয় – যা জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার লঙ্ঘন, আর এই যুদ্ধে মিত্র দুই দেশের জড়ানোরও কথা নয়।
১০. যৌন সহিংসতা
যুদ্ধের সময় সৈনিকেরা ধর্ষণের মতো যৌন সহিংসতা করলে, সেটি যুদ্ধাপরাধ বলে বিবেচিত হয়। এটি প্রায়ই উপেক্ষা করা হয় এবং যুদ্ধের সময় কী ঘটলে তাকে যৌন সহিংসতা বলা হবে, সে বিষয়েও ঐকমত্য নেই; অথচ এটিই সবচেয়ে সাধারণভাবে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ।
অতি সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ হলো টাইগ্রে যুদ্ধে ইথিওপিয়ান ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সের সৈনিকদের ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার অথবা রোহিঙ্গা গণহত্যার সময় মিয়ানমারের সৈনিকদের দ্বারা মুসলিম রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ।
সহিংস পরিস্থিতিতে যৌন সহিংসতা নিয়ে প্রতিবেদন করার সহায়ক একটি রিসোর্স হলো ডার্ট সেন্টার ইউরোপের এই গাইড। এতে যুদ্ধকালীন রিপোর্টিংয়ের কিছু পরামর্শ আছে; এবং নিজেকে নিরাপদ রাখা, যথাযথভাবে সাক্ষাৎকার নেয়া এবং ভুক্তভোগীকে উপস্থাপনের মত বিষয়ে কয়েকটি অনুচ্ছেদ আছে। এছাড়া এই গাইডে দূরবর্তী রিপোর্টিং ও মাঠপর্যায়ের মধ্যস্থতাকারী বা সোর্সের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলার উপায় নিয়েও পরামর্শ পাবেন।
১১. হাসপাতাল, স্কুল ও জ্ঞাত বেসামরিক লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে নোট নেয়া
বেসামরিক নাগরিকদের মতোই হাসপাতাল ও স্কুল, যুদ্ধকালীন সময়ে বিশেষ সুরক্ষা পেয়ে থাকে। জনসাধারণ অবশ্যই কোনো আগ্রাসনের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে না, এবং এই ঘটনাগুলো চিহ্নিত করার একটি কার্যকর টুল হলো ওপেন সোর্স ফুটেজের জিওলোকেশন। যাচাইয়ের জন্য অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে গুগল আর্থ, ইয়ানডেক্স ম্যাপস, সেন্টিনেল হাব, ইকোসেক, ও উইকিম্যাপিয়ার মতো জিওলোকেশন টুলগুলো সহায়ক হতে পারে, এবং হামলার সময়কাল (যখন ছায়া দৃশ্যমান হয়) নিরূপণ করতে এবং কালানুক্রমিক অবস্থান জানতে সানক্যাল্ক টুলটি কাজে আসবে। গুগল আর্থে স্যাটেলাইট ছবির দিকে আরও গভীরভাবে নজর দেয়ার আগে আপনাকে ঘটনাস্থলের স্থানাঙ্ক (কোঅর্ডিনেট) পেতে হবে। স্থানাঙ্ক জানার জন্য লাইভইউএম্যাপ একটি ভালো সূচনাবিন্দু। জিওলোকেশন নিয়ে বেলিংক্যাটের বেশ কিছু ভালো গাইড ও অসাধারণ সব উদাহরণ আছে।
এ ধরনের অনুসন্ধানের একটি উদাহরণ হলো লিবিয়ার অভিবাসী কারাগার, যা বোমা হামলার শিকার হয়েছিল। সামাজিক মাধ্যমে পাওয়া মাঠপর্যায়ের ছবি ও জিওলোকেশন থেকে জানা যায়, দুই মাস আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারাগারটির অবস্থান ছিল একটি অস্ত্রাগারের পাশে। নিউইয়র্ক টাইমস এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। তবে পরবর্তীতে আমি বিবিসি আরবির জন্য রিপোর্ট করেছি যে, লিবিয়ার ওপর জাতিসংঘের আরোপ করা অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে একটি বিদেশি জেট থেকে বোমা বর্ষণ করা হয়েছিল, যা একটি যুদ্ধাপরাধ।
১২. যথাসময়ে যথাস্থানে থাকা
আগে যেমনটা বলা হয়েছে, চিকিৎসা কর্মী ও হাসপাতালগুলো আর্ন্তজাতিক আইনের বলে সুরক্ষিত। তাই প্রথম সাড়াদানকারীদের লক্ষ্যবস্তু বানানো একটি যুদ্ধাপরাধ। যেমন, “ডাবল ট্যাপ” বা উপর্যুপরি আক্রমণ, যেখানে একটি প্রাথমিক বোমা হামলা বা অভিযানের পরপরই আরেকটি একই রকম হামলা চালানো হয়, বিশেষ করে আহতদের উদ্ধারকাজে নিয়োজিতদের হত্যা করার জন্য। রাশিয়ার বিরুদ্ধে, সিরিয়ায় ডবল ট্যাপ বিমান হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ২০১৯ সালে ইদলিবের একটি বেসামরিক বাজারে হামলা, যেটি আমি বিবিসির জন্য অনুসন্ধান করেছিলাম।
আরও এক ধরনের আচরণ লক্ষ্য করা প্রয়োজন: আক্রান্ত বাহিনীর আত্মসমর্পণ দৃশ্যমান হওয়া সত্ত্বেও আগ্রাসী সৈন্যবাহিনী যখন বিরতি দেয় না।
১৩. যোগাযোগ
বেশিরভাগ সময়, সৈন্যরা যুদ্ধাপরাধে জড়িত হন এবং নিজেদের যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ নথিবদ্ধ করতে থাকেন – কারণ তারা মনে করেন, ক্ষমতাসীনেরা তাদের রক্ষা করবে। কখনো কখনো এই অনুভূতির কারণে তারা নিজেদের অপরাধ জানাতে বা স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না।
লিবিয়ার গানফুদা গণহত্যায় মৃতদেহের প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের প্রমাণ সংগ্রহের পর আমার দল অপরাধের সঙ্গে জড়িত কয়েকজন যোদ্ধাকে সনাক্ত করে এবং তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চায়। কারণ, তাদেরও উত্তর দেয়ার অধিকার আছে। এদেরই একজন তার কৃতকর্ম নিয়ে গর্ব করছিলেন। তার দাবি, তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে।
১৪. তথ্য নিরাপত্তা
যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত একজন যোদ্ধার মুখোমুখি হওয়ার আগে আপনার নিশ্চিত হতে হবে, যথাযথভাবে আপনার প্রমাণের ব্যাক-আপ আছে, এবং অনুসন্ধান ও যোগাযোগের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র নিরাপদে আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে অনেক অনলাইন রিসোর্স আছে, তবে মৌলিক বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পাসওয়ার্ড ব্যবস্থাপনা, টু-স্টেপ ভেরিফিকেশন, ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক, এবং সামাজিক মাধ্যম অনুসন্ধানে কৃত্রিম প্রোফাইল ব্যবহার। জিআইজেএনের এই বিষয়ে সর্বোত্তম চর্চার একটি তালিকা আছে।
১৫. মানসিক আঘাত নিয়ে সচেতনতা
ট্রমা বা মানসিক আঘাত নিয়ে কখনো কখনো অতটা মাথা ব্যাথা দেখা যায় না, তবে যুদ্ধাপরাধ অনুসন্ধানে সম্ভবত এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অনেক সময় ঘন্টার পর ঘন্টা অনলাইনে ভয়াবহ ছবি/ভিডিও দেখতে হয়। সবচেয়ে ভালো উপায় হলো নির্দিষ্ট সময় পর পর বিরতি এবং বিশ্রাম নেয়া, এই কাজের প্রভাব নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা, এবং হত্যাকাণ্ডের ভিডিও অনুসন্ধানের সময় অডিও বন্ধ রাখা। যে সংবাদ সংস্থার কর্মীদের গভীর ও নৃশংস বিষয় ঘাঁটাঘাটি করতে হয়, তাদের জন্য ডার্ট সেন্টার একটি বিশদ ও ধাপভিত্তিক কার্যপ্রণালী তৈরি করেছে। এটি এমনভাবে করা হয়েছে, যেন তা চাপ ও মানসিক যন্ত্রণা কমাতে সহায়ক হয়।
এই ধরনের কাজের কারণে মানসিক আঘাতের ঝুঁকি বেশ ভয়াবহ। আমার ডক্টরাল গবেষণায় এই খাতের ৩০ জন ওপেন সোর্স বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার নিয়েছি এবং ৯০% অনুসন্ধানকারী মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের কথা বলেছেন। দুঃস্বপ্ন, নিদ্রাহীনতা, অবসাদ, ভীতি এবং নিজেকে গুটিয়ে ফেলা থেকে ট্রমা পরবর্তী মানসিক চাপজনিত রোগ (পিটিএসডি) ও আত্মহত্যার চিন্তার মতো ভয়াবহ সমস্যা দেখা দেয়। এ ধরনের অনুসন্ধান তদারকির দায়িত্বে থাকা ব্যবস্থাপকদের উচিত অনুসন্ধানকারীদের সহায়তা করা। তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা ও সহনশীলতার প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। অন্যদিকে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকদের উচিত আত্মনিয়ন্ত্রণ করা ও কাউন্সেলিং বা মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা নেয়া। গবেষণায় দেখা যায়, যে সাংবাদিকেরা এ ধরনের অনুসন্ধান পরিচালনা করেন, সাধারণত তাদের ছবি/ভিডিও দেখার ব্যাপারে অনেক ধৈর্য থাকে এবং তারা প্রাকৃতিকভাবে অনেক বেশি সহনশীল থাকেন। তাই, তাঁদের সেরাটা দেয়ার জন্য প্রয়োজন শুধু সহায়ক পরিবেশ।
আরও পড়ুন
হাও টু ইউজ ডেটা জার্নালিজম টু কভার ওয়ার অ্যান্ড কনফ্লিক্ট
স্মার্টফোনে ছবি যাচাইয়ের চারটি সহজ পদ্ধতি
মার্কিন ক্যাপিটল দাঙ্গায় জড়িতদের যেভাবে খুঁজে বের করলেন ওপেন সোর্স বিশেষজ্ঞরা
মনীষা গাঙ্গুলি একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা। তিনি বর্তমানে বিবিসি ওর্য়াল্ড সার্ভিসের অনুসন্ধানী দলের জন্য ডিজিটাল তথ্যচিত্র নির্মাতা হিসেবে কর্মরত। মনীষা, ফোর্বসের “গণমাধ্যমের অনুর্ধ্ব ৩০” সম্মানজয়ীদের একজন। তাঁর তথ্যচিত্রগুলো আর্ন্তজাতিক পদক জিতেছে এবং বিশ্বব্যাপী ৩০ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছেছে।