কোভিড-১৯ ডেটা চিত্রায়নের আগে যে ১০টি বিষয় মাথায় রাখবেন
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
বড় বড় করে স্পষ্টভাবে লেখা সংখ্যা আর কালো বিশ্ব মানচিত্রের ওপর লাল লাল বৃত্ত; জন হপকিন্সের এই কোভিড-১৯ ড্যাশবোর্ড যেন হয়ে উঠেছে করোনাভাইরাস মহামারির এক বিশ্বস্ত চিত্র। বিশ্বজুড়ে অনেক সাংবাদিক ও পাঠক এটি দেখছেন নানা তথ্যের জন্য।
অদৃশ্য এই বৈশ্বিক হুমকি সম্পর্কে জনগণের জানাবোঝা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন যে একটি শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠছে, সেটিই যেন তুলে ধরছে জন হপকিন্সের এই ড্যাশবোর্ড।
তবে, ভিজ্যুয়ালাইজেশনের অধ্যাপক আলবার্তো কায়রোর মতে, হন হপকিন্সের এই দারুন গ্রাফিক্সও আরো উন্নত করা সম্ভব।
কারণ এখানে থাকা গোল বৃত্তগুলো একেক জায়গায় একেকটি অর্থ নির্দেশ করে। ইউরোপের ক্ষেত্রে এটি দিয়ে বোঝানো হয়েছে একেকটি দেশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে একেকটি বৃত্ত দিয়ে বোঝানো হয়েছে একেকটি কাউন্টি। এবং কিছু দর্শক যুক্তরাষ্ট্রের এই এতগুলো বৃত্ত দেখে ভুল বুঝতে পারে।
মিয়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব কমিউনিকেশনের (ভিজ্যুয়াল জার্নালিজম) নাইট চেয়ার কায়রো বলেছেন, “এখানকার গ্রাফিক্স খুবই দুর্দান্ত। কিন্তু এখানে কি ডেটার বিভিন্ন পর্যায়ে আরো ধারাবাহিকতা রাখা সম্ভব ছিল? হয়তো সবই রাখা যেত জাতীয় পর্যায়ে। এরপর আরো জুম করে যাওয়া যেত কাউন্টিতে।”
জিআইজেএন-এর ইনভেস্টিগেটিং দ্য প্যানডেমিক ওয়েবিনার সিরিজের দ্বাদশ পর্বে ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন নিয়ে আলোচনায় আরো ছিলেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ড্যানিয়েল আইভরি এবং স্বাস্থ্য ডেটা বিশেষজ্ঞ অ্যামান্ডা মাকুলেক। সেখানে তারা তুলে ধরেছেন, ডেটাকে চিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপনের জন্য সাংবাদিকরা কিভাবে গ্রাফিক্স কাঠামো ব্যবহার করতে পারেন। এই ওয়েবিনারে অংশ নেন ৪৬টি দেশের ২৬৬জন সাংবাদিক।
মোটাদাগে তাঁদের বক্তব্য ছিল এরকম: আগে খুবই সতর্কতার সাথে সব তথ্য যাচাই ও বিশ্লেষণ করুন। তারপর, ভাবুন, সেটি কিভাবে সবচে যথার্থ ও সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপন করা যায়। একই সঙ্গে সেই গ্রাফিক্স ও ডেটা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করুন এবং কোনো অনিশ্চয়তা থাকলে সেটি বলে দিন।
কায়রো বলেছেন, বৈশ্বিকভাবে তথ্য উপস্থাপনের অন্যতম কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে ভিজ্যুয়ালাইজেশন। এগুলোর কারণেই জনসাধারণ এই মহামারি পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে পারছে।
“তবে আমার মনে হয়, ভিজ্যুয়ালাইজেশন নয়, এই করোনাভাইরাস সংকট কাভারের সবচে জটিল অংশটি হচ্ছে মানসম্পন্ন ডেটা সংগ্রহ ও যাচাই করা,” বলেছেন হাও চার্টস লাই – গেটিং স্মার্টার অ্যাবাউট ভিজ্যুয়াল ইনফরমেশন বইয়ের লেখক কায়রো, “ভালো ব্যাপার হলো: ভিজ্যুয়ালাইজেশন ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। কিন্তু আমি এটিও দেখেছি কিভাবে এই মহামারির অনেক ডেটা ভুলভাবে ভিজ্যুয়ালাইজ করা হচ্ছে।”
ডেটা সম্পর্কে রিপোর্টারদের সতর্ক করার জন্য ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন সোসাইটির অপারেশনস ডিরেক্টর ও স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাকুলেক বলেছেন, কোনো ডেটা ব্যবহার করে গ্রাফিক্স বা চার্ট বানানোর আগে রিপোর্টারদের বুঝতে হবে কিভাবে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত এসব ডেটা সংগ্রহ করা হচ্ছে।
যেমন, বিভিন্ন দেশের জাতীয় ডেটাসেটে যেভাবে তথ্য সংযোজন করা হয়, সেখানে সোয়াব নেওয়া থেকে শুরু করে সেটি পরীক্ষার তথ্য ওয়েবসাইটের স্প্রেডশিটে লিপিবদ্ধ করার মধ্যে ১০টি আলাদা আলাদা ধাপে তথ্য বিচ্যুতি ঘটতে পারে বলে। এটি হতে পারে মনুষ্য ভুলভ্রান্তি বা তথ্য সংযোজনে দেরির কারণে।
নিউ ইয়র্ক টাইমের অনুসন্ধানী সাংবাদিক আইভরি বলেছেন, একেক জায়গায় কোভিড-১৯ ডেটা একেকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে, বিভিন্ন রাজ্য ও কাউন্টির স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা প্রায়ই ভিন্ন ভিন্ন ডেটাসেটের কথা উল্লেখ করছে। কেউ হয়তো নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে কথা বলছেন, কারো ডেটা হয়তো অনুমানভিত্তিক। এরপর আবার হয়তো অন্য কোনো পদ্ধতিতে চলে যাচ্ছেন, বা সংখ্যাগুলো নতুন করে প্রকাশ করছেন।
গত মাসে, আইভরি ও তাঁর সহকর্মীরা দেখিয়েছেন: যুক্তরাষ্ট্রে মোট কোভিড-১৯ মৃত্যুর মধ্যে এক তৃতীয়াংশের বেশি মৃত্যু হয়েছে নার্সিং হোমসহ বিভিন্ন দীর্ঘকালিন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে।
আইভরি বলেছেন, “আমরা প্রায় সব অঙ্গরাজ্য থেকেই তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি। আর কাজটি এখনো চলমান। প্রায় ৭০ শতাংশ ডেটা আমাদের নিজেদেরই সংগ্রহ করতে হয়েছে ফোন করে বা বিভিন্ন ওয়েবসাইটে গিয়ে। বাকিটা আমরা সংগ্রহ করেছি [স্বয়ংক্রিয়] স্ক্র্যাপার ব্যবহার করে। আশা করছি এভাবে আমরা আরো তথ্য সংগ্রহ করতে পারব। কিন্তু আমরা অজানা বিষয়গুলো সম্পর্কে স্বচ্ছতা বজায় রাখার ব্যাপারেও সতর্ক আছি।”
আইভরি বলেছেন, ডেটা নিয়ে সংশয় তৈরি হলে সবচে ভালো সমাধান হলো কোনো স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে সরাসরি ফোন করে জেনে নেওয়া।
জিআইজেএন ওয়েবিনারের এই তিন আলোচকের বক্তব্য থেকে, কোভিড-১৯ ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন নিয়ে আমরা কিছু পরামর্শ এক জায়গায় করেছি।
সেরা ১০ পরামর্শ
- ডেটা কিভাবে পড়তে হবে সেটি ব্যাখ্যা করার আগে, গ্রাফিক্সটি কিভাবে দেখতে হবে – তা ব্যাখ্যা করুন। যেমন, মহামারির সময়ে চাকরি হারানো নিয়ে সাম্প্রতিক এক গ্রাফিক্সে, নিউ ইয়র্ক টাইমস বিষয়টি ব্যাখ্যা করে দিয়েছিল এভাবে: “চার্টের প্রতিটি বৃত্ত দিয়ে একটি পেশাকে বোঝানো হচ্ছে। যে বৃত্তটি যত বড়, সেখানে তত বেশি মানুষ কাজ করেন।”
- গ্রাফিক্স ডিজাইন করার সময়ই সেটির টেক্সট লিখে ফেলুন। এই প্রক্রিয়ায় পুরো বিষয়টি আপনার ও পাঠকের জন্য বুঝতে সুবিধা হবে।
- আপনার ডেটাগুলো একটি পদ্ধতি অনুসারে সাজিয়ে নিন। যেমন: সময়ের ক্রম অনুযায়ী বা তুলনামূলক গ্রুপের মতো করে।
- আপনার পাঠক-দর্শক যদি ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশনের ক্ষেত্রে নতুন হয়, তাহলে সহজবোধ্য ও সাধারণ কিছু দিয়ে শুরু করুন। যেমন ম্যাপ, বার গ্রাফ বা লাইন চার্ট। এসব কাজের জন্য ডেটার্যাপার, ফ্লোরিশ, ইনজাইট বা এধরণের টুল ব্যবহার করতে পারেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে বিশেষজ্ঞদের অনলাইন টিউটোরিয়াল দেখতে পারেন। যেমন, কায়রোর এই গাইড।
- তবে শুধু সহজ টুল ও চার্টের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ করে ফেলবেন না। ভিজ্যুয়ালের মাধ্যমে ডেটা উপস্থাপনের ধরনে মাঝেমধ্যেই কিছু পরিবর্তন আনুন।
- খুব বেশি পরিমাণ ডেটা ভিজুয়্যালাইজ করার চেষ্টা করবেন না। খুব বেশি তথ্য আছে মনে হলে, সেটিকে ছোট করে আনুন। কিছু প্রধান বিষয় চিহ্নিত করুন এবং সেগুলোই ফুটিয়ে তুলুন।
- ডেটার চিত্রায়নে খারাপ বলে কিছু নেই। কিন্তু ডেটাসেট ও দর্শকের ধরণ বুঝে কিছু ভিজ্যুয়ালাইজেশন ফর্ম্যাট অন্যগুলোর চেয়ে উপযুক্ত হতে পারে। জটিল কিছু চার্টকে পরিস্কারভাবে বোঝাতে রেফারেন্স পয়েন্ট হিসাবে আরেকটি গৌণ চার্টের প্রয়োজন হতে পারে। যেমন, কার্টোগ্রামের ক্ষেত্রে – যা কোনও মানচিত্রের মধ্যে থাকা অঞ্চলগুলোকে কিছুটা পরিবর্তন করে উপস্থাপন করে – তার পাশে সেই অঞ্চলের একটি সাধারণ মানচিত্রও রাখা উচিত, যাতে দর্শক তুলনা করতে পারে।
- সংখ্যার ক্ষেত্রে লিনিয়ার স্কেল ব্যবহার করুন। এবং পরিবর্তনের হার বোঝানোর ক্ষেত্রে নন লিনিয়ার স্কেল। যার মধ্যে লগরিদমিক স্কেলও থাকবে। পাঠককে এসব নন লিনিয়ার গ্রাফিক্স সম্পর্কে খুব স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করুন। কারণ প্রায়ই, পাঠকদের জন্য বিষয়টি বোঝা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
- মার্জিন অব এরর বা কনফিডেন্স ইন্টারভ্যাল-এর মতো অনিশ্চয়তার বিষয়গুলি যতটা পারা যায় ব্যাখ্যা করে দিন। ডেটায় যে ধরনের অনিশ্চয়তার কথা সংখ্যায় প্রকাশ করা সম্ভব না (যেমন: কিভাবে ডেটা তৈরি করা হয়েছে), সেগুলো সম্পর্কে আলাদা করে লিখে দিন।
- “দেখান, কিন্তু বলার চেষ্টা করবেন না” – ডিজাইনের প্রথাগত এই মন্ত্র ভুলে যান। কায়রো বলেছেন, ভিজ্যুয়াল সাংবাদিকদের একই সাথে “দেখাতে ও বলতে” হবে। গ্রাফিক্সের টেক্সট অংশ (“অ্যানোটেশন লেয়ার” নামে পরিচিত) এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এতে করে গ্রাফিক্সের মূল বিষয়গুলোও গুরুত্ব দিয়ে বলা যাচ্ছে, এবং একই সঙ্গে পাঠকও গ্রাফিক্সটি সম্পর্কে ভালোমতো বুঝতে পারছে।
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএন-এর রিপোর্টার। দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসে কাজ করেছেন প্রধান প্রতিবেদন হিসেবে। বিদেশী প্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতি, দুর্নীতি ও সংঘাত নিয়ে রিপোর্ট করেছেন বিশ্বের দুই ডজনেরও বেশি দেশ থেকে।