Screenshot
ডিপফেকের যুগে ভিজ্যুয়াল সাংবাদিকতা: সত্য যাচাই ও আস্থা অর্জন
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
জেনারেটিভ এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার করে লেখা, ছবি থেকে শুরু করে বানানো যায় অডিও এবং ভিডিও কনটেন্ট। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিটি বিকশিত হচ্ছে। তাই ভিজ্যুয়াল সাংবাদিকতা ঘিরে মানুষের আস্থা অর্জন ও সত্যতা যাচাই আজ শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, অপরিহার্যও বটে।
ইতালির পেরুজিয়াতে ২০২৪ আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতা উৎসবে “সিন্থেটিক মিডিয়ার যুগে ভিজ্যুয়াল জার্নালিজমের পুনর্বিন্যাস” শীর্ষক প্যানেল আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল জেনারেটিভ এআইয়ের ব্যবহার। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন এ বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। প্যানেলটি সঞ্চালনা করেন দ্য সেভেন ফাউন্ডেশনের শিক্ষা পরিচালক ডেভিড ক্যাম্পবেল।
এই মুহূর্তে কেন ভিজ্যুয়াল সাংবাদিকতার ওপর জোর দেওয়া উচিৎ এবং এর কোন দিকগুলো গুরুত্ব সহকারে সামনে নিয়ে আসা জরুরি তা নিয়ে কথা বলেন প্যানেলিস্টরা। ভুয়া ছবি ও ভিডিও ব্যবহারের বিপদ থেকে শুরু করে জেনারেটিভ এআই দিয়ে তৈরি কনটেন্টগুলো চিহ্নিত করতে কীভাবে প্রযুক্তিকে কাজ লাগানো যায় তার ওপর জোর দেন তাঁরা।
সত্যের দলিল হিসেবে ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট
সাংবাদিকতা ও আলোকচিত্র সাংবাদিকতার জন্য বর্তমানে সত্যিকারের হুমকি হয়ে উঠেছে জেনারেটিভ এআই। আলোকচিত্র সময়ের দলিল হিসেবে টিকে যায়। ভোগ ইতালিয়ার জ্যেষ্ঠ আলোকচিত্র সম্পাদক এবং গ্লোবাল ফটোভোগের প্রধান অ্যালেসিয়া গ্লাভিয়ানোর মতে, “বাস্তবতার সঙ্গে এর সঙ্গতি” থাকতে হবে।”
তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘আপনি আপনার বসার ঘরের সোফায় বসে সম্পাদিত কোনো আলোকচিত্র দেখিয়ে বলতে পারেন যে, আপনি গাজা থেকে রিপোর্ট করছেন – এর মানে কি? এ ধরনের ঘটনা মিডিয়ার ওপর মানুষের যে আস্থা তার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে,” বলে তিনি সতর্ক করেন।
ছবির সত্যতা সম্পর্কে মানুষের সহজাত বিশ্বাসের বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গ্লাভিয়ানো কিছুদিন আগের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। ব্রিটিশ রাজপরিবারের অফিসিয়াল টুইটার পোস্টে সন্তানদের সঙ্গে কেট মিডলটনের একটি ছবি পোষ্ট করা হয়। ছবিটি ছিল সম্পাদিত। পরবর্তীতে ওয়েলসের রাজকুমারী ছবি সম্পাদনার বিষয়টি স্বীকার করেন। ছবিটি পোষ্ট করার পর সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া আসে।
গ্লাভিয়ানো জানান, ছবিটি নিয়ে সাধারণ মানুষের এ ধরনের প্রতিক্রিয়ায় তিনি অবাক হয়েছেন। তিনি বলেন, “বিষয়টি ইতিবাচক, আর আমি ভীষণ অবাকও হয়েছি, লোকেরা আজও আলোকচিত্রকে দলিল হিসাবে মনে করে।”
তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বাস্তবতাকে বিকৃত নয়, বরং চিত্রিত করার বিরল এক উদাহরণও দেন গ্লাভিয়ানো। যার শিরোনাম, এক্সিবিট এ-আই: দ্য রিফিউজি অ্যাকাউন্ট। এতে শরণার্থীদের সঙ্গে কাজ করেছেন গবেষক, আলোকচিত্র সাংবাদিক এবং প্রযুক্তিবিদেরা।
শরণার্থীরা যে সব বৈষম্য, অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হন, পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার শরনার্থী শিবিরে তারা যে ধরনের নির্মমতার সম্মুখীন হয়েছেন, তাদের সে অভিজ্ঞতাগুলো এখানে অন্যভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যা নেহাতই ব্যতিক্রম।
কারণ, এই শরনার্থীরা যে সব করুণ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন, সে সবের চাক্ষুষ কোনো প্রমাণ গবেষক দলটির কাছে ছিল না। সেই শূণ্যতাকে পূরণ করেছে এআই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে শরনার্থীদের অসহায় মূহুর্তগুলোকে ভিজ্যুয়ালি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নানা অভিব্যক্তিতে।
মিথ্যা থেকে সত্যকে আলাদা করা
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)-এর এআই এবং গ্লোবাল চ্যালেঞ্জ ডেস্কের প্রধান আর্থার গ্রিমোনপন্ট শুরু করেন জার্মান-আমেরিকান ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক হান্না আরেন্ডের বিখ্যাত একটি উক্তি দিয়ে।
উক্তিটি হচ্ছে, “সবাই যদি আপনার সঙ্গে সবসময় মিথ্যা বলে, তার মানে এই নয় যে আপনি সেই মিথ্যা বিশ্বাস করেন, বরং আর কিছুই বিশ্বাস করেন না।”
তিনি আরও বলেন, মাত্র দুই বছরের মধ্যে জেনারেটিভ এআই শিশুসুলভ ছবি আঁকিয়ে থেকে রীতিমতো এইচডি ভিডিও তৈরিতে সক্ষম হয়ে উঠেছে। যা দেখে আপনি “কোনটি মৌলিক কনটেন্ট আর কোনটি এআই ব্যবহার করে তৈরি, সে পার্থক্য করতে হিমশিম খাবেন।”
গোটা বিষয়টি ভিজ্যুয়াল সাংবাদিকতার জন্য তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। তা হচ্ছে সিন্থেটিক কনটেন্টের “উত্তাল সমুদ্রে” মৌলিক বিষয়বস্তু শনাক্ত; জনগণের আস্থা ধরে রাখা; এবং “প্রকৃত ছবি” দিয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
গ্রিমোনপন্ট বলেন, উদ্বেগের আরও একটা জায়গা রয়েছে। সেটি হলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যালগরিদমগুলো বর্তমানে সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে কাজ করছে। অ্যালগরিদম বিজ্ঞাপন থেকে প্রাপ্ত আয় এবং ব্যবহারকারীদের সমাগম বৃদ্ধির জন্য ডিজাইন করা।
তিনি আরও বলেন,”[জেনারেটিভ এআই এবং ডিপফেকস] তথ্যের ইকোসিস্টেমে প্রবেশ করছে। এটি পদ্ধতিগতভাবে স্পর্শকাতর বা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে এমন কনটেন্টের ওপর আলোকপাত করে। বর্তমানে ভিজ্যুয়াল সাংবাদিকতার জন্য যা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
তিনি দেখান, ২০২০ সালে পপ তারকা রিহানা টুইটারে অস্ট্রেলিয়ার দাবানল ঘিরে একটি ভুল ছবি শেয়ার করেন। ব্ল্যাক সামার হিসাবে পরিচিত ভয়াবহ দাবানলে মহাদেশ জুড়ে কোটি কোটি প্রাণীর মৃত্যুর পাশাপাশি মারাত্মক পরিবেশগত ক্ষতি হয়। ছবিটি মহাকাশ থেকে তোলা হয়েছে এমনটা বলা হলেও বিষয়টি ছিল “অসম্ভব”।
সুস্পষ্টভাবেই ছবিটি জাল বা কারসাজি করে তৈরি। রিহানা ছবিটি পোস্ট করার পর তার লাখ লাখ অনুসারি ছবিটি শেয়ার করেন। এরপরে টুইটারের অ্যালগরিদম ব্যবহার করে ছবিটি আরও ছড়িয়ে দেওয়া হয়। যা কোনে “প্রকৃত কনটেন্ট বা সংবাদ কনটেন্টের চেয়ে অনেক বেশি লোকের কাছে পৌঁছে যায়।”
সেভেন ফাউন্ডেশনের ক্যাম্পবেলের এক প্রশ্নের উত্তরে এ সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করে মিডিয়া আউটলেটগুলো কিভাবে সামনে এগোতে পারে তা নিয়ে কথা বলেন আরএসএফের গ্রিমোনপোর্ট।
প্যারিস চার্টার অন এআই অ্যান্ড জার্নালিজম নিয়ে তিনি কথা বলেন। আরএসএফ, জিআইজেএনসহ ১৬টি সংস্থার সম্মিলিত চেষ্টায় তৈরি এ চার্টারটি গত নভেম্বরে প্রকাশ করা হয়।
তথ্যের সত্যতা যাচাই এবং সমাজে সাংবাদিকতার ভূমিকা নিশ্চিতে চার্টারে ১০টি মূল নীতিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
নীতিমালার মধ্যে রয়েছে— মিডিয়া কীভাবে তাদের কাজে প্রযুক্তি ব্যবহার করবে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় অবশ্যই নৈতিক বিবেচনাকে অগ্রাধিকার দেবে; কোনো ঘটনাকে তুলে ধরতে অ্যালগরিদম বা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা নয়, বরং গুরুত্ব দিতে হবে মানবিকতাকে; কোনটি প্রকৃত কনটেন্ট আর কোনটি কৃত্রিম বা বানোয়াট, তা শনাক্তে মিডিয়াকে সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে; মিডিয়াকে অবশ্যই বৈশ্বিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালন পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং টেক কোম্পানির সঙ্গে আলোচনার সময় সাংবাদিকতার গুরুত্ব এবং সমাজে এর ভূমিকার পক্ষে দেনদরবার করতে হবে।
ফ্যাক্ট-চেকিং ক্যাপশন, ফটো সিকোয়েন্স, ফরেনসিক দল
“বিশ্বাস সত্যিই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ” এ বিষয়টির ওপর জোর দিয়ে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক জুমানা এল জেইন খৌরি বলেন যে, কীভাবে তার সংস্থা ভিজ্যুয়াল সাংবাদিকতার সত্যতা রক্ষায় সহযোগিতা করছে।
বানোয়াট ছবি অপসারণের জন্য ফরেনসিক দক্ষতা দরকার। এই দক্ষতা অর্জনে বিনিয়োগ করা, আলোকচিত্রীদের কাছে ছবির ‘র’ ফাইলের (মৌলিক ফাইল) পাশাপাশি সিকোয়েন্সের ধারাবাহিকতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া এবং তাদের দেওয়া তথ্যগুলোর ফ্যাক্ট-চেকের জন্য আলাদা গবেষক দল নিয়োগের কথা বলেন তিনি।
এল জেইন খৌরি মিডিয়া আউটলেটগুলোকে তাদের হাতে আসা আলোকচিত্রের সত্যতা পরীক্ষার জন্য ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ নিয়োগে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, মিডিয়া আউটলেটগুলোকে সত্যিকারের গল্পের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। যে সব প্রতিবেদক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সত্যিকারের গল্প তুলে আনেন মিডিয়া আউটলেটগুলোকে সে সব গল্পের ওপর আলোকপাত করতে হবে। জেনারেটিভ এআই কখনই কিছুর সাক্ষী হতে পারে না— কোনোভাবেই নয়।”
সিন্থেটিক মিডিয়ার যুগে ভিজ্যুয়াল জার্নালিজমের পুনর্বিন্যাস নিয়ে সম্পূর্ণ ভিডিওটি দেখুন নিচের ইউটিউবে লিংকে।
জোয়ানা ডেমার্কো জিআইজেএনের ভিজ্যুয়াল ও নিউজলেটার সম্পাদক। গত এক দশক ধরে তিনি মাল্টায় স্থানীয় প্রতিবেদক এবং একজন ফ্রিল্যান্স ফটোসাংবাদিক হিসাবেও কাজ করছেন। পলিটিকো ইউরোপ, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি এবং ডের স্পিগেলসহ বিভিন্ন জায়গায় তার লেখা ছাপা হয়েছে।