Image: Heino for GIJN
জাহাজ ও বিমানের গতিপথ অনুসরণ: বিশেষজ্ঞ পরামর্শ
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
দেউলিয়া হয়ে যাওয়া নিষেধাজ্ঞা আরোপিত কোম্পানি, কোকেন চোরাচালানের পথ, এবং ভেসে আসা অভিবাসী নৌযান ফেরত পাঠানো থেকে শুরু করে আলোচিত সব অপহরণের মতো নানা ধরনের ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে জাহাজ ও বিমানের গতিপথ অনুসরণ বিশ্বের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
১৩তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে (#জিআইজেসি২৩) বিমান ও জাহাজের গতিপথ অনুসরণ নিয়ে একটি সেশনে, সিগমা অ্যাওয়ার্ড ও ইউরোপীয় প্রেস পুরস্কারজয়ী সাংবাদিক ইমানুয়েল ফ্রয়েডেনথাল বিমানবিষয়ক অনুসন্ধানের ওপর তার হালনাগাদ পরামর্শ তুলে ধরেন। ডিজিটালি কোনো একটি জাহাজ অদৃশ্য গেলে ঠিক কী করবেন, তা নিয়ে বেশ কিছু কৌশল তুলে ধরেন লাইটহাউস রিপোর্টসের সাংবাদিক বাশার দীব। প্যানেলটি পরিচালনা করেন আইসিআইজের (ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট) প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপক এবং ইউরোপীয় অংশীদারিত্ব সমন্বয়কারী জেলেনা কসিক।
স্টোরির সন্ধানে
”এক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন কাজটি হচ্ছে গল্পের প্রাথমিক ধারণাটি খুঁজে পাওয়া,” বলেন ফ্রয়েডেনথাল। তিনি সাংবাদিকদের পরামর্শ দেন, তারা যেন তাদের নিজস্ব বিট থেকে কাজ শুরু করেন, কারণ কোনো একটি বিমানকে এলোমেলোভাবে অনুসরণের মাধ্যমে আপনি খুব বেশি দূর অগ্রসর হতে পারবেন না। “বেশিরভাগ বিমান ভ্রমণই ক্লান্তিকর, রৌদ্রোজ্জ্বল গন্তব্যের খোঁজে আসা অবকাশ যাপনকারীদের দিয়ে ভর্তি” তিনি বলেন। এক্ষেত্রে ফলপ্রসূ পদ্ধতি হচ্ছে, এমন একটি গল্পের খোঁজ করা, যেটির সঙ্গে বিমানের সংযোগ আছে এবং যা আপনাকে আলোড়িত করে।
২০২০ সালে, পল রুসেসাবাগিনার ওপর একটি খবর চোখে পড়ে ফ্রয়েডেনথালের। এই ব্যক্তি একজন হোটেল ম্যানেজার। “হোটেল রুয়ান্ডা” ছবির ডন চেডল নামক কেন্দ্রীয় চরিত্রটি তাকে দিয়ে অনুপ্রাণিত। দেশে ফিরে আসার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। রুসেসাবাগিনা বহু বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছিলেন এবং রুয়ান্ডা সরকারের একজন কড়া সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন। খবরটি পড়ে সাংবাদিক ফ্রয়েডেনথাল ভাবছিলেন, রুসেসবাগিনা কেন স্বেচ্ছায় একটি প্রাইভেট জেটে চড়ে দেশে ফিরতে চাইলেন। এ ভাবনা থেকেই তিনি বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেন।
পত্রিকায় দেখা ওই সংবাদ থেকে তিনি জেনেছিলেন যে, বিমানটি একটি নির্দিষ্ট তারিখে দুবাই বিমানবন্দর ছেড়েছে। ফ্লাইটঅ্যাওয়ারের সমসাময়িক ডেটা ব্যবহার করে, তিনি সেদিন দুবাই থেকে রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালি পর্যন্তি উড়ে যাওয়া সবগুলো ফ্লাইটের তথ্য যাচাই করেন। একটি বিমান যদিও রুয়ান্ডার পথে ছিল বলে তার মনে হয়েছিল, তবে বিমানটি সম্পর্কে কোনো হালনাগাদ তথ্য ছিল না। ফ্রয়েডেনথাল তখন বিষয়টি পরীক্ষার জন্য অন্যান্য ডেটাবেসে চোখ বুলাতে লাগলেন।
ফ্রয়েডেনথাল বলেন, “ডেটাবেসে যদি কোনো একটি বিমানের তথ্য না থাকে, তবে তার মানে এই নয় যে তথ্যটির অস্তিত্ব নেই… সেক্ষেত্রে অন্যান্য ডেটাবেস পরীক্ষা করুন, কারণ কিছু কিছু ডেটাবেসে হয়তো কয়েকটি বিমানের তথ্য সংগ্রহ করা হয় না, কিংবা তাদের কাছে হয়তো কিছু জায়গার জন্য পর্যাপ্ত ডেটা রিসিভার নেই, যেমন আফ্রিকার অনেক অঞ্চলের জন্য নেই।”
বিমানটি যে কিগালিতে অবতরণ করেছে সেই প্রমাণ পাওয়ার পর, তার পরবর্তী ধাপ ছিল বিমানটি মালিক কে, তা খুঁজে বের করা। এজন্য, তিনি এয়ারফ্রেমস ব্যবহার করেন। এটি “বিমানের সবচেয়ে তথ্যবহুল ডেটাবেস।”
গুগল এবং সোশ্যাল মিডিয়া ঘেটে তিনি খুঁজে বের করতে সক্ষম হন যে, ওই প্রাইভেট জেট কোম্পানি থেকে কারা বিমান ভাড়া নিয়েছেন। অবশেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, ঘটনাটি একটি অপহরণ ছিল। “পরবর্তীতে আমরা তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম, কারণ রুসেসাবাগিনা নিজেই বলেছিলেন যে, তিনি একটি মিটিংয়ের জন্য বুরুন্ডিতে যাচ্ছেন ভেবে ওই বিমানে উঠেছিলেন,” বলেন ফ্রয়েডেনথাল। তিনি আরো যোগ করেন, “এই ধরনের প্রতিবেদন তৈরির জন্য প্রাইভেট জেট কোম্পানিসহ আপনি অনেক ধরনের ছবির হদিস পেতে পারেন, যা আপনার প্রতিবেদনকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে।”
যে সব সাংবাদিকেরা বিমান নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী, এডিএস-বি এক্সচেঞ্জ, ইকারাস ফ্লাইটস, কিংবা ওপেনস্কাই নেটওয়ার্কের মতো অনলাইন ডেটাবেস ব্যবহারের পাশাপাশি অন্যান্য তথ্য প্রাপ্তির জন্য তাদের উচিৎ পাইলট এবং বিমানবন্দরের অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। “তারা অনেক খোলামেলা ও বন্ধুত্বপূর্ণ এবং আপনার অনুসন্ধানের জন্য ভীষণ দরকারী সোর্স হতে পারেন,” ফ্রয়েডেনথাল ব্যাখ্যা করেন।
কোনো জাহাজ অফলাইনে চলে গেলে কী করবেন
দক্ষতার সঙ্গে সামুদ্রিক ট্রাফিক অনুসরণ করে বাশার দীব যুগান্তকারী অনেক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।
“সাংবাদিকেরা জাহাজ চলাচল সম্পর্কিত তথ্যগুলো পর্যালোচনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর অবৈধ ও অনৈতিক কার্যক্রম উন্মোচনে সহযোগিতা করতে পারে,” দীব বলেন। জাহাজের গতিপথ অনুসরণের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘন, পরিবেশবিষয়ক অপরাধ, নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং অনৈতিকভাবে অভিবাসী নৌকাগুলোকে ফেরত পাঠানোর সঙ্গে জড়িত উপকূল রক্ষাকারী সংস্থাগুলোকেও তারা চিহ্নিত করতে পারেন।
২০২২ সালে করা দীবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে একটি ছিল সিরিয়া’স “ব্লাডি” ফসফেটস। তার অনুসন্ধানী এ প্রতিবেদনটি তুলে ধরে যে, সিরিয়ায় অবস্থিত রাশিয়ার নিষিদ্ধ একটি কোম্পানি ২০১৮ সাল থেকে কীভাবে ইউরোপের সার বাজারে বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে চলেছে।
অবাক হলেও সত্যি যে, জাহাজের গতিপথ অনুসরণ বিষয়ক অনুসন্ধানগুলো অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নির্ভর করে। অনুসন্ধানের শুরুটা হয় সিরিয়ার ফসফেট রপ্তানির প্রধান প্রবেশদ্বার তারতুস বন্দর থেকে। কোন জাহাজ বন্দরে ভিড়েছে, এর পাশাপাশি স্থানীয় এবং বিদেশী কার্গো সম্পর্কিত তথ্যগুলো বন্দরের ফেসবুক পেজ থেকে প্রকাশ করা হতো। কিন্তু ২০২০ সালে, ফেসবুক পেজ থেকে হঠাৎ করে আপডেট প্রদান বন্ধ হয়ে যায় এবং আগের পোস্টগুলোও মুছে ফেলা হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সৃজনশীল খোঁজাখুঁজি আপনাকে কার্যকর ফলাফল এনে দিতে পারে: দীব ও তার দল বন্দর কর্মীদের প্রোফাইল খুঁজে বের করেন, যাদের মধ্যে কেউ কেউ বন্দরের যে জায়গাতে সার বোঝাই জাহাজগুলো নোঙ্গর করে রাখা হয় সেখানকার ছবি শেয়ার করেছেন। এর মাধ্যমে জাহাজগুলো ঠিক কোন তারিখে বন্দরে অবস্থান করছিল, সে সব তথ্যসহ অনুসন্ধানের জন্য ভিজ্যুয়াল ব্রেড ক্রাম্বস (টুকরো টুকরো প্রমাণ) হাতে পান তারা।
জাহাজগুলোকে চিহ্নিত করতে মেরিন ডেটাবেসের দীর্ঘ তালিকা এ ক্ষেত্রে খুব একটা কার্যকরী নয়। কেননা, এ জাহাজগুলো সাইপ্রাসের কাছাকাছি এসে তাদের ট্রান্সপন্ডার (স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেডিও সংকেত আদান-প্রদানের ডিভাইস) বন্ধ করে অফলাইনে চলে যায় এবং কয়েক সপ্তাহ পরে ঠিক ওই জায়গার আশপাশে ফিরে আসে। কেননা অবৈধ ফসফেট দিয়ে বোঝাইকৃত জাহাজগুলো বিভিন্ন গন্তব্যে পণ্যটি পাচারের কাজে জড়িত থাকে।
সহযোগিতার শক্তি
ঠিক এ অবস্থায়, দীব ও তার সহকর্মীরা কাস্টমস রেকর্ডের জন্য অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিপিআর) এবং তাদের সদস্য সংস্থার কাছে ফোয়া বা তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চেয়ে অনুরোধ পাঠাতে বলেন।
কোম্পানি রেকর্ড, কর্পোরেট সোর্স, জাতীয় ডেটাবেস, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং জাতিসংঘের বাণিজ্যবিষয়ক ডেটাসহ ফোয়ার মাধ্যমে পাওয়া তথ্যগুলো নিষেধাজ্ঞা আরোপিত কোম্পানিগুলোর জটিল সাপ্লাই চেইন উন্মোচনে সহায়তা করে। হঠাৎ করে জাহাজগুলোর নিখোঁজ হওয়ার ধাঁধার সমাধানে সাংবাদিক দলটি যখন মনমতো কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলো না, তখন তারা গুগল আর্থ এবং সেন্টিনেল থেকে পাওয়া স্যাটেলাইট ছবি যাচাই-বাছাই শুরু করে। তারা স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা জাহাজের অবস্থানকে সতর্কতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করেন এবং সেগুলোর সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমের পোস্টে দেখা জাহাজের আকার ও আয়তন মিলিয়ে দেখেন। তারা এভাবে ফসফেটবাহী জাহাজগুলোর সনাক্ত করেন এবং সেগুলোর অবস্থান নিশ্চিত করেন।
সামুদ্রিক গোলকধাঁধায় ঘেরা দীবের সমুদ্রযাত্রার এ অভিযানটি শেষ হয় এক আকর্ষণীয় আখ্যানে এসে। তিনি প্রমাণ করেন যে, সীমাবদ্ধতা থাকলেও প্রচলিত পদ্ধতিগুলোকে কাজে লাগিয়ে জাহাজের গতিপথ অনুসরণ করা যেতে পারে।
জাহাজের গতিপথ অনুসরণের কিছু কৌশল:
- বন্দরে কাজ করে এমন কর্মী কিংবা জাহাজের নাবিকদের সনাক্তের চেষ্টা করুন। বাড়ি থেকে হাজার খানেক মাইল দূরে অবস্থানকারী এই নাবিকেরা প্রায়ই তাদের সামুদ্রিক জীবনের এক ঝলক সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে থাকেন, যা অনুসন্ধানের লুকোনো দিকগুলোর ওপর আলোকপাত করে।
- গুগলে জাহাজের নাম লিখে পিডিএফ ফাইল অপশন সার্চ দিয়ে আপনার ভাগ্য পরীক্ষার চেষ্টা করুন। যেমন ফাইলের ধরন: ডট পিডিএফ “জাহাজের নাম।” এভাবে খুঁজলে গুগলে সূচীকৃত জাহাজের নামযুক্ত যে কোনও পিডিএফ প্রদর্শিত হয়। এভাবে আপনি হয়তো নাবিকদের নামের তালিকা খুঁজে পাবেন, যা দেখে আপনি হয়তো নিজেই অবাক হয়ে যেতে পারেন।
- বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে #হ্যাশট্যাগ দিয়ে অনুসন্ধানের চেষ্টা করুন; শুরুটা করতে পারেন বন্দর ও জাহাজের নাম দিয়ে।
- ইকুয়েসিস ব্যবহারের চেষ্টা করে দেখুন। এখান থেকে জাহাজ এবং কোম্পানির নিরাপত্তা-সম্পর্কিত তথ্য পাবেন। জাহাজ মালিকদের খুঁজে বের করতে বা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে মোটেও ভয় পাবেন না। তবে অবশ্যই সতর্ক থাকুন, যেন আপনার অনুসন্ধান অপরিপক্ক অবস্থায় প্রকাশিত না হয়।
- নটোশার্ক ব্যবহার করে যে সামুদ্রিক রেডিও যোগাযোগ হয় সেগুলো যাচাই করুন। এখানে আপনি বিভিন্ন জাহাজের মধ্যে বিনিময় করা বার্তার প্রতিলিপি দেখতে পাবেন। প্রেরণের তারিখ বা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বার্তাগুলোকে ফিল্টার করা যায়।
প্রো টিপ: লোকেশন বা অবস্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য জানানো (লোকেশন স্পুফিং) সম্পর্কে সচেতন হোন — এ প্রযুক্তিটি ব্যবহারকারীকে তার লোকেশন সম্পর্কিত তথ্য বিকৃত করতে সাহায্য করে। তবে এটি অত্যন্ত বিরল ঘটনা।