প্রবেশগম্যতা সেটিংস

Illustration: Smaranda Tolosano for GIJN

English

ইলাস্ট্রেশন: স্মারান্ডা টোলোসানো

এই গাইডটি লিখেছেন জিআইজেএন রিসোর্স সেন্টারের পরিচালক নিকোলিয়া আপোস্টলু ও জিআইজেএনের রিপোর্টার রোয়ান ফিলিপ। সম্পাদনা করেছেন রিড রিচার্ডসন ও লরা ডিক্সন। ছবিগুলো এঁকেছেন স্মারান্ডা টোলোসানো।

বিশ্বজুড়ে দারুন সব প্রভাবশালী সাংবাদিকতার জন্ম দিয়েছে আন্ডারকভার (ছদ্মবেশ) অনুসন্ধান। যেসব দেশে সরকারি নথি প্রকাশের স্বচ্ছতা বিষয়ে কোনো বিধিমালা বা সোর্সের সুরক্ষায় কঠোর আইন নেই– সেখানে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় উন্মোচনের জন্য ছদ্মবেশ ধারণই হতে পারে রিপোর্টারের ঝুলিতে থাকা হাতে গোনা টুলের অন্যতম।

এই বিষয়টি নিয়ে অভিজ্ঞ অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের পরামর্শ এবং বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা দুর্দান্ত সব কেস স্টাডি পাবেন জিআইজেএন-এর এই গাইডে। তাছাড়া, এধরনের কাজে সাংবাদিকেরা যেসব ভুল করেন এবং ছদ্মবেশে রিপোর্ট করতে যাওয়ার আগে যেসব নৈতিক বিবেচনা অবশ্যই মাথায় রাখা উচিৎ – এখানে তাও পাওয়া যাবে। 

এই গাইডের বিভাগগুলোর মধ্যে রয়েছে: 

যে কোনো ধরনের ছদ্মবেশী বা গোপন অভিযান শুরুর আগে একজন সাংবাদিককে অবশ্যই বিনা অনুমতিতে রেকর্ডিং সম্পর্কে তাঁর দেশের আইনি ও সাংস্কৃতিক কাঠামো জেনে নিতে হবে। বিশ্বের অনেক জায়গায়, কারো অজ্ঞাতে তার গোপন ভিডিও বা অডিও ধারণের জন্য রিপোর্টারেরা মামলা, সরকারি আটকাদেশ, এবং শারীরিক হামলারও শিকার হতে পারেন।

Undercover Reporting book cover

নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ব্রুক ক্রোয়েগার “আন্ডারকভার রিপোর্টিং: দ্য ট্রুথ অ্যাবাউট ডিসেপশন” বইটির লেখক। ছবি: স্ক্রিনশট

“কাজটি ব্যয়বহুল, এ কাজে একজনকে মাসের পর মাস লেগে থাকতে হয়, মানসিক চাপ তৈরি হয়, এবং এর জন্য সব ধরনের আইনি নথিপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হয়। ফলে এধরনের কোনো কাজে নামার আগে খুব ভালোভাবে চিন্তা করে নেওয়া উচিৎ,” বলেছেন নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও “আন্ডারকভার রিপোর্টিং: ট্রুথ অ্যাবাউট ডিসেপশন” বইয়ের লেখক ব্রুক ক্রোয়েগার। “তবে, ঐতিহাসিকভাবে, এটি যখন কাজ করে, তখন এসব স্টোরির প্রভাব হয় অসাধারণ। আর আমরা এই স্টোরিগুলোই মনে রাখি।”

এরপরও, ছদ্মবেশ সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ঝুঁকিগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এবং এর জের ধরে ত্রুটিপূর্ণ রিপোর্টিং, মামলা থেকে শুরু করে গণমাধ্যমের ওপর জনগণের আস্থা কমে যাওয়া পর্যন্ত– অনেক কিছু হতে পারে। আফ্রিকা মহাদেশের অন্যতম শীর্ষ অনুসন্ধানী দল, বিবিসি আফ্রিকা আই প্রায়ই ছদ্মবেশ সাংবাদিকতার কৌশল ব্যবহার করে। দলটির কেনিয়ান পরিচালক ও প্রযোজক পিটার মুরিমি বলেছেন, আন্ডারকভার অপারেশনের সময় নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “আপনি যদি কাজটি করতে না পারেন, এবং সবাইকে সুরক্ষিত রাখতে না পারেন– তাহলে তা গোটা প্রক্রিয়াকেই বাধাগ্রস্ত করবে। কাজ শেষ হওয়ার পর আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যে আপনার হুইসেলব্লোয়ার নিরাপদে আছেন, সহযোগীরা নিরাপদ আছেন এবং কর্মীরাও নিরাপদে আছেন।”

ব্যবহারিক পরামর্শ

ছদ্মবেশ সাংবাদিকতা হলো সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের সবচেয়ে বিপজ্জনক ও কঠিন উপায়গুলোর একটি। এই কাজে যুক্ত হওয়া সাংবাদিকেরা শুধু আইনি ব্যবস্থার মুখে পড়ার ঝুঁকিই নেন না, নিজের জীবনও হুমকির মুখে ঠেলে দেন। এ কারণেই বিবিসির মতো বড় বড় সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো আন্ডারকভার কাজের সম্পাদকীয় ও রিপোর্টিং প্রক্রিয়া নিয়ে স্পষ্ট গাইডলাইন তৈরি করেছে।  

ভারতীয় সাংবাদিক অনিরুদ্ধ বাহাল ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ছদ্মবেশে অনুসন্ধান চালিয়ে গেছেন; প্রথমে, তেহেলকা ম্যাগাজিনে – তিনি যেটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন – এবং এরপর ২০০৫ সাল থেকে জিআইজেএনের সদস্য সংগঠন, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান কোবরাপোস্টে। বাহাল এটিরও প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান সম্পাদক। ২০০০ সালে ক্রিকেটারদের ম্যাচ পাতানো নিয়ে প্রথম আন্ডারকভার স্টোরির পর থেকে সাড়া জাগিয়েই চলেছেন বাহাল ও তাঁর দল। তাঁদের ছদ্মবেশী অনুসন্ধানে, সংসদে প্রশ্ন উত্থাপণের জন্য ‍ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি গোপন ক্যামেরায় ধরা পড়ার পর পদত্যাগ করতে হয়েছিল ভারতের ১১ জন সংসদ সদস্যকে। 

কিন্তু রেকর্ড বাটনে চাপ দেওয়ার অনেক আগে থেকে কোবরাপোস্টের অনুসন্ধানী দল এই বিষয়গুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে: “প্রথমত, যে মানুষগুলোর অবৈধ কর্মকাণ্ড নিয়ে আমরা কাজ করতে চাই, তাদের সেসব কাজের প্রবণতা নিয়ে সব সময়ই আমাদের কাছে আগে থেকে তথ্য থাকতে হবে। এটা কখনোই শুধু কিছু পাওয়ার আশা নিয়ে তথ্য খোঁজার মতো বিষয় হবে না। দ্বিতীয়ত, স্টোরিটি করার মতো অন্য কোনো নথিপত্রই যদি না থাকে… তখনই কেবল উপায় হবে গোপন ক্যামেরা,” বলেছেন বাহাল।

স্টোরিটি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কিনা, সেটিই বাহাল ও তাঁর দলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। তিনি জানান, “(গত ২০ বছরে) যাদের নিয়ে আমরা আমরা স্টোরি করেছি, তাদের কেউই কখনো বলেনি যে সেগুলো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ছিল না।” তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, গোপন ক্যামেরার ব্যবহার যদি পেশাদারিত্বের সঙ্গে না করা হয় তাহলে সেটি শেষপর্যন্ত রূপ নিতে পারে একটি চটকদার স্টোরিতে, ভারতে যা প্রায়ই ঘটে থাকে।

২০০০ সালের কিছুটা আগে থেকেই, ছদ্মবেশ সাংবাদিকতার ব্যাপক চল শুরু হয়। দেশটির প্রায় ৬০০ টিভি চ্যানেল থেকে অনেকেই গোপন ক্যামেরা ব্যবহার করে একাধিক স্টোরি তৈরি করা শুরু করেন। ছদ্মবেশ সাংবাদিকতা এভাবেই তার বদনাম কুড়িয়েছে বলে বাহাল বিশ্বাস করেন। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “যেনতেনভাবে করা একেকটি স্টোরি এবং কোনো কোনো সময় তাতে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও স্পষ্ট নয় – এটিই এই ক্ষেত্রের সাফল্যকে মলিন করতে শুরু করে। কিন্তু এই মুহুর্তে পেন্ডুলামটি উল্টোদিকে দুলছে। এখন গোপন ক্যামেরার ব্যবহার কেউ করে না বললেই চলে।”

আন্ডারকভার রিপোর্টিংয়ের অনুমোদন দেওয়ার আগে বিবিসি আফ্রিকা আই, সাংবাদিকদের সেটির পরিণতি নিয়ে ভালোভাবে চিন্তা করতে তাগাদা দেয়। “স্টোরিটি কি অন্য কোনোভাবে বলা যেতে পারে?”– নতুন কোনো স্টোরি আইডিয়া নিয়ে আলোচনার সময় এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেন মুরিমি। “ছদ্মবেশী সাংবাদিকতা প্রথম নয়, বরং শেষ ভরসা হওয়া উচিত… এ সংশ্লিষ্ট জনস্বার্থগুলো কী? সত্যি বলতে, জনস্বার্থ না থাকলে এর কোনো মূল্য নেই।”

অন্য যেকোনো অনুসন্ধানী দলের মতোই, তাদের পরবর্তী পদক্ষেপটি হয় একদম প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা। এটি ছাড়া, অনুসন্ধানী দলটি হয়তো এমন একটি স্টোরি নিয়ে কাজ শুরু করবে, যেটি শেষপর্যন্ত গিয়ে দাঁড়াবে চরিত্র হননে। মুরিমি জোর দিয়ে বলেন, “আপনি যে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান নিয়ে অনুসন্ধান করতে যাচ্ছেন, তারা যে সত্যিই অনৈতিক কিছু একটা করছে এবং সেটি মানুষের জানা উচিৎ– সে ব্যাপারে স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকতে হবে।”

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ: রিপোর্টিং দলের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে নিরাপদে রাখা যায় কি না তা যাচাই করা। এটির নিশ্চয়তা না পেলে বিবিসির সেই ছদ্মবেশী অভিযান বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে। কখনও কখনও দলটি রিপোর্টিংয়ে সহায়তার জন্য বাইরে থেকেও লোকজন নিয়ে আসে। সাধারণত তাদেরকেই নেওয়া হয়, যারা সংশ্লিষ্ট কমিউনিটি সম্পর্কে ভালোমতো জানেন, কিন্তু সেখানে বসবাস করেন না। ফলে স্টোরিটি প্রকাশিত হওয়ার পর, এই কাজে জড়িতদের আরও দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দেয়া যায়।

ছদ্মবেশধারী সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য একটি যোগাযোগ পরিকল্পনা থাকা জরুরি, যা প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে। বিপদের আশঙ্কা দেখলে চিত্রগ্রাহক কীভাবে কাছেপিঠে থাকা দলকে সতর্ক করবেন? এটি হয়ত নিছক একটি ফোনের সাহায্যেই করা যায়, কিন্তু বিবিসি একটি সাধারণ, ‘প্যানিক বাটন’ যন্ত্র ব্যবহার করে, যেটি তাৎক্ষণিকভাবে দলের অন্য সদস্যদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেয়, যেন তারা ঘটনা সামাল দিতে এগিয়ে আসে। 

চিত্রগ্রহণের আগে চূড়ান্ত পদক্ষেপটি হলো “স্টোরির বর্ণনাশৈলী নিয়ে কাজ করা।” মুরিমি ব্যাখ্যা করে বলেন, “আপনি কীভাবে দৃশ্যগুলো ধারণ করবেন, আপনাকে কোন কোন দৃশ্য ধারণ করতে হবে, অনুসন্ধানগত দিক দিয়ে কী কী ঘটতে হবে, এবং একইসঙ্গে চিত্রগ্রহণের বিচারে সেখানে কী কী ঘটতে হবে।”

যে কোনো অনুসন্ধানের আন্ডারকভার অংশ শুরুর আগে, সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো এবং গোপন রিপোর্টিং থেকে স্টোরি ঠিক কী পাবে, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞরা অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার পরামর্শ দেন। অলংকরণ: স্মারান্ডা টোলোসানো

বিবিসি আফ্রিকা আইয়ের আরেক নারী প্রযোজক ছদ্মবেশী সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ দিতে (তাই তিনি নামপরিচয় প্রকাশ করতে চান না) গোটা মহাদেশ চষে বেড়ান। তিনি বলেছেন, আন্ডারকভার রিপোর্টিং যতটা অন্য জগতের বলে মনে হয়, ততটা আসলে নয়। কারণ এই পদ্ধতির ৮০ শতাংশই প্রথাগত, পুঙ্খানুপুঙ্খ, সোর্স নিয়ে কাজ, কিছুটা গোয়েন্দাগিরি এবং নথিপত্র নিয়ে গবেষণার কাজ। আর শেষের ২০ শতাংশ কাজ, আপনাকে ফলাফল এনে দেয়। কিন্তু প্রথাগত কাজগুলোর মাধ্যমে যদি শক্ত একটি ভিত্তি গড়ে তোলা না হয়, তাহলে এই কৌশল কোনো কাজে আসবে না।”

বিবিসির দুই প্রযোজকই একমত যে, গোপনে চিত্রধারণের বিষয়টি ভালো কাজ করে যখন সোর্সের ওপর থেকে অভিযোগের ভার তুলে নেওয়ার প্রয়োজন হয়, এবং যখন কোনো অপকর্ম নথিভুক্ত করা কঠিন হয়, যেমন যৌন নিপীড়ন বা বর্ণবাদের ক্ষেত্রে। বিবিসি আফ্রিকা আইয়ের ডকুমেন্টারি “সেক্স ফর গ্রেড্স” ও “সেক্স ফর সেল”-এ তাঁরা ঠিক এই কাজটিই করেছেন।

আন্ডারকভার স্টোরিগুলোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে সাধারণ বিষয়: অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড অনুসন্ধান এবং এটিই সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা। নাইজেরিয়ার প্রিমিয়াম টাইমসের জন্য আফ্রিকান নারীদের ইউরোপে পাচারের বিষয়টি উন্মোচন করতে গিয়ে ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন নাইজেরীয় সাংবাদিক টোবোর ওভুরি। তিনি জিআইজেএনকে বলেছেন, ছদ্মবেশ সাংবাদিকতায় ইচ্ছুক সাংবাদিকদের কোন কোন বিষয় নিয়ে চিন্তা ও পরিকল্পনা করা উচিৎ:

প্রস্তুতি
  • কী বিষয়ে ও কাকে নিয়ে অনুসন্ধান করছেন– শুধু সেটি নয়, বরং যে প্রক্রিয়ায় আপনি আপনার রিপোর্টিং-লক্ষ্য অর্জন করবেন, তার সব কিছু নিয়ে প্রাথমিক গবেষণা করুন, এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। যেমন: আপনি কোন কোন জায়গায় যাবেন– তা নির্ধারণ করে নিন, (যদি প্রবেশাধিকার সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে) কিভাবে ভেতরে ঢুকবেন, কার সঙ্গে, কখন এবং কেন। 
  • আপনি ছদ্মবেশে রিপোর্টিংয়ে যাচ্ছেন– এই বিষয়টি দলের সদস্য ছাড়া আর কাউকে জানাবেন না,  এমনকি আপনার পরিবার, বন্ধুবান্ধব বা অন্য সহকর্মীদেরও নয়।
  • নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে অবশ্যই থাকতে হবে: একটি পালানোর পরিকল্পনা, উদ্ধারকারী দল, জরুরী অবস্থার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ, সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগের কার্যকর মাধ্যম এবং মানবপাচার চক্রের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার মতো চরম বিপজ্জনক পরিস্থিতির জন্য ট্র্যাকিং ডিভাইস। 
  • ছদ্মবেশী অভিযান শুরুর আগে আইনী পরামর্শ নিন। পরবর্তীতে কোনো সমস্যার মুখে পড়লেও হয়তো আপনার এই আইনজীবীদের প্রয়োজন হতে পারে। রিপোর্টিংয়ের ছদ্মবেশ পর্যায়টি চলাকালে তাঁদের প্রস্তুত রাখুন, কারণ জরুরি অবস্থায় তাঁদের সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে। আইনজীবীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলে আপনি বিনামূল্যে এই আইনী সহায়তা পেতে পারেন।
ছদ্মবেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে পরামর্শ
  • ওভুরি বলেন, “প্রয়োজনীয় বিভিন্ন গোষ্ঠী/ব্যক্তিকে সনাক্ত করা এবং ছদ্মবেশ রিপোর্টিংয়ের প্রক্রিয়াগুলো চিহ্নিত করার পর, সেগুলো বাস্তবে প্রয়োগের কাজে নেমে পড়ুন। আপনাকে অবশ্যই চরম গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে, এবং একইসঙ্গে সহজ-সাধারণ ও বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করতে হবে। এই খেলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি থাকুন, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কারো কাছে প্রকাশ করবেন না। অন্যদের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখুন। আপনার গতিবিধি যেন কখনোই অনুমান করা না যায়।”
  • তিনি আরও বলেন, “একটি গোপন রেকর্ডিং ডিভাইস সঙ্গে রাখুন, তবে তা যেন অবশ্যই কলম বা হাতঘড়ি না হয়, কারণ অপরাধীরা সেগুলোকে সহজেই সনাক্ত করতে পারে। নিশ্চিত করুন যে, আপনার ডিভাইসগুলোর পুরো চার্জ আছে এবং সেগুলো ভালোভাবে কাজ করছে।” 
  • “সবসময় আপনার মন যা বলে, তার ওপর আস্থা রাখুন। কখনই স্টোরি শেষ করতে মরিয়া হবেন না,” ওভুরি সতর্ক করে বলেন। “কতদূর যেতে চান, তা নির্ধারণ করুন এবং আপনার পরিকল্পনামাফিক সব কিছু হবে, তেমনটা আশা করবেন না। কাছেপিঠেই হয়তো আপনার জন্য চমক অপেক্ষা করছে।”
Lessons Learned from Working Undercover GIJN story

২০১৯ সালে পোলিশ সাংবাদিক প্যাট্রিক সেপানিয়াক তাঁর আন্ডারকভার রিপোর্টিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে জিআইজেএনের জন্য লিখেছেন। ছবি: স্ক্রিনশট

আন্ডারকভার রিপোর্টিং শেষে কেউ নিউজরুমে ফেরার পর, ওভুরি অন্য সহকর্মীদের পরামর্শ দেন যেন সবাই সেই রিপোর্টারের ওপর এই কর্মকাণ্ডের প্রভাব বিষয়ে সতর্ক থাকেন। বিশেষ করে, সম্ভাব্য মানসিক স্বাস্থ্যজনিত প্রভাব। তিনি দলকে বলে থাকেন, কেউ যেন সেই রিপোর্টারের দিকে নিয়মিত নজর রাখেন এবং সবচেয়ে ভালো হয় যদি তাঁর পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) সম্পর্কেও কিছু জানাশোনা থাকে।

 ছদ্মবেশ সাংবাদিকতার একটি প্রচলিত উদাহরণ হল খাদ্যপণ্যের ব্যবসায় অনিয়ম উন্মোচন। টিভিএন ডিসকভারি পোল্যান্ডের অনুসন্ধানী অনুষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করা পোলিশ সাংবাদিক প্যাট্রিক সেপানিয়াক এর আগে লিখেছেন কসাই ছদ্মবেশে আন্ডারকভার রিপোর্টিং করার অভিজ্ঞতা নিয়ে

সেপানিয়াকের পরামর্শ:

  • ঠিক করুন কী গল্প বলবেন। শক্ত একটা চরিত্র তখনই দাঁড়ায় যখন সেখানে সত্যি ঘটনা, আবেগ আর অতীত অভিজ্ঞতার মিশেল থাকে। আপনার নিজের স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা দিয়ে গল্পটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলুন।
  • “মিথ্যা… আমার পরামর্শ হল: কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। যে গল্প ফেঁদে ভেতরে ঢুকেছেন, সেটি একদম মুখস্ত করে ফেলুন। মনে রাখবেন, যে কেউ যে কোনো সময় ঐ বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারে। আপনার উত্তরে যেন হেরফের না হয়।”
  • “ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট।  ছদ্মবেশে কোথাও যাওয়ার আগে ইন্টারনেটে আপনার সম্পর্কে যা আছে, তা যতটা সম্ভব মুছে ফেলুন। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোফাইলগুলোও মুছে ফেলুন, সম্ভব হলে নতুন প্রোফাইল তৈরি করুন। অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার অনেক আগেই আপনাকে কাজটি করতে হবে। আমার অভিজ্ঞতা থেকেও চাইলে শিখতে পারেন: আমার নাম দিয়ে গুগলে ইমেজ সার্চ দিলে ষষ্ঠ পাতায় গিয়ে আমার প্রকৃত পরিচয়সহ একটি একটি ছবি পাওয়া যেত। সেটি আমি মুছতে ভুলে গিয়েছিলাম। এই ছবির কারণেই মধ্যরাতে কসাইখানায় ধরা পড়ে যাই। রাত তিনটায় আমাকে বসের অফিসে তলব করা হয়।”
  • “বেশভূষা বদলে ফেলুন। আপনার গল্পের সাথে মিলিয়ে নিজের বেশভূষা ঠিক করুন। চিন্তা করুন মাথা কি ন্যাড়া করে ফেলবেন, চুল ছাঁটবেন, নাকি চুলের রং বদলাবেন। ভাবুন, দাঁড়ি-গোঁফ রাখবেন, না কেটে ফেলবেন। চরিত্রের সাথে মিলিয়ে পোশাক ঠিক করুন। সেরকম পোশাক না থাকলে কিনে ফেলুন, এমনকি মোজা আর আন্ডারওয়্যারও।”
  • “ব্যক্তিত্বও বদলে ফেলুন। আপনার পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলুন। যদি সেটি একাডেমিক পরিবেশ হয়, তাহলে একজন শিক্ষকের মত আচরণ করুন। আর কসাইখানা হলে, চলুন কসাইয়ের মতই। সেটি যদি হয় কোনো অপরাধীর আস্তানা, তাহলে কথা বলুন একজন অপরাধীর মত করে।”
  • গবেষণা করুন। আপনি কোথাও যাওয়ার আগে অ্যাসাইনমেন্ট সম্পর্কে যতটা সম্ভব জেনে নিন। আমি এই কাজের জন্য লাইভলিক ও ইউটিউবে মাংস উৎপাদন শিল্পে পশুর সঙ্গে নির্মমতার প্রচুর ভিডিও দেখেছি।
  • “পরিচয় পত্র। পোল্যান্ডে পরিচয়পত্র নকল করা আইনত অপরাধ। তাই আমরা সেটা না করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। অবশ্য এর কোনো প্রয়োজনও পড়েনি।”
  • পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণ সংগ্রহ। নৈতিকতার বিচারে এটাই আন্ডারকভার, তথা ছদ্মবেশ সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ। আপনি সেখানে গেছেন অব্যবস্থাপনা বা অপরাধের প্রমাণ সংগ্রহ করতে; ঘটনাকে উস্কে দিতে নয়।

যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম

মাত্র কয়েক দশক আগে,বড় বড় সব ক্যামেরা ব্রিফকেসের মধ্যে লুকানোর জন্য নানা ফন্দিফিকির খুঁজতে হতো সাংবাদিকদের। কিন্তু এখন নিয়মিত ক্যামেরার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য রেকর্ডিং সরঞ্জামের খরচ কমেছে, আর তাদের আকারও ছোট হয়েছে। তাই আপনাকে সেগুলো লুকোনোর জন্য হাজার হাজার টাকা খরচ করতে হবে না। এখন মাত্র ১৫ ডলারেও গোপন ক্যামেরা বিক্রি হয়। এবং সেগুলো যেকোনো ক্যামেরার দোকান ও অন্যান্য সাধারণ কেনাবেচার ওয়েবসাইটেও পাওয়া যায়।

কোবরাপোস্টের বাহাল বিষয়টি খোলাসা করে বলেন, “২০০৫ সাল থেকে, (সরঞ্জাম) ছোট হতে শুরু করে।” “আমরা কী ব্যবহার করি, সে ব্যাপারে আমি সাধারণত কথা বলি না, তবে আপনি যদি ডিভাইসটি শরীরের সঙ্গে লাগিয়ে নিয়ে যান, তাহলে তল্লাসির মুখে পড়তে পারেন। আবার ডিভাইসটি অন্য কোনোখানে থাকলে সেটি আপনাকে বাইরে রেখে আসতে বলা হতে পারে। তাই এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে এবং বিবেচনা করতে হবে যে, আপনি কার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন।”

গোপন ক্যামেরা অনেক বিচিত্র ধরনের হয়ে থাকে; যেমন, সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্যামেরাটি পাওয়া যায় শার্টের বোতামের আদলে, যেটি বাজারে আছে কয়েক দশক ধরে। কিন্তু এখন সম্ভাব্য প্রায় যেকোনো জায়গাতেই ক্যামেরা লুকোনো যায়: হাতে পরার ব্যান্ড, গাড়ির চাবি, ইউএসবি, চশমা বা কলম। আপনার যদি কোনো ঘরে ক্যামেরা রেখে দিয়ে চলে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে আপনি ক্যামেরা লুকিয়ে রাখতে পারেন অ্যালার্ম ঘড়ি, এয়ার-পিউরিফায়ার, ডিভিডি কেস, এয়ার ফ্রেশনার, ল্যাম্প, বর্হিগমন পথের সাইন, এবং অবশ্যই টেডি বিয়ারের ভেতরে।

এছাড়াও আপনাকে ঠিক করতে হবে – ক্যামেরাটি ঘরের ভেতরে নাকি বাইরে ব্যবহার করা হবে; যেখানে-সেখানে সহজে সরানোর প্রয়োজন হবে কিনা; এটি কি ব্যাটারিতে চলবে নাকি সরাসরি বৈদ্যুতিক সংযোগে চলবে; নাকি জিনিসটা স্থায়ীভাবে বসানো হবে। 

কোন ক্যামেরা ব্যবহার করবেন তা ঠিক করার সময়, নিশ্চিত করুন যেন ক্যামেরার রেজ্যুলুশন কমপক্ষে ১০৮০ পিক্সেল হয়। হাই-ডেফিনিশন (এইচডি) ভিডিওর জন্য এই রেজ্যুলিউশন যথেষ্ট ভালো৷ বেশিরভাগ টিভি সম্প্রচারের জন্য এটিই আপনার ন্যূনতম প্রয়োজনীয় রেজ্যুলিউশন। কিন্তু, আপনি যে বিষয়বস্তু ক্যামেরায় ধারণ করতে চাচ্ছেন, তা যদি ক্যামেরা থেকে অনেক দূরে থাকে, তাহলে ‘ফোর-কে’ ক্যামেরা ব্যবহার করাই ভালো হবে। এতে করে আপনি হাই-ডেফিনিশন কোয়ালিটি না হারিয়ে সেই ব্যক্তিকে জুম করতে পারবেন।

আপনি যদি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র বা নিরাপত্তার পেছনে বড় অংকের টাকা খরচ করা প্রতিষ্ঠান/গোষ্ঠী নিয়ে কাজ করতে যান, তাহলে সতর্ক থাকুন। কারণ তাদের কাছে এমন পাল্টা সব গোয়েন্দা সরঞ্জাম থাকতে পারে ‍যা কোনো গোপন ক্যামেরার ওয়াইফাই সনাক্ত করে ফেলতে পারে, বা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করে যে কোনো রেকর্ডিং ডিভাইস নিষ্ক্রিয় করতে পারে। ফলে গোপন ক্যামেরা বসানোর আগে, যাদের নিয়ে অনুসন্ধানে নেমেছেন, তাদের দিক থেকে কী ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকতে পারে– তা ভালোমতো গবেষণা করে নিন। 

রিপোর্টারদের অবশ্যই আন্ডারকভার কৌশলগুলোর পরিকল্পনা সাজাতে সাবধানী হতে হবে এবং গোপন ভিডিও বা অডিও রেকর্ডিং সরঞ্জাম পরিচালনার কলাকৌশল নিবিড়ভাবে বুঝতে হবে। অলংকরণ: স্মারান্ডা টোলোসানো

নৈতিক উদ্বেগ

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডার্ট সেন্টার ফর জার্নালিজম অ্যান্ড ট্রমা-এর নির্বাহী পরিচালক এবং সাংবাদিকতার নৈতিকতা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্রুস শাপিরো উল্লেখ করেন, আইনগত ও কখনো কখনো শারীরিক ঝুঁকির পাশাপাশি নৈতিকতা ও মান-মর্যাদায়ও গভীর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে আন্ডারকভার রিপোর্টিং। তিনি সতর্ক করে বলেন, “রিপোর্টারের কাছে মনে হতে পারে, একটি দুর্দান্ত স্টোরির স্বার্থে নিজের পরিচয় বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে মিথ্যা বলা ছাড়া উপায় নেই, তবে আপনার উদ্দেশ্য বা চরিত্রের ওপর কালিমা লেপনের জন্য সেই পদ্ধতিগত ছলচাতুরিকেই আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা সম্ভব।” তিনি বলেন, “ক্রমাগত ছলচাতুরি করে যাওয়া এক ধরনের নৈতিক আপোসকামিতাও বটে, আর তাই আন্ডারকভার রিপোর্টিংয়ের আগে, চলাকালীন এবং পরে এমন কৌশল ব্যবহারে অত্যন্ত সতর্ক হতে হয়।”

আন্ডারকভার রিপোর্টিংয়ের গোটা প্রক্রিয়ায় সাংবাদিকদের কীভাবে নৈতিকতার বিষয়গুলো ভাবা উচিৎ– সেটিই তুলে ধরেছেন শাপিরো। 

আগে

যেকোনো আন্ডারকভার প্রকল্প শুরুর আগে, ব্যক্তি রিপোর্টার বা রিপোর্টিং দলের তিনটি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজা উচিত:

  • বিকল্প: আন্ডারকভার রিপোর্টিং কি সত্যিই এই স্টোরি করার একমাত্র উপায় – নাকি কেবল সবচেয়ে সুবিধাজনক বলে এই পথে যাচ্ছেন? আপনি কি ওপেন সোর্স তথ্য, সরকারি নথিপত্র, ব্যক্তি-সোর্সসহ অন্যান্য সব পদ্ধতি ব্যবহার করে ফেলেছেন? 
  • লাভ-ক্ষতি বিশ্লেষণ: স্টোরিটি কি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে এর জন্য আন্ডারকভার রিপোর্টিং পদ্ধতি বেছে নিতে হবে বা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্ভাব্য বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি মেনে নিতে হবে? 
  • ঝুঁকি মূল্যায়ন: আপনি কি আপনার দল, নিয়োগকর্তা ও সোর্সের সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে সবিস্তারে চিন্তা করেছেন? এই ঝুঁকির মধ্যে শারীরিক ও আইনী হুমকি থাকতে পারে। একইসঙ্গে যারা ছদ্মবেশ রিপোর্টিং করবেন– তাঁরা তীব্র মানসিক চাপের মধ্যে পড়তে পারেন, আপনার এই রিপোর্টিং পদ্ধতির কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর আপনি মর্যাদাহানির ঝুঁকিতে পড়তে পারেন, এবং আপনার সোর্সের ওপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা থাকতে পারে।
চলাকালীন

অনুসন্ধানে আপনি একা কাজ করুন বা দলে, ছদ্মবেশ সাংবাদিকতা সব ক্ষেত্রেই অত্যন্ত চাপের কাজ। এবং নৈতিকতা সংক্রান্ত নানা চ্যালেঞ্জের কারণে শেষপর্যন্ত ছদ্মবেশে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি কমই নেওয়া হয়। শাপিরো ব্যাখ্যা করে বলেন, ছদ্মবেশের ভূমিকা ঠিকঠাক চালিয়ে যাওয়া, জানাজানি হওয়ার ভয় এবং প্রতিদিনকার রিপোর্টিং সংক্রান্ত যোগাযোগ বজায় রাখা– সব মিলিয়ে এটি ব্যাপক মানসিক চাপের বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে।

  • ছদ্মবেশে রিপোর্টিংয়ের গোটা সময়জুড়ে আপনার কী ধরনের সহায়তা দরকার হবে (আইনী, কারিগরী, সম্পাদকীয় বা মনোসামাজিক)?
  • আপনি কীভাবে জানবেন কখন এ কাজ থেকে বেরিয়ে আসার সঠিক সময়, এবং বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে বা অন্যান্য ঝুঁকির আশঙ্কা আঁচ করতে পারলে আপনার জরুরি পরিকল্পনা কী হবে?
  • ছদ্মবেশে রিপোর্টিংয়ের সময় কোনো বিশ্বস্ত সহকর্মী বা আপনার সম্পাদকের সঙ্গে নিয়মিত বিষয়গুলো আলোচনা করা, এবং প্রাত্যহিক রিপোর্টিংয়ের কঠিন সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে কথা বলা জরুরী। ছদ্মবেশী রিপোর্টিংয়ে দায়িত্ব ভাগাভাগির বিষয়টি থাকা আবশ্যক।
পরে

ছদ্মবেশে রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়। ফলে চূড়ান্ত প্রতিবেদনটিতে পাঠক-দর্শকের কাছে ব্যতিক্রমী, এমনকি চরমমাত্রায় স্বচ্ছতা বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। “আপনি কেন ছদ্মবেশ ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং কী ধরনের পদ্ধতি-কৌশল ব্যবহার করেছেন– সব কিছু পুরোপুরি ব্যাখ্যা করুন। বেনামী সোর্সের যেনতেন ব্যবহার এড়িয়ে তথ্যসূত্রের উল্লেখ বাড়ান। নথি ও ওপেন সোর্স উপকরণে হাইপারলিঙ্ক ব্যবহার করুন। এমন কোনোই ফাঁক রাখবেন না, যা দিয়ে আপনার সম্মান ও বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর আঘাত হানা যায়,” বলেছেন শাপিরো। 

শাপিরো একা নন, সাংবাদিকতার নৈতিকতা সংক্রান্ত প্রায় সব জায়গাতেই গণমাধ্যম-কর্মীদের বলা হয় তাদের রিপোর্টিং প্রক্রিয়া সম্পর্কে সৎ ও স্বচ্ছ থাকতে, এবং যে কোনো ধরনের ছলচাতুরি এড়িয়ে চলতে।

সাংবাদিকতাসুলভ ছলচাতুরির ওপর এত বিধিনিষেধই তুলে ধরে, গোপন রিপোর্টিংয়ের সঙ্গে কতটা বাস্তব ঝুঁকি  জড়িত এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে মূলধারার পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে, এ ধরনের চর্চা কেন এতটা নিন্দিত হয়ে উঠেছে। গণমাধ্যম গবেষকেদের মতে ছদ্মবেশ সাংবাদিকতার সন্দেহজনক ভাবমূর্তির জন্য দায়ী: মুখরোচক ট্যাবলয়েড পত্রিকার গোপন ক্যামেরা কার্যক্রম, ক্রমবর্ধমান অনভিজ্ঞ সংবাদমাধ্যমের বেপরোয়া ঝুঁকি গ্রহণ, ফাঁদে ফেলার বিরল ঘটনা, কিছু দেশে এর ব্যাপক ব্যবহার এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এসব প্রযুক্তির অপব্যবহার। গণমাধ্যমের ওপর জনগণের আস্থা কমে যাওয়ার পেছনে এই সব কিছুও অংশত দায়ী। 

গোপন সাংবাদিকতার গুরুত্ব

নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতার অধ্যাপক ব্রুক ক্রোয়েগার তাঁর “আন্ডারকভার রিপোর্টিং: দ্য ট্রুথ অ্যাবাউট ডিসেপশন,” বইয়ে দাবি করেছেন, এ ধারার সাংবাদিকতার চর্চাকে অন্যায়ভাবে অপবাদ দেয়া হয়েছে এবং বাস্তবে, গত ১৫০ বছরে জবাবদিহি সংক্রান্ত প্রভাবের বিচারে এটি অন্য সব ধারার সাংবাদিকতাকে ছাড়িয়ে গেছে।

নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরির সহযোগিতায়, ক্রোয়েগারের গবেষণা এখন পরিণত হয়েছে  শত শত প্রভাবশালী “গোপন অনুসন্ধান”-এর একটি আর্কাইভে – আন্ডারকভাররিপোর্টিং ডট ওআরজি – যা মূলত উত্তর আমেরিকার কাজগুলোতেই জোর দেয়।

ক্রোয়েগার বলেন, দায়িত্বশীল ছদ্মবেশ সাংবাদিকতা বিরলই হওয়ার কথা। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি আরও বিরল হয়ে পড়েছে – এবং প্রায়ই এগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয় ভুল সব কারণে। ফলে জনগুরুত্বপূর্ণ এমন অনেক বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান অধরা থেকে যায়– যেগুলো আর অন্য কোনোভাবেই করা সম্ভব হয় না। তবে তিনি এটি যোগ করেছেন যে, বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে নিপীড়ন ও শোচনীয় শ্রম পরিস্থিতি উন্মোচনে এ ধরনের রিপোর্টিং বেশ কার্যকর।

তিনি পাঁচ ধরনের গোপন-রিপোর্টিংয়ের বর্ণনা দিয়েছেন এবং বলেছেন, এদের প্রতিটির জন্য বিভিন্ন স্তরের নৈতিক ও আইনী যাচাই-বাছাই প্রয়োজন পড়ে।

১. ভোক্তাকেন্দ্রিক সাংবাদিকতা। ক্রোয়েগার বলেন, ভোক্তারা যে ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন, একজন সাংবাদিকও যদি সেটির পুনরাবৃত্তি করতে চান– তাহলে সেখানে কোনো নৈতিক বাধা নেই। যেমন, অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া হচ্ছে কিনা– তা যাচাই করতে গিয়ে সাংবাদিকেরা একটি গাড়ি মেরামতের জন্য বলতেই পারেন। প্রতিবেদনটি প্রকাশের আগে স্বাভাবিক সাংবাদিকসুলভ মতামত দেওয়ার অধিকার-এর নীতিই প্রযোজ্য হবে, কিন্তু এ নিয়ে কোনো বিশেষ যাচাই বাছাইয়ের প্রয়োজন নেই৷

২. আড়িপাতা। ক্রোয়েগার বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের কোনো বেফাঁস মন্তব্যকে একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থ বিষয়ক প্রতিবেদনের জরুরী অংশ হিসেবে দেখাতে পারলে, তাদের কথোপকথন শুনতে – এবং কথা শোনা যাওয়ার মত দূরত্বে যেতে – ছদ্মবেশ নেওয়া ন্যায্যতা পেতে পারে। এক্ষেত্রে কোনো রেকর্ডিং যন্ত্র ব্যবহৃত হলে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের প্রাইভেসি সংক্রান্ত আইনকানুন ভালোভাবে বুঝে নেওয়া জরুরী। সোর্সকেও তার মতামত স্পষ্ট করা বা ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেয়া উচিত এবং উদ্ধৃতিগুলো কীভাবে সংগৃহীত হয়েছিল সে ব্যাপারে দর্শককে জানানো উচিত।

৩. গণখাতের প্রতিষ্ঠান। সাধারণ একজন মানুষ যেসব জায়গায় যেতে পারেন, সাংবাদিকেরাও সেসব জায়গায় স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারেন। তবে ক্রোয়েগার বলেন, কখনও কখনও চ্যালেঞ্জ এড়াতে ও কোনো প্রতিষ্ঠানে বেশি সময় কাটাতে সাংবাদিকদের সুক্ষ্মভাবে ছদ্মবেশ ধরতে হয়। এই পরোক্ষ কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে জনসমক্ষে নিজেদের রিপোর্টার পরিচয় প্রকাশ্যে না আনা, প্রেস ব্যাজ এড়ানো, এবং নিজের সম্পর্কে সূক্ষ্ণভাবে ভুল ধারণা দেওয়া। যেমন ক্লিপবোর্ড নিয়ে ঘোরা বা অন্যান্য নিয়মিত কর্মী-দর্শনার্থীর মতো পোশাক পরা। তবে তিনি এসব ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের সক্রিয়-প্রতারণা এড়ানোর ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন, সাদা অ্যাপ্রোন পরা ও স্টেথোস্কোপ নিয়ে বেড়ানো, বা কোনো নির্দিষ্ট প্রতীক, ট্যাটু, বা দলের সমর্থক বা সদস্য হিসেবে সনাক্ত করা যায়- এমন চিহ্ন ধারণ করা। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এমন কাজে সাংবাদিকদের সরাসরি জিজ্ঞাসা করা হলে বা চ্যালেঞ্জ করা হলে অবিলম্বে নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় স্বীকার করা উচিত। ক্রোয়েগার বলেন, এই ধরনের রিপোর্টিং পদ্ধতিতে সম্পাদক ও বাইরের কোনো পরামর্শকের সঙ্গে বসে নৈতিক ও কৌশলগত আলোচনা করা উচিত।

৪. গোপন ক্যামেরা-নির্ভর প্রকল্প। ক্রোয়েগার বলেন, ভিডিও করার আগে ও পরে গোপন ক্যামেরা ব্যবহারের সঙ্গে জড়িত আইনী ও নৈতিক বিষয় নিয়ে পরামর্শ করা উচিত এবং যথেষ্ট পরিমাণ প্রথাগত রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে সেখান থেকে পাওয়া তথ্যপ্রমাণগুলোর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা উচিৎ। 

৫. গভীর ছদ্মবেশ। ক্রোয়েগার মনে করেন, মিথ্যা অজুহাতে বা পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে চাকরি নেওয়া, বা অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডে ভূমিকা পালনকারী হিসেবে পরিচয় দেয়ার ক্ষেত্রে – বিশেষ করে কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার ভান করার ক্ষেত্রে- সবসময় সতর্ক পরিকল্পনা, এবং প্রতিটি পর্যায়ে ব্যাপক আইনী, নৈতিক, ও নিরাপত্তা যাচাই করা আবশ্যক। কাঙ্ক্ষিত তথ্যগুলো সংগ্রহ করার অন্য কোনো পথ খোলা থাকলে অবশ্যই সেসব বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিৎ।

ক্রোয়েগার জানান, মানসম্পন্ন আন্ডারকভার রিপোর্টিংয়ে বিশেষ করে নারী রিপোর্টারেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। সবচেয়ে খ্যাতি কুড়ানো নেলি ব্লাই ১৯ শতকের শেষের দিকে নিউইয়র্কের একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে মানসিক রোগী হিসাবে ভর্তি হয়ে সেখানকার প্রাতিষ্ঠানিক বর্বরতা উন্মোচন করেছিলেন।

মূলনীতি
  • প্রথমত, কারো ক্ষতি করবেন না। ক্রোয়েগার বলেন, আন্ডারকভার কাজের জন্য কমিউনিটির সদস্যরা কোনো ঝুঁকির মুখে পড়বেন না বা তাদের গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবায় বিঘ্ন ঘটবে না – এটি সাংবাদিকদেরই নিশ্চিত করতে হবে। যেমন: তিনি বলেন, (রোগী সাজতে গিয়ে) রিপোর্টারদের কোনো মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বা বয়স্ক সেবা কেন্দ্রের বিছানা আটকে রাখা উচিত নয়, যদি সেই বিছানাটি সত্যিই কারো সেবার জন্য প্রয়োজন হয়।
  • কখনো আইন ভাঙবেন না। সাংবাদিকদের আগে থেকেই তাদের প্রকল্পের আইনী বিপদ সম্পর্কে জানতে হবে এবং আইনী জায়গাগুলো মাথায় রেখে রিপোর্টিং কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
  • চেষ্টা থেকেই বিশ্বাস আসে। ক্রোয়েগার বলেন, রিপোর্টাররা যে প্রকল্পগুলোতে পরিস্থিতি বোঝার জন্য সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন, সেগুলো সাধারণত সংক্ষিপ্ত গোপন ক্যামেরা অভিযানের চেয়ে বেশি শ্রদ্ধা কুড়িয়েছে।
  • সরাসরি মিথ্যা এড়িয়ে চলুন – বিশেষ করে লিখিত অবস্থায় থাকা কোনো মিথ্যা, বা এমন কোনো নথি যেখানে স্বাক্ষরের প্রয়োজন হয়। ক্রোয়েগার বলেছেন, যেখানে অনেক বড় জনস্বার্থ বিষয়ক তথ্য পাওয়াটা জরুরি, সেখানে “চালাকি” ও অন্যান্য ধরনের ছলচাতুরি মেনে নেয়া যায়। তিনি পরামর্শ দেন, “তবে আপনার একেবারে ডাহা মিথ্যা এড়ানো উচিত।” 
  • আন্ডারকভার রিপোর্টিং প্রকল্প, এর গ্রহণযোগ্য কৌশল এবং কী কী প্রকাশ করা হবে– এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বাইরের উপদেষ্টাদের সঙ্গে পরামর্শ করুন। আপনার রিপোর্টিং টিমের একাধিক সম্পাদক, আইনজীবী এবং আপনার প্রতিষ্ঠানের বাইরের অন্য স্বাধীন উপদেষ্টা নিয়ে গঠিত একটি বোর্ড এক্ষেত্রে বেশ কাজের হবে। তিনি বলেন, “এই কাজের সঙ্গে একেবারেই সম্পর্ক নেই– এমন কিছু মানুষ প্রয়োজন হবে আপনার কাজকে সোজাসাপ্টা ও সীমাবদ্ধ করে রাখতে।”
  • অতীতের ছদ্মবেশ সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার আলোকে এমন বিষয় সম্পর্কে সবাইকে জানান, যেগুলো থেকে কোনো আলাদা, ডেটা-ভিত্তিক প্রতিবেদন হতে পারে। ক্রোয়েগার বলেন, মার্কিন হাসপাতালে অন্য একটি সুরক্ষাজনিত ইস্যু নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে ছদ্মবেশ নেওয়া এক সাংবাদিক জালিয়াতির প্রমাণ খুঁজে পান। সেটি নিয়ে পরে আলাদা প্রতিবেদন হয়। “[সেই সমস্যাটি] প্রত্যক্ষভাবে না দেখলে আপনার হয়তো সেসব নথিপত্র চাওয়ার কথা মাথাতেও আসত না।”   

সাফল্যের কেস স্টাডি

  • কিডন্যাপার্স অ্যাসোসিয়েশন (২০২১ – ইউক্রেন): মারিয়া গরবান ও অলাভজনক সংবাদমাধ্যম স্লিডস্টভো ডট ইনফোর সাংবাদিকেরা নাগরিকদের অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন। অভিযোগটি ছিল: পুর্নবাসন কেন্দ্রে কয়েকশ ডলার দিয়ে আত্মীয়স্বজনেরা তাদেরকে মাদকাসক্ত দাবি করলে কেন্দ্রগুলো কোনো বাছবিচার ছাড়া তাদেরকে ধরে নিয়ে কেন্দ্রে আটকে রাখত। স্লিডস্টভোর সাংবাদিকরা ইউক্রেন জুড়ে এমন ৫০টি কেন্দ্রের মধ্যে দুটিতে গোপনে গিয়েছিলেন এবং আত্মীয় পরিচয় দিয়ে পরিবারের একজন সদস্যকে জোর করে পুনর্বাসন কেন্দ্রে আটকে রাখতে চেয়েছেন।
  • সাইকোলজিস্টস লিঙ্কড টু ইউএস আল্ট্রা- কনজারভেটিভ অর্গানাইজেশন্স প্রোভাইড ‘থেরাপি’ ফর হোমোসেক্সুয়ালিটি ইন কোস্টা রিকা (২০২১ – কোস্টারিকা): ওপেনডেমোক্রেসি ও রেডিওমিসোরাস ইউসিআর-এর সাংবাদিকেরা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি মৌলবাদী খ্রিস্টান সংগঠনের কোস্টারিকান দপ্তরের আয়োজনে অনলাইন “কনভার্সন থেরাপি” সেশন অনুসন্ধানের জন্য ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন। 
  • “অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন” (২০২১ – বাংলাদেশ): আল জাজিরার অনুসন্ধানী দল বাংলাদেশের সরকারের সর্বোচ্চ স্তরে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে একজন হুইসেলব্লোয়ারের সঙ্গে কাজ করেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, এমন একজনের কথোপকথন রেকর্ড করতে দলটি হুইসেলব্লোয়ারকে গোপন ক্যামেরা দিয়েছিল। অনুসন্ধানটি ২০২১ সালে ডিগ পুরস্কার জিতেছে।
  • দাসের ছদ্মবেশে সাংবাদিক (২০২০ – উগান্ডা): উগান্ডার একজন নারী সাংবাদিক নিউ ভিশন পত্রিকার জন্য রিপোর্টিং করতে গিয়ে ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন। এবং তাঁকে দুবাইয়ে কাজের জন্য নিয়োগ দিয়েছিল একটি নিয়োগ কোম্পানি। তিনি সেখানে গিয়ে অভিবাসীদের সঙ্গে দুর্বব্যস্থাপনা ও আধুনিক দাস ব্যবসার বিষয়গুলো প্রত্যক্ষভাবে দেখেছেন এবং সেগুলো নিয়ে তাঁর পডকাস্টে রিপোর্ট করেছেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল: আফ্রিকা থেকে যারা এই তেল-সমৃদ্ধ আরব দেশগুলোতে পাড়ি জমানোর কথা ভাবছে– তাদেরকে এই ভ্রমণের ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করা।
  • “এক্সপোজিং এ লাইসেন্সড প্রিডেটর” (২০২১ – ঘানা): ঘানার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অলাভজনক প্রতিষ্ঠান দ্য ফোর্থ এস্টেট এবং আন্ডারকভার রিপোর্টার মানাসেহ আজুর আউনি গোপনে একজন চিকিৎসকের ভিডিও ধারণ করেছেন। এই চিকিৎসক তার নিবন্ধিত পেশার সুযোগে প্রজনন চিকিৎসা ও চিকিৎসা সাহায্যপ্রার্থী নারীদের যৌন নিপীড়ন করতেন৷ স্টোরিটি প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি আটক হয়েছেন ও স্বীকারোক্তি দিয়েছেন
  • এ লেবার অব হিদারটু আনটোল্ড পেইন (২০২১ – কেনিয়া): রিপোর্টার নাইপানোই লেপাপা কয়েক মাস ধরে ছদ্মবেশে ছিলেন। এই সময়ে তিনি একজন মা হিসেবে গর্ভাশয়-ভাড়া দিতে পারেন (সারোগেট) এমন একজনকে খুঁজে পেতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। এবং পরবর্তীতে, সম্ভাব্য পিতামাতার জন্য নিজের গর্ভ ভাড়া দিতে ইচ্ছুক– এমন একজন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। প্রতিবেদনটি কেনিয়ার অনলাইন মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম, দ্য এলিফ্যান্ট-এ প্রকাশিত হয়েছিল। নাইপানোইয়ের অনুসন্ধানে “সারোগেটদেরকে জবরদস্তি, শোষণ ও ভয়ভীতি প্রদর্শন, সারোগেট মা ও শিশুদের কথিত মানব পাচার, জোরপূর্বক গর্ভপাত, এবং পরিচয় জালিয়াতি ও প্রতারণার” দাবিগুলো উন্মোচিত হয়েছে৷
  • “আন্ডারকভার: ইনসাইড চায়না’স ডিজিটাল গুলাগ (২০২০ – চীন): চীনের মুসলিম সংখ্যালঘু, উইঘুর জনগোষ্ঠীর মানুষদের ক্রমাগত নজরদারির আওতায় রাখতে কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করা হয়– তা নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য ফ্রন্টলাইন-এর এই তথ্যচিত্র নির্মাতারা কাজ করেছেন পার্শ্ববর্তী দেশ কাজাখস্তান থেকে। তাঁরা ছদ্মবেশী প্রক্সি রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার জন্য চীনের এক ব্যবসায়ীকে নিয়োগ দিয়েছেলেন। কারণ চীনে বিদেশীদের সব সময় চোখে চোখে রাখা হয় এবং উইঘুরদের ওপর নজরদারি করা হয়।” 
  • “বিট্রেইং দ্য গেম, (২০১৮ – কেনিয়া): আফ্রিকার সুপরিচিত আন্ডারকভার রিপোর্টার আনাস আরেমেয়াও আনাস কাজ করেন বিবিসি আফ্রিকা আইয়ে। কেনিয়া ও পশ্চিম আফ্রিকার ফুটবলে দুর্নীতি উন্মোচনের জন্য তিনি দুই বছর ধরে ছদ্মবেশ নিয়ে রিপোর্টিং চালিয়ে গেছেন। তিনি পুরো অঞ্চলজুড়ে ম্যাচ পাতানোয় সহায়তার জন্য ১০০ জন ফুটবল কর্মকর্তার নগদ ঘুষ গ্রহণের দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করেছেন।
  • ইনসাইড এ ‘সিক্রেট অ্যাবরশন ক্লিনিক’ অন হোয়াটস অ্যাপ (২০১৮ – ব্রাজিল):  বিবিসি নিউজ ব্রাজিলের এই অনুসন্ধানী দল পাঁচ মাস ধরে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে জায়গা করে নিয়েছে এবং নিরবে সেখানকার কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করেছে। এই গ্রুপে গর্ভপাতের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত সরঞ্জামের কেনাবেচা হয় এবং বৈধ গর্ভপাতের সুযোগ নেই– এমন নারীদের এ বিষয়ে নানা পরামর্শ দেওয়া হয়। দলটির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে এই গ্রুপের অ্যাডমিনদের কোনো চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ নেই, এবং রিপোর্টারদের নেয়া সাক্ষাৎকারে ডাক্তাররা বলেছেন, এই পদ্ধতি জীবননাশীও হতে পারে।
  • গুত দো এডিশন্স, নিয়মিত ফরাসী ভাষায় ছদ্মবেশী অনুসন্ধান প্রকাশ করে, যেমনটি তারা করেছে ফ্রান্সের পুলিশদের মধ্যে বর্ণবাদ ও সহিংসতার প্রবণতা নিয়ে এই প্রতিবেদনে। আর পর্ন ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে আরেক প্রতিবেদন এই খাতে “সম্মতির বালাই না থাকা, শ্রম আইনের অবমাননা, ও মানব মর্যাদার পরিপন্থী নানা চর্চা” উন্মোচন করেছে। 
  • মাই ফোর মান্থস অ্যাজ এ প্রাইভেট প্রিজন গার্ড (২০১৬ – যুক্তরাষ্ট্র): গোল্ডস্মিথ পুরস্কারজয়ী এই অনুসন্ধানে মাদার জোনসের রিপোর্টার শেন বাওয়ার লুকিয়ে লুইজিয়ানা রাজ্যের একটি গোপন কারাগারের ভেতরে গিয়েছিলেন। সেখানে থাকাকালীন, তিনি ব্যাপক নিপীড়ন ও অব্যবস্থাপনার নজির নথিভুক্ত করেছেন। এই ফাঁসকাণ্ডের পরপরই, ব্যক্তিমালিকানার কারাগার ব্যবহার বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে সেখানকার বিচার বিভাগ।
  • আন্ডারকভার ইন টেম্প ন্যাশন (২০১৭ – কানাডা): এই প্রতিবেদনে টরন্টো স্টারের সারা মোজতেহেদজাদেহব্রেন্ডন কেনেডি পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেকিং কোম্পানিগুলোর ভেতরকার দৃশ্য এবং অস্থায়ী কর্মীদের ওপর তাদের ব্যাপক নির্ভরতার কথা। এই অস্থায়ী কর্মীরা অনিরাপদ শ্রম পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করে যান; তাদের খুবই কম বা কোনো প্রশিক্ষণ নেই; এবং তাদেরকে খুবই অল্প বেতন দেওয়া হয়।

টরন্টো স্টারের এক রিপোর্টার অনিরাপদ শ্রম পরিস্থিতি, প্রশিক্ষণের অভাব ও কম বেতনের বিষয় নথিভুক্ত করতে ছদ্মবেশে অস্থায়ী কর্মী হিসেবে একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেকিং প্ল্যান্টে গিয়েছিলেন। ছবি এঁকেছেন: স্মারান্ডা টোলোসানো

সতর্কতা কেন জরুরী

অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের ছদ্মবেশে যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া উচিত, কারণ তাঁরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারেন, বা সংবাদমাধ্যমসহ নিজেরা ব্যয়বহুল মামলার মুখে পড়ে যেতে পারেন। অনেক দেশেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার চেয়ে প্রাইভেসির অধিকারকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। 

  • মন্টিনিগ্রোতে, অনুসন্ধানী সাংবাদিক জোভো মার্টিনোভিচ বলকানে অস্ত্র পাচারের স্টোরি নিয়ে ছদ্মবেশে কাজ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ১৫ মাস জেল খেটেছেন। পরে তাঁকে মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। মার্টিনোভিচ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। আগেই তিনি কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস-কে জানিয়েছিলেন যে, তিনি মনে করেন, তাঁর রিপোর্টিংয়ের কারণেই এই ধরনের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে
  • ১৯৯০ দশকের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনায়, এবিসি নিউজের রিপোর্টারেরা মুদিপণ্যের মার্কিন চেইনশপ ফুড লায়নে নিয়োগ পেতে মিথ্যা জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁরা দোকানে মেয়াদোত্তীর্ণ মাংসের অব্যবস্থাপনা ও পুনরায় মোড়কজাত করার ভিডিও ধারণ করেছিলেন। তাঁদের রিপোর্ট প্রকাশের পর এই চক্রের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, যা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার একটি যুগান্তকারী মামলা হিসেবে বিবেচিত হয়। টিভি নেটওয়ার্কটির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগগুলো শেষ পর্যন্ত বাতিল করা হয়। কিন্তু এই ছদ্মবেশী রিপোর্টিং পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত প্রযোজকদের দোষী সাব্যস্ত করা হয় অনুপ্রবেশের দায়ে এবং লাখ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণের আদেশ দেওয়া হয়। অবশেষে, একটি ফেডারেল আপিলে আদালত সেই রায়ের কিছু অংশ পাল্টে দেয় এবং জরিমানার অঙ্ক কমিয়ে দেয়। 
  • ছদ্মবেশে রিপোর্টিং করতে গিয়ে সাংবাদিকদের ভারি মানসিক বিপর্যয়ও সামলাতে হতে পারে, যেমনটা হয়েছিল ভারতের অনলাইন ওয়েবসাইট দ্য কুইন্টের ক্ষেত্রে। এর সাংবাদিকেরা গোপনে এক ভারতীয় সৈনিকের ভিডিও ধারণ করেছিলেন, যেখানে অভিযোগ ছিল: তাঁকে তাঁর এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বাড়িতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর সেই সৈনিক আত্মহত্যা করেন। পয়েন্টারের এই সাংবাদিকসুলভ বিশ্লেষণে উপসংহার টানা হয়েছে এই বলে যে, ভারতীয় সৈন্যেরা ঊর্ধ্বতনদের জন্য ছোটখাটো ঘরের কাজ করে – যা কমবেশি সবাই জানে। ফলে একজন সৈনিকের অভিজ্ঞতা আলাদা করে তুলে ধরায় ইস্যুটির কোনো অগ্রগতি হয়নি এবং এটির প্রয়োজন ছিল না। 

মাঠপর্যায়ের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা

লিখেছেন, রোয়ান ফিলিপ

দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৫ বছর সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করে আমি মাত্র চারটি ছদ্মবেশী অনুসন্ধানে অংশ নিয়েছি। আর তার তিনটিতেই বড়সড় ভুল করেছি, সব ক্ষেত্রেই আমি কাজগুলো করছিলাম তাড়াহুড়ো করে। এমন কিছু ভুল নিউজরুমগুলোতে প্রায়ই হয়ে থাকে এবং চাইলেই সেগুলো এড়ানো যায়। 

ছদ্মবেশী অভিযানে তাড়াহুড়া করবেন না

একটি ঘটনায় জোহানেসবার্গে এক সন্দেহভাজন মানব পাচারকারীর মুখোশ উন্মোচন করতে সম্ভাব্য ক্রেতা সেজে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমাকে সম্মতি দেন আমার বার্তা সম্পাদক। অপ্রত্যাশিতভাবে লোকটি ঐ রাতেই দেখা করার প্রস্তাব দেয়, এবং ছদ্মনাম ব্যবহার করায় আমিও তাতে সায় দিতে চাপ বোধ করি। তাই কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়াই আমি বেরিয়ে পড়ি তাড়াহুড়া করে। সাক্ষাত শেষে তাঁর নিজস্ব পুল হল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়, তিনি আমার কাছে ল্যান্ডলাইন নম্বর চেয়ে বসেন। আতঙ্কিত হয়ে, আমি আগেপিছে না ভেবে আমার বার্তাকক্ষের একটি লাইনের নম্বর দিয়ে ফেলি, যেটি সরাসরি ভয়েসমেইলে চলে যায়। লোকটি শান্তভাবে আমার দিকে তাকিয়ে এবং আমাকে হতচকিত করে দিয়ে বলে ওঠে, নম্বরটির প্রিফিক্স সে চিনতে পেরেছে — কারণ এটি আমার সংবাদপত্রের সুইচবোর্ড নম্বর! তার সাঙ্গপাঙ্গদের শারীরিক হামলার ভয়ে, আমি সঙ্গে সঙ্গে উল্টো দিকে দৌড়ে রাস্তায় পালিয়ে গিয়েছিলাম। ফলে স্টোরিটিও সেখানেই শেষ হয়ে যায়।

যা শিখেছি:

  • পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজনীয় সময় নিন – আর যাকে নিয়ে অনুসন্ধান করছেন, তার হাতে যেন আপনার অনুসন্ধানের কর্তৃত্ব না যায়। 
  • কাউকে ফোন নম্বর বলার প্রয়োজন হলে একটি বার্নার ফোন বা গুগল ভয়েস নম্বরের কথা উল্লেখ করুন, কখনোই নিজের নম্বরটি নয়। 
বিকল্প হিসেবে প্রচলিত পদ্ধতির কথা বিবেচনা করুন

দ্বিতীয় ঘটনায়, আমার সংবাদপত্র স্থানীয় একটি ক্যাসিনো নিয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। ক্যসিনোটি তাদের লিখিত নীতিমালার তোয়াক্কা না করে, স্কুল চলাকালীন জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তিদের সন্তানদের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে যাওয়ার সুযোগ করে দিত। সোর্সদের দাবি ছিল: শিশুদের সপ্তাহে সাত দিন পর্যন্ত ছোট কেয়ার সেন্টারে রেখে যাওয়া হত, অনেক শিশুকে দেখভালের লোক ছাড়াই ঘোরাঘুরি করতে এবং মেঝেতে ঘুমাতে দেখা যেত, এমনকি অনেককে পার্কিং লটে গাড়িতে রেখে যাওয়া হত। ক্যাসিনোর নিয়োগকারী ব্যবস্থাপকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময়, দিনের বেলার কাজের ব্যাপারে ইচ্ছা করেই অনীহা দেখানোর পর, আমাকে চাইল্ড কেয়ার সেন্টারে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে আমি কয়েক সপ্তাহজুড়ে ১০টি সন্ধ্যা কাটিয়েছি। এবং অনেক অভিযোগ ও অযত্ন-অবহেলার বিষয়গুলো প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি। এখান থেকে তৈরি হওয়া প্রতিবেদনটি বেশ প্রভাব ফেলেছিল। ক্যাসিনোর নির্বাহীরা এসব ফলাফল নিয়ে তর্কে জড়াননি, এবং তারা তাদের শিশু যত্নের নীতি সংশোধন করতে এবং নতুন সামাজিক কর্মসূচিতে অর্থায়ন করতে রাজি হয়। কিন্তু দ্রুতই নতুন কিছু সমস্যার উদ্রেক হয়। আমাদের স্টোরিটি পাঠকদের কাছে আমার আন্ডারকভার কাজ সম্পর্কে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং অনেক ক্ষেত্রে আমরা যথাযথ তথ্যসূত্র ব্যবহার করতে পারিনি। অনেক দেরিতে হলেও আমরা বুঝতে পেরেছিলাম: এই কাজের জন্য ছদ্মবেশী অনুসন্ধানের প্রয়োজন ছিল না। আমি সম্ভবত প্রাক্তন কর্মচারী, ক্যাসিনোর সিসিটিভি ফুটেজ, বা অভিভাবকদের আগের অভিযোগগুলো নিশ্চিত করার মতো অভ্যন্তরীণ নথি খুঁজে পেতে পারতাম। 

যা শিখেছি:

  • কোনো আন্ডারকভার প্রকল্প শুরুর আগে, আরও একটি টিম মিটিং করুন এবং যথাসময়ে আপনার প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের একমাত্র উপায় যে আন্ডারকভার রিপোর্টিং – এই দাবি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করুন।
  • শিশু, ভুক্তভোগী বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আন্ডারকভার কাজের চিন্তাভাবনা করলে আপনার রিসোর্স-পরিকল্পনা এবং নৈতিক ও আইনী বিষয়গুলো নিয়ে বিচার-বিবেচনার পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিন। 
  • পাঠক-দর্শকের সঙ্গে সবসময় স্বচ্ছতা বজায় রাখুন। তাদেরকে জানান যে কিভাবে আপনি কোনো একটি জায়গায় প্রবেশ করেছেন এবং কেন। 
প্রতিবেদন প্রকাশের ক্ষেত্রে স্কুপের মানসিকতা পরিহার করুন

তৃতীয় ঘটনায়, আমার সংবাদ সম্পাদক উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, বতসোয়ানায় হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া এক নারী হয়তো আইনের অপব্যবহারের শিকার হয়েছেন। দেশটির কঠোর গণমাধ্যম আইনের কারণে সেই নারীর কাছে পৌঁছানোর পথ রুদ্ধ ছিল। পরে আমি ছলচাতুরির মাধ্যমে তার কারাকক্ষ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হই। আইনজীবীর পোশাক পরে, কারারক্ষীদের কাছে অ্যাটর্নি হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে এই বলে বিশ্বাস করাই যে, আমার তাকে কিছু আইনি বিষয় বোঝাতে হবে। সেই নারীর সঙ্গে সাক্ষাতের সঙ্গে সঙ্গেই আমি রিপোর্টার হিসেবে নিজের পরিচয় দেই। তিনিও নিজের গল্পটি জানাতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই সাক্ষাৎকারে শক্তিশালী নতুন প্রমাণ উঠে আসে যে, এই নারীর বিচারের মুখোমুখি হবার মতো মানসিক অবস্থায় ছিলেন না। এমনকি হত্যাকাণ্ড ঘটনোর মতো শারিরীক সক্ষমতাও তাঁর ছিল না। এবং তিনি এখানে হয়তো আইনের অপপ্রয়োগের শিকার হয়েছেন।

কিন্তু এই প্রতিবেদনটি কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। বিচারিক কর্তৃপক্ষ অটল ছিল। এবং দুই মাস পর সেই নারীকে ফাঁসি দেয়া হয়। বতসোয়ানার এক ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা সেসময় দাবি করেছিলেন যে, আমি অবৈধভাবে প্রবেশাধিকার পেতে গিয়ে আইন লঙ্ঘন করেছি। অবশ্য প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরপরই আমি বুঝতে পারি যে, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ বাড়তি রিপোর্টিংয়ের অভাব ছিল, আর সময় হওয়ার আগেই সেটি প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদনটি লেখা হয়েছিল সরাসরি জড়িত ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে। এটি সেখানে মানবিক আবেদন সংশ্লিষ্ট নাটকীয়তা ফুটিয়ে তুললেও, অন্যান্য সোর্সগুলো দিয়ে সেটির শক্ত বুনন তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়াও, আমি এ ব্যাপারে সজাগই ছিলাম না যে আমার ছলচাতুরি স্থানীয় আইন লঙ্ঘন করতে পারে। 

যা শিখেছি:

  • ছদ্মবেশ সাংবাদিকতার মাধ্যমে পাওয়া কোনো স্কুপ তড়িঘড়ি করে প্রকাশ করার লোভ সংবরণ করুন। বিশেষ করে যখন সেখানে জড়িত মানুষদের চড়া মূল্য দিতে হতে পারে। 
  • প্রতিবেদনে নিজের বিবরণীতে গল্প বলার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করুন এবং দেখুন: কীভাবে এটি আপনার চূড়ান্ত প্রতিবেদনটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। 
  • ছদ্মবেশে নেওয়া প্রতিটি সাক্ষাৎকারকে সার্থক করে তুলুন সময় নিয়ে প্রকল্পটি শেষ করার মাধ্যমে। এবং গোপনীয় এসব কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি অন-দ্য-রেকর্ড প্রথাগত রিপোর্টিং, ও সতর্ক যাচাই বাছাই সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে ভুলবেন না।
  • বিদেশে গিয়ে ছদ্মবেশে রিপোর্টিংয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হলে সম্ভাব্য আইনী লঙ্ঘনের ব্যাপারে স্থানীয় আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
কখনো কখনো সহজ পদ্ধতিই সেরা পদ্ধতি

বলা দরকার, আমার একমাত্র সম্পূর্ণ-সফল ছদ্মবেশী প্রকল্পে সরাসরি কোনো প্রতারণা বা মিথ্যার আশ্রয় নেয়া হয়নি। তার বদলে, এখানে একটি গোপন মিটিংয়ে আড়িপাতা হয়েছিল, যেখানে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দলই আমাকে অন্য দলের সদস্য মনে করে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিল।

Secret Russian - South Afrian Nuke Talks

সবচেয়ে মৌলিক আন্ডারকভার রিপোর্টিং কৌশল ব্যবহার করে রুশ-দক্ষিণ আফ্রিকান পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে আলোচনাকে ঘিরে এই বিশেষ স্টোরি হয়েছিল। ছবি: স্ক্রিনশট

২০১৪ সালে, আমি একটি গুজব অনুসন্ধান করেছিলাম যে, দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার গোপনে রাশিয়া থেকে আটটি পারমাণবিক জ্বালানী চুল্লি কেনার পরিকল্পনা করছে – যা প্রায় ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এক অবৈধ চুক্তি। সরকার অবশ্য এ বিষয়ে কোনো আলোচনার কথা অস্বীকার করে আসছিল। অনুসন্ধানটি করতে গিয়ে আমি এক প্রত্যন্ত পর্বত রিসোর্টে সফররত রুশ পরমাণু বিদ্যুতের একটি প্রতিনিধি দলকে ট্র্যাক করি। সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার কর্মকর্তারাও জড়ো হয়েছিলেন। আমি সেখানে স্যুট পরে কেবল তাঁদের অনুসরণ করে একটি সভাকক্ষে গিয়েছিলাম।

আমি যে আলাপ-আলোচনা রেকর্ড করেছি, সেখানে অফসেট চুক্তি, প্রযুক্তিগত সুরক্ষা এবং পারমাণবিক বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয়ে বিশদ আলোচনা ছিল। একপর্যায়ে, কর্মকর্তারা যখন বুঝতে পারেন যে আমি কোনো প্রতিনিধি দলেরই সদস্য নই, তখন তারা আমাকে ঘর থেকে বের করে দেন। সংগ্রহ করা এসব তথ্যপ্রমাণ সুরক্ষিত করার পর আমি উভয় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। প্রতিবেদক হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছি এবং তাঁদের মন্তব্য জানতে চেয়েছি। উত্তরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আলোচনার বিষয়টি স্বীকার করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার কর্মকর্তারা। তারপর আমার ফলো-আপ রিপোর্টে উঠে আসে: অতীত-সম্পর্ক অস্বীকার করলেও দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা অতীতে সেই প্রতিষ্ঠানের একটি সহায়ক সংস্থার সঙ্গে পারমাণবিক জ্বালানি চুক্তিতে সমর্থন দিয়েছিলেন। এই স্কুপটির পর অন্যান্য সাংবাদিকেরাও এসব গোপন চুক্তি ও সমঝোতা নিয়ে বেশ কয়েকটি অনুসন্ধান পরিচালনা করেন। সব কিছু মিলিয়ে, এই পারমাণবিক চুক্তি শেষপর্যন্ত বাতিল হয়।

যেসব কৌশল কাজ করেছে 
  • গোপনে আড়িপেতে শোনার কৌশলটি বেশ ভালো কাজে দিয়েছিল কারণ (১) আমরা দেখিয়েছিলাম, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুতে বিশদ তথ্য সংগ্রহের অন্য কোনো উপায় ছিল না; (২) আলোচনার কথপোকথন রেকর্ড করার পরপরই আমি জড়িতদের কাছে একজন প্রতিবেদক হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছিলাম আর তাদের প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ দিয়েছিলাম। এবং, (৩) সমস্ত তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে আমরা পাঠকের কাছে নিজেদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছিলাম। 
  • আমরা এই সংক্ষিপ্ত ছদ্মবেশী তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়াকে সমর্থন জুগিয়েছিলাম প্রথাগত অন্যান্য সব রিপোর্টিং দিয়ে। এবং তারপর সেই এজেন্সি ও সরকারের অন্যান্য গোপন পারমাণবিক চুক্তি-আলোচনা নিয়ে প্রথাগত অনুসন্ধান পরিচালনা করেছিলাম। 
  • আমরা প্রতিবেদনটির প্রভাব আরও গভীর করে তুলেছি রেডিও সাক্ষাৎকার দিয়ে এবং অন্যান্য নিউজরুমের সঙ্গে সহযোগিতামূলক যোগাযোগের মাধ্যমে। 

প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহে ভূমিকা রেখেছেন জিআইজেএনের কর্মীবৃন্দ: টবি ম্যাকিনটোশ, বেনন ওলুকা, আনা বিট্রিজ আসাম, মিরাজ আহমেদ চৌধুরী, মারিয়েল লোজাদা, আমেল ঘানি, আলিম খলিকুল, এবং দীপক তিওয়ারি।

আন্ডারকভার রিপোর্টিংয়ের অন্যান্য রিসোর্স

আরও পড়ুন

আন্ডারকভার রিপোর্টিং: আমি যেভাবে কসাই হলাম

#মিটু থেকে আন্ডারকভার: নারী অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য টিপস

নারীবাদী অনুসন্ধানে যেভাবে উঠে এলো গর্ভপাত বিরোধী মিথ্যাচার


Nikolia Apostolouনিকোলিয়া আপোস্টোলু জিআইজেএনের রিসোর্স সেন্টারের পরিচালক। গত ১৫ বছর ধরে, তিনি বিবিসি, অ্যাসোসিয়েট প্রেস, নিউ ইয়র্ক টাইমস, পিবিএস, ডয়েচে ভেলে এবং আল জাজিরাসহ ১০০টিরও বেশি সংবাদমাধ্যমের জন্য গ্রীস, সাইপ্রাস ও তুরস্ক থেকে তথ্যচিত্র লিখেছেন ও প্রযোজনা করেছেন ।

রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএনের প্রতিবেদক। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমস পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন। বিদেশি প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের ২৪টির বেশি দেশে সংবাদ, রাজনীতি, দুর্নীতি ও সংঘাত নিয়ে রিপোর্ট করেছেন।

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

টিপশীট ডেটা সাংবাদিকতা পরামর্শ ও টুল

টিপশিট: আপনার অনুসন্ধানে কীভাবে সামুদ্রিক ডেটা ব্যবহার করবেন

সমুদ্র সংক্রান্ত ডেটার ধরন হতে পারে বহুবিচিত্র। সমুদ্রে দূষণ, জীববৈচিত্র্য পরিস্থিতি অথবা অর্থবাণিজ্য— এমন বিভিন্ন ধরনের ডেটা, সাংবাদিকেরা ব্যবহার করতে পারেন তাদের রিপোর্টিংয়ে। এই টিপশিটে পাবেন অনুসন্ধানে সামুদ্রিক ডেটা ব্যবহারের পরামর্শ ও রিসোর্সের খোঁজ।

পরামর্শ ও টুল

ত্রুটিপূর্ণ ও ভুয়া একাডেমিক গবেষণা নিয়ে কীভাবে কাজ করবেন

একাডেমিক গবেষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে নেওয়া হয় গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত। ফলে ত্রুটিপূর্ণ ও ভুয়া গবেষণা অনেক সময় তৈরি করতে পারে নেতিবাচক প্রভাব। পড়ুন, কীভাবে এমন ত্রুটিপূর্ণ গবেষণা নিয়ে অনুসন্ধান করতে পারেন।

গাইড পরামর্শ ও টুল

প্রতিবন্ধীদের নিয়ে অনুসন্ধানের রিপোর্টিং গাইড: সংক্ষিপ্ত সংস্করণ

জাতিসংঘের মতে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা হচ্ছেন বৃহত্তম বিভক্ত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। কার্যত প্রতিটি রিপোর্টিং বীটেই প্রতিবন্ধী বিষয়ক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা বা কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

Using Social Network Analysis for Investigations YouTube Image GIJC23

পরামর্শ ও টুল

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় শক্তিশালী টুল সোশ্যাল নেটওয়ার্ক অ্যানালাইসিস

ডেটা-চালিত সাংবাদিকতার যুগে, বিভিন্ন বিষয়কে একসঙ্গে যুক্ত করার মাধ্যমে যুগান্তকারী সব তথ্য উন্মোচন করা সম্ভব। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক অ্যানালাইসিস (এসএনএ) ঠিক এমন একটি কৌশল, যা ব্যবহার করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা ঠিক এ কাজটিই করতে পারেন।