

বার্তাকক্ষে এআই চ্যাটবট: যেভাবে নিজেদের রিপোর্ট ব্যবহার করে বাড়ানো যায় পাঠকের আস্থা
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
বড় কোনো এআই চ্যাটবট বা ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিনকে যদি জিজ্ঞেস করেন: “ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা বৈশ্বিক তেলের দামের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলেছিল?”— চ্যাটবটটি তাহলে আপনার সামনে বেশ পটুতার সঙ্গে চলমান বাজার প্রবণতা আর বিভিন্ন সাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনের লিংকসহ একগুচ্ছ পরিসংখ্যান হাজির করবে। চ্যাটজিপিটি হয়তো এর দীর্ঘ উত্তরের শুরুটাই এভাবে করবে যে: “ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম সাময়িকভাবে ৩ শতাংশের বেশি বেড়ে প্রায় প্রতি ব্যারেলে ৮১–৮২ ডলার পৌঁছেছে—যা জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ।”
তবে কোনো বার্তাকক্ষের নিজস্ব এআই চ্যাটবটকে যদি একই প্রশ্ন করেন—যেমন দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের “আস্ক দ্য পোস্ট এআই”— এটি আপানাকে মূল বিষয়গুলো তুলে ধরে অনেক বেশি স্পষ্ট ও নির্ভুল উত্তর দিবে। যেমন, “এখন পর্যন্ত তেলের দাম ওঠানামা করছে, বৈশ্বিক ক্রুড প্রায় ১ শতাংশ কমেছে, তবে পরিস্থিতি এখনো অনিশ্চিত।” সঙ্গে জুড়ে দিবে যে উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে তার থাম্বনেইল।
এই উত্তরগুলোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো তথ্যসূত্রের নির্ভরযোগ্যতা। বৃহৎ ভাষা মডেল (এলএলএম) এআই চ্যাটবটগুলো প্রায় পুরো ইন্টারনেট জুড়ে খোঁজ চালায়, যার মধ্যে যাচাইবাছাই না করা উৎসও থাকে। অন্যদিকে, গত কয়েক বছরে ফিলিপাইন থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্য পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বড় বার্তাকক্ষ চালু করেছে নিজস্ব এআই চ্যাটবট। যা কেবল তাদের নিজস্ব সাইটের প্রতিবেদন ও যাচাই করা উৎসের ডেটাবেসের ভিত্তিতে পাঠকের প্রশ্নের উত্তর দেবে। তবে এর জন্য রয়েছে কঠোর নীতিমালা, যাতে বাইরের কোনো ভ্রান্ত তথ্য বা পক্ষপাত ঢুকে না পড়ে।
এই ধরনের স্মার্ট নিউজ ইন্টারফেসের শীর্ষ উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিলিপাইনের র্যাপলারের রাই টুল, ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের আস্ক এফটি, ফোর্বসের অ্যাডিলেইড চ্যাট এবং দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের আস্ক দ্য পোস্ট এআই।
(দ্রষ্টব্য: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ব্লুমবার্গ এবং ইয়াহু নিউজের মতো বার্তাকক্ষগুলো যেসব এআই নিউজ সামারি টুল চালু করেছে এগুলো তা থেকে ভিন্ন। এ টুলগুলো পাঠকের প্রশ্নের উত্তর দেয় না; বরং ব্যস্ত পাঠকদের জন্য গল্পের মূল বিষয়গুলো বুলেট পয়েন্ট আকারে দেখার জন্য ট্যাব ক্লিক করার সুযোগ দেয়।)
এসব চ্যাটবট টুলকে পরীক্ষামূলক হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তাছাড়া এগুলোর ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। কেননা এগুলো তৈরি হয়েছে এলএলএম-এর ডিজিটাল কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে—যা পক্ষপাত, ভুল আর ‘হ্যালুসিনেশন’-এর জন্য কুখ্যাত।
তবে—ভুল তথ্য, ভ্রান্ত উৎসনির্দেশ, উৎসবিহীন মতামত এবং পক্ষপাতের মতো সমস্যায় জর্জরিত বৃহত্তর ইন্টারনেট সার্চের তুলনায় এই টুলগুলো পাঠকদের কাছে এমন তথ্য পৌঁছে দিতে চায় যা নির্ভরযোগ্য, আর যা পাঠকরা বিশ্বাস করেন মূলত তাদের প্রিয় সংবাদমাধ্যমের প্রতি আস্থার কারণে। এরা বার্তাকক্ষের আর্কাইভে সংরক্ষিত পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ও সম্পাদিত লেখা থেকে উত্তর তৈরি করে। এই এআই চ্যাটবট সম্পূর্ণ নির্ভুল নয়। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্কতার সঙ্গে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন যে এগুলো হয়তো বার্তাকক্ষকে পাঠকের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি, তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছানো, এমনকি সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক আয়ের নতুন পথও দেখাতে পারে।

ছবি: স্ক্রিনশর্ট, র্যাপলার/ রাই
র্যাপলারের রাই টুলের কার্যক্রম শুরু হয় তুলনামূলক কম-ঝুঁকিপূর্ণ পরীক্ষামূলক উদ্যোগের অধীনে—র্যাপলার চ্যাটরুমের নিরাপদ পরিবেশে ফোকাস গ্রুপ আলোচনার জন্য এআই “মডারেটর” হিসেবে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে র্যাপলার অ্যাপে এটি বেশ উচ্চাভিলাষী টুলে রূপ নেয়। অর্থাৎ, সারসংক্ষেপ তৈরির বদলে কনভারসেশন বট (এমন এক ধরনের কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যার, যা মানুষের সঙ্গে কথোপকথনের মতো করে যোগাযোগ করতে পারে) হিসেবে ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বর্তমানে এটি র্যাপলার প্রকাশিত ৪ লক্ষাধিক প্রতিবেদন এবং যাচাইকৃত ডেটাসেটের তথ্য নিয়ে কাজ করে। র্যাপলারের ডিজিটাল সার্ভিসের প্রধান জেমা মেনডোজা বলেন, ২০১১ সালে র্যাপলারের প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রকাশিত সাড়ে ৩ লক্ষাধিক নিবন্ধ নিয়ে কাজ করে টুলটি। আরো রয়েছে র্যাপলারের আগের প্রকাশনা নিউজব্রেক ম্যাগাজিনের ১০ বছরের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এবং গত পাঁচটি জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল, প্রার্থী ও ভোটার তালিকার ডেটাসেট।
মেনডোজা বলেন, রাই চালুর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পাঠককে র্যাপলার কমিউনিটিজ মোবাইল অ্যাপ ডাউনলোড ও ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা।
তিনি প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, “সোশ্যাল মিডিয়া এখন আর খবরকে সত্যিই অগ্রাধিকার দিচ্ছে না, তাহলে আপনি কীভাবে আপনার পাঠকের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন? কীভাবে টেকসই ট্রাফিক বজায় রাখবেন এবং পাঠককে আপনার কনটেন্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখবেন?”
তিনি আরও বলেন, “এ সম্পর্ক বজায় রাখার আরেকটি উপায় হলো নিউজলেটার, যা ফিলিপাইনে তেমন প্রচলিত নয়। আমাদের অ্যাপ নিয়ে পাঠকের সঙ্গে সম্পৃক্ততার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, আর রাই সেই কনটেন্টের সঙ্গে আরও সূক্ষ্মভাবে যোগাযোগ ও উপস্থাপনার একটি মাধ্যম।”
এর ‘নলেজ গ্রাফ’ ডেটাবেসে প্রতি ১৫ মিনিট পর পর সর্বশেষ প্রতিবেদন ও অনুসন্ধান যুক্ত হয়, যা প্রতিবেদন ও উৎস ডেটাসেটের ভাণ্ডারকে আরও সমৃদ্ধ করে। এরপর রাই অ্যাপ ব্যবহারকারীদেরকে তথ্যবহুল এবং তুলনামূলক হালনাগাদ উত্তর দেয়, সঙ্গে থাকে কয়েকটি সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন লিংক।
মেনডোজা বলেন, “এআইয়ের সাধারণ সমস্যা হচ্ছে এটি সব জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এবং মূলত প্রতিটি তথ্যকে একই রকম গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে। র্যাপলারে আমরা আমাদের প্রতিবেদনগুলোর তথ্য যাচাই করি এবং এর পক্ষে কথা বলি, আর সেটাই রাই-এর ভিত্তি।”
তবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে জটিল এই বিষয়গুলো সামলানোর জন্য যেমন বড় আকারের ডেটা ইঞ্জিনিয়ারিং টিম থাকে, বার্তাকক্ষে তেমনটা থাকে না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার এই যুগে বার্তাকক্ষের কনভারসেশন বটগুলোর ভুল করার বিষয়টিও খুব সাধারণ ঘটনা। যেমন, জুলাই মাসের কয়েক সপ্তাহ ধরে রাই-এর আপডেট ফাংশনে সমস্যার কারণে সর্বশেষ খবরগুলো অন্তর্ভুক্ত করা যাচ্ছিল না, ফলে কিছু উত্তর পুরোনো হয়ে যাচ্ছিল।
এলএলএম সংস্করণ ব্যবহার করলেও মেন্ডোজা জানান, রাই-এর সর্বশেষ কাস্টম-বিল্ড সংস্করণে এমন কিছু উদ্ভাবনী কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যোগ করা হয়েছে, যা বাইরের তথ্যকে ফলাফলে ঢুকতে বাধা দেয়।
অ্যাপে দেওয়া ব্যাখ্যামূলক নোটে বলা আছে: “এটি অন্যান্য চ্যাটবটের মতো নয়, যাদের ডেটা সোর্সে অনির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইটের কনটেন্ট ভর্তি করা। আর যেগুলো সবসময় যাচাইও করা হয় না। শেষ পর্যন্ত, আবর্জনা ঢুকলে আবর্জনাই বের হবে।”
“এটি মূলত কথোপকথন-ভিত্তিক। বিদ্যমান এলএলএম-এর ওপর ভিত্তি করে আমরা একটি কাঠামো তৈরি করেছি; এটি নিরপেক্ষ। তাই প্রয়োজনে আমরা এটিকে অন্য এলএলএম-এ বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে পারি” বলে তিনি ব্যাখ্যা করেন। আরো বলেন, “উত্তরগুলো প্রকাশিত প্রতিবেদন আর কাঠামোবদ্ধ ডেটা থেকে নেয়া হয়।”
মেনডোজা যোগ করেন, “আমরা এমন বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিচ্ছি যেগুলোতে র্যাপলার সত্যিই ভালো করে, তাই আমরা শুরু করছি রাজনীতি দিয়ে।”
চ্যাটবটের সীমাবদ্ধতা
আস্ক এফটি জেনারেটিভ এআই টুলটি শুধুমাত্র “এফটি প্রফেশনাল” সাবস্ক্রাইবারদের জন্য উত্তরগুলো নেয় ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের ২০০৪ সাল থেকে সংরক্ষিত আর্কাইভ থেকে।
মে মাসে, কলাম্বিয়া জার্নালিজম স্কুলের পেশাগত অনুশীলনের অধ্যাপক বিল গ্রুসকিন এই চ্যাটবটটি পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, যদিও এটির তথ্যগুলো সাংবাদিকতার মানদণ্ডে যাচাই করা, তবুও কিছু উত্তরের ক্ষেত্রে টুলটির ডেটাবেসের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি দ্রুতই ধরা পড়ে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “যেমন ‘টেসলা ২০২৪ সালে কত গাড়ি বিক্রি করেছে?’ এমন প্রশ্নের উত্তর এটি দিতে পারছিল না।”’
তবে, নিয়মিত এআই ব্যবহারকারী না হলেও, গ্রুসকিন এই চ্যাটবট ব্যবহারের বেশ কিছু সুবিধা দেখেছেন।
“এর ইন্টারফেসটি সহজ।” বলেন তিনি। “একটি বাক্স আছে, যেখানে আপনি আপনার প্রশ্ন টাইপ করবেন—যেমন ‘চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধের সর্বশেষ খবর কী?’—এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এটি সঠিক সারসংক্ষেপ সহকারে একটি চিন্তাশীল উত্তর তৈরি করে দিবে, সঙ্গে থাকবে ফুটনোট এবং এফটি–এর সেই প্রতিবেদনগুলোর লিঙ্ক যা এর উত্তরকে প্রভাবিত করেছে।”
জিআইজেএনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে গ্রুসকিন বলেন বার্তাকক্ষের এআই মডেল সংবাদের সঙ্গে পাঠকের সম্পৃক্ততা বাড়ানো, জনসাধারণকে সঠিক তথ্য দেওয়া এবং আরও কার্যকর আর্কাইভ অনুসন্ধানের সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।

২০০৪ সাল থেকে সংরক্ষিত ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের আর্কাইভের তথ্য দিয়ে আস্ক এফটি এর উত্তরগুলো তৈরি করে। ছবি: শাটারস্টক
গ্রুসকিন বলেন, “সাধারণত আমি এই ধারণাটি পছন্দ করি। একটি কারণ হলো, বেশিরভাগ নিউজ সাইটের সার্চ ইঞ্জিন খুব ভালো কাজ করে না। এমনকি বড় সাইটগুলোও ভালো ফলাফল দেখায় না এবং তারিখ অনুযায়ী সাজানোর সুযোগ দেয় না। যেমন, গুগলে ‘site:nytimes.com’ লিখে সার্চ দিলে আমি অনেক ভালো ফলাফল পাই। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে যদি আরও সহজ ও ভালো অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ হয়, আর উত্তরগুলো আসে এমন একটি ডেটাবেস থেকে যা এরইমধ্যে সম্পাদিত ও প্রকাশিত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি—আর সঙ্গে যদি কোনো সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত থাকে—তাহলে তো দারুণ।”
তিনি যোগ করেন, “এটি তখনই কার্যকর হবে যদি আপনি নিশ্চিত করতে পারেন যে এআই মিথ্যা বা কল্পিত উদ্ধৃতি হাজির বা ভুল তথ্য থেকে উত্তর তৈরি করছে না।”
হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের পাবলিক ইন্টারেস্ট টেক ল্যাবের প্রধান ড. লাতানিয়া সুইনি বলেন, সীমিত ডেটাবেসের নিউজরুম চ্যাটবটের একটি সমস্যা হচ্ছে এআই প্রোগ্রামগুলো মাঝে মাঝে আগের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অনিচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তিকর বা ভুল উত্তর দিতে পারে। যেমন, কোনো একটি সরকারি খাত ঘিরে বিতর্কিত তথ্যের কারণে ওই খাত সম্পর্কে দেওয়া উত্তর পক্ষপাতপূর্ণ বা ভুল হতে পারে। তবে তিনি বলেন, কিছু নিউজরুম ইন্টারফেস টুল হয়তো শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র নিউজরুমগুলোর মধ্যে আর্কাইভ সহযোগিতার মাধ্যমে একটি মধ্যবর্তী পন্থার আশ্রয় নিতে পারে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, “যদি আপনার আর্কাইভে থাকা নিবন্ধগুলো কোনো একটি বিষয়ের ওপর খুব অল্প পরিসরে লেখা হয় এবং কোনো একটি দিক নিয়েই আলোচনা করে, তাহলে উত্তরও অতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। অথচ বাইরে হয়তো আরও ভালো ও নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র রয়েছে। শুধু নিজের আর্কাইভের ওপর নির্ভর করলে উত্তর একপেশে হয়ে যায়। তাই বিশ্বস্ত সাংবাদিকতার আর্কাইভগুলো যদি একটি নেটওয়ার্ক হিসেবে একসঙ্গে কাজ করে বা নির্ভরযোগ্য সাংবাদিকতা সংশ্লিষ্ট আর্কাইভগুলো একটি ইকোসিস্টেম থাকলে [এআই উত্তরকে তথ্যসমৃদ্ধ করতে] এটি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাইরের সাইট থেকে তথ্য প্রবেশ রোধে নিজস্ব চ্যাটবটগুলোর জন্য ডিজিটাল ফায়ারওয়াল তৈরি করা হয়েছে, যা জাল তথ্যের ঝুঁকি অনেকটা কমায়, তবে পুরোপুরি নির্মূল করতে পারে না।
রাই-এর দেওয়া উত্তরগুলো র্যাপলারের সাধারণ সম্পাদকীয় সংশোধন নীতি অনুসরণ করে। অর্থাৎ, যদি কোনো ভুল বা ত্রুটি ধরা পড়ে, তা ঠিক করার জন্য একই নিয়ম ও প্রক্রিয়া প্রযোজ্য হবে, যেমনটি র্যাপলারের অন্য খবর ও প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে করা হয়। তাছাড়া পাঠকদেরকে চ্যাটরুমে বা ইমেইলের মাধ্যমে সম্ভাব্য ভুলগুলো তুলে ধরার জন্য উৎসাহিত করা হয়। সংবাদমাধ্যমটি জানাচ্ছে, “আমরা চেষ্টা করব ভুলের মূল কারণ খুঁজে বের করতে এবং প্রয়োজন হলে মূল সূত্র বা কনটেন্টটি সংশোধন করতে।”
ব্যবহারকারীদের মধ্যে অনেকেই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিউজরুম চ্যাটবট ব্যবহার করতে পারেন। কেননা কখনও কখনও এটি আপনার প্রশ্নের জবাবে সরাসরি বলে দিতে পারে যে, “আমি জানি না।” ধরুন, আপনি জিজ্ঞেস করেছেন “১৯২২ সালে লন্ডনে স্যার হেনরি উইলসনের হত্যার আদেশ কে দিয়েছিল?” পোস্টের চ্যাটবটটি উত্তরে বলছে, “দুঃখিত, আমরা কোনো উত্তর তৈরি করতে পারিনি।” কিন্তু চ্যাটজিপিটি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দেয় যে, “সম্ভবত আদেশ দিয়েছেন: মাইকেল কলিন্স, আইরিশ ফ্রি স্টেট প্রোভিশনাল গভর্নমেন্টের নেতা”। এ দাবিটি যদিও অত্যন্ত বিতর্কিত—যা আয়ারল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল।
“[ এ] এআইয়ের সমস্যা হলো, এটি প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে, যদিও এর কাছে যাচাই করা তথ্য নেই, তাই নিরাপত্তা নীতি থাকা প্রয়োজন,” সতর্ক করেন মেনডোজা। তিনি যোগ করেন, “তাই রাই জানে কখন ‘আমি এটি জানি না’ বলতে হবে। কেননা এ পর্যায়ে সে নিশ্চিত নয় যে, প্রশ্নটি সে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবে।”
রাই চালু হওয়ার সময়, র্যাপলারের ডেটা ও উদ্ভাবন বিভাগের প্রধান ডন কেভিন হাপাল বলেছিলেন, এই উদ্যোগটি একটি মডেল হিসেবে স্বেচ্ছাসেবী বা অ-বাণিজ্যিক বার্তাকক্ষগুলোর জন্য অনুসরণযোগ্য হতে পারে: “রাই–এর মাধ্যমে আমরা কেবল আরেকটি এআই টুল চালু করছি না, আমরা দেখাচ্ছি কীভাবে বার্তাকক্ষগুলো ডেটা ও এআই ব্যবহার করে জনসাধারণের আস্থা গড়ে তুলতে পারে। র্যাপলারের সাংবাদিকতা নীতি ও সততার ওপর ভিত্তি করে রাই তৈরি হয়েছে। আমরা প্রমাণ করছি যে, ডেটা এবং এআইকে দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করে তথ্যের সত্যতা রক্ষা করা সম্ভব, এমনকি ভুল তথ্যের বিরুদ্ধেও কাজে লাগানো সম্ভব।
জেনারেটিভ এআই আসার আগে, কিছু অনুসন্ধানী বার্তাকক্ষ ধাপে ধাপে প্রশ্ন ও উত্তরের ভিত্তিতে পাঠকের প্রশ্নের উত্তর দিত।
এ সংক্রান্ত দারুণ একটি উদাহরণ হচ্ছে চিলির ল্যাবট। যেখানে ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ব্যবহারকারীরা টেলিগ্রাম বা ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে নিউজরুমের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে কথোপকথনের মতো করে উত্তর দেখতে পেতেন। আগে থেকে লেখা সম্ভাব্য প্রশ্নের তালিকা থেকে তারা প্রশ্ন বেছে নেওয়ার সুযোগ পেতেন।
ল্যাবটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফ্রান্সিসকা স্কোকনিক বলেন, পরীক্ষামূলক ওই চ্যাটবটের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে, পাঠকদের সংক্ষিপ্ত ও নির্ভরযোগ্য তথ্যভিত্তিক কথোপকথনের প্রতি একধরনের আকর্ষণ আছে।
“আমার মনে হয়, [নিউজরুম এআই] চ্যাটবট ব্যবহার যৌক্তিক। কেননা, পাঠক অনেক সময় পুরো লেখা পড়ার সময় পান না, কিন্তু নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম থেকে সুনির্দিষ্ট উত্তর জানতে চান। বিশেষ করে এমন সংবাদমাধ্যম—যেটি দেশের সাম্প্রতিক বিষয়গুলো সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য প্রদান করে, যেমন র্যাপলার,” বলেন স্কোকনিক।
“কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জোরপূর্বক উত্তর তৈরির চেষ্টার পরিবর্তে টুলগুলোর ‘আমি জানি না’ বলার ক্ষমতা থাকতে হবে। চ্যাটবট কিন্তু পাঠকের সঙ্গে আবেগগত একধরনের সংযোগ তৈরি করতে পারে, যা স্রেফ কোনো খবর পড়ার অভিজ্ঞতার মতো নয়।”

ছবি: স্ক্রিনশর্ট/ চিলির ল্যাবট
অভ্যন্তরীণ ব্যবহার ও বিকাশ
মেনডোজা বলেন, চ্যাটবটটি র্যাপলার রিপোর্টারদেরও প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে সাহায্য করছে।
তিনি বলেন, “আমাদের সম্পাদকীয় দলটি এই টুলটিকে বেশ কাজে লাগাচ্ছে। যেমন, আমাদের ধর্ম বিটের সাংবাদিক তার প্রতিবেদনের জন্য প্রাথমিক গবেষণা করেন, কিন্তু ব্যাকআপ হিসেবে সে কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড তথ্যও যাচাই করেন, যেখানে রাই তাকে র্যাপলারে থাকা তথ্যগুলো একত্রিত করে সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরে।”
তিনি আরও বলেন, “রাই ব্যবহারের একটি সুবিধা হলো সেই সব বিষয়ে সাহায্য পাওয়া—যেগুলোর দিকে আপনি সবসময় নজর দিতে পারেন না। যেমন [সাবেক প্রেসিডেন্ট] রদ্রিগো দুতের্তের গোপন তহবিল নিয়ে অনেকবার দীর্ঘ শুনানি হয়েছে। আপনাকে এ সম্পর্কিত সব তথ্য জানতে হবে। এ পর্যায়ে আপনি রাইকে সাম্প্রতিক তথ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে পারেন। ‘স্বাস্থ্যবীমা তহবল নিয়ে কী ধরনের উদ্বেগ ছিল? বাজেট কেন কমানো হলো? প্রতিবেদনে যেই চরিত্রটি সামনে এসেছে, সে কে?’—এসব তথ্য আপনি রাইকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।”
অন্যান্য সংবাদ সংস্থাগুলো যারা নিজস্ব এআই চ্যাটবট চালুর কথা ভাবছে, তাদের জন্য মেনডোজা সতর্ক করেন, সাংবাদিকদের চ্যাটবটের ডিজাইন ও উদ্দেশ্য নির্ধারণের কাজে পুরোপুরি যুক্ত থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, “হ্যাঁ, আপনাদের ডেটা ইঞ্জিনিয়ার ও ডেভেলপার প্রয়োজন এবং এই টুলগুলো ধাপে ধাপে ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইঞ্জিনিয়ারদের একা ছেড়ে দেওয়া যাবে না। ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কনটেন্টের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ থাকা উচিত। এই বটগুলো তৈরি করার ক্ষেত্রে একটি সম্পাদকীয় দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন।”
মেনডোজা আরও বলেন, শুরুতেই সংবাদ সংস্থাগুলোর চ্যাটবটের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা উচিত এবং প্রযুক্তি কী করতে পারে এবং কী করতে পারে না তা স্পষ্টভাবে বোঝার চেষ্টা করা উচিত।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, “সারসংক্ষেপ তৈরি করা চ্যাটবটগুলো সহজভাবে ব্যবহার করা (প্লাগ-অ্যান্ড-প্লে) যায়, কিন্তু কথোপকথনধর্মী চ্যাটবটগুলো প্লাগ-অ্যান্ড-প্লে নয়। নিরাপত্তা নীতি বা ‘গার্ডরেল’ থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ, না হলে নিজের মতো করে তথ্য বানিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।”
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএনের গ্লোবাল রিপোর্টার এবং ইমপ্যাক্ট এডিটর। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসের প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন। বিশ্বজুড়ে দুই ডজনেরও বেশি দেশে সংবাদ, রাজনীতি, দুর্নীতি এবং সংঘাত নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও আফ্রিকার বিভিন্ন বার্তাকক্ষে অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর হিসেবেও কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।