

দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করে দেশ ছাড়তে হয়েছে, তবুও করে যাচ্ছেন সাংবাদিকতা
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
ভেনেজুয়েলার অনুসন্ধানী সাংবাদিক রবার্তো দেনিজ। আগে থেকেই যিনি বুঝতে পারছিলেন চারপাশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ যেভাবে খারাপের দিকে যাচ্ছে তাতে নিজের কাজ নিয়ে একদিন তাকেও বড় ধরনের ঝামেলায় পড়তে হতে পারে।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে রবার্তো দেনিজকে একসময় ‘দেশদ্রোহী’ বলে প্রচারণা চালানো হয়। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়ানো হয় নানা প্রচারণা। যেখানে তাকে সিআইএর এজেন্টের তকমা দেওয়া হয়। এমনকি তিনি একটি বারের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন—এমন একটি বিকৃত ছবি পর্যন্ত ছড়ানো হয়। শুরুতে তিনি এসবকে হাসি ঠাট্টার ছলে নিয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি হয়ে ওঠে আরও জটিল ও ভয়াবহ।
বিশেষ করে, যখন তিনি গরিব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবারের প্যাকেট সরবরাহের উদ্দেশ্যে চালু হওয়া সরকারি একটি খাদ্য কর্মসূচিতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই তাকে পরামর্শ দেওয়া হয়—দেশ ছেড়ে চলে যাওয়াই তার জন্য ভালো হবে।
তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো কয়েক মাস দেশের বাইরে গিয়ে মুখ বন্ধ রাখলেই চলবে। কিন্তু কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো কারাকাসে ফেরা তার জন্য নিরাপদ নয় বলে জানান রবার্তো দেনিজ।
রবার্তো দেনিজ ভেনেজুয়েলার অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম আর্মান্ডোডটইনফো-তে কাজ করেন। এটি জিআইজেএনের সদস্য প্রতিষ্ঠান। এই দলের অনেক সদস্যই এখন নির্বাসনে থেকে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। ২০১৯ সালে তারা জয় করেছিলেন মারিয়া মুর্স ক্যাবট পুরস্কার। নির্বাসনে থেকে সাংবাদিকতা করাটা কঠিন—এই বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন দেনিজ। তবে তিনি বলেন, সাহসী সাংবাদিকরা বিদেশে থেকেও নানা উপায়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে পারেন। যদিও ব্যক্তিগত পর্যায়ে চরম মূল্য দিতে হয়।
লন্ডনে অনুষ্ঠিত ট্রুথ টেলারস: দ্য হ্যারি ইভানস ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম সামিট চলার সময় রবার্তো দেনিজের সঙ্গে কথা বলে জিআইজেএন। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল তার অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত একটি তথ্যচিত্র। যেখানে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর ঘনিষ্ঠ এক কলোম্বিয়ান ব্যবসায়ীর দুর্নীতির গল্প তুলে ধরা হয়েছে। তথ্যচিত্রটি এমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়।
দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি সংক্ষিপ্ত ও পরিমার্জিত রূপে এখানে তুলে ধরা হলো।
জিআইজেএন: আপনার করা সবগুলো অনুসন্ধানের মধ্যে কোনটি আপনার সবচেয়ে প্রিয়? কেন?
রবার্তো দেনিজ: যদি আমাকে একটি বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে আমি বলব ২০১৮ সালের শুরুতে প্রকাশিত আমাদের একটি প্রতিবেদন লা মালা লেচে দে লোস সিএলএপি বা সিএলএপির বিষাক্ত দুধ। কেন এই প্রতিবেদনটি? কারণ আমরা দেখাতে পেরেছিলাম, ২০১৬ সালে মাদুরো সরকার গরিব লোকেদের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে সামাজিক কর্মসূচি চালু করেছিলেন, সেটির মাধ্যমে অত্যন্ত নিম্নমানের খাবার বিক্রি করা হচ্ছিল।
আমরা বের করে এনেছিলাম যে এই পণ্যে, বিশেষ করে দুধের গুঁড়োতে, ক্যালসিয়াম ও প্রোটিনের মাত্রা ছিল অত্যন্ত কম। অথচ কার্বোহাইড্রেট ও সোডিয়ামের পরিমাণ ছিল খুব বেশি—যা শিশুদের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। আমার কাছে এই প্রতিবেদনটি খুব শক্তিশালী মনে হয়েছিল। কারণ একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে দুর্নীতিকে সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে দেখানোটা মোটেও সহজ কাজ নয়। এই প্রতিবেদনে যেটা প্রকাশিত হয়েছিল, সেটা নিঃসন্দেহে ভয়ংকর। কারণ মানুষ এসব খাবার খাচ্ছিল। দুর্নীতির প্রভাব কীভাবে সবচেয়ে দরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন জীবনে পড়ে—প্রতিবেদনটি তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ বলে তবে আমি মনে করি।
জিআইজেএন: আপনার দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?
রবার্তো দেনিজ: ভেনেজুয়েলায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চালিয়ে যাওয়ায় অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমনটা অন্যান্য দেশেও দেখা যায়। তবে আমাদের বাড়তি কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। নিঃসন্দেহে, স্বৈরতান্ত্রিক প্রেক্ষাপট সেগুলোর একটি। ভেনেজুয়েলায় শুধু সরকারই নয়, সব প্রতিষ্ঠান, বিচার ব্যবস্থা সাংবাদিকদের শত্রু মনে করে। এই ধরনের লোকেরা সবাই ভাবে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে কাজ করি। আমরা যেন সিআইএর প্রতিনিধি। আর সেই কারণেই আমরা এই কাজগুলো করি। ভেনেজুয়েলা দিন দিন আরও বেশি স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠছে।
ভেনেজুয়েলায় কোনো পাবলিক রেকর্ড নেই। লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশগুলোতে ‘ডেরেচো দে পেটিশন’ বা ফোয়া (তথ্য অধিকার আইন) নামে একটি স্বচ্ছতাবিষয়ক আইন আছে। কিন্তু ভেনেজুয়েলায় এমন কোনো বন্দোবস্ত নেই। শুধু তাই নয়, আগে যেসব তথ্য প্রকাশ্যে থাকত, এখন সেগুলোও উন্মুক্ত নয়। এই পরিস্থিতিতে তথ্য পাওয়াটা ভীষণ কঠিন। আর তথ্য পেয়ে গেলে, তখন আরও বেশি সতর্ক হতে হয়। তথ্যদাতা বা সোর্স থেকে পাওয়া তথ্যের পাশাপাশি অন্যান্য স্বাধীন উৎস থেকেও তা যাচাই-বাছাই করতে হয়।
আর অবশ্যই, একজন সোর্সের পক্ষে আপনার সঙ্গে খোলামেলা সব কথা বলাটা সহজ নয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নির্বাসিত অবস্থায় সোর্সের সঙ্গে কথা বলার জন্য সময় বেশি দিতে হয়। কারণ আপনাকে তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে হয় যে, হ্যাঁ, আপনি কাজটি করবেন এবং সব সোর্সকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করবেন।

২০১৮ সালে রবার্তো দেনিজের আর্মান্ডোডটইনফোর জন্য করা অনুসন্ধান, লা মালা লেচে দে লস সিএলএপি। এতে উঠে এসেছে বিশেষ একটি সামাজিক কর্মসূচির আওতায় গরিবদের দেওয়া খাবারে ক্ষতিকর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট এবং সোডিয়ামের উপস্থিতি ছিল। ছবি: স্ক্রিনশট, আর্মান্ডোডটইনফো
জিআইজেএন: সাংবাদিক হিসেবে আপনার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী ছিল?
রবার্তো দেনিজ: সেটা তখন ছিল, যখন আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল—ভেনেজুয়েলায় থাকবো নাকি বাইরে গিয়ে নিরাপদে কাজ চালিয়ে যাবো। নিশ্চিতভাবেই এটাই সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত ছিল। শুধু সিদ্ধান্ত নেওয়া নয় বরং সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার ছিল আমার পরিবারের কথা ভাবা। নিজের পরিবার থেকে দূরে থাকা সহজ নয়। আমি বিদেশে আছি, ফিরে যেতে পারি না। আমার মা-বাবা এখনো বেঁচে আছেন। কিন্তু তাদের বয়স বাড়ছে। আমি তাদের সঙ্গে থাকতে চাই। কিন্তু পারছি না।
তবে আমার কোনো বিকল্প ছিল না। কারণ যদি ভেনেজুয়েলায় থাকতাম, তবে নিশ্চিতভাবেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চালিয়ে যেতে পারতাম না। তাই, এটা আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল। সিদ্ধান্ত নিতে আমার হাতে বেশি সময় ছিল না। তবে আমি মনে করি আমি সঠিক কাজটাই করেছি।
জিআইজেএন: সাক্ষাৎকার নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো পরামর্শ হিসেবে কী বলবেন?
রবার্তো দেনিজ: আমি বলব, সবচেয়ে ভালো পরামর্শ হলো সোর্সদের প্রতি বিশ্বাস রাখা এবং শুরু থেকেই পুরোপুরি স্বচ্ছ থাকা। যখন আপনি কোনও সোর্সের সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করেন, তখন স্পষ্ট করে বলতে হবে আপনি তথ্যগুলো কোথায় ব্যবহার করবেন এবং কথা বলার উদ্দেশ্য কী। আমি মনে করি এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সঙ্গে এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে আপনার সোর্সরা জানে আপনি কে, কীভাবে কাজ করেন এবং কেন এটা করছেন।
অবশ্যই, অনেক সোর্স আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায় কারণ তাদের কিছু স্বার্থ আছে অথবা তারা কোনও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্পর্কে খারাপ কথা বলতে চায় কিংবা তারা এমন কোনো উদ্যোক্তা সম্পর্কে তথ্য দিতে চায় যারা ভেনেজুয়েলা সরকারের সঙ্গে একই ব্যবসা দখলের জন্য লড়াই করছে। আর সাংবাদিক হিসেবে আমাদের স্পষ্টভাবে বলা উচিত: “দেখুন, এটা এমন একটি গল্প যা আমি আগ্রহ নিয়ে করছি কারণ এটা এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ, আর এটাই আমার একমাত্র স্বার্থ। যদি আপনার অন্য কোনো স্বার্থ থাকে, সেটা আপনার ব্যাপার, আমার নয়।”
জিআইজেএন: আপনি আপনার অনুসন্ধানী কাজগুলোতে কোন ধরনের রিপোর্টিং টুল, ডেটাবেস বা অ্যাপ বেশি ব্যবহার করেন?
রবার্তো দেনিজ: আমার ধারণা আমি একটু পুরনো আমলের সাংবাদিক। আমার প্রিয় টুল হলো আমার নোটবুক।
কিন্তু আজকাল অনেক টুল আছে যা খুবই কাজে লাগে। সাংবাদিকতার সবচেয়ে একঘেয়ে কাজগুলোর মধ্যে একটি হলো সব কথোপকথনগুলো লিখে নেওয়া। আরেক ধরনের টুল আছে যা খুবই দরকারি। কারণ আমি টাইমলাইন তৈরি করতে পছন্দ করি। অনুসন্ধানের সময় কখন কি ঘটেছে এবং সেই মুহূর্তে দেশে কী ঘটছিল—এটা এমন একটি টুল যা আপনার মাথায় থাকা গল্পের সব তথ্যকে তিনটি স্তরে দেখতে সাহায্য করে।
জিআইজেএন: পেশাজীবনে পাওয়া সবচেয়ে ভালো পরামর্শ কী? আর একজন আগ্রহী অনুসন্ধানী সাংবাদিককে কী পরামর্শ দিবেন?
রবার্তো দেনিজ: আমি জানি না এটা পরামর্শ হিসেবে গণ্য হবে কিনা, তবে আমরা আর্মান্ডোডটইনফোর ছোট নিউজরুমে আমরা সবসময় যেমনটা বলি… সেটা হলো সবসময় মনে রাখা উচিত কেন আপনি আপনার কাজ করছেন এবং স্মরণ রাখা উচিত যে আপনার কাজ সমাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি ভেনেজুয়েলা মত স্বৈরাচারী দেশগুলোতেও। যেখানে সেন্সরশিপ, দমন-পীড়ন ও ভিন্নমত রয়েছে। তখনও এই কাজের গুরুত্ব অপরিসীম। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শুধু প্রভাব বিস্তার নয়। ওই গল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোর জীবনে অর্থ কী তা বোঝা।
জিআইজেএন: আপনি কোন সাংবাদিকদের অনুরাগী এবং কেন?
রবার্তো দেনিজ: আমি অনেক লাতিন আমেরিকান সাংবাদিকের অনুরাগী— যেমন পেরুর সাংবাদিক গুস্তাভো গর্রিতি, কলাম্বিয়ার অনুসন্ধানী সাংবাদিক রিকার্দো কালদেরন। আর্জেন্টিনিয়ান সাংবাদিক লেইলা গুরিয়েরোকে খুবই শ্রদ্ধা করি, যিনি আর্জেন্টিনার নানা বিষয়ে অনেক বই ও গল্প লিখেছেন। কিন্তু অবশ্যই প্রথমে আমি ভেনেজুয়েলার সাংবাদিকদের কথা বলতে চাই, যারা এখনও অনেক কষ্টে আছেন। গত জুলাইয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর অনেক সাংবাদিক দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে সামগ্রিকভাবে, আমি বলব কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভেনেজুয়েলার সাংবাদিক দেশ থেকে বেরিয়ে গিয়েও তাদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা দেখিয়েছেন।
আর আমাদের বার্তাকক্ষের মধ্যে আমি মনে করি, প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক এওয়াল্ড শারফেনবার্গের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তিনি আরমান্ডোডটইনফোর অধিকাংশ সাংবাদিকের চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ। আর তিনি একধরনের বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের কাজকে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা রাখেন। আমাদের জন্য কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করেন।
জিআইজেএন: আপনার সবচেয়ে বড় ভুল কী এবং আপনি কী শিক্ষা নিয়েছেন?
রবার্তো দেনিজ: আমি মনে করতে পারি যখন আমি সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম, তখন ভেনেজুয়েলার একটি সংবাদপত্র ‘এল ইউনিভার্সাল’-এ কাজ করছিলাম। ভেনেজুয়েলার একটি কারখানায় চলা বৈধ বিক্ষোভের ওপর আমি একটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর একজন আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি অন্য পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন?” আমি বলেছিলাম, “আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু কারো সঙ্গে কথা বলতে পারিনি।”
একজন ব্যক্তি আমাকে বলেছিলেন, “আমি অমুক, আমি কোম্পানিটির আইনি প্রতিনিধি।” তিনি আরও বললেন: “আমি আপনাকে আক্রমণ করতে চাই না, লড়াই করতেও চাই না। আমি শুধু বলতে চাই, একজন সাংবাদিক হিসেবে আপনার জন্য এবং আপনার পত্রিকার পাঠকদের জন্যও এটা গুরুত্বপূর্ণ—যাতে তারা আমাদের অবস্থানটা জানতে পারে। আপনি আপনার প্রতিবেদনে যেসব বিস্তারিত তথ্য বাদ দিয়েছেন, সেগুলোও যেন জানানো হয়।”
যখন আপনি কোনো বার্তাকক্ষ বা পত্রিকায় কাজ করেন, প্রতিদিনই এক ধরনের তাড়াহুড়োতে থাকেন—আর তখন অনেক সময় কিছু না কিছু বাদ পড়ে যায়। এটা আমার জন্য খুব বড় শিক্ষা ছিল। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটা তখন ঘটেছিল যখন আমি সাংবাদিকতা পেশায় একেবারে নতুন।
জিআইজেএন: কাজের ক্ষেত্রে কীভাবে বার্নআউট এড়ান?
রবার্তো দেনিজ: যদি কোনো সম্মেলনে বা কোথাও এই বিষয়ে কথা বলতে যাই, তখন আমি প্রায়ই কৌতুকের ছলে বলি যে, “এখানে কী কোনো মনোবিজ্ঞানী আছেন?” কিন্তু সত্যি বলতে, এমন সময় এসেছে যখন আমি আমার অনুভূতিগুলোকে আলাদা করে রেখেছি। সাংবাদিক রবার্তো হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু অনুভূতিগুলো একদম পাশে রেখে দিয়েছি। এটা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো কিনা, আমি জানি না।
কিন্তু আমি বলব প্রথমেই এটা মাথায় রাখা খুব কঠিন হলেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং মনে রাখতে হবে যে এটা ব্যক্তিগত নয়। আপনি এটা করছেন কোনো রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়ীর সঙ্গে ঝগড়া করার জন্য নয়।
আরেকটা ব্যাপার হলো সর্বদা যতটা সম্ভব আপনার সম্পাদককে বিশ্বাস করার চেষ্টা করবেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যখন আপনি মনে করছেন যে আর পারছেন না বা গল্প চালিয়ে যেতে পারবেন না। তখন আপনাকে আপনার সম্পাদক এবং দলের সঙ্গে কথা বলতে হবে এবং তাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে।
তারপর আমি শরীর চর্চা করার চেষ্টা করি, বিশেষ করে দৌড়াই। দৌড়ানোর সময় আমি সব ভুলে যাই, যা শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যই নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও খুব ভালো। কাজের বাইরে অন্য কিছু পড়ার চেষ্টা করি, যেমন বই বা উপন্যাস। আমি লাতিন আমেরিকান সাহিত্য খুব পছন্দ করি। মাঝে মাঝে টিভি শো, সিনেমা বা কমেডি শো দেখতে যাওয়ারও চেষ্টা করি।
কিন্তু এমন সময়ও আসে যখন আমি সত্যিই চরম মানসিক ক্লান্তি অনুভব করি। ২০২১ সালে যেমনটা হয়েছিল। পুলিশ যখন ক্যারাকাসে আমার মায়ের বাড়িতে যায়। আমি ধরে নিচ্ছিলাম তারা দেখতে চাচ্ছিলো আমি সেখানে আছি কিনা। আমার জন্য ওই দিনগুলো ছিল খুবই কঠিন। কারণ আমি সত্যিই মনে করছিলাম, এটা আমার কাজের কারণে হচ্ছে। আর সেই অনুভূতি সামলে ওঠা খুব সহজ ছিল না।
শেষমেশ, বার্নআউট নিয়ে আমাদের সচেতন থাকা খুব জরুরি। আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের আরও যত্ন নিতে হবে। এবং হ্যাঁ, যদি মনে হয় আপনি বার্নআউট হয়ে গেছেন, তখন অবশ্যই থামতে হবে, বিশ্রাম নিতে হবে, নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং ভালো থাকতে হবে—যাতে আবার কাজ চালিয়ে যেতে পারেন।
জিআইজেএন: অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় আপনি কী কী জিনিসকে হতাশাজনক মনে করেন, বা ভবিষ্যতে কী পরিবর্তন আশা করেন?
রবার্তো দেনিজ: আমি মনে করি এটা ভেনেজুয়েলা কিংবা কলাম্বিয়ার মতো দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য: অনেক সময় মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে না। তারা বুঝতে পারে না দুর্নীতি কীভাবে তাদের জীবনে প্রভাব ফেলে। আমার জন্য, একজন সাংবাদিক এবং একজন নাগরিক হিসেবে এটা বোঝাটা কঠিন। অবশ্যই, একজন সাংবাদিক হিসেবে আমার জন্য এটা একটি চ্যালেঞ্জ। এমন গল্প বলা যা মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করবে এবং তাদের বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে।
যখন আপনি ভেনেজুয়েলায় এই কয়েক বছরের ঘটে যাওয়া সংকটের দিকে তাকাবেন, যা আমরা গত কয়েক বছর ধরে সয়ে যাচ্ছি— আপনার কাছে তা অবিশ্বাস্য মনে হয়—কারণ ভেনেজুয়েলায় কোনো গৃহযুদ্ধ হয়নি, কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও ঘটেনি। তবুও চলমান সংকটের পরিসংখ্যান গৃহযুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতোই ভয়াবহ। যা সত্যিই অবিশ্বাস্য। আর এর প্রধান কারণগুলোর একটি হলো দুর্নীতি।
আমার মনে হয় আমরা এমন একটি সময়ে আছি যখন সাংবাদিক হওয়াটা কঠিন, তবে সাংবাদিক হওয়াটাও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ভেনেজুয়েলার একজন সাংবাদিক হিসেবে আমার প্রত্যাশা হলো, আমার দেশের জন্য না হয়—মানুষের জন্য—পরিস্থিতি বদলাতে পারে, দেশ কেবল অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে নয়, গণতান্ত্রিকভাবেও পুনরুদ্ধার হতে পারে। যা আমার প্রজন্মের জন্য নয়, বরং পরবর্তী প্রজন্মের সাংবাদিকদের জন্য ভালো হবে।
লরা ডিক্সন জিআইজেএনের জ্যেষ্ঠ সম্পাদক, যিনি যুক্তরাজ্যে কর্মরত। তিনি কলাম্বিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোতে কাজ করেছেন। তার লেখা দ্য টাইমস, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট এবং দ্য আটলান্টিকে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি লন্ডনের দ্য টাইমস-এর সাবেক স্টাফ রিপোর্টার এবং আইডব্লিউএমএফ, পুলিৎজার সেন্টার, ও জার্নালিস্টস ফর ট্রান্সপারেন্সি থেকে অনুদান ও ফেলোশিপ প্রাপ্ত।