অলংকরণ: জিআইজেএন
জিআইজেএন: ২০২৫ সালের সেরা অনুসন্ধানী টুল
আমরা এমন একটি বছর নিয়ে কথা বলছি—যখন বিশ্বজুড়ে লুটেরা শাসনব্যবস্থা (চৌর্যতন্ত্র) আর স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর হামলা, দুটোই বেড়েছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা এ সময় সহযোগিতা, সাহস, প্রথাগত রিপোর্টিং এবং নতুন ও কার্যকর ডিজিটাল টুল ব্যবহার করে ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে কাজ করেছেন।
অনেক জটিল অনুসন্ধানে সূত্র ও ডেটা সংগ্রহ করা হয় নিজস্বভাবে তৈরি টুল এবং ওপেন সোর্স টুল—এই দুয়ের সমন্বয়ে। যেমন, এই বছর ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে)-এর একটি দল বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মিলে মেশিন লার্নিংভিত্তিক একটি সনাক্তকরণ টুল তৈরি করে। এরপর টুলটি ওপেন সোর্স ডেটাশেয়ার প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে ব্যবহার করে লাখ লাখ ফাঁস হওয়া নথি থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাসপোর্টসংক্রান্ত তথ্য সনাক্ত করা হয়।
তবে জিআইজেএনের বার্ষিক ‘সেরা টুল’ তালিকার এমন উদ্ভাবনী ও স্বতন্ত্র কিছু টুল তুলে ধরা হয়েছে, যেগুলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বাস্তব প্রয়োজনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, কিন্তু টুলগুলো ব্যবহার করতে উন্নত কম্পিউটার বিজ্ঞান জানার প্রয়োজন নেই।
গত বছরের তালিকায় ছিল বেলিংক্যাটের একটি মাস্টার টুলকিট, যা ওপেন সোর্স টুলগুলোর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্টারদের হালনাগাদ তথ্য দেয়। আরো ছিল একটি ব্যতিক্রমধর্মী নতুন পোর্টাল, যা বোমা বিস্ফোরণের গর্তের কাছ থেকে পাওয়া ধ্বংসাবশেষ বিশ্লেষণ করে গোলাবারুদের ধরন সনাক্ত করতে সহায়তা করে। এছাড়া এমন একটি টুল, যেটি অগুরুত্বপূর্ণ বা কম আলোচিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডেটা সংগ্রহ করতে সক্ষম। টুলটি রিপোর্টারদের বিদ্বেষপূর্ণ চরম ডানপন্থী কনটেন্ট ঘেঁটে দেখার ঝামেলা থেকে রেহাই দেয়।
২০২৫ সালের জন্য আমরা এমন কিছু নতুন বা কম ব্যবহৃত টুলের ওপর আলোকপাত করছি, যেগুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী নাও হতে পারে। তবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা তাদের নিজস্ব বিটে কাজ করতে গিয়ে যে বাস্তব সমস্যার মুখোমুখি হন, মূলত সেগুলোর ওপরই নজর দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—কোনো টুল কম জনবলসম্পন্ন বার্তাকক্ষের সময় সংকটের সমাধান করে। যে সব বার্তাকক্ষে সাধারণত ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে রেকর্ড করা জনসভা বা এই ধরনের অন্যান্য বিষয়গুলো হাতে ধরে খুঁটিয়ে দেখার মতো সক্ষমতা থাকে না। আরেকটি টুলের কথা বলা হয়েছে যা রিপোর্টারদের পরিবেশসম্পর্কিত অন্ধবিন্দু অনুসন্ধান করতে সহায়তা করে। যেমন বৈশ্বিক দক্ষিণের খনিজ উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি—সবুজ জ্বালানি পণ্যের বিপরীতে পশ্চিমা ভোক্তা ও অংশীদাররা যেটিকে পুরোপুরি ইতিবাচক বলেই মনে করেন। বিশ্বজুড়ে কোন কোন বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার নামে নিয়ন্ত্রক জরিমানা করা হয়েছে সে বিষয়ক তথ্য উন্মোচন করে তৃতীয় টুলটি। এর মধ্যে তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের কারণে আরোপিত জরিমানাও অন্তর্ভুক্ত।
আইডিআইয়ের অর্থের গতিপথ অনুসরণের টুলকিট
জীবাশ্ম জ্বালানি ও পাম অয়েল শিল্পে পরিবেশ ও শ্রম নির্যাতন উন্মোচনে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা বড় ধরনের অগ্রগতি অর্জন করেছেন। তবে পশ্চিমা বিশ্বের বিকল্প জ্বালানি খাতের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ সরবরাহকারী খননশিল্প নিয়ে নজরদারি তুলনামূলকভাবে অনেক কম। যার মধ্যে রয়েছে সৌর প্যানেল, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি এবং অন্যান্য পরিবেশবান্ধব উপকরণ। ব্লুমবার্গের সাপ্লাই চেইন বিষয়ক অনুসন্ধানটি এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় বৈদ্যুতিক গাড়ির মডেলে ব্যবহৃত অ্যালুমিনিয়াম কীভাবে অ্যামাজনে রোগব্যাধি ও ভূমি দখলের সঙ্গে যুক্ত—তা উন্মোচন করা হয়।
এ বছর যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার্স অ্যান্ড এডিটরস (আইআরই) সম্মেলনে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা জানান, এগুলো সাপ্লাই চেইন এবং স্থানীয় ক্ষতির বিষয়ে অনুসন্ধান করতে সবচেয়ে শক্তিশালী—যদিও কম ব্যবহৃত। এরমধ্যে কিছু টুল মূলত নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো তৈরি করেছে এবং তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আইডিআইয়ের অর্থের গতিপথ অনুসরণের টুলকিট বা আইডিআই ফলো দ্য মানি টুলকিট। মানবাধিকারভিত্তিক এনজিও ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট ইন্টারন্যাশনালের তৈরি এই টুলকিটে রয়েছে বিনামূল্যের নানা টুল ও ডেটাবেসের এক বিশাল ভাণ্ডার, যা রিপোর্টারদের বৈশ্বিক দক্ষিণে করপোরেট ক্ষতির প্রতিটি দিক খতিয়ে দেখার সুযোগ দেয়। এতে ওপেন সোর্স গবেষণা টুল, করপোরেট রেজিস্ট্রি, এমনকি পেনশন ফান্ডের প্রকাশ্য তথ্যও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এখানে থাকা ডেটাবেসগুলোর মধ্যে রয়েছে ল্যান্ড ম্যাট্রিক্স— এটি বিশ্বজুড়ে ভূমি চুক্তির একটি ডেটাসেট। জিআইজেএন রিসোর্স সেন্টারের পাশাপাশি আরো রয়েছে চায়নিজ লোনস টু আফ্রিকা ডেটাবেস।
- এই বিষয়ক অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ টুলের মধ্যে রয়েছে জাস্ট ট্রানজিশন লিটিগেশন ট্র্যাকিং টুল—যা নবায়নযোগ্য জ্বালানিসংশ্লিষ্ট খনন প্রকল্পে যুক্ত কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে করা মামলার একটি ডেটাবেস; ডজি ডিলস ডেটাবেস—যেখানে সমাজ বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচিত প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন সংক্রান্ত তথ্য রয়েছে; এবং ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট ট্র্যাকার—যাতে ১৭টি উন্নয়ন অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩ লাখ প্রকল্প বিনিয়োগের রেকর্ড অন্তর্ভুক্ত আছে।

ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট ইন্টারন্যাশনালের ফলো দ্য মানি টুলকিটে তালিকাভুক্ত রিসোর্সগুলোর এক ঝলক। ছবি: স্ক্রিনশট
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আয়োজিত বিভিন্ন জনসমাবেশ বা অনুষ্ঠান—যেমন সংসদীয় শুনানি, নিয়ন্ত্রক সংস্থার বৈঠক, পডকাস্ট বা লাইভ ইভেন্ট—যেগুলো এখন নিয়মিতভাবে ইউটিউব ও সরকারি ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়, সেগুলোর মধ্যেই অসংখ্য সূত্র, সম্ভাব্য অনুসন্ধানী তথ্যসূত্র এবং সংবাদযোগ্য মন্তব্য পাওয়া যায়। কিন্তু এমন দীর্ঘ ফরম্যাটের কনটেন্ট শোনা বা বিশ্লেষণ করার মতো জনবল খুব কম বার্তাকক্ষেই রয়েছে।
এই বছর যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত নিকার২৫ ডেটা সাংবাদিকতা সম্মেলনে অভিজ্ঞ সাংবাদিকরা জানান, একটি বিনামূল্যের এআই–চালিত টুল—সামারাইজডটটেক—সময় বাঁচানোর ক্ষেত্রে অসাধারণ সহজ সমাধান দিতে পারে। রিপোর্টাররা শুধু ভিডিওটির ইউআরএল সার্চ বারে পেস্ট করে “সাবমিট” চাপলেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আলোচনার একটি বিস্তারিত ও তুলনামূলকভাবে নির্ভরযোগ্য সারসংক্ষেপ পেয়ে যান, যা পাঁচ মিনিটের ভাগে ভাগ করা থাকে। টুলটি সাংবাদিকতার মানদণ্ড ও নির্ভরযোগ্যতাও নিশ্চিত করে। কারণ এতে টাইমলাইন লিংক যুক্ত থাকে—ফলে রিপোর্টাররা সারসংক্ষেপে চিহ্নিত করে রাখা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সরাসরি ক্লিক করে সেই আলোচনাটি নিজে শুনতে পারেন। এছাড়া অন্য ব্যবহারকারীর আগে থেকেই তৈরি করে রাখা বৈঠকের ট্রান্সক্রিপশনও এখানে দেখা যায়।
তবে দুটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এখানে মাসে সর্বোচ্চ পাঁচটি ভিডিও বিনামূল্যে আপলোড করা যায়, এবং ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য ভাষায় টুলটি তুলনামূলকভাবে দূর্বল।
“আমি প্রায় দেড় ঘণ্টার একটি স্কুল বোর্ড মিটিংয়ের ভিডিও আপলোড করেছিলাম। আর দেখলাম, একটি চমৎকার সারসংক্ষেপ তৈরি করতে টুলটির সময় লাগলো প্রায় ১০ সেকেন্ড,” বলেন সাহান জার্নালের ডেটা রিপোর্টার সিনথিয়া তু। তিনি আরও বলেন, “এই টুলটির দুর্বল দিক হলো—ইংরেজি নয় এমন ভাষার ভিডিওগুলোর ক্ষেত্রে সারসংক্ষেপ ততটা নির্ভরযোগ্য নয়। তবে আমার মনে হয়, এটি সত্যিই দারুণ একটি টুল।”
ইমেজ হুইস্পারার এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি কনটেন্ট সনাক্তকরণের জন্য জিআইজেএনের রিপোর্টার্স গাইড
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-সৃষ্ট কন্টেন্ট সনাক্ত করার জন্য শক্তিশালী ডিজিটাল টুলের প্রয়োজন, কারণ প্রচলিত তথ্য-যাচাই (ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের) পদ্ধতিতে যে সময় লাগে, তার চেয়ে অনেক দ্রুত বা মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই এআই ব্যবহার করে ভুল তথ্য তৈরি করা সম্ভব।
অপরদিকে, ডিজিটাল অনুসন্ধান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হেঙ্ক ফন এস সতর্ক করেন যে, জেনারেটিভ এআই মডেলের নাটকীয় উন্নতির কারণে, “২০২৩ সালের সনাক্তকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষিত একজন সাংবাদিক তাই ভুল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এআই দিয়ে বানানো কনটেন্টকেও “প্রকৃত/খাঁটি” ছবি বলে দিতে পারেন। কারণ তিনি পুরানো পদ্ধতির কথা মাথায় রেখে ওই ছবিটি যাচাই করছেন।” এআই টুল নির্মাতা এবং এআই সনাক্তকারীদের মধ্যকার এই “অস্ত্র প্রতিযোগিতা” বা লড়াইয়ে এখনও নির্মাতারাই সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। এর অর্থ হলো—ডিপফেক সনাক্ত করতে এবং এর পেছনের কুশীলবদের খুঁজে বের করতে নির্ভরযোগ্য টুল বা পদ্ধতি, সতর্কতা, আধুনিক যাচাই কৌশল এবং প্রচলিত সাংবাদিকতার একটি সমন্বিত প্রয়োগ প্রয়োজন।
এই বছর জিআইজেএনের জন্য একটি সময়োপযোগী গাইড প্রকাশ করেছেন ফন, যেখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে দ্রুত এআই-সৃষ্ট কনটেন্ট চিহ্নিত করা যায়। গাইডটিতে ডিপফেক সনাক্তের সাতটি ক্যাটেগরি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—“ কোনো দৃশ্য ”অতিরিক্ত নিখুঁত” লাগলে কীভাবে তা যাচাই করবেন, জ্যামিতিক লঙ্ঘন, পিক্সেল বিশ্লেষণ, অডিও আর্টিফ্যাক্ট, প্রসঙ্গগত ব্যর্থতা, এবং আচরণগত ধরনের সমস্যাগুলো সনাক্তকরণ।
সাংবাদিকদের জন্য রয়েছে অনেক দরকারী সনাক্তকরণ টুল এবং কৌশল। ২০২৪ সালের একটি জনপ্রিয় ফিচারে অডিও ডিপফেক সনাক্ত করার এমন অনেক পদ্ধতি বর্ণনা করেছে জিআইজেএন। তবে অনেক টুলেরই ভুল তথ্য দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। তাই ফন একটি উদ্ভাবনী ওপেন সোর্স টুল তৈরি করেছেন। টুলটির নাম ইমেজ হুইস্পারার—টুলটি চলতি বছর প্রকাশ করা হয়। টুলটি একই সঙ্গে গুগল ভিশন প্রসেসিং এবং লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল অ্যানালাইসিস ব্যবহার করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—বেশিরভাগ এআই টুলের মতো আন্দাজে উত্তর না দিয়ে, এটি যদি কোনো বিষয়ে অনিশ্চিত থাকে, তা আপনাকে জানিয়ে দেয় যে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রাসঙ্গিক তথ্য সে পায়নি। ফন এস উল্লেখ করেন, “এটি বিশ্বের সেরা টুল হতে চায় না—বরং সবচেয়ে দক্ষতার সঙ্গে সত্যতা যাচাই করতে চায়।”

ছবি: স্ক্রিনশট, ভায়োলেশন ট্র্যাকার গ্লোবাল
বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রায়ই পরিবেশগত, আর্থিক বা শ্রম সংক্রান্ত অনিয়মের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে জরিমানা করা হয়। তারা খুব নীরবে-নিভৃতে জরিমানার অর্থ পরিশোধ করে— যা সাধারণ মানুষের নজরে আসে না। আবার অনিয়মের ধরনগুলোও মাঝে মধ্যে পরিমাপ করা কঠিন হয়। মাঝে মাঝে বহুজাতিক অথবা ধনকুবেরদের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের শতভাগ দাগহীন দাবি করে। এক্ষেত্রে তাদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর পদ্ধতিগত অপকর্মের জন্য তাদেরকেই জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।
সৌভাগ্যবশত, এখন কয়েকটি বিনামূল্যের টুল রয়েছে যা বিশ্বব্যাপী ৬০টি দেশে করপোরেট অনিয়ম বিষয়ক জরিমানা রেকর্ড একত্রিত করেছে। এগুলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকদেরকে সরাসরি বিস্তারিত তথ্য এবং কোন ধারায় অনিয়মগুলো করা হয়েছে তা দেখার সুযোগ দেয়। পাশাপাশি গিনওয়াশিং (পরিবেশবান্ধব হওয়ার মিথ্যা দাবি) বা জনসংযোগকে কাজে লাগিয়ে চকচকে করে তোলা সুশাসনের দাবিগুলোর দুর্বলতা খুঁজে বের করার সহজ উপায়গুলো নিচে দেওয়া হলো।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনজিও গুড জবস ফার্স্ট-এর করপোরেট গবেষণা প্রকল্পের তৈরি ভায়োলেশন ট্র্যাকার ডেটাবেসে বর্তমানে ৪৫০টি ফেডারেল ও স্টেট নিয়ন্ত্রক সংস্থার ৬৮৪,০০০টি দণ্ড ও মীমাংসার তথ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, মেয়াদকাল শুরু হয়েছে ২০০০ সাল থেকে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মজুরি চুরি, প্রতিযোগিতা বিরোধী অনুশীলন এবং অবৈধ দূষণজনিত কার্যকলাপ। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রে অসংখ্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, তাই এই তথ্যগুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ধরনের অনুসন্ধানের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
এছাড়া এই প্রকল্পের অধীনে যুক্তরাজ্যের জন্যও একইরকম বিস্তারিত ডেটাবেস রয়েছে। নাম ভায়োলেশন ট্র্যাকার ইউকে। যেখানে ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৮০টি সংস্থার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়া ১১৭,০০০টি মামলার বিবরণ রয়েছে।
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের জন্য আরও একটি চমৎকার রিসোর্স হিসেবে এই একই প্রজেক্ট সম্প্রতি আরও বিস্তৃত পরিসরে ভায়োলেশন ট্র্যাকার গ্লোবাল পোর্টালটি চালু করেছে। এটি মূল ডেটাবেসের মতো অতটা বিস্তারিত না হলেও, বিশ্বের আরও ৫৮টি দেশ ও অঞ্চলের করপোরেট অপকর্মের এমন কিছু অনন্য ও মূল্যবান তথ্য প্রদান করে যা অন্য কোথাও পাওয়া কঠিন। এই তথ্যের একটি বড় অংশ স্থানীয় সংস্থাগুলোর প্রেস রিলিজ থেকে ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে, যেখানে লেক্সিসনেক্সিস (LexisNexis) এবং গুগল ট্রান্সলেটের (Google Translate) মতো টুলগুলোর সাহায্য নেওয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই প্রজেক্টের কর্মীরা প্রতিটি ডেটা বা তথ্য ম্যানুয়ালি (নিজেদের হাতে) যাচাই করে সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
রিপোর্টাররা কিছু দেশের করপোরেট অনিয়ম সম্পর্কিত তথ্য অন্য সংস্থান থেকেও অনুসন্ধান বা যাচাই করতে পারেন, যেমন বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস রিসোর্স সেন্টার এবং করপোরেট প্রসিকিউশন রেজিস্ট্রি।
আফ্রিকার ৪ কোটি ১০ লাখ অভিবাসীর অধিকার লঙ্ঘন বিষয়খ কোনো কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার না থাকার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন মিডিয়া সংস্থা ‘ডায়াস্পোরা আফ্রিকা ছোট পরিসরে কিন্তু উদ্ভাবনী ডেটা প্ল্যাটফর্ম চালু করেছে। এটি গ্রাফ বা চিত্রের মাধ্যমে এই জনগোষ্ঠীর অগণিত অধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরে। ডায়াস্পোরা আফ্রিকা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে তাদের ওয়েবসাইটটি দেখতে পারেন।
মাইগ্রেশন মনিটরে রয়েছে ইন্টারঅ্যাক্টিভ ম্যাপ বা মানচিত্র, যা অভিবাসী দেশগুলোতে শ্রম শোষণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রধান ঘটনাগুলোকে চিহ্নিত করে। এতে ২০১৬ সাল থেকে তথ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অত্যন্ত পরিশ্রমী ও কায়িক গবেষণার মাধ্যমে সংগৃহীত এই তথ্যের মধ্যে সীমান্তরক্ষীদের প্রাণঘাতী হামলা এবং করপোরেট শ্রম শোষণের মতো বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে ফুটে উঠেছে।
যদিও সবগুলো ঘটনা এখনো এই তালিকায় যোগ করা সম্ভব হয়নি তবে ডেটাবেসটি ক্রমাগত সমৃদ্ধ হচ্ছে। এছাড়া এই ড্যাশবোর্ডটি বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে শোষণের প্রবণতা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট প্রদান করে। মাইগ্রেশন মনিটর ড্যাশবোর্ডটি সরাসরি ব্যবহার করে আপনি এই তথ্যগুলো যাচাই করতে পারেন।

২০২৩ সালে আফ্রিকার অভিবাসী জনগোষ্ঠী মুখোমুখি হয়েছে এমন কিছু বড় ধরনের নির্যাতনের ঘটনার স্ক্রিনশট। ছবি: স্ক্রিনশট, মাইগ্রেশন মনিটর।
নতুন অলিগার্ক বা প্রভাবশালী বিত্তশালীদের ফাঁস হওয়া তথ্য অনুসন্ধানের টুল
এই বছর আইআরই সম্মেলনে, পুরস্কার বিজয়ী ফ্রিল্যান্স অনুসন্ধানী সাংবাদিক এবং সাবেক রাশিয়ার প্রতিনিধি মারিয়া জর্জিয়েভা রাশিয়া ও ইউরোপের অলিগার্ক (প্রভাবশালী বিত্তশালী) এবং উদীয়মান দুর্নীতিবাজ শাসক গোষ্ঠী বা লুটেরা শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধানে কার্যকর একগুচ্ছ ডেটাবেস শেয়ার করেছেন।
তবে জর্জিয়েভা সতর্ক করেছেন যে, সারা বিশ্বে কতৃত্ববাদী শাসন বৃদ্ধি পাওয়ার জের ধরে ধনী মিত্রদের সঙ্গে নতুন নতুন দুর্নীতির সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে এবং এর ফলে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ‘অলিগার্ক’ (প্রভাবশালী বিত্তশালী গোষ্ঠী) তৈরি হচ্ছে। আর তাদের আগ্রহ এখন প্রথাগত জ্বালানি খাতের বাইরে সম্প্রসারিত হচ্ছে। বড় বড় সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে পরিবহন, প্রযুক্তি এবং সরকারি নির্মাণ খাতের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের পদচারণা ছড়িয়ে পড়েছে।
জর্জিয়েভা বলেন, নতুন উদীয়মান এই অলিগার্ক এবং তাদের সহযোগীদের চিহ্নিত করতে নিচের টুল এবং ডেটাবেসগুলো খুবই কার্যকর।
-
- রু–পেপ ডেটাবেস: রাশিয়া, বেলারুশ এবং কাজাখস্তানের “রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের” অনুসন্ধানের তথ্যভাণ্ডার। এতে অলিগার্কদের পরিবারের সদস্য ও ব্যবসায়িক অংশীদারসহ ১৪,০০০ টি প্রোফাইল রয়েছে। সব তথ্য ইংরেজি ও রাশিয়ান ভাষায় পাওয়া যায়।
- স্পার্ক–ইন্টারফ্যাক্স ডেটাবেস: এটিকে রুশ করপোরেট তথ্যের জন্য ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ বা আদর্শ মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই পেইড (অর্থের বিনিময়ে ব্যবহারযোগ্য) টুলটিতে প্রকৃত মালিকানা, আর্থিক বিবরণী, আদালতের মামলা এবং ওই অঞ্চলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের সর্বশেষ তথ্য পাওয়া যায়।
- ওপেনটেন্ডার: ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৮টি দেশসহ সার্বিয়া, জর্জিয়া এবং উত্তর মেসিডোনিয়ার সরকারি টেন্ডার বা দরপত্রবিষয়ক তথ্যে বিনামূল্যে ব্যবহারযোগ্য একটি ডেটাবেস।
- টেলিগ্রাম বটস: আইজেসঅবগড, কুইকওসিন্টবট, গেটকন্ট্যাক্ট, ট্রুকলার, এবং স্মার্টসার্চ।
- লিটলসিস পাবলিক অ্যাকাউন্টেবিলিটি ডেটাবেস: এটি এমন একটি তথ্যভাণ্ডার যেখানে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার সম্পর্কের বিস্তারিত প্রোফাইল রয়েছে। দেখুন, এটি রিপোর্টারদের নতুন সংযোগ খুঁজে বের করতে কীভাবে সাহায্য করতে পারে।
- ফোর্বস রাশিয়ান রিচ লিস্ট: জর্জিয়েভা জানান যে, ফোর্বসের রুশ ভাষার সংস্করণে প্রকাশিত রাশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের বার্ষিক তালিকাটি নতুন এবং উদীয়মান অলিগার্কদের সনাক্ত করার একটি কার্যকর উপায়।
- রু-অ্যাসেটস: ইউক্রেন ভিত্তিক ইউকন্ট্রোল কর্তৃক উদ্ভাবিত একটি বিনামূল্যের টুল, যা রাশিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, ইউক্রেন এবং ইউরোপের বিভিন্ন ডেটাবেস থেকে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে। এটি প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার তালিকার (sanctions lists) সঙ্গে মিলিয়ে যাচাই বা ক্রস-চেক করে থাকে।
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। তিনি আগে দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসের প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন। বিদেশি প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বজুড়ে দুই ডজনের বেশি দেশে সংবাদ, রাজনীতি, দুর্নীতি এবং সংঘর্ষ সম্পর্কিত প্রতিবেদন করেছেন।