সাংবাদিকতা আর নৃতাত্ত্বিকতার মিশেলে মধ্য আমেরিকার পুরস্কারজয়ী অনুসন্ধান
অরণ্য আচ্ছাদিত স্বর্গীয় এক উপকূল এটি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রগামী জাহাজগুলো তল্লাশি এড়াতে এখানেই ছুড়ে দেয় কোকেনের থলে। উপকূলীয় এ অঞ্চলটিতে কয়েক শতাব্দী ধরে আদিবাসীদের বসবাস। একটা সময় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করলেও সহজ আর বেশি উপার্জনের আশায় জাহাজ থেকে ফেলা অবৈধ মাদক সংগ্রহের কাজে জড়িয়েছে তারা। অঞ্চলটি পরিণত হয়েছে অপরাধী আর জলদস্যুদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। এরই জের ধরে সহিংসতার শিকারও হতে হচ্ছে তাদের। যদিও তারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এই জায়গাটি মূলত মাস্কিসার উপকূল অঞ্চল। এর বিস্তৃতি পূর্ব হন্ডুরাস থেকে উত্তর নিকারাগুয়া পর্যন্ত। ইনসাইট ক্রাইমে দুইটি ভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত দ্য মাস্কিসা: দ্য হন্ডুরান জঙ্গল ড্রোনিং ইন কোকেন শিরোনামে তিন পর্বের সিরিজ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ ঘটনা। সালভাদরের দুই সাংবাদিক, হুয়ান হোসে মার্টিনেজ ডি’অবুইসন এবং ব্রায়ান আভেলারের লেখা এ প্রতিবেদনটি মার্চের সেরা অনুসন্ধানী রিপোর্ট হিসেবে সাংবাদিকতার মর্যাদাপূর্ণ ওর্তেগা ওয়াই গ্যাসেট জার্নালিজম পুরস্কার জিতে নিয়েছে। স্পেনের দৈনিক পত্রিকা এল পাইস প্রতিবছর স্প্যানিশ ভাষায় লেখা প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে থেকে বাছাই করে এ স্বীকৃতি দেয়।
মাসের পর মাস ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের স্বীকৃতি ছিল এ পুরস্কার। প্রায় দুইবছর ধরে মাঠ থেকে সংগৃহীত তথ্যের ব্যাপ্তি ছিল ৬০ পৃষ্ঠা। সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বেছে নিয়ে সংক্ষিপ্ত কলেবরে তিনটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনের মূলে ছিল গভীর ও সৃষ্টিশীল সাংবাদিকতা করার প্রচেষ্টা। তাই জটিল সমস্যাকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি সূক্ষ্মভাবে ব্যাপক তথ্য-প্রমাণের মাধ্যমে প্রতিবেদনগুলোকে সাজানো হয়েছে।
ওর্তেগা ওয়াই গ্যাসেট পুরস্কারের জুরিরা ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, “একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে চলমান সময়ের সামগ্রিক বিষয়গুলো উঠে আসে। এখানে যেমন উঠে এসেছে মাদক পাচার, পরিবেশগত সমস্যা বা পরম্পরা ও সংস্কৃতির ওপর যে হুমকিগুলো পড়েছে তার সবটাই”। এছাড়া প্রতিবেদনটিতে “পূর্ণাঙ্গভাবে তুলে ধরা হয়েছে মাদক পাচার এবং তা ঘিরে প্রশাসনিক ঔদাসীন্য কীভাবে একটি অঞ্চলের রোজকার জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”
সাংবাদিকতার এ ধরনকে লেখকেরা “নৃতাত্ত্বিক গবেষণা পদ্ধতি” বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ল্যাটআম জার্নালিজম রিভিউয়ের (এলজেআর) কাছে মার্টিনেজ ডি’অবুইসন বলেন “নৃতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার সময় যেমন কোনো জায়গায় গিয়ে দীর্ঘদিন থাকা, সেখানকার জীবনের গল্পগুলো তুলে আনা, নৃতাত্ত্বিক শৈলীতে তথ্যগত পর্যালোচনা করা এবং তা বিশ্লেষণের সময় ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোকে যুক্ত করা হয়, আমরাও ঠিক সেভাবে কাজ করেছি।”
অজানা অঞ্চল
মার্টিনেজ ডি’অবুইসন উল্লেখ করেছেন যে, ইনসাইট ক্রাইমের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক স্টিভেন ডুডলির পরামর্শে এ প্রতিবেদন তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল।
ইনসাইট ক্রাইম (জিআইজেএন সদস্য) লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বিপজ্জনক অঞ্চল এবং সবচেয়ে হিংস্র অপরাধী গ্যাংগুলোকে নিয়ে গভীর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির জন্য পরিচিত। মার্টিনেজ ডি’অবুইসন উল্লেখ করেন, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি অঞ্চলের ওপর আলো ফেলা যেটি সম্পর্কে খুব অল্প লোকই জানে।
৩৭ বছর বয়সী মার্টিনেজ ডি’অবুইসন একজন নৃবিজ্ঞানী। ২০১৪ সাল থেকে হন্ডুরাসের আটলান্টিক উপকূল নিয়ে কাজ করছেন। তবে লা মস্কিসার জঙ্গল আর এখানের আদিবাসীদের নিয়ে কাজের বিষয়টি ছিল তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন ও চ্যালেঞ্জের।
“আমি লা মস্কিসাতে কখনও যাইনি। জায়গাটা শহর থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। তাই স্টিভেনকে বলি একজন সহকর্মীকে সঙ্গে নিতে। ব্রায়ানের সঙ্গেও কথা বলি। ব্রায়ানকে বেছে নিয়েছিলাম কারণ তার সঙ্গে আমার কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি জানেন সংঘাতপূর্ণ পরিবেশে নিজেকে কীভাবে সামলাতে হয়। এল সালভাদরের গ্যাংগুলো নিয়ে আমরা কাজ করেছি। তিনি আমার সঙ্গে হন্ডুরাসেও গেছেন। আর আমি জানতাম এবার আমরা অত্যন্ত বিপজ্জনক জায়গায় যাচ্ছি,” বলেন মার্টিনেজ ডি’অবুইসন।
ত্রিশ বছর বয়সি আভেলার জানান তাঁরা একে অপরকে চেনেন ২০১৬ সাল থেকে। দেশটির তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট অস্কার অরটিজকে নিয়ে আভেলার এল সালভাদরের ডিজিটাল নিউজ আউটলেট এল ফারোতে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেন, “অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির আকাঙ্খা ও সত্যের প্রতি প্রতিশ্রুতি তাদের “অংশিদারিত্ব ও বন্ধুত্বকে গভীর করেছে।”
লা মস্কিসা নিয়ে অনুসন্ধানের শুরুটা হয় ২০২২ সালের জুলাইয়ের কাছাকাছি সময়ে। তাদের হাতে প্রাথমিক কিছু তথ্য ছাড়া অঞ্চলটি সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য ছিল না।
“তাই আমরা কাজের শুরুটা করি তথ্য সংগ্রহ দিয়ে। যদিও খুব বেশি তথ্য আমরা পাইনি। তবে জানতাম মাদক পাচারের জন্য অঞ্চলটি গুরুত্বপূর্ণ। আর মাদক পাচারকারী রামন মাত্তা ব্যালেস্টেরোস এখানেও তার কারবার খুলে বসেছেন। দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকাতে কোকেন পাচারের জন্যও জায়গাটি গুরুত্বপূর্ণ। যদিও লোকেরা এ নিয়ে খুব একটা মুখ খোলেনি। ততদিনে আমরা জেনে যাই মাদক পাচার নিয়ে এখানের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বিরোধ রয়েছে, যদিও বিরোধের মাত্রা সম্পর্কে ধারণা ছিল না” এলজেআরকে বলেন আভেলার।
দুইজন সাংবাদিকই জানিয়েছেন যে, প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ আর জরিপ ছিল তাদের কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এ অঞ্চল নিয়ে অতীতে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন লোকেদের সঙ্গে তারা ২০২২ সালের নভেম্বরের দিকে টেলিফোন যোগাযোগ শুরু করেন, যেমন গবেষক কিংবা বেসরকারি সংস্থার হয়ে কাজ করেছেন এমন ব্যক্তি। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরেজমিনে কাজ শুরু করেন, প্রায় এক মাস ধরে। একই বছরের জুনে শুরু করেন দ্বিতীয় ধাপের কাজ। এবারও ম্যাসব্যাপী কাজ করেন।
পুয়ের্তো লেম্পিরার উপকূলীয় শহরে তারা প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ছিলেন। এটি ছিল লা মাস্কিসায় ঢোকার পথ। আদিবাসীরা জায়গাটিকে বলে মিসকিটোস। তাঁরা সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নেতারাই তাঁদের অঞ্চলটি সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। আদিবাসীদের মধ্যে যারা স্প্যানিশ বলতে পারে না তাদের দোভাষী হিসাবে কাজ করেন। আমাদের তথ্যসূত্রের নেটওয়ার্কটি “স্নোবল” পদ্ধতির আদলে গঠিত হয়েছিল। যেখানে একটি সোর্স অন্য সোর্সদের নির্দেশনা দেয়, বলেন মার্টিনেজ ডি’অবুইসন।
“মাস্কিসা কী ধরনের বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা নথিভুক্ত করতে আমরা আসছি—আমাদের ঘিরে তাই আদিবাসী নেতারা বেশ আগ্রহী ছিলেন। এখানে সাংবাদিকদের খুব একটা আনাগোনা নেই, সংবাদ মাধ্যমেও এগুলো নিয়ে প্রতিবেদন হয় না। নৃবিজ্ঞানীদের কাছেও জায়গাটি খুব একটা পরিচিত নয়। সুতরাং, এখানকার সম্প্রদায়গুলোর নেতারা, যারা প্রবীণদের কাউন্সিল (কাউন্সিল অব এলডারস) নামে পরিচিত, আমাদের আসার খবর শুনে ভীষণ উৎসাহী ও উৎফুল্ল ছিল। কেননা শেষ পর্যন্ত কেউ লা মস্কিসার চলমান লড়াইয়ের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে,” বলেন তিনি।
প্রতিবেদন তৈরিতে তাঁরা বহুবিভাগীয় (মাল্টিডিসিপ্লিনারি) পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। প্রতিবেদনে মিসকিটোসের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। কীভাবে এই অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থান মাদক পাচারের অন্যতম রুটে পরিণত হয়েছে। যার গতিপথ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যায়। কীভাবে মাদক অর্থনীতি স্থানীয় জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটিয়েছে, সর্বোপরি লোভ কীভাবে আদিবাসীদের সংস্কৃতির পাশাপাশি এ অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলছে। প্রতিবেদনটি সমস্যার জটিল নেটওয়ার্ককে তুলে ধরে।
“লা মস্কিসা ঠিক স্বর্গের মতো। মধ্য আমেরিকার বিস্ময়ও বলতে পারেন। আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর একটি। যা ধ্বংস হতে চলেছে। কিংবা বলতে পারেন এই মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমি ভীষণ অবাক হয়ে ভাবি যে গোটা বিষয়টাকে কীভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে,” বলেন আভেলার।
সৃজনশীলতা আর যত্ন করে প্রতিবেদনটিকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। লেখাটা প্রথম পুরুষে (ফার্স্ট পারসন) লেখা। এতে বিষয়গত বিশ্লেষণ ও শব্দের সমৃদ্ধ ভান্ডার আছে। সাহিত্যের আদলে লেখার ফলে প্রতিবেদটি পড়ার সময় পাঠক একধরনের স্বস্তি অনুভব করে। মার্টিনেজ ডি’অবুইসন মনে করেন যা লাতিন আমেরিকান সাংবাদিকতার আদর্শ।
“এটি লাতিন আমেরিকার ঐতিহ্য। আমরা নিজেদেরকে এ ধরনের বর্ণনামূলক সাংবাদিকতার উত্তরসূরি বলে মনে করি। [গ্যাব্রিয়েল] গার্সিয়া মার্কেজ, রডলফো ওয়ালশ, মার্টিন ক্যাপারোস থেকে লেইলা গুয়েরিরো যার বীজ বপন করে গেছেন। এভাবে লিখতে হলে আপনাকে কথাসাহিত্য বিশেষ করে গল্প ও উপন্যাসের শৈলীগত বিষয়গুলো ধার করতে হবে, “বলেন মার্টিনেজ ডি আবুইসন।
লা মাস্কিসাতে প্রথমবার তারা একসঙ্গে যান। কিন্তু দ্বিতীয়বার গিয়েছিলেন আলাদাভাবে। আভেলার গিয়েছিলেন লাগোয়া দে ইবানোতে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এখানে হন্ডুরান সেনাবাহিনীর এক অভিযানে বেশ কয়েকজন মিসকিটো আহত হন ও মারা যান। আর মার্টিনেজ ডি’অবুইসন যান মোকারন নদীর দিকটাতে। যেখানে আদিবাসী নেতারা সংঘবদ্ধ অপরাধী, বন ধ্বংসকারী এবং ভূমি আক্রমণকারীদের হাত থেকে তাদের জমি রক্ষার জন্য সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
“আদিবাসীদের প্রতিরোধের দিক আবিষ্কার করাটা ছিল এ অনুসন্ধানের সবচেয়ে অবাক করা বিষয়গুলোর মধ্যে একটি, বলেন আভেলার।
“আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিরোধের বিষয়টি আমাকে ভীষণ অবাক করে। তারা দরিদ্র এবং তাদের কোনো অস্ত্র নেই। অন্য কোথাও থেকেও অস্ত্র নিয়ে আসারও সক্ষমতা নেই। না আছে তাদের বড় কোনো আর্থিক সমর্থন। তবুও তারা প্রতিরোধ করছে। কারণ হুমকিগুলো শুধু তাদের সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই নয়, জীবনের বিরুদ্ধেও। যা মিসকিটোদের মেরে ফেলছে, “আভেলার বলেন।
মার্টিনেজ ডি’অবুইসনের মতে, আমাদের প্রতিবেদনে জটিল সব সমীকরণ থাকা সত্ত্বেও তা পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
“আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, আমরা যেভাবে গল্পগুলো বলেছি বোধকরি গুটিকয়েক লোকের কাছে তা উপভোগ্য হবে। কিন্তু আমি ভীষণ অবাক হয়ে দেখি লোকেরা দীর্ঘ প্রতিবেদন পড়তেও আগ্রহী যদি তা সুন্দর ও সাবলীলভাবে লেখা হয়। তাই সাংবাদিকেরা মনে রাখবেন পাঠকের সামনে শুধু তথ্য তুলে ধরা নয়, তারা যেন তা পড়ে আরাম পান— আর এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি। আমি মনে করি সম্পূর্ণ বানোয়াট কথাগুলো হচ্ছে, এখন আর কেউ কিছু পড়তে চায় না। লোকেদের পড়ার প্রতি আগ্রহ উঠে গেছে। তারা শুধু টিকটক ভিডিও দেখতে ব্যস্ত থাকে। যেগুলো একেবারেই সত্যি নয়,” বলেন তিনি।
দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া
বর্তমানে এই সাংবাদিকরা সীমান্ত এলাকা ঘিরে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন। মার্টিনেজ ডি’অবুইসন হাইতি ও ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের সীমান্ত নিয়ে একটি অনুসন্ধান করছেন। আভেলার কাজ করছেন মেক্সিকোর দক্ষিণ সীমান্তে। এটি দিয়ে মধ্য আমেরিকা থেকে অভিবাসীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টা চালায়।
বিভিন্ন দেশের সীমান্ত এলাকা নিয়ে কাজ করলেও তাদের প্রকল্পগুলো আংশিকভাবে এল সালভাদরের সমস্যার সঙ্গেও সম্পর্কিত। এ জন্য তাদের উভয়কেই নিজ দেশের প্রেসিডেন্ট নায়েব বুকেলের অধীনে নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। ভিন্নমতকে দমন এবং সরকারের সমালোচনাকারীদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে বুকেল প্রশাসনের। ২০২২ সালের মার্চে রাষ্ট্রের “ব্যতিক্রমী অবস্থা”কে বৈধতা দিয়ে আইন জারি করেন তিনি। বলা হয় দেশের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এর ফলে দেশটিতে মানবাধিকারের ব্যাপক লঙ্ঘন ঘটেছে।
২০২২ সালের এপ্রিলে দেশটির জাতীয় জন-নিরাপত্তা সংস্থার পরিচালক জেইম মার্টিনেজ দাবি করেন, আভেলার সন্ত্রাসী গ্যাংয়ের সঙ্গে সংযুক্ত এবং কারাগারে তাঁর ভাই আটক আছেন। নিরাপত্তার স্বার্থে আভেলার এল সালভাদর ছাড়তে বাধ্য হন। তিনি বলেন, “কিন্তু আমার তো ভাই নেই। এটি ছিল প্রেসিডেন্ট নায়েব বুকেলের “ব্যতিক্রমী অবস্থা” জারির শুরুর দিককার ঘটনা। এরপর তারা অনেককে বন্দী করে। ফলে নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে আমি মেক্সিকো চলে যেতে বাধ্য হই।”
আভিলার রাভিস্তা ফ্যাক্টামের হয়ে কাজ করেছেন পাঁচ বছর। তিনি বর্তমানে একজন ফ্রিল্যান্সার। নিরাপত্তার জন্য ১১ মাস মেক্সিকোতে কাটাতে হয়েছে তাকে। এই সময়ে, তিনি সীমান্ত সম্পর্কিত প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত হন। কারণ “তার রক্তে মিশে আছে বিশুদ্ধ সাংবাদিকতা, রিপোর্টিং তাকে করতেই হবে।” বর্তমানে, তিনি এল সালভাদরে ফিরে যেতে পারেন, কিন্তু কাজের প্রয়োজনে তাকে দূরে থাকতে হচ্ছে।
“মেক্সিকোতে আমার কাজ শেষ, তার মানে এই নয় যে আমি এল সালভাদরে ফিরতে পারব না। আবার তার মানে এটাও নয় যে, ফিরে গিয়ে আপনি শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করতে পারবেন। আমার অনেক সহকর্মীকে আগের বছর বেশ কয়েকবার গা ঢাকা দিতে হয়েছে লেখালিখির জন্য। কারণ এল সালভাদরের প্রশাসনের হাতে আছে আইনি অস্ত্র, যা দিয়ে তারা যে কোনও সময় আমাদের আটক করতে পারে,” বলেন আভেলার।
২০২২ সালে মার্টিনেজ ডি’অবুইসনও দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। বুকেলে তাকে “আবর্জনার স্তুপ, গণহত্যার ভ্রাতুষ্পুত্র” বলে আখ্যায়িত করে। কার্লোস ও অস্কার নামে তার দুই ভাই আছেন। মার্টিনেজ কাজ করেন এল ফারোতে। মাঝে মাঝে বিদেশে থাকতে বাধ্য হলেও তিনি এখন এল সালভাদরেই রয়েছেন।
“আমি সবসময় দেশে ফিরে আসার ব্যাপারে জোর দিয়ে থাকি। সবাই মনে করে আমি বোধহয় দেশ ছেড়ে একেবারেই চলে গেছি। আমার বাড়ি এল সালভাদরে, আমি দেশ ছেড়ে যাইনি,” বলেন মার্টিনেজ ডি’অবুইসন।
বুকেলের কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা দেশটিতে সাংবাদিকতাকে বড় ধরনের ভঙ্গুর পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিকতা এখন অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে প্রতিযোগিতার পেরে উঠছে না। জনগণের মধ্যে সাংবাদিকতার ওপর আস্থা কমে যাচ্ছে। বুকেলে লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট, যিনি ৮০ শতাংশের বেশি সমর্থন পেয়েছেন। সংবাদমাধ্যমের ওপর যখন মানুষের বিশ্বাস কমতে শুরু করে, তখন বুকেলের মতো শাসকদের প্রভাব আরও শক্তিশালী হয়।
আভেলার মনে করেন, এরকম পরিস্থিতিতে সাংবাদিকতার ভূমিকা হচ্ছে বাস্তব ঘটনাকে নথিভুক্ত করা।
”এল সালভাদরের সাংবাদিকদের এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি যেটা করা প্রয়োজন তা হচ্ছে একটি রেকর্ড রেখে যাওয়া। দেশের গণতন্ত্র রক্ষা করার জন্য চারপাশে যা কিছু ঘটছে তার একটি রেকর্ড রেখে যাওয়াটা খুব জরুরী,” বলে মনে করেন তিনি। “আমরা হয়তো ইতিহাস পরিবর্তন করতে পারি না। তবে চারপাশে কী ঘটছে এবং কীভাবে এই সরকার গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে এবং এল সালভাদরে ক্ষমতার বিভাজন তৈরি করছে সাংবাদিক হিসেবে আমরা এসবের রেকর্ড রেখে যেতে পারি।”
ল্যাটাম জার্নালিজম রিভিউতে মূল নিবন্ধটি প্রকাশ হয়। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হয়েছে।
আন্দ্রে দুচিয়াদে রিও ডি জেনেরিও ভিত্তিক একজন ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিক এবং অনুবাদক। ২০১৮ সালে থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত “ও গ্লোবো’ এ আন্তর্জাতিক রাজনীতি ডেস্কে কাজ করেন। দ্য সায়েন্টিফিক আমেরিকান, দ্য ইন্টারসেপ্ট, এপোকা এবং এজেন্সিয়া পাবলিকা ডি জর্নালিসমোতে তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বার্লিনের গ্লোবাল পাবলিক পলিসি ইনস্টিটিউটের (জিপিপিআই)-এর সাবেক মিডিয়া ফেলো।