আর্থ অবজার্ভেশন ডেটা ব্যবহার করে আকাশ থেকে অনুসন্ধান
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
এক বছর আগে, কাতার ভিত্তিক আল জাজিরা ইংলিশ নিউজ নেটওয়ার্কে “দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়াই মহাকাশ থেকে” শিরোনামে একটি খবর প্রচারিত হয়। অভিনব এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয় তাদের ১০১ ইস্ট প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে।
এটি অন্যান্য সাধারণ প্রতিবেদন বা তথ্যচিত্রের চেয়ে বেশ আলাদা ছিল। এখানে একবিংশ শতাব্দীর মহাকাশ প্রযুক্তি ব্যবহার করে খতিয়ে দেখা হয়েছে: বছরের পর বছর ধরে চলা মানব-দাসত্বের সমস্যা। কোন জায়গাগুলোতে আধুনিক দাসত্বের মতো ব্যবস্থা টিকে আছে তা সনাক্তের জন্য ব্যবহার করা হয় স্যাটেলাইট ডেটা ও মেশিন লার্নিং। এই কাজে কারিগরী সহায়তা নেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আর্থ অবজারভেশন দলের কাছ থেকে।
উদ্ভাবনী ও অভিনব এই প্রতিবেদনে একসঙ্গে কাজে লাগানো হয় মহাকাশ প্রযুক্তি ও আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি। এমন একটি কাজের উদ্যোগ নিয়ে আল জাজিরা সত্যিই সাহসিকতা দেখিয়েছে। এটি এমন এক যুগের সূচনা করেছে, আমি যাকে বলি, “আকাশ থেকে সাংবাদিকতা” – যা ক্রমেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার একটি নতুন ও অভিনব পদ্ধতি হয়ে উঠছে।
অনুসন্ধানের জন্য আর্থ অবজারভেশন ডেটার ব্যবহার শুরু হয়েছিল সামরিক ব্যবস্থাপনায়। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নতুন হলেও, আদালতের বিচারিক কার্যক্রমে এর ব্যবহার আগেও হয়েছে। যার প্রথম দিককার উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে, সাবেক যুগোস্লাভিয়ার স্রেব্রেনিৎসা মামলার [বসনিয়ান যুদ্ধের সময় যে গণহত্যা হয়েছিল, তা অনুসন্ধান করে দেখা হয়েছিল এখানে] কথা। মায়ানমারের সেনাবাহিনী, রাখাইন রাজ্যে কী ধরনের তৎপরতা চালিয়েছে, তা খতিয়ে দেখার জন্য সম্প্রতি জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কার্যালয়ও স্যাটেলাইট ডেটা ব্যবহার করেছে।
২০১৮ সালে, মায়ানমার সরকারের চরম সমালোচনা করে শক্তিশালী একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সেখানে তারা দেখায়, কিভাবে বড় একটি অঞ্চলজুড়ে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। রিপোর্টটিতে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় স্যাটেলাইট ডেটা। একই সঙ্গে তারা দেখিয়েছে, কিভাবে মহাকাশ থেকে পাওয়া এই তথ্য দিয়ে নতুন উপায়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করা যায়।
সম্প্রতি ভারতের দুটি ঘটনার কারণে বেশ আলোচিত হচ্ছে “আকাশ থেকে সাংবাদিকতা”-র এই ধারণা। একটি হলো: বালাকোট স্ট্রাইক [যেখানে ভারতীয় বিমান বাহিনী, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে গিয়ে ‘সন্ত্রাসী ক্যাম্পে’ হামলা চালিয়েছিল।] অন্যটি চীনের সঙ্গে সীমান্ত দ্বন্দ্ব [যেখানে চীন একটি বিতর্কিত এলাকায় নির্মানকাজ চালাচ্ছে, নিচের ছবিতে দেখুন]। এই দুটি ঘটনার ক্ষেত্রেই, স্যাটেলাইট ডেটা ব্যবহার করে অনেক তত্ত্ব ও ভবিষ্যদ্বাণী তৈরি করেছে মিডিয়াগুলো। এই স্যাটেলাইট ছবিগুলো সরবরাহ করেছিল প্ল্যানেট ও ম্যাক্সার।
১০ বছর আগেও, এ ধরনের কাভারেজের কথা চিন্তা করা যেত না। কিন্তু স্যাটেলাইট প্রযুক্তির গণতন্ত্রায়ন এবং মহাকাশে পাড়ি জমানোর ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার কোম্পানিগুলোও উদ্যোগ নেওয়ায়; অনেক ভালো মানের স্যাটেলাইট ছবি পাওয়া যাচ্ছে অনেক কম খরচে। এবং সেগুলো থেকে তৈরি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ সব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।
মাত্র এক দশক আগেও, স্যাটেলাইট ডেটা সংক্রান্ত সব ধরনের কাজ করত শুধু বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো। সব কিছুর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের কাছে। কিন্তু ডিজিটালগ্লোব, ম্যাক্সার ও প্ল্যানেটের মতো কোম্পানিগুলো দৃশ্যপটে আসার পর এখন স্যাটেলাইট ডেটা সার্বজনীন হতে শুরু করেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মতো বিভিন্ন সংগঠন, এনজিও এবং আরো অনেকে এখন এসব স্যাটেলাইট ডেটা সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধান করতে পারে। এবং লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা অনেক বিষয় নিয়ে এখন অনেক সহজেই রিপোর্ট করা সম্ভব স্যাটেলাইট ডেটা ব্যবহার করে। এই কাজগুলো করতে হয়তো আগে আরো অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হতো।
বিষয়টা নিছক ডেটা বা প্রযুক্তির নয়। মূল বিষয় হলো, এতদিন যা শুধু আর্থ অবজার্ভেশন বিজ্ঞানীদের হাতে ছিল, সেই তথ্যগুলো এখন সাংবাদিকরাও পেতে শুরু করেছেন। এই পদ্ধতিকে সাংবাদিকতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
আদালতে স্যাটেলাইট ডেটার ব্যবহার
সাবেক যুগোস্লাভিয়ার স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যা, সুদানের দারফুর নৃশংসতা ও খুব সম্প্রতি বার্মার রোহিঙ্গা সংকটের মতো হাতেগোনা কয়েকটি মামলায় স্যাটেলাইট ইমেজকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে দেখা হয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত। তবে, ২০১৫ সালে, চিলির পানি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (ডিজিএ) একটি অনুসন্ধান শুরু করেছে অ্যাভোকাডো চাষে অবৈধভাবে পানি ব্যবহার নিয়ে।
বড় এলাকা নিয়ে অনুসন্ধান করার ক্ষেত্রে, স্যাটেলাইট ইমেজকেই প্রধান তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে ডিজিএ। এবং এর ওপরে ভিত্তি করেই তারা অনুসন্ধান পরিচালনা করেছে এবং রিপোর্ট তৈরি করেছে। এই অনুসন্ধানটি খুবই অভিনব ধরনের। এটি এক জায়গায় এনেছে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ, আইন-আদালত, আর্থ অবজারভেশন ও সাংবাদিকতাকে।
স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে পানির ন্যায্য হিস্যা দেওয়ার ক্ষেত্রে, এই প্রতিবেদনকে এখনো একটি বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একই ধরনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এখন তৈরি হচ্ছে আরো নানা বিষয়ে। যার মধ্যে আছে: পশ্চিম ব্রাজিলের রনডোনিয়ায় বনভূমি ধ্বংস, চীন ও ভারতে দূষণের মাত্রা, দারফুর অঞ্চলে নৃশংসতার ম্যাপ তৈরি, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্প গড়ে তোলার অগ্রগতি (দেখুন নিচের ছবিতে) এবং চীনে নতুন দ্বীপ তৈরির তৎপরতা।
আগামী বছরগুলোতে, স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ব্যবহার আরো দ্রুতগতিতে বিস্তৃত হবে। ফলে চোখের আড়ালে থেকে যাওয়া আরো অনেক ঘটনা আলোর মুখ দেখবে। এবং এই প্রবণতা ক্রমেই বাড়তে থাকলে, এক সময় হয়তো আদালতেও তথ্যপ্রমাণ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ডেটাকে।
বদলে যাবে ভবিষ্যতের সাংবাদিকতা
মহাকাশ থেকে সাংবাদিকতা আরো অনেক না বলা গল্প সবার সামনে তুলে আনবে। আগামী বছরগুলোতে, সাংবাদিকতা, স্যাটেলাইট ডেটা ও স্টোরিটেলিংয়ের দারুন কিছু সমন্বয় দেখা যাবে।
ভৌত ও দর্শনগত; দুই বিবেচনাতেই অনেক অজানা জায়গায় পা রাখবে এই নতুন ধারার সাংবাদিকতা। আর্থ অবজারভেশন কমিউনিটি যেভাবে এই স্যাটেলাইট ডেটার বৈজ্ঞানিক ও পরিসংখ্যানগত নানা তথ্য জানে, সেগুলো নিশ্চিতভাবেই নতুন মাত্রা যোগ করবে আকাশ থেকে সাংবাদিকতায়।
আরো পড়ুন:
স্যাটেলাইট ছবি কোথায় পাবেন এবং কীভাবে ব্যবহার করবেন?
স্যাটেলাইট ছবিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে যে ৯টি অনুসন্ধান
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল জিওস্পেশিয়াল ওয়ার্ল্ড-এ। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
শিবপ্রকাশ ইয়ারগাল একজন জিওস্পেশিয়াল ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) বিষয়ক গবেষক। রাজস্থানের এনআইআইটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি প্রযুক্তিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন। তিনি বিশেষভাবে কাজ করেন জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও টেকসই ব্যবস্থা নিয়ে।