

A woman holds a banner with the inscription "Journalism is not terrorism" in support of independent journalists working in Belarus. Image: Shutterstock
রাষ্ট্র যদি তথ্য লুকায়, অনুসন্ধান করবেন কি করে: বেলারুশ যা শেখাল
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
২০২০ সালে বেলারুশের আনাচেকানাচে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেরে দৃষ্টি কেড়েছিল সেই প্রতিবাদ। আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কো, যিনি গত ত্রিশ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন তাঁর বিরুদ্ধে ভোট কর্মীরা অভিযোগ তুলেছিলেন ভোট চুরির।
বিক্ষোভ ছিল শান্তিপূর্ণ। তারপরও লুকাশেঙ্কো নির্দয়ভাবে দমন করলেন। ভিন্নমতাবলম্বী, শতশত সাংবাদিক, অধিকারকর্মী ও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার হলো। নতুন করে নিপীড়ন শুরুর পর দ্যা বেলারুশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ জার্নালিস্টস (বিএজে)র হিসেবে ওই ঘটনার পর ৪০০রও বেশি সাংবাদিক নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন।
ডেটা হারভেস্ট, দ্যা ইউরোপিয়ান ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সের একটি অধিবেশনে সাংবাদিক আলিনা ইয়ানচুর বলেন, “তাদের বেশিরভাগই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা বেলারুশ, বেলারুশের পণ্য ও কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন,“এরপর বেলারুশ সরকার নতুন আরেক পরিকল্পনা নিয়ে আসে – তারা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে বৈদেশিক বাণিজ্যের তথ্য লুকাতে শুরু করে।”
ইয়ানচুর স্বাধীন সংবাদমাধ্যম বেলারুশিয়ান ইনভেস্টিগেটিভ সেন্টার (বিআইসি) কাজ করেন। তাঁদের কাজের কেন্দ্রে রয়েছে দুর্নীতি, নিষেধাজ্ঞা এড়ানো ও লুকাশেঙ্কোর অর্থ-সম্পদ। বিআইসিকে কর্তৃপক্ষ “উগ্রবাদী সংগঠন”আখ্যা দিয়েছে। তাই তারা এখন দেশের বাইরে থেকে পরচিালিত। বেলারুশ এখন সংবাদমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে নিপীড়নমূলক পরিবেশ বিরাজ করছে এমন দেশগুলোর একটি। আরএসএফ মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে তারা দশধাপ পিছিয়েছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে বেলারুশের অবস্থান এখন ১৬৭।
নিপীড়ন শুরুর পর থেকে সরকারি ডেটা পাওয়া অসম্ভব হয়ে যায়। ২০২০ সালে অতিমারীর সময়, কর্তৃপক্ষ মৃত্যুর তথ্য লুকাতে শুরু করে। ২০২০ সালের পর অভিবাসন ডেটা নিয়েও শুরু হয় লুকোচুরি। হয় ডেটা পাওয়া যাচ্ছিল না, যা পাওয়া যাচ্ছিল তাও ছিল অসম্পূর্ণ। ফলে কত মানুষ দেশ ছেড়ে গেছেন সেই তথ্য উদ্ঘাটন করা কঠিন হয়ে পড়ে। বেলারুশের প্রধান পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠান জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে, আনুষ্ঠানিকভাবে ডেটা প্রকাশ থেকে বিরত থাকে।
ডেটা পাওয়া কঠিন হলেও বেলারুশিয় সাংবাদিকেরা ঠিকই রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড অনুসন্ধানের উপায় বের করে নিয়েছেন। বিআইসি একটি অনুসন্ধানের দৃষ্টান্ত টেনে ইয়ানচুর সরকারের নির্যাতনের মুখে কীভাবে জনস্বার্থে প্রতিবেদন করে যেতে হবে সেই পরামর্শ দেন।
ক্যাপশন: রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স এর মুক্ত গণমাধ্যম সূচক অনুযায়ী বেলারুশ শেষের ১০ শতাংশের মধ্যে পড়েছে। বেলারুশকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে, সাংবাদিকদের জেলে পাঠানোয় বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম দেশ। ছবি: স্ক্রিনশট, আরএসএফ
নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর কৌশল উদ্ঘাটন
নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কী করে বেলারুশের উৎপাদিত সার বিশেষ করে ইউরিয়া ইউরোপিয় ক্রেতাদের হাতে পৌঁছাচ্ছে এবং কীভাবে বেলারুশের বৃহত্তম রাষ্ট্রীয় সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান উৎপাদনকারী দেশের নাম গোপন করছে ২০২৩ সালে তা উদ্ঘাটন করে বিআইসি।

বেলারুশের ইনভেস্টিগেটিভ সেন্টার (বিআইসি)র আলিনা ইয়ানচুর। সৌজন্যে, ইয়ানচুর
বেলারুশে বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিসংখ্যান গোপন করা হলেও, ইউরোপীয় দেশগুলোয় এসব তথ্য উন্মুক্ত। ইয়ানচুর প্রায়ই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পরিসংখ্যান অফিস ইউরোস্ট্যাট ব্যবহার করেন।
তিনি বলেন, “ইউরোস্ট্যাট একটি নির্ভরযোগ্য উৎস। কারণ ইউরোপিয় দেশগুলোর জন্য তারা কোথা থেকে কি পরিমাণ পণ্য আমদানি করছে তার রেকর্ড রাখায় কড়াকড়ি আছে।”
ইয়ানচুর বাণিজ্যে বৈশ্বিক ডেটা প্লাটফরম ইউএন কমট্রেড ব্যবহার করেন। এখানে বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশের বাণিজ্য সংক্রান্ত তথ্য আছে। ইউরোপের বাইরেও বৈশ্বিক ব্যবসাবাণিজ্যের ৯৯ ভাগের তথ্য তারা রাখে।
অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে নিষেধাজ্ঞা জারির আগে ও পরে বিআইসি বেলারুশ ও উজবেকিস্তানের মধ্যে ইউরিয়া রপ্তানির তথ্য তুলনা করেন ইউরোস্ট্যাটের তথ্যের সঙ্গে। ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশগুলোর বাণিজ্য তিনগুণের বেশি বেড়েছে বলে খোঁজ পাওয়া যায়। উজবেকিস্তান বেলারুশের প্রধান বাণিজ্য সহযোগী হয়ে দাঁড়ায়।
ছবি : বেলারুশিয়ান ইনভেস্টিগেটিভ সেন্টার
উজবেকিস্তানের ভাড়াটে প্রতিষ্ঠানে মারফত পণ্য পাঠিয়ে বেলারুশ নিষেধাজ্ঞা এড়ায় – এ তথ্য নিশ্চিত হতে তারা আরও বেশ কিছু সূত্রের সঙ্গে আলোচনা করে।
ইয়ানচুর বলেন, “পরিসংখ্যানগুলো থেকে একটা প্রবণতা দেখা যায় আর এই প্রবণতাই আপনাকে ক্লু দেবে। তবে, এর বাইরেও বিকল্প ব্যাখ্যা থাকতে পারে। এমনও হতে পারে গত পাঁচবছরে উজবেকিস্তান হয়তো ১০টি কারখানা তৈরি করেছে আর বিপুল পরিমাণে সার রপ্তানি শুরু করেছে। কোনো ডেটাই প্রশ্নাতীত নয়। যে ডেটাই আপনি দেখবেন প্রশ্ন তুলুন।”
তিনি বাণিজ্য বিষয়ক প্রতিবেদন, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি নিয়মিত পড়া ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। একজন বিশেষজ্ঞ বিআইসি দলকে বলেন, কারিগরি দিকের কথা চিন্তা করলে উজবেকিস্তান থেকে সড়ক পথে বা ট্রেনে সার পৌঁছানো কঠিন। কিন্তু বেলারুশ থেকে সহজ। যে নথিপত্র ছিল, তাতে একজন ভুল খুঁজে পান।
তিনি আরও বলেন,“যখন আমরা আমাদের নথিপত্রগুলো বিশেষজ্ঞদের দেখাই, তাঁরা হাসছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল নাইট্রোজেন সার নিয়ে যারা কাজ করে এই নথির এই লেখাগুলো তাদের নয়।
ইয়ানচুর এবার বিভিন্ন দেশের মধ্যে ইউরিয়া জাহাজিকরণের খোঁজখবর নিতে শুরু করেন। কোন কোন প্রতিষ্ঠান নিজেদের মধ্যে কেনাবেচা করছে বা বাণিজ্য চুক্তি করেছে। তারা কখনও কখনও পেইড ডেটাবেসের সাহায্য নেন ( যে ডেটাবেসে প্রবেশ করতে টাকা দিতে হয়)। এমন দুটি ডেটাবেস হলো ইম্পোর্টজিনিয়াস ও পানজিভা।
এ ছাড়াও তাঁরা বিভিন্ন সূত্রের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি বলেন,“আমাদের অধিকারকর্মী আছেন, সার শিল্পের সঙ্গে যাঁরা জড়িত বা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, আমাদের এমনকি ধর্মযাচকদের একটি দলও রয়েছে। অধিকারকর্মীদের অনেকেই আগে থেকে যেসব প্রতিষ্ঠান নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছিল তাদের দিকে চোখ রাখছিল।
প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পাওয়ার উপায়
পণ্যের যোগানদাতাকে নিষেধাজ্ঞা এড়াতে কোনো কোনো ব্যক্তি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের কাজ করেন। এই নেটওয়ার্কে কারা কারা আছেন খুঁজে বের করতে বিআইসি দেশের বাইরের সাংবাদিকদের সঙ্গে কাজ করেন।
ইয়ানচুর বলেন, ‘আমার পরামর্শ হলো যখনই আপনি অন্য একটি দেশের প্রতিষ্ঠানের নাম পাবেন, তখনই সেই দেশের সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করি।কারণ তাঁদের পক্ষে হয়তো ওপেন সোর্সে আমি যা পাচ্ছি তার চেয়ে বেশি তথ্য সংগ্রহের সুযোগ আছে।” তাঁরা কিছু কোম্পানি রেকর্ডও খুঁজে বের করেন।
- বেলারুশের অফিশিয়াল বিজনেস রেজিস্টার (শুধুমাত্র বেলারুশ থেকে এই রেজিস্টার ব্যবহার করা সম্ভব বা ভিপিএন)
- লিগাত.বাই, এই সাইটে বেলারুশ, রাশিয়া, ইউক্রেন, কাজাখস্তান, মলদোভা, কিরগিজস্তান ও উজবেকিস্তনে নিবন্ধন আছে এমন প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনের বিস্তারিত তথ্য ও আর্থিক বিবরণী পাওয়া যায়।
- অর্গিনফো.উয, উজবেকিস্তানে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিনামূল্যে পাওয়া সম্ভব এই সাইট থেকে।
- ইউ.কন্ট্রোল ইউক্রেনিয় প্রতিষ্ঠানের তথ্য প্রায় বিনামূল্যে পাওয়া যায়।
- স্পার্ক-ইন্টারফ্যাক্স.আরইউ সাইটে রাশিয়া, কাজাখস্তান ও বেলারুশের ব্যবসা বাণিজ্যের তথ্য রয়েছে।
- ওপেনকরপোরেটস, বিশ্বজুড়ে ১৪০ টি অধিক্ষেত্রের ২০০ মিলিয়ন প্রতিষ্ঠানের তথ্য আছে এই সাইটে।
- ডান অ্যান্ড ব্র্যাডস্ট্রিট এভানে সরকারি-বেসরকারি মোট ৫০০ মিলিয়ন প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত তথ্য আছে।
- সার্চ.বিসনোড.আরএস এই সাইটে স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার ব্যবসাবাণিজ্য সম্পর্কিত সাইট।
- উন্টারনিমেনরেজিস্টার, একটি জার্মান কোম্পানি রেজিস্টার
- নর্থ ডাটা, জার্মানি, স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও পোল্যান্ডের বেশ কিছু ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানের তথ্য আছে এখানে। সাংবাদিকরা বিনামূল্যে এই সাইটে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন।
ব্যক্তিকেন্দ্রিক অনুসন্ধান যেভাবে
যখন কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি নিয়ে অনুসন্ধান চালাবেন, তখন ওই ব্যক্তির ব্যবসা-বাণিজ্যের তথ্য সংগ্রহ করবেন। তাদের ফোন নম্বর ধরে অনুসন্ধান শুরু করতে পারেন, ওসিসিআরপির আলেফ ও ওসিন্ট.ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে ভালো তথ্য পেতে পারেন। সাইবার পার্টিজান নামে অপর আরেকটি সূত্রের ওপর তিনি নির্ভর করে থাকেন। অনামা তথ্যযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, হ্যাকার ও অধিকারকর্মীদের এই প্লাটফরম “তাদের কারিগরি দক্ষতাকে একনায়কদের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”

সাইবার পার্টিজান অনামা আইটি বিশেষজ্ঞ হ্যাক্টিভিস্টদের প্লাটফরম। ছবি: প্লাটফরমটির ফেসবুক পেজ
ইয়ানচুর বলেন, “এক পর্যায়ে তারা বেলারুশ সরকারের কিছু অফিশিয়াল ডেটাবেজ হ্যাক করেন। আমরা যদি কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে কোনো তথ্য জানতে চাই, এবং জনস্বার্থের জন্য প্রয়োজন এই যৌক্তিকতা বোঝাতে পারি তাহলে আমরা তাদেরকে পাব।” তথ্যের মধ্যে পাওয়া যাবে ওই ব্যক্তি কোথায় কাজ করেন, তাঁদের যোগাযোগের নম্বর, পাসপোর্টের তথ্য ২০২১ সালের গ্রীষ্ম পর্যন্ত তাদের সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার খবর।
একই ছবি যখন সাইবার পার্টিজান কিংবা আর কারও কাছ থেকে পাওয়া গেছে তখন সঠিকতা যাচাইয়ে ইয়ানচুর অ্যামাজন রিকগনিশন এর সাহায্য নিয়েছেন। রিভার্স ইমেজ সার্চ (আয়নায় আমরা যেভাবে ছবি দেখে থাকি) এর জন্য তিনি সাহায্য নেন বিনামূল্যের সার্চফরফেসেস.কম, ফেসচেক.আইডি ও টিনআই ও পিমআইজ। এর মধ্যে পিমআই এর সেবা নিতে টাকা লাগে।
এমিলি ও’সুলিভান জিআইএন এর সম্পাদকীয় সহযোগী। তিনি বিবিসি প্যানোরোমায় গবেষক ও বিবিসি নিউজনাইটরে এনএইচএস ইউনিটের সহকারী প্রযোজক হিসেবে কাজ করেছেন। সিটি ইউনিভার্সিটি লন্ডন থেকে অনুসন্ধানীয় সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর করেছেন এমিলি।