খবরের খোঁজে বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক সীমান্ত পাড়ি
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
প্রতি বছর আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের হাজার হাজার অভিবাসী বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক সীমান্ত দারিয়েন গ্যাপ পাড়ি দেন। বিশাল ও ভয়ংকর এই রেইনফরেস্ট কলম্বিয়া ও পানামাকে যুক্ত করেছে।
স্প্যানিশ ভাষায় এই ভূখণ্ডকে বলা হয় “এল তাপন দেল দারিয়েন।” ইংরেজিতে এর আক্ষরিক অর্থ দারিয়েন গ্যাপ নয়, বরং দারিয়েন স্টপার। এই নামটিই সম্ভবত গহীন ও প্রতিকূল এই জঙ্গলের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে বেশি মানানসই।
অতীতে এই অঞ্চলকে ঘিরে সড়ক-রেলপথ থেকে শুরু করে আন্তঃমহাসাগরীয় খাল পর্যন্ত নানা ধরনের অবকাঠামো প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও, শেষপর্যন্ত সব বাদ দিতে হয়েছে। ফলে জনহীন সীমান্তটি সংগঠিত অপরাধী ও গেরিলা গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণেই রয়ে গেছে। এর রুক্ষ ভূপ্রকৃতি আরও অনেক ঝুঁকি নিয়ে হাজির হয়; যেমন সাপের কামড়, গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ, চরম বৃষ্টিপাত এবং ভূমির বিপজ্জনক গঠন। ৫০০০ বর্গ কিলোমিটারের এই রেইনফরেস্টের মধ্য দিয়ে যাত্রাটি সাত দিনের। আর গোটা পথজুড়ে পাওয়া যায় মৃত অভিবাসীদের দাফন-না-করা খুলি, কাঁধের হাঁড় ও উরুর অস্থি, যা দারিয়েন গ্যাপ পাড়ি দেওয়ার ভয়াবহ ঝুঁকি বারবার মনে করিয়ে দেয়।
ক্যালিফোর্নিয়া সানডে ম্যাগাজিনে ভয়ানক এই সীমান্ত-পাড়ির ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট করে, ২০২০ সালে ফিচার শাখায় পুলিৎজার পুরস্কার জিতেছিলেন নাদিয়া ড্রস্ট। তিনি বলেন, “হুট করে গেরিলা দল বা উরাবেনিয়োসদের (আধাসামরিক বাহিনী পরিচালিত মাদক চোরকারবারি চক্র) সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার চেয়ে আমার ভয় ছিল বেশি সেই সব অপরাধীদের নিয়ে, যারা কোনো সংগঠিত চক্রের সদস্য নন।” পিবিএস নিউজআওয়ারের জন্যেও রিপোর্ট করা এই সাংবাদিক বলেন, “পথজুড়ে অভিবাসীদের ওপর পদ্ধতিগত ডাকাতি ও যৌন নিপীড়নের যেসব খবর আমরা পাচ্ছিলাম, আমার মতে, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় উদ্বেগ।”
আলোকচিত্র সাংবাদিক ব্রুনো ফেডেরিকো এবং কার্লোস ভিয়ালোনকে সঙ্গে নিয়ে অভিবাসীদের একটি দলের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিলেন ড্রস্ট। তারা খালি পায়ে হেঁটেছেন, আরও অনেকের মত বিপদসংকুল সেই পথ অনুসরণ করেছেন, চটের বিছানায় ঘুমিয়েছেন, বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মাত্র একটি তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছেন এবং একজন স্থানীয় চোরাকারবারির দেখানো পথে এগিয়ে গেছেন।
পুলিৎজার পুরস্কারের বিচারকেরা ম্যাগাজিনের জন্য ড্রস্টের লেখাটিকে “বৈশ্বিক অভিবাসনের একটি সাহসী ও চমকপ্রদ বিবরণ হিসাবে বর্ণনা করেছেন যা অভিবাসীদের জন্য বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক পথ, দারিয়েন গ্যাপের মধ্য দিয়ে একটি দলের পদযাত্রাকে নথিবদ্ধ করেছে।” ভূমধ্যসাগর বা যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তের মত অভিবাসী পারাপারের অন্যান্য রুট নিয়ে অনেক স্টোরি হলেও, রেইনফরেস্ট ও সশস্ত্র গোষ্ঠী-জনিত বিপদের কারণে দারিয়েন এতদিন সাংবাদিকদের কাছে আড়ালেই ছিল। তাঁদের রিপোর্টের আগে, দারিয়েন গ্যাপ নিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এই বর্ণনার মতো (সেখানেও আলোকচিত্রী হিসেবে ছিলেন ভিয়ালোন) কিছু সাংবাদিকতা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলো মূলত কলম্বিয়া ও পানামার সেইসব শহর থেকে আসা তথ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল, যেখানে অভিবাসীরা এসে পৌঁছাতেন বা যেখান থেকে তারা রওনা করতেন। সেই স্টোরিগুলোতে অভিবাসীদের যাত্রাপথ উন্মোচনের সাহস দেখা যায়নি।
মহাদেশ-পাড়ি
গত বছর ১৩৩,০০০ অভিবাসী এই পথ পাড়ি দিয়েছেন এবং ২০২২ সালে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। এদের বেশিরভাগই লাতিন আমেরিকার অন্য একটি দেশ হয়ে দারিয়েন গ্যাপের কলম্বিয়া অংশে পৌঁছান, এবং তারপর সাধারণত উত্তর যুক্তরাষ্ট্রের দিকে রওনা দেন। যেসব অভিবাসী এই বিপদসংকুল সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার ঝুঁকি নেন, তাদের মধ্যে হাইতির অধিবাসী সবচেয়ে বেশি; তারপরেই কিউবান ও ভেনেজুয়েলানদের অবস্থান। তবে আফ্রিকার ক্যামেরুন ও অ্যাঙ্গোলা এবং এশিয়ার পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মত দূরদেশ থেকেও অনেকেই আসেন। অনেক পথ ঘুরে তারা এখানে এসে পৌঁছান। আর কখনো কখনো এই যাত্রার শুরুটা হয় সামাজিক মাধ্যম থেকে নিছক এই কথা জানতে পেরে যে দক্ষিণ আমেরিকার কিছু দেশে অভিবাসন আইনে কড়াকড়ি নেই।
ফেডেরিকো বলেন, “এই রুট চালু হয়েছে কিছু পরিস্থিতির কারণে। এদের একটি হলো ইউরোপের সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়া। ইউরোপ যেতে মরিয়া এই অভিবাসীদের ঠাঁই হয় কারাগারে, তারা ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরেন, অথবা কোথাও গিয়ে আটকে পড়েন।” ইউরোপ-পাড়ির পথ ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসায় দক্ষিণের প্রান্তিক দেশগুলোর অভিবাসীরা ইকুয়েডর, ব্রাজিল ও পেরুর মত দেশের অভিবাসী-বান্ধব আইনের সুবিধা গ্রহণের দিকে ধাবিত হন।
প্রাথমিক অবস্থান থেকে একেক সময় একেক পথ ধরে অভিবাসীরা এগোতে থাকেন উত্তরে, দারিয়েনের দিকে; তারপর মধ্য আমেরিকা এবং মেক্সিকোর উত্তর সীমান্ত হয়ে, তারা শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান।
পাচারের এই রুট নিয়ে খুব একটা সাংবাদিকতা হয় না এবং এগুলো ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত নির্দিষ্ট সংগঠন বা ব্যক্তি সম্পর্কেও নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। যেমন, একটি অপরাধী সংগঠনের একক নিয়ন্ত্রণে কতগুলো রুট আছে? এই পথের প্রতিটি অংশ কি স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হয়?
২০ বছর ধরে কলম্বিয়ায় বসবাসরত চিলির আলোকচিত্রী ভিয়ালোন বলেন, “আমার ধারণা, চীন বা বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের একটি চক্র পরিচালিত হয়। একবার এক বাংলাদেশি অভিবাসী আমাকে বলেছেন, বাংলাদেশে তার ঋণের পরিমাণ ৪০,০০০ মার্কিন ডলার, অর্থাৎ নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত পুরো ভ্রমণের খরচ বাংলাদেশের কেউ তাকে ধার দিয়েছে। নিজ দেশে যদি কাউকে এই পরিমাণ অর্থ দিতে হয়, তবে আমার ধারণা, সেখানে এমন একটি সুসংগঠিত চক্র আছে যা অনেক দেশজুড়ে বিস্তৃত।”
দারিয়েন-পাড়ি
এই স্টোরি নিয়ে কাজ করা তিন সাংবাদিকই ছিলেন ফ্রিল্যান্সার। কানাডীয় বংশোদ্ভূত ড্রস্ট ২০০৯ সাল থেকে কলম্বিয়ায় বসবাস করছেন। তিনি কাজ শুরু করেন গ্লোবাল পোস্ট নামের একটি মার্কিন ডিজিটাল সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠানে। এরপর ফ্রিল্যান্সার হিসেবে লিখেছেন টাইম ম্যাগাজিন, আল জাজিরা আমেরিকা, গ্লোবাল অ্যান্ড মেইল এবং বিবিসির মত সংবাদমাধ্যমে।
ফেডেরিকো ২০১০ সালে কলম্বিয়ায় স্বাধীন তথ্যচিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেন, এবং ২০১৬ সাল থেকে তিনি পিবিসি নিউজআওয়ারের নিয়মিত ফিচার রিপোর্ট করছেন। ফার্ক গেরিলাদের সঙ্গে কলম্বিয়ার শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে ড্রস্ট ও ফেডেরিকোর প্রতিবেদন, ২০১৭ সালের ওভারসিস প্রেস ক্লাব অ্যাওয়ার্ড এনে দিয়েছে এই যুগলকে।
ভিয়ালোন তাঁর কাজের অংশ হিসেবে ২০০০ সালের প্রথম দিকে দারিয়েন গ্যাপ নিয়ে রিপোর্টিং শুরু করেন। এই অঞ্চল সম্পর্কে তাঁর ব্যাপক জানাশোনা ছিল, এবং দশকের পর দশক ধরে গড়ে তোলা যোগাযোগের কল্যাণে তাঁর দল এই পথ নিরাপদে পাড়ি দিতে পেরেছে।
স্মৃতি হাতড়ে ভিয়ালোন বলেন, “দারিয়েনে যখন আমার যাতায়াত শুরু হয়, তখন রেইনফরেস্ট যাত্রায় কয়েকজন পরিচিত ব্যক্তি আমার সঙ্গে থাকতেন, যাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় স্থানীয় একটি বারে, তবে সেটি ছিল এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। এই একই লোকগুলো আমাকে ডাকাতির চেষ্টা করেছিল এবং ফেলে চলে গিয়েছিল। তখন আমি কয়েকজন আদিবাসী স্থানীয় গাইডের সঙ্গে নদী পার হই। তারাও আমাকে ফেলে চলে যায়।” তিনি বলেন, “বিশ্বস্ত কাউকে গাইড হিসেবে নেয়া ছিল আমার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তাই, দারিয়েনে কয়েক বছর ধরে কাজ করার পর আমি আকান্দি শহরে আমার এক বন্ধুকে বলি ভালো একজন গাইডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে; সে এমন এক পরিবার থেকে এসেছে যারা শহরটির গোড়াপত্তন থেকেই সেখানে বাস করছে।”
সেই গাইড শিকারের সন্ধানে বা স্বর্ণের খোঁজে ৪০ বছর ধরে দারিয়েনে যাতায়াত করেছেন এবং জঙ্গলে যাওয়া-আসা করা প্রত্যেককে তিনি চিনতেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বেশ কয়েকবার অভিবাসীদের যাত্রাপথ ধরে গিয়েছেন ভিয়ালোন এবং তাঁর সঙ্গে কাজ করার গুরুত্বও বুঝতে পেরেছেন। তিনি বলেন, “২০১৯ সালে নাদিয়া ও ব্রুনোর সঙ্গে কলম্বিয়া সীমান্তের খুব কাছে গিয়ে আমরা চোরদের কর্মকাণ্ড দেখেছি, এবং আমাদের গাইড এসব চোর ও তাদের পরিবার সম্পর্কে জানতেন। অল্পবয়সী এই লোকেরা আমাদের দেখে পালিয়ে গিয়েছিল।”
ভিয়ালোন আরও বলেন, ডাকাতেরা সবসময় সীমান্তের পানামা অংশে অভিবাসীদের ওপর হামলা চালায়, কখনো কলম্বিয়া অংশে কিছু করে না। এর সম্ভাব্য কারণ, কলম্বিয়ার অবৈধ অস্ত্রধারী গোষ্ঠীগুলো তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে অপরাধীদের চুরি করতে বারণ করে। দারিয়েনের বাসিন্দারা ভিয়ালোনকে বলেছেন, এসব গোষ্ঠী মাদকপাচার থেকে যে আয় করে তা অভিবাসী-বাণিজ্য থেকে হওয়া আয়ের তুলনায় ফিকে পড়ে যায়।
তারপরও, এসব গোষ্ঠীর উপস্থিতি ও সাধারণ নিরাপত্তাহীনতা সীমান্তের কলম্বিয়া অংশে সমস্যাকে জটিল করে তুলেছিল। ভিয়ালোন বলেন, তাঁদের গাইড নিশ্চিত করেছিলেন, হুমকিদাতারা যেন জানে যে সাংবাদিকেরা অভিবাসীদের যাত্রাপথ নিয়ে কাজ করবেন, কত দিনের জন্য এবং কোন কোন রুট ধরে। ভিয়ালোনের মতে, এই আগাম সতর্কতা ক্ষতির ঝুঁকি কমিয়েছে: এক অর্থে, এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে, তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের দলটিকে অনুমোদন দিয়েছে।
ড্রস্ট বলেন, “আমাদের পক্ষে বেশ কিছু শক্তিশালী বিষয় কাজ করছিল। তার মধ্যে একটি হলো, যে কোন সম্ভাব্য চোর আমাদের গাইডদের চিনত। দ্বিতীয়ত, আমাদের দলটি সংখ্যায় বড় বলে, সেখানেও নিশ্চিত নিরাপত্তা ছিল। আমার ধারণা, যাত্রার শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে মোট পাঁচজন গাইড এবং সর্বোচ্চ ৩৫জন অভিবাসী ছিলেন।”
জঙ্গল জুড়ে সাংবাদিকদের পথ দেখাতে প্রত্যেক গাইড প্রতিদিনের জন্য ২০০ মার্কিন ডলার নিয়েছেন। তবে এই খরচ যথাযথ ছিল বলে মনে করেন ভিয়ালোন। তিনি ব্যাখ্যা করেন: “যথাযথ স্থানীয় সহায়তা ছাড়া এমন জায়গায় গেলে, আপনাকে হয় খালি হাতে ফিরতে হবে, নয়তো আপনার সঙ্গে খুব খারাপ কিছু হবে।”
যাত্রা শুরুর সময় পূর্বসতর্কতা হিসেবে সাংবাদিকেরা প্রয়োজনের তুলনায় দ্বিগুণ খাবার, পানি, প্রাথমিক চিকিৎসা উপকরণ, সাপের কামড়ের প্রতিকার হিসেবে নির্বিষকরণ চিকিৎসা সামগ্রী, স্যালাইন সল্যুশনের বেশ কয়েকটি আইভি ব্যাগ, একটি স্যাটেলাইট ফোন এবং একটি জিপিএস ট্র্যাকারও সঙ্গে নিয়েছিলেন যেন তারা পিবিএস নিউজআওয়ারের প্রযোজককে প্রতিদিন তাদের সম্ভাব্য অবস্থান জানিয়ে সংকেত পাঠাতে পারেন।
এক সপ্তাহ ধরে এই রেইনফরেস্টের মূল অংশ দিয়ে পায়ে হেঁটে যাত্রা করা মোটেও সহজ ছিল না। বিশ্বের অন্যতম স্যাঁতস্যাঁতে এই অঞ্চলে ছোটখাটো বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে সবকিছু ব্যাকপ্যাকে ঝুলিয়ে বয়ে বেড়াতে হয়েছে। দলটি গাছে ঝোলানো বস্তায় রাত কাটিয়েছে, এবং পথিমধ্যে কোনো গ্রাম বা বিশ্রামের সুযোগ ছিল না। এমনকি গোড়ালি মচকানো বা পড়ে যাওয়ার মত সামান্য দুর্ঘটনা পুরো রিপোর্টিং অভিযানকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারত বা তার চেয়েও খারাপ কিছু হতে পারত।
তবুও জিআইজেএনের সদস্য সংগঠন পুলিৎজার সেন্টার একটি ইন্সুরেন্স পলিসির সুবিধা দিয়েছে, যা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত ফ্রিল্যান্সারদের দেয় না। এই পলিসিতে জরুরি ভিত্তিতে স্থান ত্যাগের খরচও অর্ন্তভুক্ত ছিল।
তবুও, ফ্রিল্যান্সার হিসেবে, এতটা কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ একটি রিপোর্টিং প্রকল্পের দায়িত্ব নেয়ার বাড়তি জটিলতাগুলো তুলে ধরেন ড্রস্ট: একটি সংবাদ প্রতিষ্ঠানের কর্মী আহত হলে এবং কাজে অক্ষম হলেও বেতন পান। কিন্তু ফ্রিল্যান্সার হিসেবে, কোনো অভিযানে আহত হলে মাসের পর মাস কাজ থেকে দূরে থাকতে হতে পারে, আর নিজেদের করা স্টোরির পারিশ্রমিকের বাইরে আর কিছু না-ও জুটতে পারে।
যাত্রাপথের রিপোর্টিং
ড্রস্ট ও ফেডেরিকো এই উচ্চাকাঙ্খী প্রকল্প নিয়ে ছয় মাস কাজ করেছেন; ভিয়ালোন মূলত এই অভিযানের জন্য সরঞ্জাম ও পরিচিত লোক যোগাড় করেছেন এবং ক্যালিফোর্নিয়া সানডে ম্যাগাজিনে ছবি পাঠিয়েছেন। রিপোর্টিংয়ে মাঠ পর্যায়ে তিন সপ্তাহ লেগেছে: কলম্বিয়ার কাপুরগানা শহরে এক সপ্তাহ, অভিবাসীদের সঙ্গে যাত্রাপথে হেঁটে এক সপ্তাহ, এবং পানামায় এক সপ্তাহ। তারপর ড্রস্ট ও ফেডেরিকো তিনটি টেলিভিশন প্যাকেজ লেখা ও সম্পাদনায় দুই থেকে তিন মাস সময় নিয়েছেন। একইভাবে ড্রস্ট, তিন মাস ধরে, দিন রাত এক করে তাঁর সাময়িকীর জন্য লেখাটি শেষ করেছেন।
ড্রস্ট তাঁর সোর্সদের সঙ্গে যে ব্যক্তিগত আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, সেটি এই স্টোরিতে প্রাণ আনার জন্য অপরিহার্য ছিল, কারণ অভিবাসীরা প্রতিবেদনে সনাক্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ছিলেন। তিনি বলেন, “একসঙ্গে একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া দারুণ কাজে এসেছে।” যাত্রাপথে আমি কোনো অভিবাসীর ইনডেপথ সাক্ষাৎকার নেইনি- অন্তত সাময়িকীর জন্য লেখায় এটাই আমার রিপোর্টিং কৌশল ছিল, যদিও জানি, কেউ আমার স্টোরির মূল চরিত্র হলে সেটাই করতাম- আমাকে হয়তো কয়েক ঘন্টা ধরে, প্রত্যেকের সাক্ষাৎকার নিতে হত।” তিনি বলেছেন, অভিবাসীদের ট্রেইলে মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ, তাদেরকে জানা, এবং সম্পর্ক গড়ার দিকেই তাঁর মনোযোগ ছিল।
ড্রস্ট এই যাত্রাপথে ক্যামেরুন ও পাকিস্তানিদের একটি দলের সঙ্গে ২৪ ঘন্টা কাটিয়েছেন। পরিশেষে তারাই সাময়িকীর লেখার মূল চরিত্র হিসেবে উঠে এসেছে। পানামায় অভিবাসী ক্যাম্পে পৌঁছানোর পরই কেবল তিনি তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সবাইকে কোস্টারিকা সীমান্তে না নেয়া পর্যন্ত, তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
ফেডেরিকো বলেছেন, তাঁর প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল একই সময়ে দুই ধরনের ছবি তোলা: সাময়িকীর জন্য স্থিরচিত্র এবং টিভির জন্য দীর্ঘ সময়ের ভিডিও। কিন্তু তার হাতে ছিল কেবল ১০টি ক্যামেরা ব্যাটারি, প্রতিদিন একটি, এবং সেগুলোকে চার্জ দেয়ার কোনো উপায় নেই। এই পরিস্থিতিতে তিনি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম সময়ের দৃশ্য ধারণ করেছেন। রেইনফরেস্টের বিশালতা ও সৌন্দর্য ধারণের জন্য দলটি একটি ড্রোনও নিয়ে গিয়েছিল, তবে জঙ্গলজুড়ে এটি বয়ে বেড়ানো বেশ কষ্টসাধ্য ও কঠিন হয়ে ওঠে।
ফেডেরিকো বলেন, “অভিবাসীদের সঙ্গে গড়ে ওঠা ব্যক্তিগত সম্পর্ক আমি ছবিতে ধারণের চেষ্টা করেছি। সত্যি বলতে কি, নিউ ইয়র্কে লাঞ্চের সময় এখনো তাদের কারো কারো সঙ্গে আমরা দেখা করি। তিন বছর পেরিয়ে গেছে এবং তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ এখনো হারায়নি।”
২০২১ সালের জানুয়ারিতে টুইটারে একটি “অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতার” বর্ণনা দেন ড্রস্ট। পিবিএস নিউজআওয়ারের সেই রিপোর্টের সুবাদে স্টোরি প্রকাশের দু বছর পর একজন বাংলাদেশি নিউ ইয়র্কে খাবার ডেলিভারির করতে গিয়ে তাঁকে চিনতে পারেন। এই সাংবাদিকেরা যে পথে গিয়েছেন, সপ্তাহখানেক পর তিনি সেই একই পথ পাড়ি দিয়েছেন। ড্রস্ট তাঁর টুইটে বলেন, “রিপল [বাংলাদেশি অভিবাসী] এই ভিডিও তার বন্ধু ও পরিবারকে দেখিয়েছেন, যা তাদেরকে বুঝতে সাহায্য করেছে যে এখানে পৌঁছাতে তাকে কিসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। যারা এভাবে আমেরিকায় এসেছে, তাদের অনেকের সঙ্গে এখন আমি আবার যুক্ত হয়েছি; আশ্রয়-প্রার্থীদের অনেকে আমাকে বলেছে, তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে রিপোর্ট হতে দেখা তাদের জন্য কতটা অর্থ বহন করে।”
ড্রস্টের মতে, এটি অভিবাসীদের মনে এমন অনুভূতি তৈরি করে যে তাদেরও কেউ দেখছে, বিশেষ করে এমন একটি দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আসার পর। তাদের কষ্টের বোঝা কিছুটা হলেও হালকা হয়, কারণ অন্যেরাও তখন সেটি বুঝতে পারে। রিপলের মত অন্যদের কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন: “এখানে পৌঁছাতে তাকে একটি দুর্গম জঙ্গল পাড়ি দিতে হয়েছিল যেসব কারণে, অথবা একটি অমানবিক অ্যাসাইলাম ব্যবস্থায় সে এখন যে আচরণের শিকার হচ্ছে – তার কিছুই বদলাতে না পারলেও গল্পের সেই মানুষগুলোর কাছে সাংবাদিকতা অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে: শুধু গল্পটাকে বলে, এবং কারো হয়ে সত্যটাকে তুলে ধরে।”
সম্পাদকের নোট: ক্যালিফোর্নিয়া সানডে ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হোয়েন ক্যান উই রিয়েলি রেস্ট? শীর্ষক রিপোর্ট পুলিৎজার পুরস্কার ও ২০২১ মাইকেল কেলি অ্যাওয়ার্ড এনে দিয়েছে ড্রস্টকে। অন্যদিকে পিবিএস নিউজআওয়ারে প্রচারিত ডেসপারেট জার্নি প্রতিবেদনের জন্য ড্রস্ট ও ফেডেরিকো ২০২১ পিবডি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন।
আরও পড়ুন
মানব পাচার অনুসন্ধান: চোখের সামনেই লুকোনো যে অশুভ শক্তি
অভিবাসীদের না-বলা গল্প যেভাবে উঠে এলো মহাদেশজোড়া অনুসন্ধানে
ম্যাপিং মাইগ্রেশন ডেথস উইথ জিআইএস মডেলিং
সান্তিয়াগো ভিয়া একজন পদকজয়ী সাংবাদিক, যিনি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে লাতিন আমেরিকার সংবাদ মাধ্যমগুলোতে লিখেছেন। বর্তমানে তিনি কলম্বিয়ায় থাকেন এবং সেখানকার এল এসপেকতাদোর পত্রিকার জন্য কলাম লিখেন। ইতিপূর্বে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, ভেনেজুয়েলা, এবং ইকুয়েডরে বিদেশি প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন।