Image: Shutterstock
নির্বাচনে ভুয়া তথ্য ঠেকাচ্ছে জেনারেটিভ এআই, বৈশ্বিক দক্ষিণে প্রভাব কম
২০২৪ সালকে বলা হচ্ছে বৈশ্বিক সাধারণ নির্বাচনের বছর। বছর জুড়েই চলছে নির্বাচন। বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ বছর। এ সুযোগে জেনারেটিভ এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার করে ভুয়া তথ্য প্রচারকারীরা জাল ছবি, জাল ভিডিও আর ভুয়া অডিও তৈরির মাধ্যমে চালাচ্ছে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা।
এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) মিথ্যার বিস্তারে বিপ্লব ঘটাচ্ছে, কিন্তু এটি কী মিথ্যা তথ্য নির্মূলেও সাহায্য করতে পারে?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি নরওয়ে, জর্জিয়া এবং ঘানার তিনজন ফ্যাক্ট-চেকারের সঙ্গে কথা বলি। এই ফ্যাক্টচেকাররা তাদের কাজের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করছেন। কিন্তু আমরা যখন বিভিন্ন ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তি প্রয়োগের বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে যাই, তখন নতুন নতুন প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার বিষয়গুলো সামনে চলে আসে। পশ্চিমের বাইরের দেশগুলোয় কিংবা প্রশিক্ষণ মডেলের ভাষাগত সীমাবদ্ধতার কারণে এআই খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছে না ।
এআই কীভাবে সাহায্য করতে পারে?
জেনারেটিভ এআই খুব দ্রুত ও নির্ভুলভাবে কাজ করতে সক্ষম। ফলে ফ্যাক্ট-চেকিং এ অনেক প্রতিষ্ঠানই প্রযুক্তিটি ব্যবহারে উৎসাহী হচ্ছে।
যেমন, নরওয়ের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান ফ্যাকশেস ভেরিফাইজারবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স (ওএসআইএনটি) ব্যবহার করে সমস্যার সমাধান করছে। নিজেদের কাজের সুবিধার্থে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এআইয়ের ব্যবহার নিয়েও তারা পরীক্ষা চালাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা হেনরিক ব্র্যাটলি ভোল্ড। জিওস্পাই নামে একটি এআই ফটো জিওলোকেশন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা নিয়ে তিনি বলেন “ছবি থেকে বিভিন্ন ফিচার বের করে সেগুলো ভৌগলিক অঞ্চল, দেশ এবং শহরের ফিচারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি আমরা।”
বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এআই গবেষকদের সঙ্গে মিলে তারা কিছু টুল তৈরিতেও কাজ করেছেন, যেগুলো আরও বেশি কার্যকর ফলাফল দিতে সক্ষম। এমন একটি টুল ট্যাঙ্ক ক্লাসিফায়ার। যা ব্যবহারকারীর পোস্ট করা ছবিতে থাকা ট্যাঙ্ক বা যুদ্ধযান শনাক্ত করতে সক্ষম। অন্যটি একটি ভাষা সনাক্তকরণ টুল। টুলটি ভিডিও বা অডিও ফাইলে ঠিক কোন ভাষায় কথা বলা হচ্ছে— তা পরীক্ষা করে।
ফ্যাকশেস ভেরিফাইজারবারের দলটি ওএসআইএনটি অনুসন্ধানকে ভিজ্যুয়ালাইজ (দৃশ্যমানভাবে তুলে ধরা) করতে ব্যবহার করছে চ্যাটজিপিটি।
এ নিয়ে ব্র্যাটলি ভোল্ড বলেন, “আমরা আমাদের ডেটাবেসকে কাজে লাগিয়েছি। এটি ছিল একটি দীর্ঘ গুগল শিট। চ্যাটজিপিটির মাধ্যমে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন প্রতিবারই আমাদের নির্দেশনা (প্রম্পট) অনুসারে একটি এমবেডেড ম্যাপ তৈরি করতে পারে। আমরা কাজ করেছি চ্যাটজিপিটির ডেটা ইন্টারপ্রেটার ফাংশন (নির্দেশনা কাঠামো) নিয়ে। যেন এটি ডেটাগুলো বুঝে প্রসেস করতে সক্ষম হয়।”
এ পদ্ধতিতে ভৌগলিক অবস্থানকে ভিজ্যুয়ালি তুলে ধরা যায়। কোডের মাধ্যমে টুলগুলো এই কাজ করে থাকে। ডাউনলোড করা যাএমন কিছু এইচটিএমএল ওপেনস্ট্রিটম্যাপ সরবরাহ করে। প্রয়োজনে যা পরিমার্জন ও পুনরায় নকশা করাও সম্ভব। এভাবে আমরা এমন একটি ম্যাপ হাতে পাই, যেখানে গাজায় চলমান যুদ্ধের যাচাইকৃত (ফ্যাক্ট চেক করা হয়েছে) সব ছবি এবং ভিডিও রয়েছে।
নরওয়েজিয়ান ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা ফ্যাকশেস ভেরিফাইজারবার জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা হেনরিক ব্র্যাটলি ভোল্ড। বলেন, “চ্যাটজিপিটির মাধ্যমে খুব অল্প সময়ে প্রাথমিক কোনো ধারণাকে প্রোটোটাইপ (একটি ধারণা বা প্রক্রিয়া পরীক্ষার জন্য প্রাথমিক নমুনা বা মডেল তৈরি) আকারে তুলে ধরা যায়।”
এ সম্পর্কে তিনি বলেন “আমরা ইচ্ছেমতো বিভিন্ন কলাম নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি। তারপরও কাজ শেষ হয়েছে খুব দ্রুত। চ্যাটজিপিটিকে আমরা ক্রমান্নয়ে জটিলতর সমস্যা সমাধান করতে বলি। প্রতিবারই তা আমাদের সন্তোষজনক ফলাফল দিয়েছে। আমরা কোডের বিভিন্ন দিক নিয়ে পরীক্ষা করেছি, আবার আমাদের পছন্দসই ফিচারগুলোকেও বেছে নিতে পেরেছি।”
নরওয়েজিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের এআই গবেষকদের সঙ্গে মিলে একটি ড্যাশবোর্ড তৈরি করছে ফ্যাকশেস ভেরিফাইজারবার, যা নিউজরুমে এআইয়ের ব্যবহার বাড়াবে। এ ড্যাশবোর্ডে থাকবে এআইয়ের তিনটি কম্পোনেন্ট। যেগুলো ব্যবহার করে তিন ধরনের কাজ করা যাবে। এক, সোর্স ভিডিও টেনে আনা ও ড্রপ করা এবং একটি কী ফ্রেম বাছাই করা, যেটি বিপরীত চিত্র (রিভার্স ইমেজ) অনুসন্ধানের জন্য টুল প্রস্তুত করবে। দুই, টেক্সট-স্ক্যান করা এবং কী ফ্রেমে প্রদর্শিত পাঠ্যের ওপর ভিত্তি করে অনুসন্ধান করা। তিন, কোনো ভিডিওতে বিষয়বস্তু শনাক্ত করা এবং তা একে অপরের থেকে কতটা দূরে রয়েছে তা জানানো।
যদিও ব্র্যাটলি ভোল্ড জানান, ড্যাশবোর্ডটিকে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। বিভ্রান্তিমূলক ও ভুল তথ্য ছড়ানোর মাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এআইয়ের সহযোগিতা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও বাড়ছে।
তিনি আরো বলেন “বিশ্বাসযোগ্য ও পুরোপুরি নির্ভুল ফ্যাক্ট-চেক করতে আমাদের আধা ঘন্টা থেকে শুরু করে তিন দিন কিংবা আরো বেশি সময় লাগতে পারে। নিউজরুমের অনেক সময় দ্রুত সাহায্যের প্রয়োজন হয়, তখন তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য যাচাইয়ের প্রয়োজন পড়ে, এ সময় তিন দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব নয়।”
জর্জিয়াতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা
জেনারেটিভ এআই নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে জর্জিয়ার ফ্যাক্ট-চেকিং প্ল্যাটফর্ম মিথ ডিটেক্টর-এর একটি দল। এডিটর-ইন-চীফ তামার কিন্টসুরাশভিলি বলেন, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে পড়া ক্ষতিকারক তথ্য শনাক্ত করতে সাহায্য করছে এআই। এ জন্য তারা একটি ম্যাচিং মেকানিজম ব্যবহার করছেন। যা কিছু বিষয়বস্তুকে মিথ্যা বলে শনাক্ত করে এবং এআইকে সাহায্য করে অনলাইনে একই রকম মিথ্যা বিষয়বস্তু খুঁজে বের করতে।
তিনি আরো বলেন, “আমরা যখন কোনো বিষয়বস্তু নিয়ে নির্দেশনা দিই, এআই তখন একই ধরনের বিষয়বস্তু খুঁজে পায়। কিন্তু ভুয়া তথ্য প্রচারকারীরা খুব ভালোভাবেই জানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নীতিগুলোকে কীভাবে পাশ কাটাতে হয়। তাই তারা অনেক সময় ফেসবুক পেজের মাধ্যমে প্রচার না করে বরং রাজনৈতিক দল বা উগ্র ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ভুয়া কনটেন্ট ছড়িয়ে দেয়। আমাদের পক্ষে শুধু পাবলিক পেজ ও গ্রুপগুলোকে দেখা সম্ভব। তাছাড়া ক্রাউডট্যাঙ্গলের মতো সোশ্যাল লিসেনিং টুল ব্যবহার করে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিদের সবসময় শনাক্ত করাটাও সম্ভব হয় না।”
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের আগস্ট নাগাদ ক্রাউডট্যাঙ্গল বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে মেটা। এদিকে অক্টোবরে জর্জিয়াতে নির্বাচন হবে। মেটার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ক্রাউডট্যাঙ্গলের জায়গায় তারা কনটেন্ট লাইব্রেরি এপিআই নামের নতুন একটি টুল নিয়ে আসছে।
কিন্টসুরাশভিলি জানান, এআই যদিও কিছু বিষয়বস্তু চিহ্নিত করতে সাহায্য করছে, তবে টুলটি যেহেতু জর্জিয়ান ভাষায় প্রশিক্ষিত নয়, তাই তথ্যগত কিছু অমিল রয়েই যায়। যা আবার আমাদের যাচাই করতে হয়।
তিনি আরও বলেন, “টুলগুলো ঠিকঠাক মতো কাজ করলে আমাদের সময় বাঁচে, তবে কিছু টুল নিয়ে এখনও পরীক্ষা চলছে। এআই ফ্যাক্ট-চেকিং টুলগুলো এখনও খুব একটা দক্ষতা সম্পন্ন নয়, তবে আমি নিশ্চিত যে ভবিষ্যতে টুলগুলো আরও উন্নত হবে।”
কিন্টসুরাশভিলি আমাকে বলেন যে, ফেসবুক ড্যাশবোর্ড থেকে আসা ডেটাগুলো তারা শেয়ার করতে পারেন না। আর এখানেই তারা অনেক বেশি অসঙ্গতি দেখতে পান।
এর মাধ্যমে তিনি বলতে চেয়েছেন, এআই সফলভাবে ব্যক্তিত্ব সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্যগুলো মিলাতে পারে। যদি কোনো পোস্টে কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে (যেমন জর্জিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিডজিনা ইভানিশভিলি) কিংবা কোনো মিডিয়া আউটলেট (যেমন স্পুটনিক) এর কথা উল্লেখ করা থাকে, এআই তখন এ বৈশিষ্ট্যগুলোকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। তবে বিষয়ভিত্তিক (থিমেটিক) কোনো পোস্টের ক্ষেত্রে খুব একটা সঠিক ফলাফল দিতে পারে না।
এআইয়ের ভাষাগত সীমাবদ্ধতা
যুক্তরাজ্যের ফুলফ্যাক্ট এবং স্পেনের মালদিতা ও নিউট্রাল-এর মতো বেশ কয়েকটি ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা এরই মধ্যে তাদের কাজের সুবিধার্থে এআই টুল ব্যবহার করছে। অন্যান্য দেশের আউটলেটগুলোও আগ্রহী। তবে বার্তা কক্ষগুলোর প্রশ্ন হচ্ছে অল্প সংখ্যক লোকেরা যে ভাষায় কথা বলে, এআই টুলগুলো সেসব ভাষার ক্ষেত্রে কার্যকর হবে?
ঘানার নিউজভিত্তিক ফ্যাক্ট-চেকিং প্ল্যাটফর্ম ঘানাফ্যাক্ট– এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবস্থাপনা সম্পাদক রাবিউ আলহাসান। তার এ প্রতিষ্ঠান বর্তমানে এআই টুল ব্যবহার বিষয়ক কিছু গাইডলাইন (নির্দেশনা) তৈরি করেছে। তিনি বলেন, এআই টুল ব্যবহার বিষয়ে তারা ভীষণ সতর্ক। তাই প্রকৃত তথ্য যাচাইয়ের জন্য তারা এর প্রয়োগ করবে না।
তিনি আরও বলেন, “আমরা মনে করি ছোট অঞ্চল ও দেশগুলো সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া বাড়লে এই টুলগুলোর সক্ষমতাও বাড়বে। তখন তারা ভুল তথ্য ছড়ানোর মতো সমস্যা মোকাবেলায় আরও কার্যকরভাবে কাজ করতে পারবে।”
তবে তিনি এও বলেন যে, “যেভাবে এআই ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে করে আমরা মনে করি কনটেন্ট তৈরি করা বা ফ্যাক্ট-চেক করার সময় প্রত্যাশিত নির্ভুল ফলাফল এআই থেকে পাওয়া যাবে না। মেশিন লার্নিং টুলগুলোকে যে কায়দায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সেটিই মূলত এসব সীমাবদ্ধতার জন্য দায়ী।”
মিথডিটেক্টরের ফ্যাক্ট-চেকিং-এর প্রধান মাইকো রাতিয়ানি এক বছর আগের একটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, জর্জিয়ান ভাষায় চ্যাটজিপিটিকে দেশের রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বেশ কিছু বিতর্কিত উত্তর দিয়েছিল।
ঘানাফ্যাক্টের আলহাসান জোর দিয়ে বলেন, মূলধারার বেশিরভাগ এআই টুলই পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির আদলে তৈরি ও সেভাবেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে তাদের। তাদের ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা নির্ভর কনটেন্ট নিয়ে কাজ করার উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে।
যেমন,বাংলা, সোয়াহিলি, থাই এবং উর্দুর মতো ভাষায় বিপরীতে চ্যাটজিপিটি-৩.৫ সংষ্করণের সক্ষমতা পরীক্ষা করছে রেস্ট অব ওয়ার্ল্ড। তবে চ্যাটবটের তথ্যেও অনেক সমস্যা পাওয়া গেছে। রেস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ডের অন্য একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে ইমেজ-ভিত্তিক জেনারেটিভ এআই জাতীয়তা ভেদে পক্ষপাতমূলক, গৎবাঁধা ও অসম্পূর্ণ (রিডাকশনিজম) তথ্য উপস্থাপনের প্রবণতা রয়েছে।”
গবেষকেরা এ ধরনের ভাষাগত অসঙ্গতির উপর জোর দিয়েছেন। যেমন, ডিজিটাল প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ড. স্কট টিমকি, চিন্ময়ী অরুণ এবং জামিলা ভেনতুরিনি বৈশ্বিক দক্ষিণের স্থানীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করে এআই বিকাশের বিরুদ্ধে সর্তক করেছেন।
ঘানার প্রধান ভাষা ইংরেজি। কিন্তু আলহাসান বলেন, সেখানে ১০০টিরও বেশি স্থানীয় ভাষা রয়েছে। যা একটি অতিরিক্ত ভাষাগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। যেসব দেশে এ ধরনের কথ্য ভাষায় কথা বলার প্রচলন রয়েছে, সেখানে ফ্যাক্ট-চেকারদের উদীয়মান এ প্রযুক্তি থেকে উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
মিথডিটেক্টরের তামার কিন্টসুরাশভিলিও একই ধরনের উদ্বেগের কথা বলেন। তাদের দলটি সফলভাবে এআই টুলকে যাচাই করছে। যদিও তিনি বলেন যে, জর্জিয়ার মতো দেশের ভাষা অনলাইনে খুব একটা ব্যবহারিত হয় না। এ ধরনের ভাষা নিয়ে এআই প্রতিষ্ঠানগুলোর আরো বেশি কাজ করা উচিৎ।
তিনি মনে করেন, “স্বল্প সংখ্যক লোকেরা কথা বলে এমন ভাষার ক্ষতিকারক কনটেন্ট শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।” তামার কিন্টসুরাশভিলি তাই বলেছেন, “স্বল্প সংখ্যক লোক যে ভাষায় কথা বলে, বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো তা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। জর্জিয়াতে রাষ্ট্রভাষা ছাড়াও সংখ্যালঘু বসতি রয়েছে। তাই আর্মেনিয়ান এবং আজারবাইজানীয় ভাষাগুলোকেও বিবেচনায় নেওয়া উচিত। না হলে ফ্যাক্ট-চেকারদের কাজ আরও জটিল হয়ে যায়।”
নরওয়েজিয়ার ভাষায় কথা বলে খুব অল্প লোক। এআইয়ের নতুন কোনো পরিষেবায় এ ভাষাটি অগ্রাধিকার পাবে না। তবে ব্র্যাটলি ভোল্ড বলেন “এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম চ্যাটজিপিটি। আমাদের জন্য যা দারুণ কাজ করে। এটি ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আমাদের নিজস্ব ভাষায় নির্দেশনা দিতে পারি। চ্যাটজিপিটি বেশিরভাগ সময় প্রেক্ষাপটগুলোও বুঝতে পারবে।”
তবে তিনি এটাও বলেন যে, টুলটি নিখুঁত নয়। ” এটি প্রত্যেক সময়ে কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য তুলে ধরবে। যেমন এটি যখন ডেনিশ ভাষায় উত্তর দেবে, তখন নরওয়েজিয়ার বিষয়ে বিভ্রান্ত হবে।”
নরওয়েতেও চ্যাটজিপিটির সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান। ব্রাটলি ভোল্ডের দলটি কোডিংয়ের জন্য টুল ব্যবহার করে দেখতে পেয়েছে যে, দুপুর ২ টার পর এটি দিয়ে কাজ করাটা রীতিমতো মাথা ধরিয়ে দিতে পারে। কেননা তখন চ্যাটজিপিটি খুব একটা কাজ করে না। ভোল্ড ও তার দলের ধারণা এ সময় আমেরিকানদের দিন শুরু হয়। তারা কাজে নামে। চ্যাটজিপিটিতে ট্রাফিক বেড়ে যায়। তাই এ সময়ে ভুল তথ্য প্রদর্শন করতে থাকে।
তিনি আরো বলেন, “তাছাড়া টুলটির কল্পিত তথ্য দেওয়ার প্রবণতাও রয়েছে। তাই তথ্যটি সঠিক কিনা তা যাচাই করার জন্য আমাদের বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছির। আমরা হাতে কলমে প্রতিটি জিওপয়েন্ট যাচাই করেছি।
বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো কী সাহযোগিতা করতে পারে?
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘানা। আলহাসান ও তার দল অক্লান্ত পরিশ্রম করছে ভুল তথ্য ছড়ানো ঠেকাতে। এটি নিয়ে কাজ করার সময় তারা ট্রল ফার্মগুলোর তৎপরতা দেখেছে। এই ফার্মগুলো নির্বাচন ঘিরে এআই দিয়ে তৈরি কনটেন্ট ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্ল্যাটফর্মগুলো যখন ছোট অঞ্চল বা ছোট আকারের বাজারগুলোকে অবহেলা করে তখন সেখানে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর প্রচেষ্টা ঠেকাতে অনেক বেশি ফ্যাক্ট-চেকারের প্রয়োজন পড়ে।
এদিকে মেটা, চ্যাটচজিপিটি এবং টিকিটকের কনটেন্ট মডারেটর (ব্যবহারকারীদের ডেটা স্ক্রীন করে এবং অনুপযুক্ত বা ক্ষতিকর কনটেন্ট সরিয়ে দেয়) এবং ডেটা ট্যাগাররা (যারা মূল ফাইল ডেটাতে মেটাডেটা যোগ করে) ভাল বেতন এবং উন্নত কর্মপরিবেশের দাবিতে আদালতের দারস্থ হচ্ছেন। ফলে ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে আফ্রিকায় লড়াইয়ের বিষয়টি অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে।
কন্টেন্ট মডারেটরদের মধ্যে ১৫০ জনেরও বেশি সদস্য মিলে প্রতিষ্ঠা করেছে আফ্রিকান কন্টেন্ট মডারেটর ইউনিয়ন। প্রতিষ্ঠাতাদের তথ্যানুসারে বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ৪০০। জ্যাকবিনের প্রতিবেদন অনুসারে যুক্তরাজ্যভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ফক্সগ্লোভ লিগ্যাল বলেছে,এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে মেটা গোপনে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মডারেশন চুক্তি করেছে।
আলহাসান অবশ্য মনে করেন বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে। নিজেদের প্ল্যাটফর্মের কনটেন্টের মান উন্নত করতে হবে। বিশেষ করে আফ্রিকাতে এবং অন্যান্য অ-পশ্চিমা অঞ্চলের বাজারগুলোতে।
“এমন কিছু বাজার আছে যাদের জন্য [বিগ টেক] কোনো ধরনের তহবিল সরবরাহ করে না এবং মনোযোগও দেয় না। এতে কিন্তু সেখানে তাদের প্ল্যাটফর্ম সম্পর্কিত সমস্যাগুলো দূর হয়ে যায় না,” বলেন তিনি।
আলহাসান তার কথার পক্ষে আরো যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন “পশ্চিমের প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো যদি এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়, এবং ওই সমস্যাগুলো যদি তাদের গণতন্ত্রকে নাড়া দিতে সক্ষম হয়; তাহলে আপনি ওই সব দেশগুলোর কথা ভাবুন, যেখানে গণতন্ত্র হালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”
মেটার অন্যতম বৃহত্তম বাজার ভারত। ফেসবুকের ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা গেছে দেশটির ৩৪ কোটি ব্যবহারকারীর প্ল্যাটফর্ম জুড়েই ভুল এবং বিভ্রান্তিমূলত তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ দেশটির ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধীদের মদদপুষ্ট বিভিন্ন বট (স্বয়ংক্রিয় সফ্টওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন) ও ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে ২০১৯ সালের নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো হয়।
নথিগুলোতে আরও দেখা যায় যে, ওই দেশে ফেসবুকের পর্যাপ্ত লোকবল নেই। ফলে তারা ভুয়া কনন্টেটের সুনামির বিপরীতে লড়াই করতে ব্যর্থ হয়েছিল। ফাঁস হওয়া নথিগুলো থেকে আরও জানা যায় যে কোম্পানির বৈশ্বিক বাজেটের ৮৭ শতাংশ অর্থই বরাদ্দ করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভুল তথ্য যাচাইয়ের কাজে। বিপরীতে বাকি বিশ্বের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল মাত্র ১৩ শতাংশ অর্থ।
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো যদি আঞ্চলিক এবং জাতীয় পরিস্থিতি মোকাবেলায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে অক্ষম হয়, তাহলে আমরা কী আর এআই প্ল্যাটফর্মগুলোকে বিশ্বাস করতে পারি?
এ সম্পর্কে ফ্যাকশেস ভেরিফাইজারবারের ব্র্যাটলি ভোল্ড জানান, যারা এআই নিয়ে কাজ করতে আশাবাদী তাদের জন্য একটি ভাল সমাধা হতে পারে বৃহত্তর পরিষেবাগুলোতে জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইন্ড ট্রান্সফরমার ব্যবহার করা।
তিনি বলেন, “নরওয়েজিয়ানরা নরএলএলএম বা নরজিপিটি ব্যবহার করছে—এমনটা আমি দেখতে পাচ্ছি না।”
“বৃহত্তর প্রেক্ষাপট বিবেচনায় হয়তো যা খুবই সামান্য উদ্যোগ। কিন্তু ছোট জনগোষ্ঠীর এবং সাংস্কৃতিক অঞ্চলগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি আগামীতে বিভিন্ন টুলে এটিকে প্রয়োগ করা হবে।” উল্লেখ করেন তিনি।
চলতি বছর সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে জর্জিয়া। মিথডিটেক্টরের কিন্টসুরাশভিলিও তাই মনে করে যে ভাষা শেখার মডিউল উন্নয়নে প্রযুক্তি কোম্পানি আর একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ করা উচিত। এছাড়া বৃহৎ ভাষার মডেলগুলো বৈচিত্র্যময় করার জন্য অন্যান্য অংশীজনদেরও সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে।
এ সম্পর্কে তিনি বলেন “কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আর স্থানীয় সংস্থা মিলে ডিজিটাল বিশ্বে জর্জিয়ান ভাষাকে আরও নির্ভুলভাবে উপস্থাপনের লক্ষ্যে কাজ করছে। আমি আশা করি স্বল্প সংখ্যক জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে এটি ব্যবহারের প্রচেষ্টা সফল হবে। তবে ডিজিটাল বিশ্বে জর্জিয়ান ভাষাকে আরও সহজবোধ্য করে উপস্থাপনের জন্য শুধুমাত্র ফ্যাক্ট চেকারদের কাছ থেকে নয়, বরং বিভিন্ন সংস্থা, গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়কেও কাজ করতে হবে, বিনিয়োগও বাড়াতে হবে।
এ লক্ষ্যে কাজ করতে হবে ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং (এনএলপি) নিয়ে। এআইয়ের এ শাখাটি কম্পিউটারকে মানুষের ভাষা বোঝানো, ব্যাখ্যা করা ও প্রসেস করায় সক্ষম করে। এটি অর্থবহ ও ব্যবহারোপযোগী। যেমন, জর্জিয়ার ইলিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় এনএলপি শাখাটিকে বৈচিত্র্যকরণে ইইউ অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে।
তাছাড়া শুধুমাত্র প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর ভাগ্য ছেড়ে দেওয়া নয়, অন্যভাবেও কাজ করা যায়। ফ্যাকশেস ভেরিফাইজারবার যেমন কয়েকটি সহযোগী সংস্থার হাতে তৈরি। এটির সূচনা হয়েছিল, নরওয়ের প্রধান সংবাদ মাধ্যমগুলোর সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা থেকে। যারা সাংবাদিকদের সত্য তথ্য যাচাই এবং ওএসআইএনটি কৌশল বিষয়ক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিউজরুমের দক্ষতা বৃদ্ধিতে নজর দেয়।
এই নীতিটিই ভেরিফাইজারবারকে এআই টুল তৈরিতে অনুপ্রাণিত করছে। এ টুলগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত বা ওপেন-সোর্স। যা গিটহাব-এ আপলোড করে দেওয়া হয়েছে। যে কেউ চাইলে এগুলো নিয়ে কাজ করতে পারে বা কাজে লাগাতে পারে।
ব্রাটলি ভোল্ড বলেন, “ছোট এলাকার বার্তাকক্ষগুলোর জন্য আমি বলব যে বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে এক হয়ে কাজে নামাটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, ছোট নিউজরুম এবং ছোট অঞ্চলের নিউজরুমগুলো এভাবে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করতে পারে।”
তিনি আরো বলেন, “প্রতিবেদন নিয়ে আমাদের প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠা উচিত নয়। বরং সহযোগিতার মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। পাশের কোনো বার্তাকক্ষ নয়, আমাদের প্রধান শত্রু ভুয়া তথ্য।”
গ্রেটেল কান পানামার সাংবাদিক। তিনি মন্ট্রিলে কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (সিবিসি) এর জন্য কাজ করেছেন। সেখানে তিনি রেডিও এবং ওয়েবের জন্য প্রতিদিনের সংবাদ তৈরি করতেন।