

Image: Shutterstock
ডেটা সাংবাদিকতার ১০ সাধারণ ভুল
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
এ যুগের ডেটা সাংবাদিকতা সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে, নীতি পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখছে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, সরকারের দুর্বল নীতি থেকে শুরু করে জাতিগত কিংবা লৈঙ্গিক বৈষম্যের মতো বিষয় বোঝাতে জোরালো প্রমাণ হাজির করতে পারে ডেটা সাংবাদিকতাই। তবে, এতকিছুর পরও ডেটা সাংবাদিকতার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
প্রচলিত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে— যেমন, রোবোকলের (ভুতুড়ে কলের) মূল উৎস শণাক্ত করায় গড়পড়তা অদক্ষতা কিংবা ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে বা প্রতিষ্ঠানে অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো নিয়ে অনুসন্ধানের অনীহা ইত্যাদি।
এদিকে ডেটা নির্ভর রিপোর্টিংয়ের মধ্যেও বেশকিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন এটি কী ধরনের বিষয় তুলে ধরছে, কীভাবে ডেটা মূল্যায়ন করছে এবং এর গল্প বলার পদ্ধতি কি ইত্যাদি।
নিকার হলরুমে উপস্থিত আলোচক আর অংশগ্রহণকারীদের কাছে জিআইজেএনের প্রশ্ন ছিল, ডেটা সাংবাদিকতায় কী ধরনের সীমাবদ্ধতা তাঁরা প্রত্যক্ষ করছেন? তা ছাড়া, যেসব বিষয় অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত, কিংবা বার্তাকক্ষে যে ধরনের দক্ষতাকে অপেক্ষাকৃত কম কাজে লাগানো হচ্ছে সে ধরনের দক্ষতাকে শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার উপায় কি?
১. ডেটা বিশ্লেষণ ও গল্পের ভাষ্যের মধ্যে সংযোগের অভাব
ওয়াল্টার ক্রনকাইট স্কুল অব জার্নালিজমের সাংবাদিকতায় নাইট চেয়ার সারাহ কোহেন বলেন, “প্রতিবেদন তৈরিতে আমরা গল্পের যে ভাষ্য সেদিকে খুব একটা মনোযোগ দিচ্ছি না — একটি প্রতিবেদনে ডেটা হলো একটা ভিত্তির মতো, যেখান থেকে ভাষ্যের সূত্রপাত হয়। কিন্তু আমরা মনে করছি ডেটাটাই সব।
তিনি আরও বলেন, “আমি একজন বিচারক [ডেটা জার্নালিজম বিষয়ক বিভিন্ন পুরষ্কারের]। তাই আমি আপনাদের বলতে পারি যে, পুরস্কারের জন্য জমা পড়া ৯০ শতাংশ প্রতিবেদনই আমি বাদ দিয়েছি। কারণ ওগুলোতে ডেটা ব্যবহারের দুর্দান্ত চর্চা চোখে পড়লেও সাংবাদিকতার মাপকাঠিতে মোটেও তা দুর্দান্ত কিছু হয়নি। আমরা দুটোই করতে পারি— তবে একজন সাংবাদিক হিসাবে আমরা ঠিক কোন কাজটি সবচেয়ে ভালো করতে পারি তা যদি ভুলে যাই, তাহলে লাভটা কি?”
মিনিয়াপলিস স্টার ট্রিবিউনের ডেটা সম্পাদক মেরিজো ওয়েবস্টার সারা কোহেনের সঙ্গে একমত। তিনি বলছিলেন, “গল্পের মেরুদণ্ড হওয়া উচিত ডেটা, কিন্তু প্রায়ই তা গোটা দেহের আকার ধারণ করছে। আসলে, আমি মনে করি ‘ডেটা স্টোরি’ বিষয়টিই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা উচিত। তরুণ সাংবাদিকদের গল্পকে গল্প হিসাবেই ভাবতে হবে এবং গল্পগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার সূত্র হিসেবে ডেটাকে কাজে লাগাতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “কার্যকর ডেটা শনাক্ত করার পাশাপাশি প্রতিবেদনকে আরো মানবিক করে তুলতে আমরা একটি অনুচ্ছেদের পেছনে অন্তত তিন মাস সময় ব্যয় করতাম।”
কোহেনও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “ডেটা রিপোর্টাররা মনে করে যে, তাদের অনুসন্ধানগুলো বেশ চমকপ্রদ, কিন্তু তা নয়— বরং গল্পের মানবিক উপাদানগুলোই গুরুত্বপূর্ণ। ” — সারা কোহেন, সাংবাদিকতায় নাইট চেয়ার, ওয়াল্টার ক্রনকাইট স্কুল অব জার্নালিজম।
২. স্বল্প–দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন পাঠকদের জন্য দুর্বল হাইপারলিঙ্ক সংযোজন
ডেটা প্রতিবেদনে প্রায়ই ডেটার মূল উৎসগুলো দেখতে পাঠকদের “এখানে ক্লিক করুন” বা এ সম্পর্কিত সিরিজ গল্পগুলো খুঁজতে “আরো পড়ুন”— এমনকি পাঠকদের একটি ইউআরএলে ক্লিক করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।
অসাবধানতাবশত প্রতিবেদন লেখার সময় অনেকক্ষেত্রেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বা স্বল্প দৃষ্টিশক্তির পাঠকদের কথা মনে থাকে না। কিংবা যারা ডেটা আকারে গল্পটি পড়ার জন্য স্ক্রিন রিডার সফ্টওয়্যার ব্যবহার করেন, সেখানে পাঠ্যের ওপর হাইপারলিঙ্কগুলো কোনো কাজে আসে না।
নিউইয়র্ক আমস্টারডাম নিউজের অনুসন্ধানী প্রতিবেদক হেলিনা সেলেমন বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন যে, “আমাদের সবার উচিত ‘এখানে ক্লিক করুন’ বলার পরিবর্তে সম্পূর্ণ বর্ণনামূলক বাক্যাংশ ব্যবহার করা, কারণ স্ক্রিন রিডারে এগুলো শুধুই একটি তালিকা হিসাবে ফুটে ওঠে।
“লিঙ্কে এমন কিছু শব্দ সংযুক্ত করুন, যা লিঙ্কটি সম্পর্কে তথ্য তুলে ধরে। তাছাড়া মিডিয়াগুলো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের পাঠের উপযোগী করেও সংবাদ সরবরাহ করছে না।”

“এখানে ক্লিক করুন” এর মতো বাক্যাংশে হাইপারলিংক জুড়ে দেওয়া এড়িয়ে চলুন। কেননা এটি স্ক্রিন-রিডার সফ্টওয়্যার ব্যবহার করে এমন বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের কাছে ডেটা বিশ্লেষণের কাজটিকে আরো কঠিন করে তুলতে পারে। ছবি: স্ক্রিনশট, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া আইটি ব্লগ
৩. অনুমোদিত ডেটায় কখনো কখনো আউটলায়ার (ডেটাসেটের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ডেটা) দুই দফা যাচাইয়ের বাইরে থেকে যাওয়ায় বিপত্তি
“যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন করে তোলে তা হচ্ছে, ডেটা আমাদের ভুল দিকে পরিচালিত করতে পারে।” জিআইজেএনের সঙ্গে একটি পৃথক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন আর্জেন্টিনাভিত্তিক ডেটা সাংবাদিকতার প্রশিক্ষক স্যান্ড্রা ক্রুসিয়ানেলি, তিনি আইসিআইজের সদস্য এবংসোলোলোকালডটইনফোর প্রতিষ্ঠাতা। কেননা “ডেটাগুলো হয়তো অসম্পূর্ণ, পুরানো, এমনকি ডাটাবেজে ভুলভাবে তুলে দেওয়া হতে পারে।”
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচারণার অর্থ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদনের বাস্তব উদাহরণ তুলে ধরেন ক্রুসিয়ানেলি। যেখানে একটি উন্মুক্ত সরকারি ডেটাবেসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, একজন দাতা একটি রাজনৈতিক দলকে ১ মিলিয়ন ডলার (১০ লাখ ডলার) দিয়েছেন।
বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বিশাল এ অর্থের পরিমাণ আমাদের সন্দেহ জাগিয়ে তোলে। “আমরা ওই দাতাকে খুঁজে বের করে জানতে চাই যে আসলেই তিনি এ পরিমাণ অর্থ দিয়েছিলেন কিনা। দেখা যায়, তিনি শুধুমাত্র ১ লাখ ডলার দিয়েছিলেন। এরপর আমরা যখন ওই ডাটাবেসের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাই, তখন আমাদের বলা হয় ‘এটি লেখার ভুল ছিল।’
“আপনি শুধু বিষয়টি একবার কল্পনা করুন, যদি আমরা মিলিয়ন ডলার কথাটা উল্লেখ করে একটি শিরোনাম করতাম!”
যেহেতু প্রতিটি ডেটা সারি পরীক্ষা করা অবাস্তব, তাই তিনি সুপারিশ করেন সাংবাদিকদের কাছে যদি কোনো সংখ্যা বা পরিমাণকে অনেক বেশি কম বা বেশি বলে মনে হয়, তাহলে সেগুলোর দিকে নজর দিন।
“আমরা যখন ডেটা বিশ্লেষণ করি, তখন খোদ ওই সংখ্যাগুলোই ভুল তথ্য দিতে পারে,” তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি আরও বলেন, “তাই যাচাইকরণ অপরিহার্য। দেখতে হবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোন পরিমাণটি সবচেয়ে বেশি পরিবর্তিত হয়েছে, বা কোনটি সবচেয়ে কমেছে?”
(২০২৩ সালে জিআইজেএনের নিকার সম্মেলনে “হলওয়েস রাউন্ড-আপ” প্রতিবেদনে এ পয়েন্টটি তুলে ধরা হয়েছিল, যেখানে স্প্রেডশীটের ফাঁকা সারির সাধারণ ত্রুটির বিষয়গুলোও উল্লেখ করা হয়। ১০টি সাধারণ ডেটাবিষয়ক ত্রুটি যা অনুসন্ধানকে নষ্ট করতে পারে— জিআইজেএনের এ লেখাটি পড়ুন।)
৪. বিটভিত্তিক রিপোর্টার স্বল্পতার কারণে বাদ পড়ছে ডেটাতে থাকা অতি জরুরি তথ্য
আজকাল কয়টি নিউজ আউটলেটের সক্ষমতা আছে আলাদা করে রিপোর্টারদের শ্রম, স্থানীয় রাজনীতি বা প্রাথমিক শিক্ষা বিট ভাগ করে দেওয়ার?
অতীতে, এ বিট রিপোর্টাররা প্রায়ই জটিল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে পারতেন— এবং ডেটার অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরতেন — বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া ডেটাগুলা চিনতে পারতেন এবং তা অনুসন্ধানী বা ডেটা সম্পাদকদের সামনে হাজির করতেন। যারা প্রায়ই তাদের সঙ্গে বিট রিপোর্টারদের কাজে নিতেন।
জার্নালিস্টটুলবক্সডটএআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা মাইক রেইলি বলেন, সারাবিশ্বেই বার্তাকক্ষ থেকে রিপোর্টারদের সংখ্যা কমে যাওয়ার অর্থ হল তথ্যভিত্তিক অসংখ্য অনুসন্ধানের হারিয়ে যাওয়া। এর সঙ্গে বিট রিপোর্টারদের একটি অংশ হারিয়ে গেছে যারা রহস্যাবৃত, অস্পষ্ট বা দুর্বোধ্য বিষয়গুলোতে আলো ফেলতে পারতেন।
“এই শূন্যতা পূরণের জন্য আমাদের সৃজনশীল হতে হবে— যেখানে যৌথসমন্বয় অবশ্যই সাহায্য করবে,” বলেন রেইলি। তিনি আরো যোগ করেন যে, অপ্রচলিত বিটের ডেটা ঘিরে ডেটা সম্পাদকদের আরো সক্রিয়ভাবে চিন্তা করা উচিত, যেমন বিমান চলাচল বা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কিংবা বয়ষ্কদের যত্নবিষয়ক ডেটাগুলো তাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে কিনা।
৫. জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক একই ধরনের ডেটার মধ্যে আটকে থাকা
জিআইজেএনের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন লাতিন-আমেরিকান স্বাধীন মিডিয়া আউটলেট লা ডেটা কুয়েন্টার ডেটা বিশ্লেষণ সম্পাদক হ্যাসেল ফ্যালাস।
তিনি বলেন, “বিষয়টি যদিও সত্য যে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে সুস্পষ্ট পরিণতি, যেমন তাপপ্রবাহ, বন্যা এবং খরা নিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন রয়েছে, তবে ভূপৃষ্ঠের বাহ্যিক দিকগুলোর বাইরেও অন্যান্য বিষয়কগুলো নিয়ে আরও গভীর অনুসন্ধানের প্রয়োজন”
প্রতিষ্ঠানটি জলবায়ু পরিবর্তন ও লিঙ্গ সম্পর্কিত ডেটা সাংবাদিকতা নিয়ে কাজ করে। তিনি আরো বলেন যে, “জলবায়ু পরিবর্তনের বিপরীতে অভিযোজন ব্যবস্থা বিশ্লেষণ: প্রশমন এবং মানিয়ে নেওয়া বিষয়ক দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগুলো ঘিরে নিউজ আউটলেটগুলোর গভীর অনুসন্ধান চালাতে হবে।”
ফ্যালাস আরো বলেন: “আমরা যদি শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে দৃশ্যমান পরিণতিকে চিহ্নিত করি, তাহলে সমস্যার বহুমাত্রিক জটিলতা উপেক্ষার ঝুঁকি থেকে যায়। উদাহরণস্বরূপ, জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন বা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ার পরিবেশগত সমস্যাগুলো ছাড়াও আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিকগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা।”

জলবায়ু পরিবর্তনের গভীর প্রভাবগুলো বোঝার জন্য ডেটা ব্যবহার করেছে লা ডেটা কুয়েন্টা, যেমন এ চার্টে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত প্রভাব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির কারণে বিভিন্ন দেশের পরিকল্পিত অভিবাসন সম্পর্কিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ছবি: স্ক্রিনশট, লা ডেটা কুয়েন্টা
৬. শ্রম পাচারের ডেটা প্রতিবেদন উপেক্ষিত
সাম্প্রতিক বছরে শ্রম পাচারের ওপর তথ্য বহুল গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান পাঠকের মনোযোগ অকৃষ্ট করেছে, যেখানে বিদেশী মার্কিন সামরিক ঘাঁটি এবং মধ্যপ্রাচ্যে বৈশ্বিক ফাস্ট ফুড চেইনগুলোতে কর্মরত অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন ও অবমাননার বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
শ্রম পাচারে প্রায়ই শোষণ, কঠিন কর্ম পরিবেশ, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, এমনকি শ্রম ঠিকাদাররা যে শ্রমিকদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করছে এমন বিষয়গুলো জড়িত। এ শ্রম ঠিকাদারেরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে কাজ করে।
এ ধরনের বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন তৈরিতে কাজ করেছেন এনবিসি নিউজের সাবেক অনুসন্ধানী সম্পাদক অ্যান্ড্রু লেহরেন । তিনি মনে করেন এ প্রতিবেদনগুলো বিশ্ব জুড়ে কর্মী শোষণের ভয়াবহ হিমশৈলের সিকিভাগ তুলে ধরে, যেখানে অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আরো অনেক ডেটা রয়েছে।
লেহরেন বলেন, “আমাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের পশ্চিমা কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের ওপর— সন্দেহ নেই যে পাচার হয়ে আসা এ শ্রমিকদের গল্পগুলো কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা।”
তিনি বর্তমানে নিউইয়র্কের কিউনি জার্নালিজম স্কুলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পরিচালক।
লেহরেন বলেন, “বড় বড় কর্পোরেশনগুলো বিশ্বের বিভিন্ন যে জায়গায় কারখানা পরিচালনা করছে, যেখানে সস্তা শ্রমের ব্যাপক চাহিদা বিদ্যমান। সস্তা শ্রমিকের জন্য পশ্চিমা এ প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত নির্ভর করে শ্রম সরবরাহকারী সংস্থার ওপর, যাদের নজর থাকে খরচ কমিয়ে সর্বাধিক মুনাফা অর্জনের।
ফলে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল এবং ফিলিপাইনের থেকে আসা অভিবাসী শ্রমিকেরা তাদের কাছে নিগ্রহের শিকার হন। এ বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির জন্য যৌথ সহযোগিতার পাশাপাশি অনেক বেশি সময় নিয়ে অনুসন্ধান চালানোর প্রয়োজন পড়ে— যা বাস্তব এবং বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ঘটছে।
৭. ভোক্তারা যেখানে জালিয়াতির শিকার সেখানে ডেটা ব্যবহারে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাকে উপেক্ষা
পরিচয় চুরির ঘটনা এবং অনলাইন স্ক্যাম এমন দুটি বিষয় যেখানে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এ বিষয়গুলোর দিকে সাংবাদিকদের মনোযোগ কমই। ব্যক্তিকে তার পরিচয় বা আর্থিক বিবরণী প্রকাশ করতে বাধ্য করতে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয় একগাদা খুদে বার্তা, ইমেইল, কিংবা ফোনকলের বিবরণী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক্ষেত্রে জনস্বার্থে গভীর অনুসন্ধান করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ । কারণ অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ জানাতে বা বিষয়টি স্বীকার করতে বিব্রত বোধ করেন।
কিউনি জার্নালিজম স্কুলের চিটিং অ্যান্ড লার্নিং বিভাগের পরিচালক জেরেমি ক্যাপলান বলেন, “পরিচয় চুরি, ফিশিং এবং লোকেদের পাসপোর্টের তথ্য এবং সিকিউরিটি কোড দিতে বাধ্য করার মতো অনেকগুলো স্ক্যাম রয়েছে যা সংগঠিত উপায়ে ঘটে।”
তিনি আরো বলেন “আমরা এ বিষয়গুলোর ওপর যথেষ্ট প্রতিবেদন দেখতে পাচ্ছি না। এ স্ক্যামগুলো কীভাবে কাজ করে?তাদের চালিকা শক্তি কি? এদের পেছনে কোন দল আছে? হুমকির প্রবণতা সম্পর্কে ডেটা আমাদের কী বলে?
তিনি আরো বলেন: “আমি যদি আপনাকে একটি ইমেইল পাঠাই, তাতে লেখা থাকে: ‘আপনার অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানটি আমাদের ব্যাংকে ভুল অ্যাকাউন্টে অর্থ জমা করেছে— তার জন্ম তারিখ X, এবং আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে এটি তার সঠিক অ্যাকাউন্ট’, এ ধরনের ইমেইলের ফাঁদে অনেকেই পড়তে পারেন। ”
৮. ডেটানির্ভর ব্যতিক্রমী ইতিবাচক প্রতিবেদনকে উপেক্ষা
এটা একরকম অচিন্ত্যনীয় যে, প্রচলিত অনুসন্ধানী কোনো প্রতিবেদনে ইতিবাচক কোনো বিষয় বেরিয়ে এসেছে। অথচ, ডেটা সাংবাদিকতা সহজেই অজানা, বা অপ্রত্যাশিত, ইতিবাচক নীতিগত ফলাফলগুলো সামনে আনতে পারে। এতে করে জনসাধারণের মধ্যে আস্থা তৈরি হয় এবং নীতিনির্ধারকদের জবাবদিহিও নিশ্চিত করার সুযোগ তৈরি হয়।
নিউজ আউটলেটগুলো মেট্রিক্সের নাটকীয় উন্নতিকে সামান্যই তুলে ধরে, যেমন সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য হার এবং শিশুমৃত্যু হারের তীব্রতা হ্রাস — যা গত তিন দশকে কমেছে ৫৯ শতাংশ কিংবা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বের উৎসাহজনক বৃদ্ধি।
কিউনির ক্যাপলান বলেন, নিউজরুমের মূল্যায়ন করা উচিত যে তারা নেতিবাচক-পক্ষপাত প্রদর্শন করছে কিনা। এছাড়া তিনি সতর্ক করে দেন যে, ইতিবাচক ডেটার চেয়ে নেতিবাচক ডেটার ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি কিন্তু পাঠকের চোখ এড়ায় না।
সুইডিশ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হ্যান্স রোসলিংয়ের “ফ্যাক্টফুলনেস: টেন রিজনস উই আর রং অ্যাবাউট দ্য ওয়ার্ল্ড –অ্যান্ড হোয়াই থিংস আর বেটার দ্যান ইউ থিংক বইটি ডেটা বিষয়ক বোঝাপড়া তৈরির জন্য বেশ ভালো বলে তিনি উল্লেখ করেন। হ্যান্স রোসলিং সাংবাদিকদের চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন যে “আপনি আগে নিজেকে বোঝান যে এটি ভালো এবং খারাপ উভয়ই হতে পারে।”
ক্যাপলান বলেন, “রোজলিং দুর্দান্ত কিছু ডেটা পরীক্ষা করে দেখেছেন, যেগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইতিবাচক প্রবণতা তুলে ধরে। যেমন প্রতিদিন এক ডলারের নিচে আয় করে এমন লোকের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমেছে।”
তিনি যুক্তি দেখান, “ডেটা যা দেখায়, বাস্তব অবস্থা তার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ— এ ধরনের বিষয় মনে করার প্রবণতা রয়েছে আমাদের। যেখানে মিডিয়াও একটি ভূমিকা পালন করে। এর প্রধান কারণ,যদিও নেতিবাচক বা সমালোচনামূলক খবরের প্রয়োজন, লোকেরা সংবাদ গ্রহণ করতে চায় না, কারণ দর্শকরা বিশ্বাস করেন যে সত্যিকার অবস্থা আরো অনেক বেশি নেতিবাচক।
কোনো প্রতিষ্ঠানের বড় কোনো প্রকল্পের ফলে সৃষ্ট ভয়াবহ ক্ষতি কিংবা বৈষম্য নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করার সময়, সাংবাদিকরা ঘুরেফিরে হাতেগোনা কয়েকটি ইতিবাচক আউটলায়ার ডেটা পয়েন্টের (ডেটাসেটের অস্বাভাবিক মান) ওপর আলোকপাত করেন — যেমন কিছু শহর বা সেক্টর যেখানে ক্ষতির মাত্রা প্রশমন করা হয়েছে, বা সুবিধা অর্জিত হয়েছে।
ক্যাপলান বলেন, বরং ফলো-আপ প্রতিবেদন করার সময় এ বিষয়গুলো খোঁজা উচিৎ — বিশেষ করে নীতিনির্ধারকেরা যদি ইতিবাচক কোনো পরিবর্তনের প্রত্যাশা না করে থাকেন।
৯. বিভিন্ন দল এবং অংশীদারিত্ব গড়ে তোলায় ব্যর্থতা
লা ডেটা কুয়েন্টার ফ্যালাস বলেন, “উল্লেখযোগ্য একটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, অনেক নিউজরুমে ডেটা সাংবাদিকতার জন্য আন্তঃবিভাগীয় দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব,” বলেন লা ডেটা কুয়েন্টার ফ্যালাস।
তিনি বলেন, “অনেক মিডিয়া আউটলেটে একটি ‘ডেটা ইউনিট’ আছে। যেখানে মূলত একজন ব্যক্তিই ডেটা সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, ভিজ্যুয়ালাইজ, এটির ওপর প্রতিবেদন তৈরি, গল্প লেখা, এমনকি একটি ভাইরাল টিকটক তৈরির মতো সবকিছুই করবে বলে আশা করা হয়। যা কাজের কিছু নয়।
“ডেটা সাংবাদিকতা প্রকল্পগুলোর সমন্বিত হওয়া প্রয়োজন, যেখানে রিপোর্টার, ডেটা বিশ্লেষক, ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজার, সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষজ্ঞ এবং সম্পাদকদেরও থাকা উচিত।”
ফ্যালাস বলেন, এটি বাহ্যিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য — যার মধ্যে রয়েছে নাগরিক সংগঠন, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী, বিশেষজ্ঞ, এবং আউটলেটগুলোর সঙ্গে মিডিয়া অংশীদারত্ব, । এটি একটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব যে দক্ষতা ও পাঠক-শ্রোতা-দর্শক রয়েছে তার বাইরেও অন্যদের টানতে সমর্থ হয়।
তিনি বলেন, একই ধরনের অংশীদারদের বেছে নেওয়ার পরিবর্তে, অনুসন্ধানের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সক্ষম: যেমন ডেটা বিশ্লেষণ, ভিজ্যুয়ালাইজেশন, গল্প বলা, পডকাস্ট তৈরি, গ্রাফিক ডিজাইন এমন বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করে মিডিয়া অংশীদারদের শনাক্ত ও নির্বাচন করা অপরিহার্য ।”
১০. নিউজরুমে আধুনিক ডেটা বিশ্লেষণ ও এআই দক্ষতার অভাব
ফ্যালাস বলে, স্প্রেডশীট ম্যানেজমেন্ট, এক্সেল বা গুগল শীটে, ডেটা সাংবাদিকতার জন্য অপরিহার্য। তবে, অনেক রিপোর্টার এ টুলগুলো প্রাথমিক কাজগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে: যেমন যোগ করা, বিয়োগ করা, কে উপরে বা নিচে আছে তা চিহ্নিত করা।
প্রাথমিক এ কাজগুলো ছাড়াও আরো গভীরে যাওয়া সম্ভব। আর (R) এবং পাইথনের এর মতো প্রোগ্রামিং ভাষায় আরও প্রশিক্ষণ গ্রহণ সাংবাদিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। লিনিয়ার রিগ্রেশন বা ক্লাস্টার বিশ্লেষণের মতো মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম বা পরিসংখ্যান কীভাবে প্রয়োগ করতে হয় সে বিষয়ক বোঝাপড়াটা ডেটা সহ আরও জটিল বিশ্লেষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এ টুলগুলো আমাদের প্যাটার্নগুলোকে আরো ভালভাবে তুলে ধরে বৃহত্তর জনস্বার্থের জন্য প্রয়োজনীয় উত্তর খুঁজে পেতে সাহায্য করে।
ফ্যালাস আরো বলেন যে, কিছু মৌলিক ও সময়সাপেক্ষ ডেটা নিয়ে কাজের সময় কীভাবে “দক্ষতা ও নৈপুণ্যের সঙ্গে জেনারেটিভ এআই টুলগুলো ব্যবহার করতে হয় সাংবাদিকদের যে সম্পর্কে শিখতে হবে, অন্যথায় আপনার অনুসন্ধান থেমে যেতে পারে।”
তিনি বলেন, “উদাহরণস্বরূপ, কয়েক সপ্তাহ আগে পুয়ের্তো রিকোতে, আমি আমার সহকর্মীদের জন্য একটি কর্মশালা পরিচালনা করেছিলাম যেখানে আমরা ডেটা সাংবাদিকতায় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় চ্যাটজিপিটি ব্যবহারের সুবিধা এবং সীমাবদ্ধতা দুটি দিকেই তুলে ধরি।
“আমরা ‘প্রম্পট’ তৈরির সুস্পষ্ট উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা কেবল ‘কপি এবং পেস্ট’ করার পরিবর্তে চিন্তাশীল মনোভাবের ওপর জোর দিয়েছি। জেনারেটিভ এআই প্রোগ্রামিং ভাষা শেখার জন্য একটি মূল্যবান হাতিয়ার হিসাবে কাজ করতে পারে যা আপনাকে আরও গভীরে নিয়ে যেতে পারে।”
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। এর আগে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসের প্রধান প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন। একজন বিদেশী সংবাদদাতা হিসেবে তিনি বিশ্বের দুই ডজনেরও বেশি দেশের সংবাদ, রাজনীতি, দুর্নীতি এবং সংঘাতের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর হিসেবে কাজ করেছেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং আফ্রিকার নিউজরুমের জন্য।