টাকা পাচার , নতুন যে প্রবণতার দিকে নজর দেওয়া উচিত সাংবাদিকদের
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
চল্লিশ বছর আগে মাদক কারবারী আর দুর্নীতিবাজ বৈদেশিক কর্মকর্তারা ক্যারিবিয়ার বিমানবন্দরগুলোতে প্লেন উড়িয়ে নিয়ে যেতেন। ছোট আকৃতির ওইসব উড়োজাহাজের কার্গো হোল্ডে থাকত নগদ অর্থ ভর্তি ডাফেল ব্যাগ। পাইলটরা ধীরে ধীরে উড়োজাহাজগুলোকে রানওয়ের শেষ প্রান্তে থাকা ব্যাংকভবনের কাছে গিয়ে দাঁড় করাতেন। এরপর উড়োজাহাজ থেকে ওই ব্যাগগুলো ঠেলে দেয়া হতো ব্যাংক কর্মচারীদের দিকে। বিনা বাক্য ব্যয়ে তাঁরা তা রেখে দিতেন। ব্যাংকগুলো মোটা অংকের বিনিময়ে অবৈধ ওই অর্থ পাচারে সহযোগিতা করতো।
অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি) র সহপ্রতিষ্ঠাতা ড্রিউ সুলিভানের মতে, অর্থ পাচারের জগতে বিস্ফোরণ ঘটেছে। তিনি বলেন, “আগে যেখানে লাখ টাকা পাচার করা হতো, এখন তা কোটিতে পৌঁছেছে। টাকার অঙ্কের মতো অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে জটিলতাও বেড়েছে। এখন অর্থ পাচারের কায়দাকানুন আগের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক ও পরিশীলিত। আর খুব সহজও। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের তাই অর্থপাচারের নতুন প্রবণতাগুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সুলিভান বলেন, “অতীতে রানওয়ের শেষ প্রান্তে থাকা ওই ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে অর্থপাচরের জন্য চার্জ দিতে হতো ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। আর এখন অর্থ পাচার করা যায় সাধারণ ব্যাংকিং লেনদেনের তুলনায় কম খরচে।” ২০২৪ অনুসন্ধানী প্রতিবেদক ও সম্পাদক সম্মেলনে আন্তর্জাতিক আর্থিক অপরাধ প্রবণতার ওপর একটি অধিবেশনে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন সুলিভান। তিনি বলেন “আমরা লন্ড্রোম্যাট প্রজেক্ট নিয়ে যে ঘটনাগুলো দেখেছি, সেখানে [লন্ড্রোম্যাটের খরচ] লেনদেন খরচের পরিমাণ ছিল শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। ব্যাংকে স্বাভাবিক আর্থিক লেনদেনে আমরা যে ফি প্রদান করি, তার থেকেও কম।”
আইআরই প্যালেনে সুলিভানের সঙ্গে অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক হিসেবে ছিলেন মার্থা মেন্ডোজা। তিনি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের পুলিৎজারজয়ী রিপোর্টার। প্যানেল আলোচনায় তাঁরা অর্থ পাচারের বিভিন্ন নতুন কৌশলের ওপর আলোকপাত করেন। বিশেষ করে অবৈধ সম্পদ লুকাতে যেসব কৌশল অনুসরণ করা হয়, তা অনেকসময় চিহ্নিত করাই কঠিন হয়ে পড়ে।
এর মধ্যে রয়েছে বাস্তবে অস্তিত্ব নেই এমন পণ্য নিজেই নিজের কাছে বিক্রি করা, ক্রিপ্টোকারেন্সি ম্যানিপুলেশন, কাল্পনিক কর্মচারীদের বেতন দেয়া— আর যদি অনেক বেশি প্রশ্নের করা হয় তাহলে গোটা ব্যাংকটাই কিনে নেয়া।
সুলিভান সাংবাদিকদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, তাঁরা যেন অর্থ পাচারকে ঘুষ বা কর ফাঁকির মতো অন্যান্য আর্থিক অপরাধের সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলেন। এক্ষেত্রে ওসিসিআরপি সংজ্ঞা দিয়েছে তা মনোযোগ দিয়ে দেখার কথা বলেছেন সুলিভান। অর্থপাচারের সংজ্ঞা হলো, “অবৈধভাবে প্রাপ্ত অর্থের উৎস গোপন করে, তা বিদেশী ব্যাংকে বা বৈধ কোনো ব্যবসার সরিয়ে ফেলা।”
সুলিভান বলেন, “অবৈধভাবে প্রাপ্ত’ এ তথ্যটিই গুরুত্বপূর্ণ। এটাকে আপনি ধরে নিতে পারেন আপনার অনুসন্ধানের ভিত্তি বা বড় অপরাধের প্রথম ধাপ – যেখান থেকে পাচার শুরু হয়।”
তিনি আরও বলেন, আদালতে প্রমাণ করার সময় সবচেয়ে কঠিন বিষয়গুলোর মধ্যে যা একটি। একজন অনুসন্ধানী প্রতিবেদক হিসাবে এটি প্রমাণ করা বেশ কঠিন যে, এখানে নিশ্চিতভাবে অর্থ পাচার করা হয়েছে। তাই সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে না জানানো হলে, আপনি মূলত এই বিষয়ের ওপর খুব বেশি প্রতিবেদন খুঁজে পাবেন না।”
‘পাচার হয়ে যাওয়া টাকার গন্তব্য খোঁজাই’ সেরা রিপোর্টিং কৌশল
সুসংবাদ হচ্ছে— মেন্ডোজার মতে, ছদ্মবেশে লুকিয়ে অর্থ পাচারের নতুন প্রবণতা সত্ত্বেও ফাঁস হওয়া বিভিন্ন নথি থেকে সাংবাদিকেরা বিনাপয়সায় পাচার সংক্রান্ত জটিল অনেক ধাঁধার উত্তর খুঁজে নিতে পারেন।
কারণ অবৈধভাবে উপার্জিত আয় লুকানোর প্রাথমিক কৌশলগুলো আগের মতোই আছে: ভান করুন আপনি আলাদা দুইজন ব্যক্তি। উপরন্তু, অর্থ লুকানোর এ কৌশলটি সফলভাবে ব্যবহারের উপায় হলো ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস বা সেশেলসের মতো জায়গাগুলোতে গোপনীয়তা আইনের আওতায় অফশোর শেল কোম্পানি বা ট্রাস্ট খোলা। যেখানে প্রকৃত মালিকদের তথ্য বের করাটা কঠিন। যা করার জন্য ফাঁসকৃত নথির প্রয়োজন।
মেন্ডোজা বলেন, “আপনি পানামা পেপারসের মতো ফাঁস হওয়া তথ্যগুলো আলেফ বা আইসিআইজের ডেটাতে ঢুকে দেখতে পারেন এবং যোগসূত্র তৈরির কাজ শুরু করতে পারেন।”
তিনি আরো জানান, “কাজটি কিন্তু সময়সাপেক্ষ। কিন্তু আপনি যদি কোনো একটা সংযোগ খুঁজে পান, ব্যাস, তাহলেই কাজ শেষ। আপনি যে নামটি খুঁজছিলেন, ফাঁস হওয়া ওই নথিতে একবার আপনি যদি তা খুঁজে পান, এরপর কোম্পানিস হাউস বা ওপেনকর্পোরেটসের মতো টুল ব্যবহার শুরু করতে পারেন। যেখানে আপনি একই রকম বা অভিন্ন নামের পরিচালকদের বোর্ড খুঁজে পাবেন, কিংবা অভিন্ন নামের ব্যক্তিকে।”
সংক্ষেপে, অর্থ পাচারের তিনটি ধাপ এখনও মূলত একই: “বিনিয়োগ” (আর্থিক ব্যবস্থার মাধ্যমে নগদ অর্থ লাভ); “বিন্যাস” (নগদ অর্থের উৎস গোপন করে অতিরিক্ত লেনদেন); এবং “অঙ্গীভূতকরণ” (তহবিলকে ব্যবহার ও বিনিয়োগযোগ্য সম্পদে পরিণত করা)।
মানি লন্ডারিং এর নতুন রূপ
জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে সেকেলে পদ্ধতি:
- “স্মার্ফিং” – এটি এমন একটি কৌশল যেখানে নগদ অর্থ জমা করার জন্য কয়েক ডজন লোককে ব্যবহার করা হয়। সুলিভান বলেন, “অর্থ নিয়ে যেন কোনো প্রশ্ন না ওঠে, সে জন্য কৌশলে, যেমন ১০ হাজার ডলারের পরিবর্তে ৯ হাজার ৯৯০ ডলার জমা দেয়া হয়। লোকেরা ক্রিপ্টো এটিএম ব্যবহারের মাধ্যমে এখনও এটি করে। নানাধরনের লোকেদের দিয়ে বিভিন্ন পরিমাণ অর্থ জমা দেয়া আর ক্রিপ্টো ওয়ালেট ব্যবহার মাদক ব্যবসায়ীদের স্মার্ফিংয়ের একটি দুর্দান্ত কৌশল। কেননা কেউ যদি ভিন্ন ভিন্ন ক্রিপ্টো ওয়ালেট আর বিভিন্ন লোকের নাম ব্যবহার করে তাহলে তাকে চিহ্নিত করার কাজটি মোটেও সহজ নয়।”
- নগদ অর্থ পাচার – “এখনও আফ্রিকার নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় এটা করা হচ্ছে—দুবাইয়ের মতো জায়গাগুলোতে প্রচুর পরিমাণে সোনা, হীরা আর নগদ অর্থ যাচ্ছে। সেগুলো রাখা হচ্ছে ওখানকার ব্যাংকগুলোতে। পৃথিবীর কয়েকটি জায়গার মধ্যে দুবাই একটি, যেখানে আপনি প্রচুর পরিমাণে নগদ জমা করতে পারেন—সত্যিকার অর্থেই কেউ আপনাকে কোনো প্রশ্ন করবে না,” বলে উল্লেখ করেন সুলিভান।
- নগদ ব্যবসা – সুলিভান জানান যে, “নগদ ব্যবসায় এখনও পুরানো-প্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়: ক্যাসিনো, গাড়ি ধোয়া, পার্কিং লট— এ ধরনের যে কোনও জায়গা যেখানে প্রচুর পরিমাণে নগদ প্রবাহ বিদ্যমান।” তিনি আরো যোগ করে বলেন, “তবে নগদ অর্থের দিন প্রায় শেষ। খুব কম লোকই আজকাল প্রচুর পরিমাণে নগদ বহন করে। ব্যবসার ক্ষেত্রেও তাই। ব্যতিক্রম ক্যাসিনোর মতো জায়গাগুলো। যেখানে আপনি যেতে পারেন, প্রচুর পরিমাণে চিপ কিনতে পারেন, বিনিময় করতে পারেন নগদ অর্থ। এরপর বলুন, ‘এ অর্থ আমি ক্যাসিনো থেকে পেয়েছি।’ আরো একটি কৌশল রয়েছে। আপনি বলতে পারেন যে, ‘আমাদের প্রচুর পরিমাণে মাংস নষ্ট হয়ে গেছে।’ যদিও এগুলো অর্থ পাচারের ছোট-খাটো কৌশল। তবে লাখ বা শত কিংবা হাজার নয়। অনেকে কোটি কোটি ডলার পাচার করছে। তার জন্য নতুন কৌশলও উদ্ভাবিত হয়েছে।
এখনও কিছু পদ্ধতি চিরসবুজ:
- বিলাসবহুল আবাসন – বিদেশে বাড়ি বা ব্যক্তিগত সম্পত্তি কেনার মতো বিষয়ে অপরাধীরা সাধারণত তাদের অর্থ লুকায় না। কারণ এগুলো কিনতে খুব বেশি ঝামেলা পোহাতে হয় না। তাঁরা বরং সামনে লন আছে বা আলাদাভাবে তত্ত্বাবধায়ন করতে হয়, এমন বাড়ি কিনতে চায় না। আবার পশ্চিমা দেশের কোনো শহরে মাঝারি আকারের অ্যাপার্টমেন্ট কিনতেও খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। কারণ তাতে খুব বেশি কাগজপত্রের কাজ সামলাতে হয়। সুলিভান বলেছেন যে, এর পরিবর্তে তাঁরা অনেক অর্থ দিয়ে দামী অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে পছন্দ করে। আবাসন বাজারের মূল্য বৃদ্ধির জের ধরে উচ্চ মূল্যের বিষয়টি মূলত পাশ কাটানো সম্ভব হয়। সুলিভান বলেন, “একবার অর্থ পাচারের পর, আপনি বিদেশে আপনার সম্পদ সরাতে চাইবেন। এ জন্য আপনাকে যা করতে হবে, তা হচ্ছে ২০০ মিলিয়ন (২০ কোটি) মূল্যের অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়।” তিনি আরও বলেন, “আর তাই আপনি নিউ ইয়র্ক বা লন্ডনের মতো জায়গায় খালি কোনো দামী অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজবেন। আপনাকে কেবল যে কাজটি করতে হবে তা হচ্ছে, অফশোর কোম্পানি ও প্রক্সির (আপনার হয়ে পরিচয় দিয়েছে) নাম দিয়ে তা লুকিয়ে রাখা।”
- অফশোর কোম্পানি, ট্রাস্ট, এবং হেজ ফান্ড – সুলিভান বলেন, “আপনাকে সত্যিকার অর্থে অফশোর কোম্পানির মালিক বনে যেতে হবে। কেউ জানবে না আপনিই মালিক। আপনার ঘোষিত কোম্পানি ও লুকানো কোম্পানির মধ্যকার যেকোনো লেনদেনকে বাস্তবের লেনদেনের মতো মনে হবে। যদিও তা সত্য নয়। হেজ ফান্ডগুলো খুব অস্বচ্ছ। হেজ ফান্ড ও অফশোর কোম্পানির সমন্বয়ের দেয়ালটা ভাঙ্গা কঠিন।” তিনি আরো যোগ করেন: “যেমন সেন্ট ভিনসেন্ট বা লিচটেনস্টাইনের মতো জায়গাগুলোতে অফশোর ট্রাস্টের কোনো মালিকের তথ্যই আপনি খুঁজে পাবেন না। বরং অন্য জায়গায় কোনো ট্রাস্টের মাধ্যমে অর্থ সংক্রান্ত তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে।” পরামর্শ: কর্পোরেট রেজিস্ট্রি দেখার পাশাপাশি কোম্পানির ওয়েবসাইট ঘাঁটতে থাকুন। এছাড়া সুলিভান আরো বলেন যে, কোনো কোম্পানি সম্পর্কে বাজারের বৈধ অন্যান্য প্রতিযোগীদের কাছে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
টাকা পাচারের নতুন ও জনপ্রিয় কৌশল
- বাণিজ্য–নির্ভর অর্থ পাচার। এ পদ্ধতির মাধ্যমে চালান এবং লেনদেনের পরিমাণ হেরফের করে ব্যাংকে দেখানো হয় যে, বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে এ আয় অর্জিত হয়েছে। “এ কৌশলটি এখন সবচেয়ে জনপ্রিয়,” বলে উল্লেখ করেন ওসিসিআরপির এ প্রকাশক। তিনি আরও জানান, “আপনার কাছে সত্যিকার অর্থেই কোনো ইস্পাত আছে কিনা তা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনাকে ক্রেতা ও বিক্রেতার নাম সরবরাহ করতে হবে। এরপর ব্যাংকে গিয়ে আপনাকে বলতে হবে যে, ‘দেখুন, আমি ৫০০ মিলিয়ন (৫০ কোটি) ডলারের ইস্পাত বিক্রি করেছি, সেখান থেকে আমার মুনাফা হয়েছে ২০০ মিলিয়ন (২০ কোটি) ডলার।’ এমন অনেক কোম্পানি আছে যাঁরা আপনাকে জাল কাগজপত্র তৈরিতে সাহায্য করবে… আপনি হয়তো ওই ‘ইস্পাত’গুলো একটি অফশোর কোম্পানি থেকে অন্য অফশোর কোম্পানিতে সরাচ্ছেন। এভাবে আপনি অর্থের উৎস ধ্বংস করছেন। প্রথম লেনদেনে দেখিয়েছেন যে, আপনি ফুল কিনেছেন। পরবর্তী লেনদেনটি ইস্পাতের। এর পরেরবার কিনেছেন কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ।” সুলিভান তাই বলেন যে: “এ কারণেই আমি লেনদেন সম্পর্কিত তথ্যে বিশ্বাস করি না, কারণ এগুলোতে অনেক ভুল তথ্য থাকে, এবং শেষমেশ দেখা যায় চুক্তির মাধ্যমেই আপনি বড় অংকের মুনাফা অর্জন করেছেন। আর এভাবেই আপনি এক বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার পাচার করেছেন।”
- লন্ড্রোম্যাট – অর্থ লুকানোর অন্যতম সেরা কৌশল লন্ড্রোম্যাট। সাধারণত কোনো ব্যাংক কিংবা অনেক বেশি সম্পদশালী ব্যক্তি এ কৌশল অবলম্বন করে। যেখানে গোপনীয়তা আইনের অধীনে একাধিক শেল কোম্পানির মাধ্যমে ক্রেতার নাম প্রকাশ না করে বড় অংকের সম্পদ ক্রয়ের সুযোগ থাকে। সুলিভান বলেন, লাটভিয়া-ভিত্তিক একটি লন্ড্রোম্যাট এতটাই নির্লজ্জ ছিল যে তাঁরা তাদের ক্লায়েন্টদের জন্য অর্থ পাচারের “গাইড” পর্যন্ত প্রকাশ করেছিল। সেখানে উল্লিখিত একটি পরামর্শের মধ্যে লেখা ছিল: আপনি যদি ইস্পাত বিক্রির ভান করে থাকেন তবে নিশ্চিত করুন যে আপনি একটি ক্রেনের জাল কাগজপত্রও তৈরি করেছেন — কারণ অন্য কোনো ব্যাংকের পক্ষ থেকে হয়তো আপনার কাছে জানতে চাইতে পারে যে, আপনি কীভাবে এ ইস্পাতগুলো একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিচ্ছেন। (নিচে ওসিসিআরপির ট্রোইকা লন্ড্রোম্যাট অনুসন্ধানের ভিডিওটি দেখুন।)
- অফশোর ঋণ – “আপনি যদি নিজের কোম্পানি থেকেও ঋণ নেন, তবে তাও ব্যাংকগুলো গ্রহণ করে। কারণ আপনি একটি উৎস থেকে ঋণ পেয়েছেন।” সুলিভান ব্যাখ্যা করেছেন, “আপনি ওই অর্থ ব্যয় করতে পারেন এবং অবশ্যই কাউকে আপনার অর্থ ফেরত দেয়ারও প্রয়োজন নেই। কারণ ঋণের ওই অর্থ গোপন মালিকের একটি অফশোর কোম্পানি থেকে এসেছে, পরবর্তীতে কোম্পানিটি হারিয়ে গেছে।” পরামর্শ সন্দেহজনক কোনো কোম্পানির আর্থিক রেকর্ড দেখার সময়, সাংবাদিকরা প্রতিষ্ঠানটির ঋণের উৎস খুঁজতে পারেন। খেয়াল রাখবেন, ওই ঋণগুলো কখনও ফেরত দেয়া হয় না। রিপোর্টাররা আরও দেখবেন ঋণের অর্থ “নগদ” জামানত হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে কিনা। “যদি কেউ ব্যবসায়িক ঋণের জন্য নগদ অর্থ ব্যবহার করে তবে তা বৈধ ব্যবসার হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ আপনার যদি নগদ থাকে তবে কেন আপনি ঋণ নিবেন?” বলেন সুলিভান।
- প্রক্সিদের কাছে পাঠানো হয় ব্যর্থ চুক্তির কাগজপত্র – “আমরা একজন অলিগার্কের (সম্পদশালী অভিজাত, যাঁরা শুধু অর্থ-ক্ষমতার মালিকই নন, সম্পদের উৎস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রাজনীতি বা সরকারকে প্রভাবিত করেন) পক্ষ থেকে একজন প্রক্সির কাছে পাঠানো ইমেইলে দেখেছি। যেখানে শেয়ার বিক্রি বিষয়ক চুক্তির কথা বলা হয়েছে। স্বাক্ষরিত ওই চুক্তিতে কোনো তারিখ বা শেয়ারের দাম উল্লেখ করা ছিল না। মূলত একটি ফাঁকা চেক পাঠানো হয়,” উল্লেখ করেন সুলিভান। আরও বলেন যে, “ রাশিয়ার অলিগার্করা ঘুষ দিতে এ ধরনের ব্যর্থ চুক্তি কৌশলকে কাজে লাগাতে পছন্দ করেন। ওই চুক্তিতে তাঁরা বলেন ‘ আমরা যদি চুক্তি অনুয়ায়ী কাজ করতে ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের কাছে আপনাদের ১০ মিলিয়ন (১ কোটি) ডলার পাওনা থাকবে, কারণ সমস্যা তৈরি করার জন্য আমরা আপনাকে জরিমানা দিতে চাই।’ তাঁরা ওই একই ইমেইলে [প্রক্সিতে] প্রথমে চুক্তির কথা উল্লেখ করেছে এরপর আবার চুক্তি বাতিলের কথা লিখে পাঠিয়েছে!”
- ব্যাংক কিনে নেওয়া। “কিছু অপরাধী আছে যাঁরা আস্ত একটি ব্যাংক কিনে নেয়,” যোগ করেন সুলিভান। তিনি আরো বলেন যে, “আপনি নিজেই নিজেকে আপনার অর্থ ঋণ হিসেবে দেন, তারপরে আপনার নিজের ব্যাংককে পথে বসান। রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপে যা প্রায়ই ঘটে। এছাড়া আপনি আপনার নিজের ব্যাংকের মধ্যেই একটা অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে অর্থ লেনদেন করতে পারেন— এ ধরনের লেনদেন মূলত নিয়ন্ত্রকসংস্থাগুলোর কাছ থেকে লুকানো হয়।”
- প্রক্সি হিসেবে এমন মানুষের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে বাস্তবে যাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। অপরাধীরা প্রায়ই অন্যের নামে নিবন্ধন করে নিজের সম্পদ লুকিয়ে রাখে — কিন্তু প্রক্সির ধরনে পরিবর্তন হচ্ছে। “আগের দিনে, প্রক্সি ছিল সহজ: প্রক্সি হিসেবে নিজের স্ত্রী বা সন্তানকে ব্যবহার করা হতো,” সুলিভান বলেন। “কিন্তু সাংবাদিকেরা বিষয়টি ধরে ফেলেন এবং জিজ্ঞাসা করতে শুরু করে: ‘আপনার ১২ বছর বয়সী সন্তান কেন এই কোম্পানির মালিক?’ এরপর অপরাধীরা প্রক্সি হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করে নিবন্ধিত এজেন্টদের। কিন্তু তাও আর আড়াল থাকে না। হয়ে ওঠে সন্দেহজনক। আমরা একজন নারীকে খুঁজে পেয়েছি, যিনি কাজ করতেন সিঙ্গাপুরের বার্গার কিং-এ। তার নামে ৬ হাজারের মতো কোম্পানি “মালিকানা” ছিল। এখন তাই কোম্পানির মালিক দেখানোর জন্য এমন সব জাল নাম-ঠিকানা ব্যবহার করা হচ্ছে, যাদের বাস্তব কোনো অস্তিত্বই নেই। অস্তিত্বহীন নকল মানুষদের ভালো দিকটি হচ্ছে, আপনি কখনও তাদের খুঁজে পাবেন না।”
- ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন। “একটি ক্রিপ্টো অ্যাকাউন্টে আপনি অবৈধ অর্থ লেনদেন করতে পারেন, কোনো ব্যক্তির সঙ্গে লেনদেন করতে পারেন, এবং তারপর ওই অর্থ বেনামী ক্রিপ্টোকারেন্সি] মনেরোর (ক্রিপ্টোকারেন্সি যা অনেক বেশি গোপনীয়তা সংরক্ষণকারী প্রযুক্তিসহ একটি ব্লকচেইন ব্যবহার করে লেনদেন ও ব্যক্তি সম্পর্কিত তথ্য লুকায়) মতো কিছুর মাধ্যমে পাঠাতে পারেন। এবং সেই অর্থ কোথায় গেছে তা আপনি গোপন রাখতে পারবেন,” সুলিভান যোগ করেন।
- কর মওকুফের অপব্যবহার। এ পর্যায়ে সুলিভান ব্যাখ্যা করেন যে, “আপনি দেখবেন যে এই ধনী ব্যক্তিরা কর মওকুফের জন্য আবেদন করেছে। যেখানে তাঁরা বলে: ‘আমরা বিদেশে প্রচুর অর্থ পেয়েছি; এটা ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রের সত্যিই আমাকে উৎসাহিত করা উচিত কারণ এটি দেশের কাজে লাগবে।” তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, এটি মূলত বাজে কথা, কারণ তাঁরা বছরের পর বছর ধরে কর ফাঁকি দিয়ে চলেছে। যদিও, রাষ্ট্রের সঙ্গে কর মওকুফের বিষয় নিয়ে আমরা সংগঠিত অপরাধীদের সমঝোতায় পৌঁছানোর বিষয়গুলোও দেখেছি—তাই সরকার চাইলে খুব সহজে প্রচুর পরিমাণ কালো অর্থকে রাতারাতি সাদা করতে পারে।”
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। এর আগে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসের প্রধান প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন। একজন বিদেশি সংবাদদাতা হিসেবে তিনি বিশ্বের দুই ডজনেরও বেশি দেশের সংবাদ, রাজনীতি, দুর্নীতি এবং সংঘাতের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর হিসেবে কাজ করেছেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং আফ্রিকায়।