প্রবেশগম্যতা সেটিংস

» গাইড

বিষয়

সংবাদে দুর্বোধ্য সংখ্যায় বিভ্রান্ত পাঠক, করণীয় জানালেন ডেটা বিশেষজ্ঞরা

সবচেয়ে পরিশ্রমী ও মনোযোগী অনুসন্ধানী ডেটা সাংবাদিকও মাঝে মধ্যে সংখ্যার ফাঁদে পড়ে যান। তাই কেবল তথ্যগত ত্রুটি বা ভুল হিসাব এড়ালেই সাংবাদিক হিসেবে আপনার কাজ শেষ হয়ে যায় না। বরং সংখ্যাগুলোকে এমনভাবে তুলে ধরুন, পাঠক যেন সহজে বুঝতে পারে প্রতিবেদনে কী বলা হচ্ছে।

 

অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা সংখ্যার ক্ষেত্রে হরহামেশা যে ভুলগুলো করে বসেন তার মধ্যে অন্যতম একটি শতাংশ মান থেকে আরেকটি শতাংশ মান যোগ বা বিয়োগ করে পরিবর্তনের হার হিসাব করা। (যেমন: সফল মামলার সংখ্যা যদি ১২ শতাংশ থেকে কমে ৭ শতাংশে আসে, তাহলে ৫ শতাংশ নয়; বরং প্রায় ৪২ শতাংশ কমেছে।) এই ভুল এতটাই সাধারণ যে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) তাদের স্টাইল গাইডে শতাংশ বোঝাতে “%” চিহ্ন ব্যবহারের অনুমতি দিলেও, পরিবর্তনের মাত্রা বোঝাতে “পারসেন্টেজ পয়েন্ট” ব্যবহারের কথা বলেছে। যাতে নির্ভুল ও সঠিক ব্যাখ্যা নিশ্চিত করা যায়। সংখ্যা বিশ্লেষণে আরেকটি বড় ভুল হচ্ছে কার্যকারণের (causation)  সঙ্গে সম্পর্ককে (correlation)  গুলিয়ে ফেলা। এ ধরনের ভুল এড়াতে জিআইজেএনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত, “ডেটা সাংবাদিকতার ১০ সাধারণ ভুল” এবং “ডেটার যে সামান্য ১০টি ভুলে ভেস্তে যেতে পারে অনুসন্ধান”—লেখা দুটি পড়তে পারেন।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নিকার ২০২৫ ডেটা সাংবাদিকতা সম্মেলনের একটি প্যানেলে সতর্ক করে বলা হয়, অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা অনেক সময় এমন সব সূক্ষ্ম সংখ্যাগত ভুল করে থাকেন, যা প্রতিবেদনের মূল বিষয় থেকে মনোযোগ সরিয়ে পাঠকদের আস্থা নষ্ট করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, যদি অতিরিক্ত সংখ্যা ব্যবহার করা হয়, উপস্থাপন পদ্ধতি যদি সঠিক না হয় বা সংখ্যাগুলোর সহজ ও প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা না দেওয়া হয়, তাহলে সম্পূর্ণ সঠিক সংখ্যাও পাঠকদের বিভ্রান্ত করতে বা ভুল ধারণা দিতে পারে।

নিকার সেশনে উপস্থিত ছিলেন ডেটা সাংবাদিক জেনিফার লাফ্লারজাইমি ডাউডেল। লাফ্লার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্কলি ক্যাম্পাসের গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব জার্নালিজমে ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন ও গবেষণা পদ্ধতি পড়ান। পুরস্কারপ্রাপ্ত ডেটা সাংবাদিক ডাউডেল কাজ করছেন রয়টার্সে। তাঁরা সংখ্যার মাধ্যমে পাঠকদের ভুল তথ্য দেওয়া বা বিভ্রান্ত করা এড়াতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন:

নির্ভুল হলেও দুর্বোধ্য সংখ্যা অনেক সময় ভুল তথ্যের জন্ম দিতে পারে

আপনি ভাবতেই পারেন, “প্রতি চারজন নারীর মধ্যে একজন”—এভাবে বলার চেয়ে “২৫.২১% নারী” বলাটা বেশি সঠিক। কিন্তু জেনিফার সতর্ক করে বলেন, “২৫.২১%” বললে পাঠক অনেক সময় বুঝতে পারেন না। এখানে আপনি যদি “চারজনের মধ্যে একজন” বলেন, তাহলে তাদের জন্য সহজ হয়। তাছাড়া সংখ্যা ব্যবহার করে লেখাটা নির্ভুল মনে হলেও ডেটা সমর্থিত নাও হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে লাফ্লার জানান , “আমার ধারণা আমরা দশমিক যুক্ত করি কারণ মনে করি যে, এটা বেশ বুদ্ধিদীপ্ত কাজ। কিন্তু পাঠকদের জন্য তা বোঝাটা কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া, আপনি যে ডেটা নিয়ে রিপোর্ট করছেন তাতে যদি ভুল থাকে—তাহলে দশমিকের ব্যবহার ভুল তথ্যেই তুলে ধরে।”

বিশেষজ্ঞরা আরও উল্লেখ করেন যে, বেশিরভাগ ডেটা প্রকৃতপক্ষে যেই মুহূর্তে সংগ্রহ করা হয়, মূলত সেই সময় থেকেই তা কিছুটা পুরোনো হয়ে যায়। তাই অতিরিক্ত দশমিক ব্যবহার পাঠকদের ডেটার গভীরতা ও নির্ভুলতা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর ধারণা দিতে পারে। তাঁরা আরো বলেন, “যদি সম্ভব হয়, তাহলে ‘প্রতি চারজনের একজন’ বা ‘প্রায় অর্ধেক’ এভাবে বলুন। খুব জরুরি না হলে সংখ্যাকে ভাঙ্গতে যাবেন না বরং নিকটতম পূর্ণ সংখ্যা দিয়ে বলুন: যেমন, ‘৪৪,৭৯২’ না বলে ‘প্রায় ৪৫,০০০’ বলুন।

নির্ভুল গড় সংখ্যাও যে কতটা বিভ্রান্তিকর হতে পারে, সে প্রমাণ দিয়েছেন ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টারস অ্যান্ড এডিটরস (আইআরই)-এর ডেটা বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা সরকারি ডেটা ব্যবহার করে মুদ্রাস্ফীতির হার অনুযায়ী শিক্ষকদের বেতনের গড় হিসাব বের করেন ৫৩,২৩৪ ডলার। এরপর একই ডেটাকে ভিন্ন একটি সূত্রে বসিয়ে পান ৫৩,২২৬ ডলার। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে আসেন যে, সংখ্যাটিকে ভেঙ্গে না বলে বরং ৫৩,২০০ ডলার বলা ভালো। কারণ এটা বুঝতে সহজ আর নির্ভুল।

সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে “এত গুণ বেশিবলাটা এড়িয়ে চলুন

সাংবাদিকরা প্রায়ই বলেন, কোনো কিছুর পরিমাণ ৫০০ হলে তা ১০০ থেকে “পাঁচ গুণ বেশি”। অথচ বাস্তবে তা “চার গুণ বেশি।” (কারণ ১০০% বৃদ্ধি মানেই দ্বিগুণ বা ‘দুই গুণ বেশি’।) এক্ষেত্রে নির্ভুল উপায় হচ্ছে নতুন সংখ্যা পুরোনো সংখ্যার “পাঁচ গুণ বেশি”—এভাবে বলা। সবচেয়ে ভালো হয় যদি বলেন, এই সংখ্যা আগের সংখ্যার “পাঁচ গুণ।” লাফ্লার বলেন, “আমি প্রায়ই এমনটা দেখি; তাই আমি ‘বেশি’ শব্দটি ব্যবহার না করার পরামর্শ দিই, বরং সরাসরি বলুন এটা কত গুণ। কারণ ‘বেশি’ শব্দটা পাঠকদের জন্য বিভ্রান্তিকর।” তাই আমি যখনই দেখি ‘এক্স গুণ বেশি’, তখন অনুমান করি লেখক আসলে বলতে চেয়েছেন ‘এক্স গুণ’, মোটেও ‘এক্স গুণ বেশি নয়।”

ছোট সংখ্যার ক্ষেত্রে দশমিকের পরের অংশটি দিবেন না

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সংখ্যানির্ভর প্রতিবেদনে “প্রতি ১০০” (শতাংশ) লেখাটা জরুরি কিংবা জাদুকরি কিছু নয়। পাঠকের কাছে সহজভাবে তুলে ধরার জন্য সাংবাদিকদের উচিত ছোট সংখ্যাগুলোর দশমিক সরিয়ে ফেলা—যেমন, হত্যাকাণ্ডের হার যদি ০.০৭% হয়, সেক্ষেত্রে প্রতি  ১০০,০০০ জনের মধ্যে ৭০জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন—এভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে।

আপেক্ষিক সংখ্যা তুলনা করার সময় সহজ করে বলুন

সাংবাদিক জুটি এক্ষেত্রে তাদের প্রিয় বিড়ালগুলোর (এখন মৃত)  ওজনের পার্থক্য তুলনা করে দেখিয়েছেন। ডাউডেলের বিড়াল অমিগোর ওজন ছিল ১০ কেজি, আর লাফ্লারের বিড়াল স্ট্যানলির ৫ কেজি। ডাউডেল বলেন, “অমিগো স্ট্যানলির চেয়ে ১০০% বেশি ভারী” বা “অমিগো ছিল স্ট্যানলির ওজনের ২০০%,”—প্রায়গিক অর্থে যদিও এভাবে বলাটা সঠিক হতে পারে। তবে তিনি সতর্ক করেন যে, এভাবে বললে অনেক পাঠকের জন্যই তা বোঝাটা কঠিন। এর পরিবর্তে বরং “অমিগো ছিল স্ট্যানলির ওজনের দ্বিগুণ”—এটি পাঠকরা অনেক সহজেই বুঝতে পারবেন।”

পূর্ণ সংখ্যা হতে পারে আপনার জন্য সতর্ক সংকেত

ডাউডেল সতর্ক করে বলেন, সরকারি ডেটাসেটে দেখানো সংখ্যাটিও ভুল হতে পারে। যেমন কোনো ওয়েবসাইটের ডাউনলোড সীমা ৫,০০০ দেওয়া আছে। অনেক সময় সাংবাদিকরা তা খেয়াল নাও করতে পারেন। তিনি যোগ করেন, “প্রত্যেকটি ডেটাসেটে ছোট হরফে লেখা তথ্যগুলো পড়তে ভুলবেন না—সেখানে স্পষ্টভাবে বলা থাকে, আপনি সংখ্যাগুলো দিয়ে কী করতে পারবেন আর কী করতে পারবেন না। তাই পূর্ণ সংখ্যার ব্যাপারে সতর্ক থাকুন: অনেক সময় নিখুঁত পূর্ণ সংখ্যা হতে পারে আপনার জন্য কোনো সতর্ক সংকেত।”

মনে রাখবেনমাথাপিছুমানে শুধুই জন প্রতি

ডাউডেল উল্লেখ করেন, “মাথাপিছু” কথাটার মানে নিয়ে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে, যা আসলে “জন প্রতি” বোঝায়। এ প্রসঙ্গে লাফ্লার যোগ করে বলেন, কিছু প্রতিবেদনে মাঝে মাঝে তিনি অদ্ভুত সব পরিসংখ্যানের উল্লেখ দেখেন, যেখানে লেখা থাকে ওমুক গোষ্ঠীর মধ্যে “মাথাপিছু ৩০০টি হত্যাকাণ্ড।” তিনি আরো বলেন, “তাই যখন আমরা ছোট সংখ্যা নিয়ে কাজ করি, যেমন সহিংস অপরাধ বা বিরল রোগের সংক্রমণ, তখন আপনি দেখবেন যে সেগুলোতে বলা হয় প্রতি ১০,০০০ বা ১,০০,০০০ জনের হিসেবে, যাতে আপনি পুরো সংখ্যা দেখতে পারেন।”

সংখ্যা দিয়ে যখন বোঝানো সম্ভব নয়, তখন গ্রাফিক ব্যবহার করুন

“বিশ্বের যে ছয়টি দেশে বেতনসহ জাতীয় মাতৃত্বকালীন ছুটির আইন নেই” তারমধ্যে একটি যুক্তরাষ্ট্র—পরিসংখ্যানটি ব্যতিক্রমী আইনটির ব্যাপকতা বোঝাতে সক্ষম নয়। তাছাড়া পরিসংখ্যানে তথ্য ঘাটতিও বিদ্যমান—কারণ ওই ছয়টি দেশের মধ্যে চারটি দ্বীপরাষ্ট্র এবং আকার এত ছোট যে বিশ্ব মানচিত্রে স্পষ্টভাবে দেখাও যায় না। লাফ্লার বলেন, নিউইয়র্ক টাইমস গ্রাফিক্সটি পাঠকদের জন্য অর্থপূর্ণভাবে উপস্থাপন করেছে।

NYT graphic on global paid leave policy, by country

নিউইর্য়ক টাইমসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাপী মাতৃত্বকালীন ছুটির নীতির উপর একটি গ্রাফিক্স। শুধুমাত্র কমলা রঙ দিয়ে চিহ্নিত দেশগুলোতে জাতীয় মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই। ছবি: স্ক্রীনশট, দ্য নিউইর্য়ক টাইমস

 

বিলিয়নের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন, এবং সংখ্যা আকারে তুলে ধরুন

বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন বিলিয়ন সংখ্যার ব্যবহার মিডিয়াতে এত বেশি প্রচলিত যে সংখ্যাগুলোর ব্যাপকতা সাংবাদিক ও পাঠকরা মাঝে মাঝে বুঝতে পারেন না। যেমন ধরা হয়: এক মিলিয়ন সেকেন্ড  মানে মাত্র ১১ দিন, কিন্তু এক বিলিয়ন সেকেন্ড প্রায় ৩২ বছরের সমান। আর্থিক প্রতিবেদনে মিলিয়ন ও বিলিয়ন দিয়ে বিভ্রান্ত হওয়াটা অনেক বেশি সহজ। ডাউডেল সাম্প্রতিক একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন, যেখানে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা লক্ষ্য করেন যে, ট্রাম্প প্রশাসনের ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি (ডোজ) পরিষেবা একটি সরকারি চুক্তি বাতিল করে ৮ মিলিয়ন ডলার বাঁচিয়েছে, অথচ জনসমক্ষে তাঁরা বলে বেড়াচ্ছিল ৮ বিলিয়ন ডলার। যা বড় ধরনের ভুল। সরকারি কর্মকর্তাটি সম্ভবত “৮,০০০,০০০.০০” কে ভুল করে “৮,০০০,০০০,০০০” হিসেবে পড়েছিলেন।

নিজেকে প্রশ্ন করুন: “আমি কী কিছু ভুলে গেছি?”

এ প্রসঙ্গে ২০২১ সালের একটি মজার ঘটনার কথা বলা যায়। ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও তখন ব্রডওয়ের একটি জনপ্রিয় গানের গাণিতিক লিরিক “ফাইভ হানড্রেড টুয়েন্টি ফাইভ থাউজেন্ড সিক্স হানড্রেড মিনিটস: হাউ ডু ইউ মেজার; মেজার আ ইয়ার?” এর আদলে উল্লেখ করেছিল,“থার্টিন মিলিয়ন ওয়ান হানড্রেড ফর্টি থাউজেন্ড মিনিটস: ‘রেন্ট’-এর প্রথম পরিবেশনার ২৫ বছর পার হয়েছে।” পরবর্তীতে দেখা যায় যে প্রতিবেদনটির সম্পাদকরা মধ্যবর্তী অতিরিক্ত সাতটি দিনের হিসাব করতে ভুলে গেছেন, যেগুলোর প্রতিটি ৫২৭,০৪০ মিনিট করে। ফলে, শিরোনামটি সংশোধন করে তাদের লিখতে হয়ছিল “১৩,১৫০,০৮০ মিনিট।” ঘটনাটি ডেটা সাংবাদিকদের দিকে দারুণ একটি  প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।

আপনার খসড়াটি জোরে জোরে পড়ুন

নিকার সম্মেলনের অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্যে বলা হয় যে, ডেটা প্রতিবেদনের খসড়া উচ্চস্বরে পড়ার অনেক সুবিধা রয়েছে। “আমি সবসময় উচ্চারণ করে পড়ি—এটি বুঝতে সহায়তা করে যে কোথায় বেশি সংখ্যার ব্যবহার হয়েছে,” বলেন লাফ্লার। “আপনার বিশ্লেষণের সময় নিশ্চিত করুন যে আপনি কয়েকটি বাক্যে এটি ব্যাখ্যা করতে পারবেন। বিষয়টি পরীক্ষার জন্য আমি আগে আমার মায়ের কাছে ফোন করে তাকে পড়ে শোনাতাম এবং দ্রুত বুঝতে পারতাম যে আমার হাতে কোনো গল্প আছে কিনা।” ডাউডেলও একমত পোষণ করে বলেন: “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আপনার অনুসন্ধানগুলো তুলে ধরা, পাঠকদের সংখ্যা দিয়ে বিভ্রান্ত করে ফেলা নয়।”

জনপ্রিয় বয়ানের ক্ষেত্রে মানানসই সংখ্যার প্রতি সতর্ক থাকুন

ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচিত একটি ডেটাভিত্তিক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, টেসলা সাইবারট্রাকে আগুণ ধরার হার ১৪.৫ শতাংশ। যার মানে দাঁড়ায় রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত টেসলা সাইবারট্রাকের প্রতি সাতটি গাড়ির মধ্যে গড়ে একটিতে আগুণ লেগেছে। পরিসংখ্যানটি ভয়াবহ রকমের উচ্চ হারকে তুলে ধরে। স্বাভাবিকভাবেই পরিসংখ্যানটিকে সন্দেহের চোখে দেখা উচিত। লাফ্লার জানান, পরবর্তীতে ওই  সংবাদমাধ্যমের পক্ষ থেকে সংখ্যাটি সংশোধন করে জানানো হয় যে, আসল হার ছিল ১,০০০ গুণ কম, বা প্রতি ১,০০,০০০ গাড়ির মধ্যে ১৪.৫টির ক্ষেত্রে আগুণ লাগার ঘটনা ঘটেছে। (তাছাড়া সংশোধিত তথ্যটিও ছিল ত্রুটিপূর্ণ—কারণ এতে নমুনার সংখ্যা ছিল অনেক কম, আর ব্যবহৃত ডেটাটি ছিল মূলত “আপেলের সঙ্গে কমলাকে তুলনা করার মতো ভুল। অর্থাৎ একে অপরের সঙ্গে তুলনাযোগ্য নয় এমন তথ্য মিলিয়ে গণনা করা হয়েছিল। পুরো হিসাবটির ভিত্তি ছিল মাত্র দুটি গাড়ি দুর্ঘটনা আর নতুন বছরের প্রথম দিন লাস ভেগাসে হওয়া একটি আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনার ওপর। এছাড়াও, বিতর্কিত ওই গাড়িগুলোর প্রকৃত বিক্রির সংখ্যাও কম দেখানো হয়েছিল।

লাফ্লার পরামর্শ দিয়েছেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, “যখন খটকা লাগবে, তখন আপনার  অবচেতন মনের কথা শোনার চেষ্টা করুন।”

ডাউডেল পরামর্শ দিয়েছেন: আপনার নিজের অনুমানের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটিকে প্রশ্ন করুন। আপনি যেমনটি ভেবেছিলেন গল্পটি হয়তো তেমন নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের অনুমানের সঙ্গে মূল কাহিনীর মিল থাকে না এবং সম্পূর্ণ অন্যদিকে নিয়ে যায়। তবে শেষমেশ অনেক বেশি আকর্ষনীয় ও নিখুঁত হয়ে ওঠে।

এই দুইজন ডেটা বিশেষজ্ঞই আইআরইর “নাম্বার্স ইন দ্য নিউজরুম” গাইডের দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে গাণিতিক ধারণাগুলো ঝালিয়ে নেওয়ার পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। গাইডটি লিখেছেন সারা কোহেন। এই হ্যান্ডবুকের গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরামর্শের মধ্যে যেমন রয়েছে:

IRE Numbers in the Newsroom Guide

ডেটা সাংবাদিকদের জন্য দারুণ একটি সহায়ক উৎস আইআরইর ‘নাম্বার্স ইন দ্য নিউজরুম’ গাইডটি। ছবি: স্ক্রীনশট, আইআরই

একটি অনুচ্ছেদে মোট ডিজিটের সংখ্যা আটটির কম রাখার চেষ্টা করুন

তবে এটা যে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে তা নয়, তবে পরামর্শটি দারুণ। সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বিশেষজ্ঞরা বলেন, যে ধরনের সাবধানতার সঙ্গে আপনি কোনো বক্তা বা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির উদ্ধৃতি বেছে নেন, ঠিক ওইভাবে সংখ্যা বেছে নিন” এবং যেকোনো অনুচ্ছেদে মোট ডিজিটের সংখ্যা আট ঘর পর্যন্ত সীমিত রাখার চেষ্টা করুন। এতে করে আপনি দুটি সংখ্যা (যেমন শতকরা হার) এবং একটি সাল উল্লেখ করতে পারবেন। এখানে যেমন ডিজিট বেশি হয়েছে তবে যদি দশমিকগুলো বাদ দেওয়া হয়, তাহলে তা গাইডের নির্দেশনাকে অনুসরণ করবে: “২০২৪ সালে অফিস অব রিডানড্যান্সির বাজেট ৪৮ শতাংশ বেড়ে ৭০০.৩ মিলিয়ন ডলার থেকে ১.০৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।” তবে এর চেয়েও ভালো হয় যদি বাক্যটি একটি মাত্র সংখ্যায় প্রকাশ করা যায়: “গত এক বছরে অফিস অব রিডানড্যান্সির বাজেট প্রায় অর্ধেক বেড়ে ১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।”

গড়ের ওপর গড় গণনা পরিহার করুন

কোহেন বার্তাকক্ষের এই সাধারণ ভুলকে “সবজীকে অতিরিক্ত সিদ্ধ করে ফেলার” সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, সাংবাদিকেরা অনেক সময় বাজেটের মতো বিষয়গুলোতে বিভিন্ন শতাংশ পরিবর্তনকে একসঙ্গে গড় হিসাব করে “গড় শতাংশ পরিবর্তন” তুলে ধরেন। এভাবে হিসাবের সমস্যা হচ্ছে, এটি শিক্ষাখাতের ২% বৃদ্ধির সঙ্গে নতুন কোনো ছোট বিভাগে ১৪০% বৃদ্ধিকে সমানভাবে হিসাব করে।

সহজ পদ্ধতির মাধ্যমে বের করুন “প্রতি কতজনের মধ্যে একজনঝুঁকিতে

সচরাচর ঘটে না এমন ঘটনা পরিসংখ্যান আকারে তুলে ধরার কাজটি কঠিন মনে হতে পারে, আসলে কিন্তু তা নয়। ধরুন, কোনো শহরে প্রতি বছর ৪৩ লাখ মানুষের মধ্যে ২০ জন বজ্রপাতের শিকার হন। এ সংখ্যা দিয়ে সরাসরি ভাগ করলে ফলাফল হয় ০.০০০০০৫—যা অনেক পাঠকের কাছে অর্থহীন লাগতে পারে। কিন্তু কোহেন বলেন, এই ছোট সংখ্যাটিকে ১ দিয়ে ভাগ করলেই সহজ ও বোধগম্য হয়। প্রতি কতজনের মধ্যে একজন (ওয়ান আউট অব) এ হিসাবটি পাওয়া যায়—এক্ষেত্রে যেমন: প্রতি ২ লাখ জনের মধ্যে একজনের বজ্রপাতের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।


রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। এর আগে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসের প্রধান প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন। একজন বিদেশী সংবাদদাতা হিসেবে তিনি বিশ্বের দুই ডজনেরও বেশি দেশের সংবাদ, রাজনীতি, দুর্নীতি এবং সংঘাতের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।