প্রবেশগম্যতা সেটিংস

রিসোর্স

বিষয়

অনুসন্ধান গাইড: রাষ্ট্রের টাকায় কেনা অস্ত্র কার বিরুদ্ধে- কেন ব্যবহার হচ্ছে, ক্ষতি-ই বা কী

সম্পাদকের মন্তব্য: এই অধ্যায়টি জিআইজেএন রিপোর্টারস গাইড টু ইনভেস্টিগেটিং ওয়ার ক্রাইমসএর নতুন সংযোজন। লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে।

বিশ্বজুড়ে অস্ত্র কেনাবেচার ব্যবসা বিশাল অর্থনীতির অংশ। বিলিয়ন ডলারের শিল্প। কেবল ব্যবসার বিষয় নয়, বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক আর মানবাধিকারের বিষয়ও  এতে জড়িত। অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে রাষ্ট্র আর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল লাভ করে। কিন্তু এই অস্ত্র যখন যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা বা আগ্রাসনের জন্য ব্যবহৃত হয়—তখন এর পরিণতি হয় ভয়াবহ। এ অবস্থায় অস্ত্র রপ্তানিকারক ও বিক্রেতারা ওই অপরাধের সঙ্গে জড়িত হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। যদিও কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধের দায় নির্ধারণ এখনও বিতর্কিত বিষয়। এমন পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা এই জটিল আর গোপন সম্পর্কগুলো উন্মোচনের মাধ্যমে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনেন।

যেখানে অস্ত্র বিক্রির ঘটনা হয়তো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক অপরাধে পরিণত হয়েছে, অথবা সংঘাতকালীন কিংবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালানো মানবাধিকার লঙ্ঘনের সহায়তায় ব্যবহৃত হয়েছে—এ ধরনের পরিস্থিতি অনুসন্ধানে সাংবাদিকদের সহায়তা করবে এই লেখা। এ ধরনের অনুসন্ধানে নামতে হলে সাংবাদিকদের আইনি কাঠামো, অনুসন্ধান পদ্ধতি এবং বাস্তব ঘটনা বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়। যার মাধ্যমে অস্ত্র লেনদেন এবং কথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ, জাতীয় অপরাধ কিংবা কাঠামোগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে সংযোগ খুঁজে বের করা সম্ভব হয়।

এটি সহজ কাজ নয়—তবে অত্যন্ত জরুরি।

এখানে বিপুল পরিমাণ অর্থ জড়িত। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। বৈশ্বিক অস্ত্র রপ্তানির ৪৩ শতাংশ ছিল তাদের দখলে। পরের অবস্থানে ছিল ফ্রান্স (৯.৬ শতাংশ) এবং এই সময়ের মধ্যে রাশিয়ার অংশীদারিত্ব কমে দাঁড়ায় ৭.৮% শতাংশ।

এই পরিসংখ্যানগুলো দেখায় যে কয়েকটি প্রধান দেশের হাতে অস্ত্র রপ্তানি কেন্দ্রীভূত। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্য—দেশগুলোর অনেকেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য। এই ব্যবসায় জড়িত বেসরকারি কোম্পানিগুলো জটিল আইনি কাঠামোকে কাজে লাগিয়ে নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর পথ খুঁজে নেয়। তাছাড়া অবৈধ অস্ত্র লেনদেনের কারণে অপরাধীদের বিচার হওয়ার ঘটনাও বেশ বিরল।

এই লেখায় নতুন অংশটি যুক্ত করার উদ্দেশ্য হলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের এমন সব কৌশল ও পরামর্শ প্রদান করা, যাতে তাঁরা অস্ত্র লেনদেনের ঘটনাগুলো অনুসন্ধানে সক্ষম হন— বিশেষ করে যে সব অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধাপরাধের মতো ঘটনা ঘটাতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন আইনি কাঠামো সম্পর্কে ভালো বোঝাপড়া তৈরি। কোথায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটেছে তা চিহ্নিত করা। প্রমাণ সংগ্রহ ও নথিভুক্ত করা। অস্ত্র সরবরাহের চেইন অনুসরণ করা এবং আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে কিনা তা যাচাই করে দেখা।

আইনি কাঠামো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা

আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাণিজ্য সংক্রান্ত যে আইনি কাঠামো রয়েছে, তা বোঝা অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য খুব জরুরি—বিশেষ করে যখন যুদ্ধাপরাধে কারো জড়িত থাকার সম্ভাবনা নিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়। এই আইনি কাঠামোগুলো চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ও অনুমোদনকারী দেশগুলোর দায়-দায়িত্ব ঠিক করে দেয় এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার জন্যও নিয়ম নির্ধারণ করে। এতে স্পষ্টভাবে বলা থাকে, কোন অস্ত্র রপ্তানি বৈধ এবং কোনটি আন্তর্জাতিক মানবিক আইন (আইএইচএল) বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো গুরুতর অপরাধে ভূমিকা রাখতে পারে।

বৈশ্বিক অস্ত্র বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চুক্তি আর্মস ট্রেড ট্রিটি (এটিটি)। ২০১৩ সালে গৃহীত এ চুক্তিটি  কার্যকর হয় ২০১৪ সালে। এখন পর্যন্ত ১১৬টি সদস্য দেশ এই চুক্তি স্বাক্ষর ও কার্যকর করেছে (আরও ২৩টি দেশ চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও এখনো তা কার্যকর করেনি)। এদের অনেকেই বিশ্বের প্রধান অস্ত্র উৎপাদক। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া সদস্য হিসেবে নাম লেখায়নি (যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তা অনুমোদন করেনি)।

এটিটি (আর্মস ট্রেড ট্রিটি)-এর ধারা ৬-এ স্পষ্টভাবে বলা আছে—যদি কোনো রাষ্ট্র জানে যে তাদের রপ্তানি করা অস্ত্র যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ অথবা গণহত্যাতে ব্যবহার করা হবে, তাহলে সেই অস্ত্র রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কুইনটেন ডেগ্রোট বলেন: “এই ধারাটি দেখিয়ে দেয়, কোনো দেশ সরাসরি যুদ্ধাপরাধ না করেও যদি জেনেশুনে এমন জায়গায় অস্ত্র পাঠায় যেখানে সেই অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধাপরাধ হতে পারে, তাহলে সেই দেশকেও দায়ী ধরা হবে। সাংবাদিকরা চাইলে এটা তাদের লেখায় তুলে ধরতে পারেন। কারণ এটা স্পষ্টভাবে বলে দেয়—একটা রাষ্ট্র কখন আন্তর্জাতিক আইনে দায়ী হয়ে পড়ে।”

অস্ত্র রপ্তানিতে সরাসরি নিষেধাজ্ঞাই নয়—এটিটির ৭ নম্বর ধারায় আরো বলা আছে, অস্ত্র রপ্তানি করার আগে একটি দেশকে অবশ্যই যাচাই করে দেখতে হবে: সেই অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধের সময় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে পারে কিনা। যদি দেখা যায়, মানবধিকার লঙ্ঘনের প্রবল ঝুঁকি আছে, তাহলে এই ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্র অস্ত্র রপ্তানির অনুমতি দিতে পারবে না। (আন্তর্জাতিক অস্ত্র চুক্তি নিয়ে আরও জানতে, এই গাইডের ‘ব্যান্ড অ্যান্ড রেস্ট্রিকটেড ওয়েপনস’ অধ্যায় দেখুন।)

আর্মস ট্রেড ট্রিটি (এটিটি)-র পাশাপাশি, ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন এবং এর অতিরিক্ত প্রোটোকলগুলো আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের (আইএইচএল) মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। এই চুক্তিগুলো যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সাধারণ মানুষ ও যুদ্ধবন্দিদের সুরক্ষা দেওয়ার নিয়ম ঠিক করে দেয়। আইন অনুযায়ী, সব রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব হলো এই নিয়মগুলো মেনে চলা এবং নিশ্চিত করা যেন অন্য রাষ্ট্রগুলোও এগুলো মানে।

অস্ত্র লেনদেনের ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে, এই আইনগুলো একটি সাধারণ দায়িত্বের কথা তুলে ধরে। এর মধ্যে রয়েছে—এলোপাতাড়ি হামলা নিষিদ্ধ করা, সাধারণ নাগরিক ও যোদ্ধার মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য করা, হামলার আগে যথাসম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করা এবং এমন কোনো অস্ত্র, উপায় বা কৌশল ব্যবহার না করা যা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সব মিলিয়ে, এই চুক্তিগুলো সব দেশকে বাধ্য করে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনকে সম্মান করতে এবং অন্যদের কাছ থেকেও সেই সম্মান নিশ্চিত করতে।

অনেকেই মনে করেন, এই চুক্তিগুলোর অর্থ শুধু আইএইচএল মেনে চলা নয়, বরং যেখানে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন হচ্ছে, সেখানে সহায়তা বা সাহায্য না দেওয়া (যেমন: অস্ত্র সরবরাহ না করা)। এটাও একটি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তবে এই ব্যাখ্যা সর্বজনীনভাবে গৃহীত নয় এবং বিষয়টি এখনো বিতর্কিত। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো কিছু রাষ্ট্র মনে করে— যদি তারা কোনো সংঘাতে সরাসরি জড়িত না থাকে, তাহলে এই ধরণের বাধ্যবাধকতা তাদের ওপর প্রযোজ্য নয়।

এছাড়া, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির (আইসিআরসি) রুল ১৪৪ তে—অস্ত্র লেনদেনের বিষয়টি সরাসরি উল্লেখ করে না।

সদস্য দেশগুলোর জন্য অস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কমন পজিশন ২০০৮/৯৪৪/সিএফএসপি আঞ্চলিক পর্যায়ে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক কিছু নীতিমালা নির্ধারণ করেছে। এই নীতিমালা অনুযায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন (আইএইচএল) নিয়ে অস্ত্র গ্রহণকারী দেশের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন তা যাচাই করতে হয়। পাশাপাশি এই নীতিতে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় রাখতে বলা হয়েছে—যেমন মানবাধিকারের অবস্থা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং অনুমোদন নেই এমন ব্যবহারকারীর হাতে অস্ত্র পৌঁছানোর ঝুঁকি।

এসব চুক্তি ও আইনি নীতিমালার পাশাপাশি, আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ রয়েছে, যেগুলোর লক্ষ্য হলো ছোট অস্ত্র ও হালকা অস্ত্রের অবৈধ বাণিজ্য ও বিস্তার রোধ করা। জাতিসংঘের প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন (পিওএ) রাষ্ট্রগুলোকে উৎসাহিত করে—তারা যেন জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে ছোট ও হালকা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। রাষ্ট্রগুলোকে ছোট ও হালকা অস্ত্র চিহ্নিতকরণ ও ট্র্যাকিংয়ের জন্য একটি মানসম্পন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করতে বাধ্য করে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেসিং ইনস্ট্রুমেন্ট (আইটিআই)। যাতে অস্ত্রের জবাবদিহিতা বাড়ে এবং অবৈধ অস্ত্র প্রবাহ শনাক্ত করা সহজ হয়। কিনশাসা কনভেনশন-এর মতো চুক্তি মধ্য আফ্রিকা ও রুয়ান্ডার মধ্যে ছোট ও হালকা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে আঞ্চলিকভাবে কাজ করে। লক্ষ্য অস্ত্রগুলোর অবৈধ বাণিজ্য ও ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করা

AK-47 weapons cache, arms trading

ছোট ও হালকা অস্ত্রের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ অনেক কঠিন।  (ছবি: শাটারস্টক)

জাতিসংঘের ট্রান্সন্যাশনাল অর্গানাইজড ক্রাইম কনভেনশনের অংশ ফায়ারআর্মস প্রোটোকল অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উৎপাদন ও পাচার রোধে দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেয়। যা আগ্নেয়াস্ত্র, গুলিসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশের অবৈধ বাণিজ্যে বন্ধে কাজ করে। আরেকটি উদ্যোগ হলো ওয়াসেনার অ্যারেঞ্জমেন্ট। চুক্তিটি অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলোকে কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতার মধ্যে ফেলে না। তবে সাধারণ অস্ত্র ও দ্বৈত-ব্যবহার (বেসামরিক (নাগরিক) এবং সামরিক—উভয় ধরনের ব্যবহার) করা যায় এমন পণ্য রপ্তানিতে দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে কাজ করে।

এই সব আইনি নীতিমালা সম্মিলিতভাবে অস্ত্র লেনদেনের সীমা নির্ধারণ করে। আইনটি সাংবাদিকদের জন্য একটি কাঠামো তৈরি করে। এর মাধ্যমে সাংবাদিকরা অস্ত্র চুক্তির বৈধতা বিশ্লেষণ করতে পারেন। অস্ত্র রপ্তানি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনে ভূমিকা রেখেছে কিনা—তা নিয়ে অনুসন্ধান করতে পারেন। (তবে প্রতিবেদনে এটি স্পষ্ট করে উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, এই আইনগুলো মূলত রাষ্ট্রের দায়িত্ব নির্ধারণ করে, কিন্তু কোনো রাষ্ট্র যদি তা লঙ্ঘন করে তা যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের সমতুল্য হবে না)।

একটি সংঘাতের ঘটনা নির্বাচন করুন এবং অনুসন্ধানের কাঠামো তৈরি করুন

সাংবাদিকদের উচিত এমন সব তথ্যসূত্র পরীক্ষা করা, যা বেসামরিক মানুষের ওপর হামলার ঘটনা, জনবহুল এলাকায় বিস্ফোরক অস্ত্র ব্যবহারের তথ্য এবং অন্যান্য সূত্র তুলে ধরে যা মানবাধিকার লঙ্ঘন চিহ্নিত করতে সাহায্য করতে পারে।

সাংবাদিকদের উচিত কিছু মৌলিক প্রশ্ন থেকে শুরু করা, যেমন: কোন কোন দেশ বা কোন কোন কোম্পানি এই সংঘাতের সঙ্গে জড়িত পক্ষতগুলোকে অস্ত্র সরবরাহ করছে? এসব অস্ত্রের উৎস প্রমাণ করা সম্ভব কি? এসব অস্ত্র কি এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িত, যেগুলো আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের পরিপন্থি ও উদ্বেগ তৈরি করে? কোনো সরকার, এনজিও বা জাতিসংঘের সংস্থা কি এরইমধ্যে এসব অস্ত্র বাণিজ্য নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে? এ বিষয়ে অন্য কেউ কি রিপোর্ট করেছে? অনুসন্ধান এগিয়ে নিতে নতুন কোনো প্রমাণ পাওয়া গেছে কি?

যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ সংগ্রহ

যখন সাংবাদিকরা কোনো সংঘাতের ঘটনা নির্বাচন করে অনুসন্ধান শুরু করেন, তখন তাদের কাজ হয় যুদ্ধাপরাধের সম্ভাব্য নির্দিষ্ট ঘটনার প্রমাণ সংগ্রহ করা। এর মধ্যে রয়েছে বেসামরিক জনগণের ওপর হামলা, হাসপাতাল বা স্কুলের মতো সুরক্ষিত অবকাঠামোর ধ্বংস, এবং নিষিদ্ধ অস্ত্র যেমন ক্লাস্টার মিউনিশন বা অ্যান্টি-পারসোনেল ল্যান্ডমাইন ব্যবহারের ঘটনা।

এই কাজটি করতে, সাংবাদিকদের উচিত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, মেডিসিনস সান ফ্রন্টিয়ারস এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের মতো সংগঠনগুলোর মাঠ পর্যায়ের রিপোর্ট পর্যালোচনা করা। এসব সংস্থা যাচাই করা সাক্ষ্য, স্যাটেলাইট চিত্র এবং ডিজিটাল ফরেনসিক বিশ্লেষণ প্রকাশ করে। যা নির্দিষ্ট ঘটনার সঙ্গে নির্দিষ্ট অস্ত্র বা যন্ত্রাংশের সংযোগ প্রমাণ করে।

সাংবাদিকদের উচিত কিছু তথ্যভাণ্ডারের তথ্য যাচাই-বাছাই করা, যা বেসামরিক মানুষের ওপর অতিরিক্ত ক্ষতি, জনবহুল এলাকায় বিস্ফোরক অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য তুলে ধরতে পারে (এখানে এভরি ক্যাজুয়ালটি কাউন্টস  নামে একটি দাতব্য সংস্থার বেসামরিক ক্ষতির তথ্য ব্যবহার করা যেতে পারে)। যা শর্ত লঙ্ঘন চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে।

ঘটনাগুলোর একটি স্প্রেডশীট বা ডেটাবেস তৈরি করতে পারেন। যা বেশ কাজে লাগে। যেখানে সময়, তারিখ, স্থান, ব্যবহৃত অস্ত্রের ধরণ, অপরাধী, বেসামরিক নিহতের সংখ্যা এবং সম্ভাব্য আইনি লঙ্ঘনের কলাম থাকবে। এর মাধ্যমে অনুসন্ধানের ফলাফলগুলো সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো যায় এবং পরবর্তী ধাপের প্রস্তুতি নেওয়া সহজ হয়। এই বিষয়টি গাইডে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

ব্যবহৃত অস্ত্র শনাক্ত করা

যখন কোনো নির্দিষ্ট ঘটনার প্রমাণ সংগ্রহ হয়ে যায়, তখন অনুসন্ধানকারীদের জন্য পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ব্যবহৃত অস্ত্রটির উৎস খুঁজে বের করা। সাধারণত, এই কাজ শুরু হয় ঘটনার পর তোলা ওপেন সোর্স ছবি বা ভিডিও বিশ্লেষণ করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, স্বাধীন সংবাদ প্রতিবেদন এবং নাগরিক সাংবাদিকতা প্রায়ই মূল্যবান ভিজ্যুয়াল তথ্য সরবরাহ করে।

যেমন, বোমার অবশিষ্টাংশ, টেইলফিন বা শেল কেসিংয়ের ছবি থেকে কখনো কখনো অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করা যায়। কারণ এসব অবশিষ্টাংশের ওপর থাকে বিশেষ সিরিয়াল নম্বর, কারখানার চিহ্ন বা নকশার বৈশিষ্ট্য। এগুলো অস্ত্রের উৎস নিশ্চিত করার বাস্তব প্রমাণ হিসেবে কাজ করে।

কিছু প্রতিষ্ঠান বিস্ফোরক অস্ত্র শনাক্ত করার জন্য বিস্তারিত গাইড তৈরি করেছে। যেমন বেলিংক্যাট-এর “আ বিগিনার’স গাইড টু আইডেনটিফাইং এক্সপ্লোসিভ অর্ডন্যান্স ইন সোশ্যাল মিডিয়া ইমেজারি” । এখানে বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, যার মাধ্যমে ভিজ্যুয়াল প্রমাণ বিশ্লেষণ করে অস্ত্রের ধরন ও উৎস নির্ণয় করা যায়। একইভাবে, বোম্ব টেকস উইদাউট বর্ডারস এর “বেসিক আইডেনটিফিকেশন অব অ্যামুনিশন ইন ইউক্রেন” গাইডে ইউক্রেনে পাওয়া মিউনিশনের অসংখ্য চিত্র ও তথ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

ইউক্রেনের কিয়েভ খ্রেসচাটিক স্ট্রিটে এক প্রদর্শনীতে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত রুশ শাহেদ ড্রোনের অবশিষ্টাংশ প্রদর্শিত হচ্ছে। (ছবি: শাটারস্টক, ডমিত্রো স্টোলিয়ারেঙ্কো)

এই রিসোর্সগুলোর পাশাপাশি অস্ত্র বিশেষজ্ঞ বা কনফ্লিক্ট আর্মামেন্ট রিসার্চ (সিএআর) ও অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্স (এওএভি)-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করা অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে। (সম্পাদকের মন্তব্য: এই অধ্যায়ের লেখক এওএভির নির্বাহী পরিচালক।)

বছর এবং অঞ্চলের ভিত্তিতে বিভিন্ন সংঘাতে ব্যবহারিত অস্ত্র শনাক্তকরণের ম্যানুয়াল সরবরাহ করে সিএআর। যা ভিজ্যুয়াল প্রমাণের সঙ্গে নির্দিষ্ট অস্ত্রের মডেল ও প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে সাহায্য করে।

এছাড়া ইউএনআইডিআইআর; যা প্রচলিত অস্ত্র ও গোলাবারুদের ‘এন্ড-ইউজ’ এবং ‘এন্ড-ইউজার’ সার্টিফিকেশন নিয়ে গবেষণা করে; কন্ট্রোল আর্মস, যা অস্ত্র বাণিজ্য পর্যবেক্ষণে নিয়োজিত একটি এনজিও; এবং   এট্রিটি সেক্রেটারিয়েট, যারা রাষ্ট্র থেকে প্রতিবেদন সংগ্রহ করে ও সীমিত তথ্য প্রকাশ করে—এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্যও অনুসন্ধানে কাজে লাগাতে পারেন।

অস্ত্র ও গোলাবারুদের ওপর থাকা চিহ্নগুলো বোঝাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত, এসব অস্ত্রের ওপর নির্দিষ্ট রঙের প্যাটার্ন এবং অক্ষর থাকে। এর মাধ্যমে অস্ত্রের ধরন, উৎপত্তিস্থান এবং কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। যেমন, আর্টিলারি শেলের রঙের বেল্ট দেখে ধারণা পাওয়া যায় যে, এগুলো কী উচ্চ বিস্ফোরক, ধোঁয়া নাকি অনুশীলনের জন্য তৈরি গোলা।

এই চিহ্নগুলো বুঝতে হলে বিভিন্ন দেশ ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান চিহ্নিতকরণের নিয়মগুলো সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন।
একটি অস্ত্রের গঠন, আকৃতি এবং আয়তন অতিরিক্ত শনাক্তকরণ সূত্র হিসেবে কাজ করতে পারে। কোনো গোলা-বারুদের আকার ও গঠন পরিচিত মাপকাঠির সঙ্গে তুলনা করে বিশ্লেষকেরা সম্ভাব্য মডেলগুলোর সংক্ষিপ্ত তালিকা করতে পারেন। যখন সরাসরি মাপ নেওয়া সম্ভব হয় না, তখন ফটোগ্রামেট্রি নামক প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে—যার মাধ্যমে ছবি থেকে থ্রিডি মডেল তৈরি ও নির্ভুল মাপ নির্ধারণ করা যায়। এর জন্য অ্যাগিসফট মেটাশেপ বা ফটোমডেলার মতো সফটওয়্যার ব্যবহার করা যেতে পারে । এছাড়া, ন্যাটো এক্সপ্লোসিভ অর্ডন্যান্স ডাটাবেস (এনএটিও-ইওডিডি), এআরইএস ওয়েপন আইডি সুইট এবং জেনেভা ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর হিউম্যানিটারিয়ান ডিমাইনিং (জিআইসিএইচডি)–এর অ্যামুনিশন ম্যানেজমেন্ট অ্যাকটিভিটি প্ল্যাটফর্ম (এএমএপি) এর মতো টুলগুলো মাত্রা ও গঠনগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তথ্য মিলিয়ে দেখতে সাহায্য করে।

এই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করলে যুদ্ধক্ষেত্র বা বিস্ফোরণের পরের জায়গায় গিয়ে অস্ত্র দেখার দরকার হয় না। ছবি দেখে দূর থেকেই সেগুলো চিনে ফেলা যায়। এতে ঝুঁকি কমে যায় এবং কাজটাও সহজ হয়।

নতুন প্রযুক্তি দ্রুত বিকাশের কারণে অস্ত্র সনাক্তকরণ আরও কার্যকর ও নির্ভুল হচ্ছে। এখন দূর থেকে বিশ্লেষণ করা, ভিজ্যুয়াল শনাক্তকরণ স্বয়ংক্রিয় করা এবং বিভিন্ন তথ্যভাণ্ডার একত্রিত করে তাৎক্ষণিক তুলনা করা সম্ভব হচ্ছে। এআই পরিচালিত ছবি শনাক্তকরণ সরঞ্জাম, ৩ডি ফোটোগ্রামমেট্রি সফটওয়্যার এবং মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম এখন অস্ত্রের খণ্ডাংশ বা ছবির মাধ্যমে অস্ত্রের ধরন নির্ধারণ করতে সক্ষম।

শত্রুপূর্ণ বা কঠিন পরিবেশে মাঠ পর্যায়ের কর্মী ও বিশ্লেষকরা ড্রোন ক্যামেরা, অগমেন্টেড রিয়ালিটি ইন্টারফেস এবং ক্লাউড-ভিত্তিক ফরেনসিক ডেটাবেস ব্যবহার করে দ্রুত অস্ত্র শনাক্ত করে থাকেন। এই টুলগুলো শুধু ফরেনসিক বিশ্লেষণের গতি বাড়ায় না, বরং মানবিক কারণে মাইন পরিষ্কার এবং যুদ্ধক্ষেত্রের ঘটনাগুলো নথিভুক্ত করার সময় যেসব প্রমাণ ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর নির্ভুলতাও অনেক বাড়িয়ে দেয়।

ভিএফ্রেম এবং টেক ৪ ট্রেসিং-এর মতো গ্রুপগুলো মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ও কম্পিউটার ভিশন ব্যবহার করে গোলাবারুদ শনাক্তকরণের কিছু কাজ স্বয়ংক্রিয় করার জন্য টুল তৈরি করছে। ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল নাগাদ, ভিএফ্রেম বার্লিন ভিত্তিক মেনোমনিক  নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেছে, যারা সংঘাত অপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার ডিজিটাল ডকুমেন্টেশন করে। তারা কম্পিউটার ভিশন ব্যবহার করে কোটি কোটি ভিডিও থেকে গোলাবারুদ খুঁজে বের করার একটি পাইলট প্রকল্প পরিচালনা করছে। ইউরোপীয় কমিশনের মাধ্যমে অর্থায়িত টেক ফোর ট্রেসিং সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট কাজে সহায়তা করার জন্য ব্যবহার করা যাবে।

এই ধরনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির খোঁজ-খবর রাখা সাংবাদিকদের জন্য অস্ত্র শনাক্তকরণের নতুন পথ খুলে দিতে পারে। এমনকি যদি কোনো অস্ত্রের ভৌত অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করা না যায়, তবুও উচ্চমানের ছবি ও সঠিক বিশ্লেষনের মাধ্যমে সেই অস্ত্রের উৎপত্তি বা উৎস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া সম্ভব।

Gaza,Envelope,,Israel:,24,,October:,Close,Up,Of,Munition,Of

যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি এম১০৭ কামানের ১৫৫ মিমি গোলা—এই ধরনের বড় গোলাগুলোর গায়ে সাধারণত এ ধরনের লেখা বা চিহ্ন থাকে। বিশ্লেষকরা এই চিহ্ন দেখে বুঝতে পারেন এই অস্ত্র কোথা থেকে এসেছে এবং এটা কেমন ধরনের। ছবি: শাটারস্টক

সরবরাহ শৃঙ্খল অনুসরণ

অস্ত্রটি সংঘাতে ব্যবহৃত হয়েছে—তা শনাক্ত করার পর গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো অস্ত্রটি কারখানা থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে কীভাবে পৌঁছেছে তা অনুসন্ধান করা। এই ‘সরবরাহ শৃঙ্খল’ অনুসরণ যুদ্ধাস্ত্র বাণিজ্যের প্রক্রিয়া বোঝার জন্য এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হয়েছে কিনা তা মূল্যায়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রাথমিক উৎস হলো স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরপি) এর অস্ত্র লেনদেন ডেটাবেস। এখানে ১৯৫০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় ধরনের প্রচলিত অস্ত্রের লেনদেনের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।  যেমন সরবরাহকারী ও গ্রহণকারী দেশ এবং লেনদেনকৃত অস্ত্রের ধরণ। এই তথ্য বিশ্লেষণ করে সাংবাদিকরা এমন নকশা ও নির্দিষ্ট লেনদেন চিহ্নিত করতে পারেন যা তাদের অনুসন্ধানে কাজে আসতে পারে।

আরও বিস্তারিত তথ্যের জন্য জাতীয় অস্ত্র রপ্তানি রিপোর্টগুলো খুবই মূল্যবান। যুক্তরাজ্যে সরকার প্রতিবছর এবং ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে স্ট্র্যাটেজিক রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে গন্তব্য ও অস্ত্রের ধরণ অনুসারে লাইসেন্স অনুমোদনের তথ্য দেওয়া থাকে। এসব প্রতিবেদন যুক্তরাজ্যের সরকারি ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়।

অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্য দেশগুলো থেকে অস্ত্র রপ্তানির তথ্য সংগ্রহ করে প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন অ্যাগ্রিগেটস আর্মস এক্সপোর্ট ডেটা, যা ইউরোপের অস্ত্র রপ্তানির পরিমাণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে, স্টেট ডিপার্টমেন্টের সেকশন ৬৫৫ প্রতিবেদন সরাসরি বাণিজ্যিক বিক্রির অনুমোদনের অফিসিয়াল তথ্য প্রদান করে। আর ডিফেন্স সিকিউরিটি কোঅপারেশন এজেন্সি (ডিএসসিএ) গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক সামরিক বিক্রির তথ্য দেয়।

অস্ত্র রপ্তানির সাল এবং অস্ত্র ব্যবহারের সাল মিলিয়ে দেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো দেশ ২০২৩ সালে গাইডেড মিসাইলের একটি চালান পায় এবং ২০২৪ সালে সেই একই ধরনের মিসাইল দিয়ে কোনো হামলা ঘটে, তাহলে অস্ত্র সরবরাহ ও ব্যবহারের মধ্যে শক্তিশালী যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। মনে রাখবেন, অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহু বছর অস্ত্রাগারে থাকে। তাই সরাসরি ক্রয় ও ব্যবহারের সংযোগ স্থাপন করাটা বেশ কঠিন হতে পারে। সক্রিয় সংঘাতময় অঞ্চলে দেশগুলো ব্যবহার করতে পারে পুরনো অস্ত্রও। বিশেষ করে বড় ধরনের আক্রমণের সময়— যা হয়তো অনেক আগেই রপ্তানি করা।

অস্ত্র সরবরাহ শৃঙ্খলের জটিলতা বোঝার জন্য পাওয়া তথ্য ও রিপোর্টের গভীর বিশ্লেষণ দরকার। এসআইপিআরআই ডেটাবেস এবং জাতীয় রপ্তানি প্রতিবেদনগুলো ব্যবহার করে সাংবাদিকরা খুঁজে পেতে পারেন— অস্ত্র কীভাবে সংঘাতময় এলাকায় পৌঁছায়। যা আন্তর্জাতিক আইনের সম্ভাব্য লঙ্ঘন সম্পর্কে আলোকপাত করে এবং অস্ত্র বাণিজ্যের জবাবদিহিতার বিষয়টি জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেয়।

Kielce, Poland, September 5, 2024, wheeled and tracked military vehicles presented at the stand during the International Defense Industry Exhibition in Kielce (MSPO 2024)

সাঁজোয়া যান (সৈন্য পরিবহনকারী গাড়ি) পোল্যান্ডের কিয়েলচে শহরে অনুষ্ঠিত ২০২৪ সালের আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা শিল্প প্রদর্শনীতে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। ছবি: শাটারস্টক

আইনি লঙ্ঘত হয়েছে কিনা—তা মূল্যায়ন

এই পর্যায়ে সাংবাদিকদের আবারও আইনি কাঠামোর দিকে ফিরে তাকানো উচিত। এটিটি বলছে, কোনো রাষ্ট্র যদি জানে যে অস্ত্র রপ্তানি যুদ্ধাপরাধ সংঘটনে ব্যবহৃত হবে, তাহলে সেই রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া যাবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো—“জানা” বলতে কী বোঝায়? আদালত ও আইনি বিশেষজ্ঞরা এটাকে দুইভাবে ব্যাখ্যা করেন — এক হলো ‘বাস্তব জ্ঞান’— এবং অন্য হলো ‘সম্ভাব্য জ্ঞান’। প্রথমটি সরকার সরাসরি জানে যে অস্ত্র কোথায় বা কীভাবে ব্যবহার হবে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সরকারের কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি জানার কথা ছিল, সেটি না জানলেও ধরে নেওয়া যায় যে তারা জানতো বা জানা উচিত ছিল।

এটিটি’র ৭(২) ধারা বলছে, যদি কোনো অস্ত্র রপ্তানির ঝুঁকি মূল্যায়নে দেখা যায় যে যুদ্ধাপরাধের আশঙ্কা আছে, তবুও রপ্তানিকারক দেশ চাইলে রপ্তানি করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে ঝুঁকি কমার ব্যবস্থা নিতে হবে এবং তা গ্রহণযোগ্যও হতে হবে। যেমন: অস্ত্র ব্যবহারকারী দেশের পক্ষ থেকে দেওয়া বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি বা আশ্বাস।

অস্ত্র কিনেছে এমন দেশের পক্ষ থেকে যদি এলোপাতাড়ি বিমান হামলার মতো ধারাবাহিক নিপীড়নের তথ্য জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ বা কোনো এনজিও যদি আগে থেকে প্রকাশ করে থাকে, তাহলে রপ্তানিকারক দেশের পক্ষে “আমরা জানতাম না” বলাটা আর বিশ্বাসযোগ্য থাকে না (যদিও অনেক সময় তারা তা বলেই থাকে)।

ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য তিনটি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: প্রথমত, অস্ত্র ক্রয়কারী দেশের অতীত আচরণ কেমন ছিল, দ্বিতীয়ত, তাদের সেনাবাহিনী বা সরকারি কৌশলগত নীতিতে বলপ্রয়োগের ব্যাপারে কী বলা আছে এবং তৃতীয়ত, রপ্তানিকারক দেশকে তারা অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

যদি দেখা যায়— মানবাধিকার লঙ্ঘনের আগের ঘটনাকে উপেক্ষা করা হয়েছে, কিংবা সতর্কবার্তাগুলোর কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে রপ্তানিকারক দেশ ঝুঁকির বিষয়ে জানতো বা জানার কথা ছিল। এই পরিস্থিতি বাস্তব এবং সম্ভাব্য জ্ঞান— দুই ধরনের আইনি মানদণ্ডের মধ্যে পড়ে যেতে পারে।

সরকারের সচেতনতা জবাবদিহিতা

অস্ত্র বিক্রির সময় রপ্তানিকারক দেশের সরকারের কাছে কী তথ্য ছিল তা নির্ধারণ করতে হয় সরকারী নথি, আলোচনার রেকর্ড ও আইনি দলিলগুলো খতিয়ে দেখার মাধ্যমে। যেমন, যুক্তরাজ্যে পার্লামেন্টের আলোচনা ও অনুসন্ধান থেকে তথ্য পাওয়া গেছে যে, অস্ত্র আমদানিকারক দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ক তথ্য যুক্তরাজ্যের সরকারের কাছে ছিল। এছাড়া, ফ্রিডম অব ইনফরমেশন (ফোয়া) অনুরোধের মাধ্যমে অস্ত্র রপ্তানি সংক্রান্ত অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ এবং ঝুঁকি মূল্যায়নের তথ্যও জানা যায়।

সরকারের জবাবদিহিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ২০১৯ সালে একটি মামলা হয়। যুক্তরাজ্যের কোর্ট অব আপিলের পক্ষ থেকে বলা হয় সৌদি আরবকে অস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স দেওয়াটা ছিল অবৈধ। আরো বলা হয়, সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেনে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের লঙ্ঘন করেছে কিনা তা যথাযথভাবে যাচাই  না করেই যুক্তরাজ্য সরকার অস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স দিয়েছে, যা অবৈধ। এই রায়ে স্পষ্ট করে আরো উল্লেখ করা হয় যে, অস্ত্র রপ্তানি অনুমোদনের আগে কঠোর ঝুঁকি মূল্যায়ন করাটা সরকারের আইনগত বাধ্যবাধকতা।

কোর্ট অব আপিলের রায়ের পর যুক্তরাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে রায় মেনে চলার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে ছিল এমন নতুন অস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স অনুমোদন না দেওয়া যেগুলো সৌদি আরব ও তার জোটসঙ্গীরা ইয়েমেনের সংঘাতে ব্যবহার হতে পারে। একই সঙ্গে রায়ের প্রভাব বিবেচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলা হয়।

Saudi Air Force Typhoon jet

সৌদি এয়ারফোর্সের একটি ইউরোফাইটার টাইফুন যুদ্ধবিমান। ২০১৯ সালে ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগের কারণে যুক্তরাজ্যের একটি আদালত সৌদি আরবে যুদ্ধবিমানসহ সব ধরনের সামরিক রপ্তানি নিষিদ্ধ করে। এই টাইফুন যুদ্ধবিমান ইউরোপীয় একটি জোট তৈরি করে, যার সদস্য যুক্তরাজ্যও। (ছবিঃ শাটারস্টক)

অস্ত্র রপ্তানিতে করপোরেট দায়বদ্ধতা

সরকারের বাইরেও বেসরকারি প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলো অস্ত্র বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। এসব করপোরেশনও যুদ্ধাপরাধে সহায়তার অভিযোগে দায়ী হতে পারে—যদিও এর জন্য উচ্চমাত্রার আইনি প্রমাণ প্রয়োজন হয়। যেমন: কোম্পানিটি ইচ্ছাকৃতভাবে সহযোগিতা করেছে এবং তারা জানত যে, তাদের সহায়তা যুদ্ধাপরাধ ঘটাতে সহায়ক হবে—এমনটা প্রমাণ করতে হয়। তাছাড়া, করপোরেশনদের বিরুদ্ধে শুধু স্থানীয় আদালতেই মামলা করা সম্ভব, কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা চালাতে পারে না। কেননা এখানে দেশের পক্ষ থেকে অস্ত্র লেনদেন করা হচ্ছে না, বরং বাইরের একটি দেশ একটি কোম্পানির কাছ থেকে অস্ত্র কিনছে। এইসব করপোরেশন যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য আধুনিক অস্ত্র তৈরি, বাজারজাত এবং বিশ্বব্যাপী বিক্রি করে। এদের কর্মকাণ্ড সাধারণত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ধরনের নিয়ন্ত্রণের আওতায় পড়ে। করপোরেট সংশ্লিষ্টতা অনুসন্ধান করতে হলে কোম্পানির প্রকাশিত নথি, রপ্তানির তথ্য এবং লবিং কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে হয়।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোকে প্রায়ই তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে বার্ষিক প্রতিবেদন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে জমা দেওয়া নথির মাধ্যমে তথ্য প্রকাশ করতে হয়। এসব তথ্যের মধ্যে রপ্তানি চুক্তি এবং ঝুঁকি মূল্যায়নের মতো বিষয়ও থাকে। ওপেনকরপোরেটস, অরবিস, এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) ইডগার  সিস্টেমের মতো ডেটাবেস রিপোর্টারদের কোম্পানির কাঠামো, সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবং আর্থিক লেনদেন সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য দিতে পারে।

প্রতিরক্ষা কোম্পানির প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণের সময় সাংবাদিকদের করপোরেট কাঠামোর ওপর বিশেষভাবে নজর দেওয়া উচিত। ওপেনকরপোরেটস, অরবিস, অথবা এসইসির ইডগার সিস্টেমের মতো টুল ব্যবহার করে মূল কোম্পানি, সহযোগী প্রতিষ্ঠান, অফশোর কোম্পানি বা শেল কোম্পানি শনাক্ত করা সম্ভব—যেগুলো অনেক সময় বিতর্কিত কার্যক্রম আড়াল করতে কাজে লাগানো হয়।

বার্ষিক প্রতিবেদন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে জমা দেওয়া নথিতে সাধারণত কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত থাকে—যেমন: রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত নীতিমালা মেনে চলার ঘোষণা, আইনি ঝুঁকির বিবরণ, অথবা কোন অঞ্চলে কত আয় হয়েছে তার বিশ্লেষণ—যেগুলো সংবেদনশীল অঞ্চলে অস্ত্র বিক্রির ইঙ্গিত দিতে পারে।

বিশেষ করে চূড়ান্ত ব্যবহারকারী, অফসেট চুক্তি বা দ্বৈত-ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তি সংক্রান্ত তথ্যের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব অনেক সময় নিজেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়। পর্যবেক্ষক সংস্থার অনুসন্ধান ও সরকারি লাইসেন্স সংক্রান্ত তথ্যের সঙ্গে এ ধরনের তথ্যঘাটতিগুলোকে মিলিয়ে দেখা উচিত। করপোরেট প্রকাশিত তথ্যকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রপ্তানি ডেটাবেসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা (যেমন: যুক্তরাজ্য সরকারের ডেটাবেস, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বার্ষিক অস্ত্র রপ্তানি প্রতিবেদন, কিংবা এসআইপিআরআই-এর তথ্য) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স সিকিউরিটি কো-অপারেশন এজেন্সির (ডিএসসিএ) প্রতিবেদনের সঙ্গে তুলনা করার মাধ্যমে নির্দিষ্ট চুক্তি, গন্তব্য দেশ ও ব্যবসায়িক অংশীদারদের চিহ্নিত করা সম্ভব।

চূড়ান্ত, স্বচ্ছতা—বা কখনো কখনো এর অভাব— একটি কোম্পানির অস্ত্রসম্পর্কিত কার্যক্রমের জবাবদিহিতা ও নৈতিক অবস্থান বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। বেশ কিছু কোম্পানি অস্ত্র রপ্তানি নীতিকে প্রভাবিত করতে লবিং করে—সাংবাদিকদের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ। অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো এরইমধ্যে এমন বহু ঘটনা নথিভুক্ত করেছে, যেখানে প্রতিরক্ষা খাতে যুক্ত কোম্পানিগুলো নিজেদের পক্ষে অনুকূল রপ্তানি নীতির জন্য লবিং করেছে, কিংবা তাদের পণ্যের সঙ্গে যুক্ত সম্ভাব্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করেছে। এই ধরনের কর্মকাণ্ডগুলো বোঝাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ — সাংবাদিকদের উচিত এজেন্ডার বাইরে হওয়া বৈঠক বা আলোচনার দিকে সতর্ক নজর রাখা। লবিং অনুসন্ধান নিয়ে আরও জানতে পড়ুন জিআইজেএনের লবিংগাইড।

প্রকাশের প্রস্তুতি: গল্প তৈরি

অনুসন্ধানের শেষ পর্যায়ে—যখন অস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ শনাক্ত করা হয়েছে, আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং সাপ্লাই চেইনের সূত্র ধরা পড়েছে—তখন সাংবাদিকদের কাজ কেবল তথ্য সংগ্রহ নয়, বরং একটি সুসংগঠিত ও প্রভাবশালী গল্প তৈরি। এই পর্যায়ে গল্প বলার কৌশল হয়ে ওঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রমাণ যতই গুরুতর হোক না কেন, সেগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যাতে তা সাধারণ পাঠক, আইনবিদ কিংবা নীতিনির্ধারক—সব ধরনের দর্শক-শ্রোতার কাছে বোধগম্য, মানবিক এবং বিশ্বাসযোগ্য হয়।

অনেক অনুসন্ধানী সাংবাদিক যেটাকে ‘গ্রাউন্ড ট্রুথ’ বলা হয়, সেটিই দিয়ে শুরু করেন। তারা গল্পের ভিত্তি রাখেন একটি নির্দিষ্ট, মানবিক ঘটনার ওপর: যেমন একটি স্কুলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, ধ্বংসপ্রাপ্ত হাসপাতাল, বা বিস্ফোরণে ভাঙা একটি আবাসিক এলাকা। বেঁচে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য, মৃতদের নাম এবং দৃশ্যমান শারীরিক প্রমাণ ঘটনাস্থলকে স্পষ্টতা ও নৈতিক গুরুত্বসহকারে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে। সেখানে কি চিকিৎসক কর্মীকে আক্রমণ করা হয়েছিল? আহত সৈন্যদের কি হত্যা করা হয়েছিল?

অনেক অনুসন্ধানী সাংবাদিক তাঁদের কাজ শুরু করেন “গ্রাউন্ড ট্রুথ” দিয়ে — অর্থাৎ বাস্তব, চোখে দেখা ও প্রমাণযোগ্য ঘটনা থেকে। একটি নির্দিষ্ট মানবিক ঘটনায় ওপর ভিত্তি করে তাঁরা গল্পটি গড়ে তোলেন: যেমন কোনো স্কুলে মিসাইল হামলা, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া একটি হাসপাতাল, বা বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত একটি আবাসিক এলাকাকে ঘিরে। বেঁচে যাওয়া মানুষের সাক্ষ্য, নিহতদের নাম এবং বাস্তব প্রমাণ—ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া এইসব উপাদান একটি নৈতিক গুরুত্ব সৃষ্টি করে। প্রশ্ন করা হয় চিকিৎসাকর্মীদের লক্ষ্য করে কি হামলা চালানো হয়েছিল? আহত সৈন্যদের কি হত্যা করা হয়েছিল?

ঘটনার বর্ণনা সংযত ও নির্ভুল হতে হবে। যাতে পাঠক আবেগে ভেসে না গিয়ে  বিষয়বস্তুর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেন। দৃশ্যের বর্ণনা শুধু ভূমিকা নয়, বরং গোটা অনুসন্ধানের নৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলে।

এ পর্যায়ে সাংবাদিকেরা প্রায়ই পাঠকদের ঘটনাস্থলের  স্পর্শকাতর বাস্তবতায় নিয়ে যান। পাঠকেরা যেন চোখে দেখা, কানে শোনা কিংবা শরীরে অনুভব করতে পারেন। তাঁরা শব্দের বর্ণনা দিতে পারেন—ওপর দিয়ে চলে যাওয়া তীক্ষ্ণ বাঁশির মতো আওয়াজ, কিংবা তীব্র গর্জনে ফেটে পড়া গোলার শব্দ। তারা বিস্ফোরণের আগে-পরে বাতাসে ছড়িয়ে বোমার টুকরো বা পরে দীর্ঘসময় ভেসে থাকা গন্ধের বর্ণনা দিতে পারেন। যেমন—বারুদের গন্ধ, পোড়া প্লাস্টিক, ঝলসে যাওয়া মাটির গন্ধ। সংঘাতের সময়টাও তাঁরা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন—তখন কী ভোর ছিল, গোধূলি, নাকি মধ্যদুপুর? এবং হামলার ঠিক আগমুহূর্তে মানুষজন কী করছিলেন? কেউ কি রান্না করছিলেন? শিশুদের কেউ কি স্কুল থেকে ফিরছিল? এলাকাবাসী কি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন?

এই ব্যক্তিগত বিবরণগুলো অলঙ্করণ নয়—বরং পরিসংখ্যানের আড়ালে থাকা মানুষগুলোর বাস্তবতা তুলে ধরার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এমন ছোট ছোট বিবরণ পাঠকের মধ্যে সহানুভূতি এবং ঘটনার বিভিন্ন আবহ তৈরি করে। এভাবে ভুক্তভোগী মানুষগুলোকে শুধু সংখ্যা হিসেবে নয় বরং জীবিত মানুষ হিসেবে দেখানো যায়।  যাদের ছিল জীবন, স্বপ্ন, এবং রোজকার জীবন। এই মানুষগুলো আসলে কেমন ছিলেন, কারা ছিলেন, তাদের কোন স্বপ্নগুলো শেষ হয়ে গিয়েছিল, কোন ভবিষ্যতগুলো ভেঙে গিয়েছিল—সাংবাদিকরা তা অনুসন্ধান করতে পারেন। একজন শিক্ষার্থী—যিনি প্রকৌশলী হতে চেয়েছিলেন। একজন দাদি—যিনি পরিবারের বন্ধন জোরদার করতেন; এক তরুণী—যিনি সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলোশিপ পেয়েছিলেন। এই সব হারানো আকাঙ্ক্ষার মুহূর্তগুলো প্রতিবেদনটির আবেগপূর্ণ ভিত্তি গড়ে তোলে।

মাঠ পর্যায়ের এই বিস্তারিত তথ্যগুলো শুধুমাত্র অলঙ্কারের জন্য নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিও তৈরি করে। যা কেবল তথ্য ও আইনি দলিল দিয়ে সম্ভব হয় না। এর মাধ্যমে গল্পটিকে মানবিক করে তোলা যায় এবং মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধা ধরে রাখা সম্ভব হয়। সাংবাদিকরা এর মাধ্যমে নিশ্চিত করে যে, তাঁর অনুসন্ধানটি শুধু অস্ত্রের গতিপথই তুলে ধরেনি বরং সেই অস্ত্রের আঘাত থেকে সৃষ্ট শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকটিও তুলে ধরেছে।

সহিংসতার ঘটনাস্থল থেকে গল্পটি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে—ভৌগলিক এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। সাংবাদিকেরা উৎস পর্যন্ত অস্ত্রের গতিপথ অনুসরণ করেন: গোলাবারুদে থাকা নাম-চিহ্ন থেকে শুরু করে কারখানার উৎপাদন লাইন, রপ্তানিকারক দেশ থেকে শুরু করে সেই রাজনৈতিক বা করপোরেট পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যন্ত—অস্ত্র ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ঠ সমস্ত পক্ষগুলোকে হাজির করেন। তারা খুঁজে দেখেন, সেই বোমা কোথায় তৈরি হয়েছে, কোন কোম্পানি বা দেশ সেটি রপ্তানি করেছে, কারা অনুমতি দিয়েছে—সবকিছু। খতিয়ে দেখেন, কীভাবে একটি নির্দিষ্ট বোমা একটি নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট একটি শহরের নির্দিষ্ট একটি ভবনে গিয়ে আঘাত হেনেছে।

নথিপত্র সংগ্রহের কাজটি গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকেরা বিভিন্ন সূত্র মিলিয়ে দেখেন—যেমন: অস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স রেকর্ড, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ডেটাবেস, সংসদীয় তথ্য, কোম্পানির দাখিল করা নথি, এবং তথ্য অধিকার আইনের (ফোয়া) আওতায় পাওয়া দলিল। যদি দেখা যায়, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সম্পর্কে সতর্ক করার পরও অস্ত্র বিক্রি হয়েছে—তাহলে তা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশগুলো যদি দাবি করে, তারা ঝুঁকি মূল্যায়ন করেছে—সেই দাবিগুলোরও যাচাই করা হয়।

প্রতিবেদনে আইনের বিষয়গুলো খুব যত্ন করে যুক্ত করা হয়। সাংবাদিকেরা তুলে ধরেন যে, অস্ত্র বাণিজ্য চুক্তি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়ম বা দেশের নিজস্ব রপ্তানি আইন অনুযায়ী কার কী দায়িত্ব ছিল। তাঁরা তুলে ধরেন—কোথায় দায়িত্ব পালন করা হয়নি, কোথায় মন্ত্রীদের আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল, কোথায় এনজিওগুলো উদ্বেগ জানিয়েছিল—তবুও কীভাবে অস্ত্র বিক্রির চুক্তি চালিয়ে যাওয়া হয়েছে। আইনি বিষয়গুলোকে বিমূর্ত আমলাতান্ত্রিক হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, বরং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দলিল হিসেবে তুলে ধরা হয়—যেখানে ক্ষতির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরও তা পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে।

শুধু অনুমানের ওপর নির্ভর করে দায় চাপিয়ে দেওয়া হয় না —খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়। যেসব পক্ষ এই ঘটনায় যুক্ত, যেমন: অস্ত্র তৈরিকারক কোম্পানি, সরকারি অফিস কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা— সাংবাদিকরা তাদের সাথে যোগাযোগ করেন । সাংবাদিকতার নিয়ম অনুযায়ী, অভিযুক্তদের নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যার সুযোগ দেওয়া হয়। তাঁরা যদি উত্তর দেয়, কিংবা উত্তর না দেয়, অথবা এড়িয়ে যায় — প্রতিটি প্রতিক্রিয়াই অনেক সময় মূল নথির মতোই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। তাই কেউ চুপ থাকলে, গোলমেলে কথা বললে, বা সরাসরি অস্বীকার করলেও, তা যেমন ভাবে ঘটেছে, সেভাবেই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদনজুড়ে ভাষার ওপর খুব সতর্কভাবে নজর দেওয়া হয়। জটিল বা টেকনিক্যাল শব্দ যতটা সম্ভব কম ব্যবহার করা হয়, আর দরকার হলে সহজভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। লেখার ভঙ্গি থাকে পরিমিত ও ভারসাম্যপূর্ণ। এই ধরনের প্রতিবেদন শক্তিশালী হয়  যুক্তি বা মতাদর্শ থেকে নয়, বরং স্পষ্ট প্রমাণ থেকে। যদি কোনো অনুসন্ধান শুধু সচেতনতা তৈরির গণ্ডি পেরিয়ে নীতিমালা বা আইনের পরিবর্তন আনতে চায়, তাহলে সেটিকে সম্পাদক, আইনজীবী এবং সমালোচকদের কঠিন প্রশ্নেরও জবাব দেওয়ার মতো শক্ত হতে হয়।

কীভাবে গল্প উপস্থাপন করবেন—তাও গুরুত্বপূর্ণ। অনুসন্ধানটি দীর্ঘ প্রতিবেদন, মাল্টিমিডিয়া ফিচার, বা সিরিজ প্রতিবেদন—যেভাবেই তুলে ধরেন না কেন এমনভাবে মাধ্যম নির্বাচন করতে হবে যেন তা বেশি সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌছায় এবং সহজে বোঝা যায়। জটিল বিষয় বোঝাতে ভিজুয়াল সরঞ্জাম যেমন: অস্ত্রের ডিজাইন, স্যাটেলাইট ছবি, সাপ্লাই চেইনের সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। ডেটা বিশ্লেষক, ডিজাইনার বা ইন্টারঅ্যাকটিভ মিডিয়া বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সহযোগিতায় মাধ্যমে অনুসন্ধানকে আরো সহজ ও শক্তিশালীভাবে তুলে ধরা যেতে পারে।

এমন একটি অনুসন্ধান সংবাদ প্রকাশের চেয়েও বেশি কিছু। একটি ঘটনাকে এমনভাবে তুলে ধরা যা ভবিষ্যতে আইনগত ব্যবস্থা নিতে, সরকারের নজরদারি বাড়াতে বা মানুষকে সঠিক তথ্য জানাতে সাহায্য করে। দৃঢ়তার সঙ্গে করা হলে এই ধরনের সাংবাদিকতা জবাবদিহিতার হাতিয়ার হয়ে ওঠে—যা অন্যায় উদঘাটন করে, স্মৃতি সংরক্ষণ করে, আর কোনোভাবেই অপরাধীদের ছাড় দেয় না।

দারুণ একটি উদাহরণ হিসেবে লিবিয়ার ‘গেম অফ ড্রোনস’ (২০২০)-এর কথা বলা যেতে পারে। বিসিবি আফ্রিকা আই এবং বিসিবি আরবিক ডকুমেন্টারিজের একটি অনুসন্ধান। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ত্রিপোলির একটি সামরিক একাডেমিতে ড্রোন হামলায় ২৬ জন নিরস্ত্র ক্যাডেট নিহত হওয়ার ঘটনার ওপর তৈরি। প্রতিবেদনে স্যাটেলাইট ছবি, ডিজিটাল ফরেনসিক এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার ভিত্তিতে ড্রোনের উৎস শনাক্ত করা হয়। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের দলটি খুঁজে পায়, হামলায় ব্যবহৃত ড্রোনটি ছিল চীনে তৈরি উইং লুং II নামের একটি ড্রোন, যা পরিচালনা করছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। এটি ছিল লিবিয়ার উপর জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার স্পষ্ট লঙ্ঘন। বর্ণনা আর ভিজ্যুয়াল প্রমাণের মাধ্যমে মানুষের ওপর অস্ত্র রপ্তানির নৃশংস প্রভাব এবং বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপের ফলাফল তুলে ধরা হয়। দেখানো হয় যে, অল্প নজরদারির বিষয়টি কাজে লাগিয়ে কীভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে এবং তার ফলাফল কতটা ভয়াবহ। এই প্রতিবেদনটি গভীর এবং দৃশ্যমান সাংবাদিকতার অন্যতম উদাহরণ, যা রাষ্ট্রীয় পক্ষগুলোর আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি তুলে ধরে।

BBC Game of Drones investigation Wing Loong 2

বিসিবি’র একটি অনুসন্ধানে স্যাটেলাইট ছবি এবং সরকারি নথি ব্যবহার করে দেখানো হয়েছে যে, চীনের তৈরি ও সংযুক্ত আরব আমিরাত পরিচালিত ড্রোনগুলো লিবিয়ার বিমানঘাঁটিতে পাঠানো হয়েছে যা জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার লঙ্ঘন। ছবি: স্ক্রিনশট, বিসিবি

ক্ষমতাকে জবাবদিহির সাংবাদিকতা

বিশ্বব্যাপী অস্ত্র বাণিজ্য মূলত একটি ক্ষমতার খেলা। এটি গড়ে ওঠে রাজনৈতিক জোট, ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং কৌশলগত প্রয়োজনীয়তার উপর—প্রায়ই জাতীয় নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক প্রয়োজনের আড়ালে নিজেকে ন্যায্যতা দেয়। কিন্তু “রক্ষার সক্ষমতা” বা “রপ্তানি বৃদ্ধির” পেছনে লুকানো থাকে ভাঙা বাড়ি, অনাথ শিশু, ক্ষতিগ্রস্ত হাসপাতাল এবং ভয়ঙ্কর যুদ্ধাপরাধের মানবিক বাস্তবতা।

এইসব পরিস্থিতিতে দূরবর্তী বোর্ডরুম এবং মন্ত্রণালয়ে নেওয়া নীতিগত সিদ্ধান্তের ভোগান্তি ভোগে সাধারণ মানুষ, যারা এই বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারে না। সাংবাদিকতার কাজ হলো সেই দূরত্ব কমিয়ে আনা এবং সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর তুলে ধরা।

ক্ষমতাকে জবাবদিহি করার সাংবাদিকতা, যে ভূমিকা রাখে

বিশ্বব্যাপী অস্ত্র বাণিজ্য মূলত একটি ক্ষমতার খেলা। এটি গড়ে ওঠে রাজনৈতিক জোট, ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং কৌশলগত প্রয়োজনীয়তার উপর। জাতীয় নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক প্রয়োজনের দোহাই দিয়ে ন্যায্যতা দেওয়া হয়। “প্রতিরক্ষা সক্ষমতা” বা “রপ্তানি বৃদ্ধির” বিমূর্ত ভাষার পেছনে লুকিয়ে থাকে বাস্তব মানুষের দুর্দশা। বোমা বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত বাড়ি, অনাথ শিশু, ক্ষতিগ্রস্ত হাসপাতাল আর ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধের ঘটনা।

দূরবর্তী  কোনো মিটিংরুম বা মন্ত্রণালয়ের কক্ষে বসে নেওয়া নীতিমালা ও সিদ্ধান্তের পরিণতি ভোগ করতে হয় সেই সব সাধারণ নাগরিকদের, যারা কখনোই এ বিষয়গুলো নিয়ে কিছু বলার সুযোগ পায়নি। সাংবাদিকতার কাজ হলো সেই  শূণ্যতা ও দুরত্বটা পূরণ করা।

অস্ত্রগুলো কারখানা থেকে যুদ্ধক্ষেত্র পর্যন্ত কীভাবে পৌঁছায়, কোন পথ দিয়ে যায় এবং যাঁরা এই অস্ত্র ব্যবহারে ভূমিকা রেখেছে তাদের দায়ী করে সাংবাদিকরা শুধু অন্যায় উন্মোচনই করেন না—তারা হারিয়ে যাওয়া বা ভেঙে পড়া জীবনের গল্পগুলোকেও দৃশ্যমান করে তোলেন। সংঘাতের যে সব ঘটনা প্রপাগান্ডা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় বা রাজনৈতিকভাবে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে, সেখানে সাংবাদিকদের কাজগুলো এক ধরনের গণদলিল হয়ে ওঠে। তারা এমন সব সত্য নথিভুক্ত করেন, যা অনেকেই ভুলিয়ে দিতে বা ভুলে যেতে চায়।

কেস স্টাডিজ

কে ইস্রায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করছে? — অ্যাকশন অন আর্মড ভাইলেনস (এওএভি)

পদ্ধতি: বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনটি তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন আইয়ান ওভারটন (এই অধ্যায়ের লেখক)। এতে গাজার চলমান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে ইসরায়েলকে দেওয়া সামরিক সহায়তার বিষয়টি বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ২০২৩ সালের অক্টোবরের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-অনুমোদিত ২৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অস্ত্র রপ্তানি এবং জার্মানির অস্ত্র রপ্তানির পরিমাণ ১০ গুণ বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। যা যুদ্ধাপরাধের ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক অভিযোগ সত্ত্বেও সামরিক সরঞ্জামের ধারাবাহিক সরবরাহের কথা তুলে ধরে। এওএভি তাদের গবেষণায় বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করেছে।  যেমন ওপেন সোর্স তথ্য, প্রতিরক্ষা রপ্তানি লাইসেন্স সংক্রান্ত তথ্য, এবং আইনি চ্যালেঞ্জ সংক্রান্ত মামলার নথিপত্র। তারা সিএএটি এবং এসআইপিআরআইয়ের মতো পর্যবেক্ষণকারী সংস্থার তথ্য পর্যালোচনা করেছে। ইয়াহু ফাইন্যান্সের মতো টুল ব্যবহার করে অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত শেয়ার বিক্রির আর্থিক বিশ্লেষণ চালিয়েছে। এরপর তারা এই তথ্যগুলো প্রতিষ্ঠানগুলোর সরকারি বিবৃতি ও গণমাধ্যমের রিপোর্ট দিয়ে যাচাই করেছে। এই তথ্যনির্ভর ও জনজবাবদিহিতামূলক অনুসন্ধান শুধু অস্ত্র সরবরাহের চিত্রই উন্মোচন করেনি, বরং দেখিয়েছে কীভাবে যুদ্ধের সময়গুলোতে অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানি ও তাদের কর্মকর্তারা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। প্রতিবেদনে যেসব কোম্পানির নাম এসেছে, তাদের সবার সঙ্গে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হয়েছিল—কেউই সাড়া দেয়নি।

ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন বিমান হামলাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এই হামলাগুলোর অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল ছিল — দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট

পদ্ধতি: পোস্টের এই অনুসন্ধানী বিশ্লেষণ (এবং কলম্বিয়া ল স্কুলের হিউম্যান রাইটস ইনস্টিটিউটের সিকিউরিটি ফোর্স মনিটরের সহযোগিতায়) প্রকাশ করেছে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের বিমান অভিযানকে সহযোগিতা করেছে — এতে হাজার হাজার নাগরিক নিহত হন।

পোস্টের এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে (কলম্বিয়া ল স্কুলের হিউম্যান রাইটস ইনস্টিটিউটের সিকিউরিটি ফোর্স মনিটরের সহযোগিতায়) উঠে আসে, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন কীভাবে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের বিমান অভিযানকে সহযোগিতা করেছে —যে অভিযানে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। দ্য পোস্ট এবং এসএফএম প্রথমবারের মতো ১৯টি ফাইটার জেট স্কোয়াড্রনের পরিচয় শনাক্ত করেছে, যারা সৌদি নেতৃত্বাধীন ইয়েমেন যুদ্ধের বিমান অভিযানে অংশ নিয়েছিল। এই অনুসন্ধানে তারা ৩,০০০-র বেশি উন্মুক্ত ছবি, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, মিডিয়া রিপোর্ট এবং ভিডিও বিশ্লেষণ করে এই তথ্য বের করে। এরপর সাংবাদিক ও গবেষকেরা রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত চুক্তিগুলো বিশ্লেষণ করেন। এতে প্রকাশ পায়, যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা শুধু প্রতিরক্ষামূলক সহায়তায় সীমিত—সরকারি ভাষ্যে এমন দাবি করা হলেও, বাস্তবে সেই সহায়তা অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। এভাবে বিভিন্ন স্তরে স্তরে ফরেনসিক যাচাই ও নীতিগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের সম্ভাবনা রয়েছে—এমনটি জানার পরও যুক্তরাষ্ট্র সরকার দীর্ঘদিন ধরে এর সঙ্গে জড়িত ছিল।

Washington Post investigation US support for Saudi:Gulf airstrikes in Yemen

দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট দেখিয়েছে যে, সৌদি আরব এবং অন্যান্য উপসাগরীয় মিত্র দেশগুলোর স্কোয়াড্রনগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দিয়েছে, সেটার মাধ্যমে তারা ইয়েমেনে বিমান হামলা ও বোমাবর্ষণ অভিযান চালিয়েছে। ছবি: স্ক্রিনশট, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট

বিপজ্জনক বাণিজ্য: মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে অস্ত্র তৈরিতে সহায়তাস্পেশাল অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল ফর মিয়ানমার (এসএসি-এম)

বিপজ্জনক বাণিজ্য রিপোর্টটি দেখায় কীভাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশটির ভিতরে বিশাল একটি অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তুলেছে এবং তা চালিয়ে চলছে। রিপোর্টে প্রশ্ন করা হয়েছে, এই ব্যবস্থা কি মানবাধিকার লঙ্ঘনে সহায়তা করেছে কি না। রিপোর্টটিতে ওপেন-সোর্স অনুসন্ধান, মিয়ানমার সামরিক বাজেটের ফাঁস হওয়া নথির বিশ্লেষণ, স্যাটেলাইট ছবি, আমদানি/রপ্তানি রেকর্ড এবং প্রায় ৩০ জনের সাক্ষাৎকার ব্যবহার করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছেন সাবেক সৈনিক ও অস্ত্র বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা। এসএসি-এম অনুসন্ধানে নানা ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। যেমন অস্ত্রের যন্ত্রাংশ কোথা থেকে আসছে তা খুঁজে বের করা বা ফাঁস হওয়া সামরিক বাজেটের কাগজপত্রগুলো পরীক্ষা। পাশাপাশি, দলটি ওএসআইএনটি কৌশল (ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স) ব্যবহার করে বার্মিজ ও ইংরেজি উভয় ভাষার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম খুঁটিয়ে দেখেছে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, তাইওয়ান, ভারত, চীন এবং সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশের কোম্পানিগুলো সচেতনভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার অস্ত্র উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ, যন্ত্রপাতি এবং সফটওয়্যার সরবরাহ করে সহযোগিতা করেছে।

প্রধান তথ্য ও লিংকসমূহ

আন্তর্জাতিক মানবিক আইন (আইএইচএল) সংক্রান্ত আইনি পর্যালোচনা দিয়েছেন কুইনটেন দ্য গ্রোটে, যিনি জেনেভা অ্যাকাডেমি থেকে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে এলএল.এম. ডিগ্রিধারী।



ড. আইয়েন ওভারটন অ্যাকশন অন আরমড ভায়োলেন্স (এওএভি) এর নির্বাহী পরিচালক। তিনি বিশ্বব্যাপী সশস্ত্র সহিংসতা নিয়ে গবেষণা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছেন। তিনি বিবিসি ও আইটিএনের সাবেক সাংবাদিক, যিনি দুই ডজনের বেশি সংঘাতপূর্ণ এলাকায় রিপোর্টিং করেছেন। এওএভির তথ্য নিয়মিত জাতিসংঘ ও অন্যান্য বড় ফোরামে উপস্থাপন করেন।  তিনি ফোরাম অন দ্য আর্মস ট্রেডের একজন বিশেষজ্ঞ সদস্য এবং ওয়েসলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ গন্স অ্যান্ড সোসাইটি বোর্ডের সদস্য। এছাড়া, তিনি ল্যান্সেটের একটি বৈশ্বিক বন্দুক সহিংসতা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুসন্ধানে সহ-কমিশনার হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বাইলাইন টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, এলএ টাইমস, এবং দ্য হাফিংটন পোস্টে লিখেছেন। তাঁর কাজ পীবোডি অ্যাওয়ার্ড, দুটি অ্যামনেস্টি অ্যাওয়ার্ড, ওয়ানওয়ার্ল্ড মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড, প্রিক্স সিরকম এবং বিএএফটিএ স্কটল্যান্ডসহ বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছে। তিনি তিনবার রয়্যাল টেলিভিশন সোসাইটি অ্যাওয়ার্ড এবং একটি ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ডের জন্য শর্টলিস্ট হয়েছেন। যুদ্ধ সাংবাদিকতার জন্য তিনি পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল ও এমএ ডিগ্রিও নিয়েছেন। তাঁর বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘গান বেবি গান’ (ক্যাননগেট, ২০১৫) এবং ‘দ্য প্রাইস অফ প্যারাডাইস’ (কোয়্যার্কাস, ২০১৯), যা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে আমাদের লেখা বিনামূল্যে অনলাইন বা প্রিন্টে প্রকাশযোগ্য

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

অনুসন্ধান পদ্ধতি পরামর্শ ও টুল

পাসপোর্ট থেকে অফশোর দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করা এখন আরও সহজ

অফশোর কোম্পানি ও ট্রাস্টের মালিকানা অনুসন্ধানে কাজ করা অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য পাসপোর্ট অনেক সময়ই কাজ করে ধাঁধার টুকরো হিসেবে। গোপন সম্পদের মালিকানা অনুসন্ধানে এটি প্রায়ই হারানো সংযোগ বা ‘মিসিং লিংক’ হয়ে ওঠে।

অনুসন্ধান পদ্ধতি পরামর্শ ও টুল

বায়ু দূষণের পেছনে থাকে দুর্নীতি, অনুসন্ধানে তথ্য দেবে ওপেন সোর্স টুলস

দূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মের ফাঁক-ফোকরকে কাজে লাগায়। এখানে তাই অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরাই পরিবেশ বিষয়ক দুর্নীতির তথ্যগুলো উন্মোচন করেন। আর এ কাজে তাদের সহায়তা করতে পারে ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স (ওএসআইএনটি) টুলস।

অনুসন্ধান পদ্ধতি জলবায়ু

নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে তেল ও গ্যাস বিষয়ক রিপোর্টিং — পারমাণবিক বর্জ্য

সাংবাদিক জাস্টিন নোবেলের এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেখিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাধর শিল্পখাত তেল-গ্যাস, সরকারের ও একাধিক সহযোগী সংস্থার সমর্থনে কীভাবে পানি, বায়ু, ভূমি, মাটি ও কৃষিপণ্যসহ, নিজেদের কর্মী ও আশপাশের সাধারণ মানুষের ফুসফুস, রক্ত, আর হাড় পর্যন্ত দূষণ পৌঁছে দিচ্ছে।

অনুসন্ধান পদ্ধতি গবেষণা

প্লেনস্পটার এবং পরিবহন পর্যবেক্ষকদের বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আপনার অনুসন্ধানে যেভাবে সহায়তা করতে পারে

বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে শখ আছে মানুষের। কেউ পাখি দেখেন, কেউ বা সাপ। আবার কারও নেশা উড়োজাহাজ, জাহাজসহ নানা যানবাহনের দিকে। তাঁরা শুধু এগুলোর খোঁজখবর নিয়েই বসে থাকেন না। রীতিমতো আলোচনা করেন সামাজিক মাধ্যমে। আপনার অনুসন্ধানে এদের কাজে লাগাতে পারেন আপনি। পড়ুন এই প্রতিবেদনে।