

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা: নতুন সাংবাদিকদের জন্য সাক্ষাৎকার নেয়ার কৌশল
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
সাংবাদিকতা ভীষণভাবে সাক্ষাৎকার নির্ভর, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাও এর ব্যতিক্রম নয়। একটি শক্তিশালী অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির সময়ও স্বাভাবিকভাবেই কয়েকদফা সাক্ষাৎকার নেয়ার প্রয়োজন পড়ে। তথ্য ফাঁস বা ঘটনার সত্যতা যাচাই থেকে শুরু করে মূল সোর্সদের সঙ্গে কথা বলা—একটি প্রতিবেদন তৈরির জন্য একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিককে অসংখ্য তথ্য সংগ্রহ করতে হয়।
প্রথম কাজটিকে বেশ সাদামাটা ও একঘেয়ে মনে হতে পারে; তবে সাক্ষাৎকার নেয়া সত্যিকার অর্থে সহজ নয়। এর জন্য দক্ষতা, ধৈর্য নিয়ে সুকৌশলে এগোতে হয়। যাঁরা ভালো সাক্ষাৎকার নেন তাঁরা মনোযোগী, বুদ্ধিমান, আর গুরুত্বপূর্ণ সূত্র খুঁজে বের করতে সদা তৎপর। তাঁরা সাধারণত বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানেন, যথেষ্ট দক্ষতা রাখেন ও সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে আসেন।
এই অধ্যায়ে বিভিন্ন ধরনের সাক্ষাৎকার, পদ্ধতি ও কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যা আপনাকে বুঝতে সাহায্য করবে আপনি ঠিক পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছেন কিনা। এছাড়া অনুসন্ধান, প্রমাণ সংগ্রহ, এবং সবশেষে—গল্প হিসেবে কোনটি আসলে গুরুত্বপূর্ণ সে ধারণা দিবে।
সাক্ষাৎকার: নিয়মমাফিক নাকি জরুরী কাজ?
সাক্ষাৎকার হতে পারে নানা ধরনের। টিভি উপস্থাপকের জন্য যা হয়তো মামুলি খোশ গল্প করা। কিন্তু একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের জন্য সাক্ষাৎকার একেবারেই ভিন্ন। প্রতিটি সাক্ষাৎকারই তাঁর জন্য সত্য উন্মোচনের মুহূর্ত। চরম মূহুর্তে যে কেউ সহজে হাতের কাছে আসা সুযোগকে হাতছাড়া করে বসতে পারে। আবার, যদি সব ঠিকমতো চলে, তবে অপ্রত্যাশিতভাবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও বের করে আনতে পারে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য সাক্ষাৎকার নেয়া মানে সূত্র ধরে ক্রমশ এগিয়ে যাওয়া: একটি প্রশ্নের উত্তরে পাওয়া তথ্যের মাধ্যমে নতুন প্রশ্নের জন্ম হয়। মনে রাখবেন: অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় আমাদের শেখানো হয়েছে, কোনো বক্তব্য, প্রশ্নের উত্তর, বা তথ্য প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। এ কারণে অনুসন্ধানী সাংবাদিকের জন্য সাক্ষাৎকার নেয়ার প্রক্রিয়াই একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। কখনো কখনো যা আইনী ফরেনসিক সাক্ষাৎকারের মতো মনে হতে পারে। সাংবাদিক ও পুলিশ কর্মকর্তার কাজের ধরন, সক্ষমতা, এবং পদ্ধতিগুলো যদিও আলাদা, তবু একটি মিল রয়েছে। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তাঁরাও সত্য উদ্ঘাটন করতে বা ঘটনার প্রকৃত রহস্য উন্মোচন করতে চান।
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির সময় তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎকার নেয়াটা রিপোর্টারের জন্য অপরিহার্য: হতে পারে অনুমানগুলো ঠিক কিনা তা দেখা বা খণ্ডন করার জন্য, প্রাথমিক সোর্সের বক্তব্য বা অভিযোগগুলো যাচাই করার জন্য, কিংবা সূত্রের মুখোমুখি হওয়ার জন্য।
তাই, যে কারো সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং ভিন্ন পরিস্থিতি ও লোকেদের ব্যক্তিত্বের সাথে মানিয়ে নিয়ে তাদের মুখোমুখি হওয়ার দক্ষতা থাকাটা খুব জরুরি। বেশিরভাগ সময় কথা বলতে অনীহার কারণে সোর্সদের মুখ খোলানো যায় না; তাই প্রথমে তাদের অনীহা কাটাতে হয়। এখানেই সাক্ষাৎকার নেয়ার শিল্প নিহিত। সোর্সকে কথা বলানোর কায়দাগুলো আয়ত্ত করাটা অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য অপরিহার্য।
কিছু সাক্ষাৎকার আগেই ঠিক করা থাকে, যেখানে ই-মেইল বা ফোন কলের মাধ্যমে সময় নিয়ে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পাঠানো হয়। কিছু দেশে, যেমন আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে, সরকারি কর্মচারী বা সরকারি কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎকারের জন্য আনুষ্ঠানিক চিঠির মাধ্যমে অনুরোধ জানানোর প্রয়োজন হতে পারে।
আকস্মিকভাবেও কারো সাক্ষাৎকার নেয়া যেতে পারে। যেমন, এমন কারো সঙ্গে আপনার হঠাৎ দেখা হয়েছে, যাকে সাচরাচর পাওয়াটা খুব কঠিন। আবার কখনও সঙ্গত কারণেই সাংবাদিকরা আকস্মিক কারো সাক্ষাৎকার নেয়ার কৌশল বেছে নিতে পারেন। এভাবে তাঁরা যে সবসময় সফল হন তা নয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে এ চেষ্টাটাই যথেষ্ট।
ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার্স অ্যান্ড এডিটরস (আইআরই) সম্পাদিত গাইডে সাক্ষাৎকারের তিনটি প্রধান ধরন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। লেখাটি ২০১৬ সালে নিউ অরলিয়েন্সে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সিবিসি’র দ্য ফিফথ এস্টেট -এর প্রযোজক জুলিয়ান শের দেয়া পরামর্শের ওপর ভিত্তি করে তৈরি।
১. তথ্য সংগ্রহের জন্য
২. ঘটনার আবেগীয় দিক বোঝার জন্য
৩. মানুষের কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের জন্য
কী ধরনের প্রশ্ন করা হবে—এর পেছনে একাধিক কারণ থাকে। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই তিনটি কারণ একসাথে যুক্ত করা যেতে পারে।
প্রস্তুতি
একটি ভালো সাক্ষাৎকারের প্রথম ও প্রধান বিষয় প্রস্তুতি। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বেলায়ও তা ব্যতিক্রম নয়। তাদের বরং আরো বেশি বেশি প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। কেননা অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা যে সব বিষয় নিয়ে কাজ করেন, সেগুলো অনেক বেশি সংবেদনশীল, বিতর্কিত, জটিল এবং সত্য প্রকাশের সাথে সম্পর্কিত। আর বেশিরভাগ সময়ই সে তথ্যগুলো আড়াল করা হয়, কিংবা অন্তত স্বেচ্ছায় তা প্রকাশ করা হয় না। প্রস্তুতি নেয়া মানে প্রশ্ন করতে বসার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অতীত ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা, যেন আরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করা যায়।
গবেষণা
ভালো অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা একাধারে ভালো গবেষকও । সাক্ষাৎকার নেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ঘটনা সম্পর্কে যতটা সম্ভব তথ্য জানাটা (অথবা যতটা সম্ভব তথ্য খুঁজতে থাকুন) আপনার প্রশ্ন তৈরির জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণার মধ্যে যেমন রয়েছে আপনি যাঁর সাক্ষাৎকার নিতে যাচ্ছেন, তাঁর আগের বক্তব্য বা অবস্থান সম্পর্কে খোঁজ নেয়া। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে— তা জানাও প্রয়োজন। সেই সাথে, অনুসন্ধানের মূল বিষয় সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকা। ওই ব্যক্তির সামাজিক জীবন সম্পর্কে ধারণা রাখা। তাঁর শখ নিয়ে তথ্য জানাও সাক্ষাৎকারের সময় আপনার বেশ কাজে আসতে পারে। ফুটবল, সঙ্গীত, বই, বা বিদেশে বেড়ানো নিয়ে টুকটাক আলাপ চালানোর মাধ্যমে ”বরফ গলাতে” পারেন।
এই তথ্যগুলো না জেনে কারো সাক্ষাৎকার নিতে গেলে সাংবাদিক হিসেবে আপনার দুর্বলতাগুলোই ফুটে উঠবে। পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ চলে যেতে পারে বিপরীত পাশে বসা লোকটার হাতে। অর্থাৎ আপনি যে ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিতে এসেছেন তাঁর হাতে। এটি বরং উল্টো হওয়া উচিত। মনে রাখবেন সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীকেই সব সময় পুরো প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে। তাই মুখোমুখি সাক্ষাৎকার নিতে যাওয়ার আগে ওই ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের বিষয়টি মুখ্য হয়ে ওঠে। বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিক যখন সত্য বের করার চেষ্টা করেন বা সাক্ষাৎকারদাতাকে এমন কিছু স্বীকার করতে বাধ্য করেন যা তিনি আগে কখনও কোথাও বলেননি। বা এমন কোনো তথ্য যা তিনি জনসাধারণের সামনে অস্বীকার বা লুকানোর চেষ্টা করেছেন।
রেকর্ড করতে ও নোট নিতে তৈরি থাকুন
বিশেষ কিছু পরিস্থিতি ছাড়া কারো সাক্ষাৎকার নিতে যাওয়ার আগে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের অবশ্যই রেকর্ডিং ডিভাইস এবং নোটবুক সাথে রাখতে হবে। কেউ কেউ আছেন যাঁরা যে কোনো একটি নিয়ে যান। রেকর্ডিং ডিভাইস নিলে হয়তো নোটবুক নেন না। আর নোটবুক নিলে রেকর্ডার রাখেন না। কিন্তু সাক্ষাৎকারের প্রতিটি মুহূর্ত ধরতে, দুটোই প্রয়োজন। এমনকি আপনার সোর্স যদি খুব বন্ধুত্বপূর্ণও হয়। রেকর্ডিং ডিভাইস সব কথা ধারণ করে। আর নোটবুক সাথে রাখুন আলাপচারিতার বাইরের প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি বিষয়গুলো টুকে রাখার জন্য। কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কিছুর দিকে লক্ষ্য রাখার জন্য, যেন সম্পূরক কোনো প্রশ্ন বাদ না পড়ে। পাশাপাশি প্রযুক্তিগত ত্রুটি থেকে নিরাপদ থাকার জন্য।
কিছু দেশে, সাক্ষাৎকার রেকর্ড করার আগে আনুষ্ঠানিক সম্মতি নেওয়া আবশ্যক। তবে একবার সম্মতি পেলে, রেকর্ডার ব্যবহারে যতটা কৌশলী হওয়া যায় ততটা ভালো, অর্থাৎ সরাসরি সাক্ষাৎকারদাতার সামনে না রেখে এমনভাবে রাখুন যেন তাঁর চোখে কম পড়ে । তাহলে যিনি সাক্ষাৎকার দিবেন তিনি তুলনামূলক কম আত্মরক্ষামূলক মনোভাব পোষণ করবেন।
আর অফ-দ্য-রেকর্ড সাক্ষাৎকার অনেক সময় সাংবাদিকদের অতিরিক্ত তথ্য সংগ্রহে সাহায্য করতে পারে। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে সাংবাদিকেরা এ ধরনের সাক্ষাৎকার নেন। যেমন আপনি যে প্রতিবেদনটি নিয়ে কাজ করছেন তাতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যোগ করবে কিন্তু নাম-পরিচয় প্রকাশ হলে সোর্স ঝুঁকিতে পড়বে তখন অফ-দ্য-রেকর্ড সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। তবে কোনো সাংবাদিক যদি একবার সোর্সের সাথে অফ-দ্য-রেকর্ড কথা বলতে রাজি হন, সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে তাঁর প্রতিবেদনে ওই সোর্সের কথা আর উল্লেখ করা সম্ভব হবে না। যতক্ষণ না সাংবাদিক আবার ওই সূত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে অন-দ্য-রেকর্ড তথ্য নেয়ার সম্মতি না নিবেন।
আপনি কার সাক্ষাৎকার নিবেন, কখন এবং কেন ?
একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে অনেক ধরনের সোর্স থাকে। আমরা তাদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করার চেষ্টা করতে পারি। প্রয়োজনে তাদের দক্ষতা ও ধরন আলাদা হতে পারে, অথবা কখনও কখনও মিলেও যেতে পারে।
কে |
কখন |
কেন |
মন্তব্য |
---|---|---|---|
সাক্ষী বা
হুইসেলব্লোয়ার |
প্রাথমিক পর্যায়ে। |
ফাঁস হওয়া তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া এবং প্রাথমিক তথ্য বা ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া যে এটি নিয়ে অগ্রসর হবেন কিনা। |
সাক্ষী এবং হুইসেলব্লোয়ারকে দেখতে হবে ভিন্নভাবে। হুইসেলব্লোয়ারের লুকানো স্বার্থ থাকতে পারে, কিন্তু সাক্ষী এমন কেউ যিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। |
ঘটনার সাথে জড়িত সোর্স |
অনুসন্ধানের জন্য যখন প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয় তখন এর সাথে প্রায়ই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তালিকা থাকে। |
তাদের সম্পৃক্ততা বা দায়বদ্ধতা থাকলে তা প্রতিষ্ঠিত করা, তাঁরা যে অভিযোগগুলো করছে তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা এবং অন্য পক্ষকে তাদের বিরুদ্ধে আনা গুরুতর অভিযোগের জবাব দেয়ার সুযোগ দেয়া। |
এটি অনুসন্ধানের কেন্দ্রবিন্দু। জটিল বা অত্যন্ত সংবেদনশীল অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে কিছু কিছু সোর্সকে দুই কিংবা আরো বেশিবার সাক্ষাৎকার নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। |
বিশেষজ্ঞ |
সাংবাদিকদের মাঝে মাঝে কিছু জটিল বিষয় বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিতে হয়। |
অন্য সোর্স থেকে পাওয়া বক্তব্য বা আপনার অনুসন্ধানের জন্য প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়গুলো ব্যাখার জন্য। |
কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষজ্ঞরা তথ্যগুলো ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন, যা সাংবাদিককে ওই ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিতে বাধ্য করতে পারে। |
ব্যবসায়িক নির্বাহী, সরকারি কর্মকর্তা এবং অন্যান্য ক্ষমতাধর ব্যক্তি |
অনুসন্ধানের শেষ দিকে (যখন তাদের নিয়ে অনুসন্ধান শেষ, কিংবা রিপোর্টিংয়ের শুরুতে তাদের সাথে যোগাযোগ করাটা ভালো)। |
সাধারণত ঘটনা সম্পর্কে তাদের বোঝাপড়া বা তাদের নেতৃত্ব কিংবা প্রতিনিধিত্ব অথবা প্রতিষ্ঠানের কী দায়িত্বে ছিলেন/আছেন তা নির্ধারণ করতে এই সোর্সদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। |
প্রয়োজনীয় তথ্য হাতে না আসা পর্যন্ত অভিজ্ঞ অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা এই সোর্সদের সাথে কথা বলা এড়িয়ে চলেন। কেননা শুরুতেই যদি তাদের জানানো হয়, তাহলে তাঁরা তাদের প্রভাব বা ক্ষমতা ব্যবহার করে গোটা অনুসন্ধানী প্রকল্পটিকেই “থামিয়ে” দিতে পারে। |
প্রথম যাঁর সাক্ষাৎকার নেবেন
আমরা সাধারণত যাবতীয় গবেষণার কাজ শেষ করে প্রস্তুতি নিয়ে তারপর সাক্ষাৎকার নিতে যাই। ফাঁস হওয়া কোনো তথ্যের ভিত্তিতে যদি অনুসন্ধানটি শুরু করি তাহলে হুইসেল ব্লোয়ার (তিনি যদি কথা বলতে রাজি থাকেন), সাক্ষী কিংবা ঘটনা সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য দিতে পারেন এমন সোর্সদের সঙ্গে দেখা করে সরাসরি তাঁর সাক্ষাৎকার নিই। বেশিরভাগ সময়, এই সূত্রগুলো কথা বলতে রাজি থাকে। হয়তো তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকতে পারে যা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে (বিশেষ করে কিছু স্বঘোষিত হুইসলব্লোয়ারদের ক্ষেত্রে)। অনুসন্ধানের প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। তবে তাদের প্রাথমিক বক্তব্য বা অভিযোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরবর্তীতে আরও সাক্ষাৎকার নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
একটি ফাঁস হওয়া তথ্য বা সূত্র থেকে সাংবাদিক প্রাথমিক বিবৃতির সঙ্গে বিরোধপূর্ণ—এমন অনেক তথ্য পেতে পারেন। প্রথম সাক্ষাৎকার আপনাকে অনুসন্ধানের মূল রূপরেখা তৈরিতে সহায়তা করবে। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সাক্ষাৎকার সাধারণত তথ্য নিশ্চিত করতে বা সোর্সদের মুখোমুখি হয়ে সরাসরি প্রশ্ন করার জন্য।
কিন্তু প্রতিবেদকের কাছে যখন ফাঁস হওয়া কোনো লিংক নেই, প্রতিবেদনটি করা হচ্ছে ধারণার ওপর ভিত্তি করে, তখন সাংবাদিক যে ব্যক্তিকে নিয়ে অনুসন্ধান করছেন, তাঁর সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সোর্সদের দিয়ে শুরু করবেন। কিংবা যাদের কাছে সহজে পৌঁছানো যায়, তাদের থেকে—যাঁরা ঘটনা সম্পর্কে জানেন কিন্তু সরাসরি জড়িত নন।
ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট সূত্রসমূহ
অনুসন্ধানের মাধ্যমে সাংবাদিক যেহেতু পর্দার আড়ালের ঘটনা প্রকাশ করেন, তাই আগে থেকে চূড়ান্ত তালিকা করে সেই সব নাম ধরে ধরে অগ্রসর হওয়াটা কঠিন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেমনটা হয়: একটি সোর্স থেকে আপনি পরবর্তী সোর্সের সূত্র পাবেন। এরপর আরেকটি। এভাবে ধাপে ধাপে আপনাকে অগ্রসর হতে হবে। এবং প্রত্যেক সোর্সের কাছে পৌঁছাতে পারবেন। প্রতিবেদক হিসেবে আপনাকে সর্বোচ্চ সংখ্যক সোর্সের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। প্রতিবেদনে একবার কারো নাম উল্লেখ করা মানেই হচ্ছে প্রতিবেদক ওই সূত্রের সঙ্গে কথা বলেছেন।
বিশেষজ্ঞ
প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু যদি জটিল হয়, যেখানে প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও বোঝাপড়া প্রয়োজন—তখন বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার নিতে হতে পারে। যাঁরা সাংবাদিক এবং সাধারণ জনগণের জন্য কঠিন বিষয়গুলোকে সহজে বুঝিয়ে বলতে পারেন। সম্ভাব্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে আসতে পারেন আইনজীবী, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক এবং অন্যান্য খাতের পারদর্শী ব্যক্তিরা। তারা ঘটনার সাথে জড়িত না হলেও তাদের ব্যাখ্যা প্রয়োজন। আর যারা ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত “বিশেষজ্ঞ” হিসেবে তাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হবে না, কারণ সেখানে স্বার্থের সংঘাতের সম্ভাবনা থাকে।
উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা
সরকারি কর্মকর্তা, কোম্পানির নির্বাহী এবং অন্যান্য ব্যক্তিরা সাধারণত সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীদের তালিকায় শেষের দিকে থাকেন। বিষয়বস্তু ঘিরে দায়বদ্ধতা বা ধারণা থাকার কারণে তাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। কখনও কখনও তাঁরা অনুসন্ধানের কেন্দ্রস্থলে থাকতে পারেন। তবে সাক্ষাৎকার নেয়ার অনুরোধ জানানোর আগে অবশ্যই তাদের সম্পর্কে আপনার কাছে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য থাকতে হবে।
ঘটনার মূল কেন্দ্রবিন্দু: অনুসন্ধানের জন্য সাক্ষাৎকার
ওপরের বিষয়গুলো শেষ করার পর, শুরু হবে মূল কাজ: সোর্সের মুখোমুখি হওয়া এবং সাক্ষাৎকার নেয়া। মানুষ মাত্রই ভিন্ন ভিন্ন মানসিকতা ধারণ করে, এবং প্রতিক্রিয়া দেখায়। তাই সাক্ষাৎকার নেয়ার কাজটি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই আগে থেকে প্রস্তুতি নিলে তা খানিকটা সহজ হতে পারে। তবে নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস আর মনোবিজ্ঞান বিষয়ক অল্প কিছু ধারণা রাখা এবং মানুষের সাথে যোগাযোগ করার দক্ষতা থাকলে আপনার জন্য কাজটি করা খানিকটা সহজ হতে পারে।
সাক্ষী বা হুইসলব্লোয়ারদের সাথে সাক্ষাৎকার তুলনামূলকভাবে সহজ হতে পারে যদি তাঁরা রিপোর্টার, রিপোর্টারের নৈতিকতা এবং রিপোর্টারের আউটলেটের প্রতি আস্থা রাখেন। তবে “সহজ” মানে কখনই সোজা বা ঢিলেঢালা নয়। সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীর সর্বোচ্চ প্রস্তুতি থাকতে হবে। যাতে সঠিক, ঘটনাভিত্তিক তথ্য দেয়ার জন্য সাক্ষাৎকারদাতাকে রাজি করানো যায়। এ কাজের সফলতা আপনাকে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করবে।
সাক্ষাৎকারের শুরুটা করতে হবে সহজ কিছু প্রশ্ন দিয়ে। এতে যিনি সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন তাঁর জড়তা কাটানো যাবে। এরপর ধীরে ধীরে কঠিন প্রশ্নের দিকে অগ্রসর হতে হবে।
আগে থেকে তালিকাভিত্তিক প্রশ্ন তৈরি করা উচিত, যাতে কোন প্রশ্ন বাদ না পড়ে। তবে সাক্ষাৎকার নিতে বসে রিপোর্টারের কখনোই আগে থেকে লিখে নিয়ে যাওয়া বা চিন্তা করে রাখা প্রশ্নগুলো অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করা উচিত নয়। “আলাপ-আলোচনা” কোন দিকে গড়াচ্ছে সে অনুযায়ী প্রশ্ন করাটা অনেক বেশি কাজের।
সাক্ষাৎকারের কৌশল আয়ত্ত মানে ভীষণ মনোযোগী শ্রোতা হওয়া— অর্থাৎ নিজের কানকে শতভাগ প্রস্তুত রাখা। প্রখ্যাত কলম্বিয়ান সাহিত্যিক ও সাংবাদিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বিষয়টি ভীষণ চমৎকার করে বলেছেন।
টেপ রেকর্ডার কতটা উপকারী—তা আমরা জানি, কিন্তু কখনোই সাক্ষাৎকারদাতার মুখের ওপর থেকে আপনার চোখ সরানো উচিত নয়। কারণ কথার চেয়ে তাঁর অভিব্যক্তি অনেক বেশি কিছু বলতে পারে, অবশ্য কখনও কখনও বিপরীতও হতে পারে।
তিনি আরো যোগ করেছেন:
“বেশিরভাগ সাংবাদিকই টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করতে থাকেন, আর মনে করেন সাক্ষাৎকারদাতার বলা কথাগুলো হুবহু লিখে তাঁর আকাঙ্খার পূর্ণতা দিচ্ছেন। একজন মানুষ যখন কথা বলে, তাঁর চোখে-মুখে অসংখ্য অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে; তিনি দ্বিধান্বিত হন, বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসেন, বাক্য শেষ করেন না, কিংবা অযথা মন্তব্য ছুঁড়ে দেন। আমার মনে হয়, কেবল অডিও ধারণের উদ্দেশ্যেই সাংবাদিকদের টেপ রেকর্ডার ব্যবহার করা উচিৎ। যা হয়তো পরে কখনও তাঁর কাজে লাগতে পারে। যেভাবে তিনি গল্প বলার বা বিষয়বস্তু বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ( এ অধ্যায়ের লেখক ফরাসি ভাষা থেকে এখানে এটি ভাষান্তর করেছেন। ফরাসি ভাষায় পুরো লেখাটি এখানে পাওয়া যাবে)।
অনুসন্ধানী সাক্ষাৎকার, বিশেষ করে মুখোমুখি সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় এ লেখাতে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পদ্ধতিটি একবার বোঝা গেলে, প্রশ্ন করা এবং পরবর্তী প্রশ্নের মাধ্যমে আরো তথ্য বের করে আনা সম্ভব হবে। বেশিরভাগ সময়ে ওপেন এন্ডেড’ প্রশ্ন (উত্তর “হ্যাঁ” বা “না” এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়) বেশি পছন্দ করা হয়। তবে, বিশেষ ক্ষেত্রে সরাসরি এবং সুনির্দিষ্ট প্রশ্নগুলো অনেক বেশি তথ্য বের করতে পারে। তবে এ ধরনের প্রশ্নগুলো সাক্ষাৎকারের শুরুতে ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয় না। কেননা অনেক সময় এ ধরনের প্রশ্ন করার ফলে সাক্ষাৎকারদাতা বেঁকে বসতে পারে বা রেগে যেতে পারে। প্রশ্নটি যদি সাক্ষাৎকারদাতাকে লজ্জাজনক বা আপত্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলে তখন সাক্ষাৎকারটি অসম্পূর্ণ রেখেই তিনি চলে যেতে পারেন।
উপসংহার
সাক্ষাৎকার নেয়া রিপোর্টারদের জন্য বেশ কঠিন, বিশেষ করে অনুসন্ধানী রিপোর্টারদের জন্য। সাক্ষাৎকার নেয়ার কৌশল শেখানো (অথবা শেখা) কোনো তত্ত্বিক চর্চা হতে পারে না, কারণ এগুলো বিভিন্ন ধরনের জ্ঞান এবং দক্ষতার আলোকে তৈরি। এক্ষেত্রে সফল হতে হলে আত্মবিশ্বাস আর কঠিন প্রস্তুতির প্রয়োজন। বাকিটা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আসে। কাজ করতে করতে শেখা এবং সহকর্মীদের কাছ থেকে শেখার মাধ্যমেও। তাই, যখনই সম্ভব, একজন সহকর্মীর পরামর্শ নিন, বিশেষ করে যদি আপনি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় নতুন হয়ে থাকেন।
হামাদু তিদিয়ান সাই একজন অভিজ্ঞ সেনেগালি সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতার নিবেদিত প্রশিক্ষক। পাশাপাশি অনুসন্ধানী ও বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন তৈরিতে বিশেষায়িত এবং পুরস্কারজয়ী অনলাইন সংবাদ প্ল্যাটফর্ম ওয়েস্টাফ নিউজ (Ouestaf News)-এর প্রতিষ্ঠাতা। একাধারে সাংবাদিকতা, যোগাযোগ এবং ডিজিটাল মিডিয়া স্কুল ই-জিকমের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক। ডাকারে অবস্থিত এ স্কুলটি আফ্রিকার পরবর্তী প্রজন্মের সাংবাদিকদের প্রশিক্ষন দিয়ে থাকে। আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সংস্থা হিসেবে পরিচিত ডাকারভিত্তিক ওয়েস্ট আফ্রিকা ডেমোক্র্যাসি রেডিও এবং আফ্রিকা চেক-এর বোর্ডেও রয়েছেন হামাদু। আশোকা অ্যান্ড নাইট ফাউন্ডেশনের “নিউজ অ্যান্ড নলেজ” বিভাগের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছেন সামাজিক উদ্ভাবক হিসেবে। কোভিড মহামারীর সময় ভ্রান্ত তথ্য ছড়ানো প্রতিরোধে “ভুল তথ্যের বিরুদ্ধের বিশ্বাসযোগ্য তথ্য” উদ্যোগ নেন। তিনি আফ্রিকার ১৬ জন প্রতিনিধির একজন, যাঁরা কোভিড-১৯ -এর বিপরীতে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক তথ্য সরবরাহ করেন। ২০২১ সালে অর্জন করেছেন ব্রাসেলস রিব্র্যান্ডিং আফ্রিকা ফোরামের “মিডিয়া লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড” সম্মাননা।