ছবি: শাটারস্টক
জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘাত নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দায়িত্বশীলতা ও নৈতিকতা বিষয়ক পরামর্শ
ধর্ম যেসব গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মানুষের সামাজিক বা সাংস্কৃতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ—সাংবাদিকদের মধ্যে যারা এই ধরনের জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘাত বিটে কাজ করেন—তাদের চ্যালেঞ্জ কেবল মাঠের বাস্তবতা তুলে ধরা নয়, বরং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তা উপস্থাপনও। তবে অনলাইনে ছড়ানো বিভ্রান্তিকর তথ্য আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক সংবাদ চক্রের চাপ সামলাতে গিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরাও মাঝে মধ্যে উপস্থাপন বা ভাষার ফাঁদে পড়তে পারেন, যা তথ্য দেওয়ার বদলে উত্তেজনা বা সংঘাতকে উসকে দেয়।
ভারত, নাইজেরিয়া, ইরাক এবং বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ক প্রতিবেদনগুলোকে উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলের সংঘাত বা উত্তেজনা নিয়ে প্রতিবেদন করতে গিয়ে সাংবাদিক ও সম্পাদকরা এই উদাহরণ সামনে রেখে নির্দিষ্ট নীতি অনুসরন ও চর্চা করতে পারেন। এর মধ্যে কিছু নীতি দীর্ঘদিনের চর্চা কিংবা সাধারণ জ্ঞানের অংশ। জাতিগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ রয়েছে, এমন দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতপূর্ণ এলাকায় কাজ করা সংবাদমাধ্যমকে দায়িত্বের পরিধি ও অঞ্চলের সংবেদনশীল বিষয়গুলো নিয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হয়।
‘লেবেল’ করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকুন
ধর্মীয় ও জাতিগত গোষ্ঠী কিংবা বিরোধের সংবাদগুলো নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির সময় সাংবাদিকদের সর্তকতার সঙ্গে শব্দ নির্বাচন করা জরুরি। বিশেষ করে সংবাদের শিরোনামে সাম্প্রদায়িক, পক্ষপাতদুষ্ট, প্রভাবিত—এমন উত্তেজনামূলক ভাষা ব্যবহার সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। ২০২১ সালে নাইজেরিয়ার উত্তর-মধ্য অঞ্চলে একটি মিলিশিয়া গোষ্ঠীর হাতে যাত্রীদের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনা নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনে অংশগ্রহণকারীদের জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়কে জোর দিয়ে উপস্থাপন করার ফলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল।
হামঅ্যাঙ্গল মিডিয়ার সহ-সম্পাদক এবং স্ট্যান্ডার্ডস ও এথিকস বিভাগের প্রধান জনস্টন ক্পিলাকা মনে করেন, নাইজেরিয়ায় সংঘর্ষের একটি ঘটনা কাভার করতে গিয়ে তিনি অস্বস্তি বোধ করেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, একটি বাক্যই জনগণকে শান্তও করতে পারে, আবার উস্কেও দিতে পারে। (সম্পাদকের মন্তব্য: লেখক হ্যামঅ্যাঙ্গল মিডিয়ার হয়ে কাজ করেছেন এবং প্রতিষ্ঠানটির ফেলোও ছিলেন।)
সাংবাদিকতার ভাষা অনেক সময় জনমতের ওপর তথ্যের চেয়েও বেশি প্রভাব ফেলে। “ফুলানি হার্ডারস” (যা সাহারা, সাহেল ও পশ্চিম আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা প্রধানত মুসলিম এক জাতিগোষ্ঠীকে নির্দেশ করে) বা “খ্রিষ্টান আদিবাসী”র মতো শব্দগুচ্ছ সহজেই একপেশে ধারণা তৈরি করতে পারে এবং কোনো এক সম্প্রদায়কে অপরাধী বা খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে।
তিনি বলেন, “যেই মুহূর্তে আপনি কোনো সংঘাতকে জাতিগত বা ধর্মীয় পরিচয়ে বেঁধে ফেলেন, আপনি আসলে এক ধরনের গৎবাঁধা ধারণা তৈরি করেন। আর এই ধরনের ধারণা অত্যন্ত বিপজ্জনক—এগুলো অবিশ্বাস বাড়ায়, আর কখনও কখনও মানুষের প্রাণও কেড়ে নেয়।”
২০২৫ সালের জুনে ক্পিলাকা একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। শিরোনাম ছিল ‘প্লাতেও মব অ্যাকশন: হোয়েন আইডেনটিটি বিকামস আ ডেথ সেনটেন্স ইন নাইজেরিয়া (প্লাতেও গণআক্রমণ: যখন পরিচয়ই নাইজেরিয়ায় মৃত্যুদণ্ডে পরিণত হয়)।” এতে তিনি ব্যাখ্যা করেন, হিউমঅ্যাঙ্গল তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে যে “দীর্ঘস্থায়ী জাতিগত ও ধর্মীয়ভাবে বিভাজিত প্রদেশগুলোতে” গণ-সহিংসতার ঘটনা বাড়ছে। যার মূল কারণ “জাতিগত ও ধর্মীয় প্রোফাইলিং” (কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সন্দেহের লক্ষ্যবস্তু করা)। যার ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করছে নাইজেরিয়ার উত্তর-মধ্য অঞ্চলের ভ্রমণকারীরা।
হ্যামঅ্যাঙ্গল তাদের সম্পাদনাব নীতিতে কঠোরভাবে জাতিগত ও ধর্মীয় লেবেল ব্যবহারে বিরত থাকে—যাতে তাদের প্রতিবেদন কোনোভাবেই উসকানিমূলক না হয় এবং একই সঙ্গে তারা যেন একটি নিরপেক্ষ ও মর্যাদাপূর্ণ সংবাদমাধ্যম হিসেবে তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারে।
একটি প্রতিবেদন একাধিক সম্পাদককে দিয়ে পর্যালোচনা করান
রিপোর্টাররা অনেক সময় ঘটনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে যান—তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা কখনও কখনও ব্যক্তিগত পক্ষপাতও প্রতিবেদনে প্রভাব ফেলতে পারে। সম্পাদকরা এখানে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেন। যাতে আবেগ যেন তথ্যের যথার্থতাকে ছাপিয়ে না যায় এবং গল্পটি জনস্বার্থেই পরিবেশিত হয়।

জনস্টন ক্পিলাকা, হ্যামঅ্যাঙ্গল মিডিয়ার সহ-সম্পাদক এবং এথিকস ও স্ট্যান্ডার্ডস বিভাগের প্রধান। ছবি: ক্পিলাকার সৌজন্যে
ভারসাম্যের বিষয়গুলো নির্ভর করে উন্মুক্ত যোগাযোগের ওপর। নাইজেরিয়ার প্লাতেও প্রদেশের সন্দেহভাজন সশস্ত্র হামলার ঘটনা অনুসন্ধানের সময় সাংবাদিকতা ও মন্তব্য, বস্তুনিষ্ঠতা, ও পরিচয়ের মধ্যকার সীমারেখা পার হওয়ার ঝুঁকির কথা ভেবে ভয় পাচ্ছিলেন ক্পিলাকা। কারণ সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তারই নিজস্ব জাতিগত গোষ্ঠী।
এই সাংবাদিক বলেন, “আমি জানতাম, আমার ব্যক্তিগত অনুভূতির রেশ অনায়াসে এই গল্পে চলে আসবে, তাই আমি আগে থেকেই আমার সম্পাদককে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে আমার দৃষ্টিভঙ্গি এখানে প্রভাব ফেলতে পারে।” কিন্তু তাদের বার্তাকক্ষে রয়েছেন বিষয়ভিত্তিক কয়েকজন দক্ষ সম্পাদক। সংঘাতসংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো তাই একাধিক সম্পাদকের হাত ঘুরে যায়। এদের একজন চরমপন্থা বিষয়ক সম্পাদক, একজন লিঙ্গ বিষয়ক সম্পাদক, একজন লাইন সম্পাদক, এবং একজন বিশেষজ্ঞ সম্পাদক—তাদের পর্যালোচনাগুলো গভীর বিশ্লেষণ নিশ্চিত করে।
ক্পিলাকা বলেন, “পক্ষপাত আসতেই পারে । কিন্তু বিশ্বাস, দক্ষতা আর খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে সম্পাদক ও রিপোর্টাররা নিজেদের দুর্বলতাকে কাটিয়ে উঠে শক্তিশালী এবং দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করতে পারেন।”
যতটা সম্ভব মানুষের কথা শুনুন
সাধারণ মানুষের কণ্ঠ ছাড়া প্রতিবেদনের যথার্থতা এবং ভারসাম্য থাকে না—এগুলো অপরিহার্য।
“আপনি কারো সঙ্গে কথা না বলে তাদের গল্প বলতে পারবেন না,” বলেন ক্পিলাকা। তাই সাক্ষাৎকার নির্ধারণ করার পরিবর্তে, তিনি প্রায়ই সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের ঘরে বা স্থানীয় নেতাদের কাছে যান, যাতে তারা তাদের তাজা অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাগুলো বলতে পারেন। ক্পিলাকা মনে করেন, এ বছরের শুরুতে প্লাতেও প্রদেশের উত্তরাঞ্চলের বাছা স্থানীয় সরকারি এলাকায় নৃশংস গণহত্যার ঘটনা ঘটলে সেখানে গিয়ে সবার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলার পর চরম সত্য উদঘাটনে সক্ষম হন। “চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে সম্প্রদায়ের লোকেরাই সবচেয়ে বেশি জানেন—কারণ তারা এরমধ্যে বসবাস করেন।”
সংঘাতপূর্ণ পরিবেশে দুই পক্ষের কথা শোনা এবং কোনো আগাম প্রস্তৃতি ছাড়া তাৎক্ষণিক কথোপকথন প্রতিবেদনে ভারসাম্য ও গভীরতা আনে বলে মনে করেন ক্পিলাকা।
সংঘাত–সংবেদনশীল প্রতিবেদনের নীতি অনুসরণ করুন
মিডিয়া উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং সংঘাত-সংবেদনশীল প্রতিবেদন বিষয়ক প্রশিক্ষক সালাম ওমের স্বাধীন মিডিয়া আউটলেট কিরকুকনাউ-এর প্রধান সম্পাদক। তাদের সংস্থাটি ইরাকের বিতর্কিত অঞ্চলের সংবাদ তুলে ধরে। এই অঞ্চলে, উত্তর ইরাকের ইরাকি কুর্দিস্তানসহ, কুর্দ, আসিরীয়, ইয়াজিদি, তুর্কমেন এবং শাবাকের মতো অ-আরব গোষ্ঠী বসবাস করে, যাদের বাহথ পার্টির শাসনের সময়ে “আরবিকরণ” করা হয় এবং ইরাকের ফেডারেল সরকার ও কুর্দ আঞ্চলিক সরকার উভয়ই যাদের ওপর কর্তৃত্ব দাবি করে। এখানে ভূখণ্ড ও সম্পদের নিয়ন্ত্রণ, যেমন তেল ও গ্যাস নিয়ে বিবাদ রয়েছে। কিরকুক হলো কিরকুক গভর্নরেটের রাজধানী—এই অঞ্চলের তেল শিল্পের কেন্দ্র।

ছবি: স্ক্রিনশর্ট, কিরকুকনাউ
“সাংবাদিকতা বিভক্ত সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করে, সংখ্যালঘুদের কণ্ঠস্বর তুলে আনে, এবং মিনা অঞ্চলে শান্তি ও গণতান্ত্রিক উন্নয়নে অবদান রাখে—এ বিষয়গুলো আমার মধ্যে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে,” বলেন ওমের।
কিরকুকের আশেপাশের গ্রামগুলোতে আরব ও কুর্দ সম্প্রদায়ের কৃষকদের মধ্যে জমি সংক্রান্ত বিবাদ এবং উত্তেজনা নিয়ে অনুসন্ধান পরিচালনা করার সময় কিরকুকনাউ বার্তাকক্ষের ন্যায্যতা, নিরপেক্ষতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক মূল নীতির প্রতিফলন ঘটায়। আরব ও কুর্দ উভয় পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে, উসকানিমূলক ভাষা ব্যবহার এড়িয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিবাদ যেন আর না বাড়তে পারে তা নিশ্চিত করা হয়।
আধুনিক সাংবাদিকতায় সংঘাত-সংবেদনশীল প্রতিবেদন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কঠিনও— বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন ওমের। তিনি বলেন “সাংবাদিকদের সর্বাধিক ১০টি নীতির বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত, যেমন যাচাই, নিরপেক্ষতা, মৌলিকত্ব, অন্তর্ভুক্তি, স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, মানবিকতা, জবাবদিহিতা এবং ক্ষমতায়ন।”
ভাষা ব্যবহারে স্পষ্ট সম্পাদনা নীতি রাখুন
যেসব সম্প্রদায় ক্রমাগত পরিবর্তনশীল সংঘাত পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে, সেখানে সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য নিজেদের কাজ করা এবং শ্রোতাদের সুরক্ষা দেওয়া একটি জরুরি কাজ। প্রস্তুতিই এখানে মূল বিষয়, বলেন ওমের। “উসকানির ঝুঁকি কমাতে হলে স্পষ্ট কৌশল থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—যেমন ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, লিঙ্গনীতি এবং সুরক্ষাবিষয়ক নীতি।”
বিশ্বাস আসে অন্তর্ভুক্তি থেকে, বলেন ওমের। যখন বহুমাত্রিক গোষ্ঠীর সংবাদ কাভার করা হয়, সম্পাদনার দিকনির্দেশনা স্বচ্ছ থাকে, এবং প্রতিবেদনগুলো একাধিক ভাষায় প্রকাশিত হয়—তখন স্থানীয় সম্প্রদায়গুলো বিশ্বাস করে যে প্রতিবেদনগুলো সঠিক, এবং সংবাদমাধ্যম তাদের বিরুদ্ধে নয়, বরং তাদের জন্য কাজ করছে।
“এই ধারাবাহিকতা অত্যন্ত অস্থির পরিস্থিতিতেও কাজের পরিসর ধরে রাখতে সাহায্য করে,” যোগ করেন ওমের।
ওমের স্মরণ করেন বাস্তবে বিষয়টি কেমন হতে পারে। ইরাকে একটি সংঘাত কাভার করার সময় কিরকুকনাউ-এর নিউজরুম একটি অস্বাভাবিক অনুরোধের মুখে পড়ে। জড়িত পক্ষগুলোর এক দল চেয়েছিল নিহতদের “শহীদ” বলে উল্লেখ করতে—একটি শব্দ যা গভীর অর্থবোধক, যা ক্ষতিকে পবিত্রতা দেয় এবং বর্ণনাকে একপেশে করে তোলে।
তবে কিরকুকনাউ-এর সিদ্ধান্ত ছিল পরিষ্কার। “আমরা তা প্রত্যাখ্যান করেছি,” বলেন ওমের। “সাংবাদিক হিসেবে আমরা কারা সঠিক বা কারা ভুল তা নির্ধারণের অবস্থানে নেই, আমরা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নই। আমাদের কাজ সত্য তুলে ধরা।”
গতি ও নির্ভুলতার মধ্যে ভারসাম্য রাখুন — যেখানে গুরুত্ব পাবে নির্ভুলতা
ব্রেকিং নিউজ এবং ভাইরাল হওয়া বিভ্রান্তিকর তথ্যের এই যুগে নির্ভুলতার মতোই জরুরি হয়ে উঠেছে ধৈর্য্য বা সংযম। ওমের বলেন, “প্রকাশের আগে সব তথ্য যাচাই করুন, প্রতিবেদন নিয়মিত হালনাগাদ রাখুন, আর ভুল হলে সংশোধনী দিন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সতর্ক পদ্ধতি বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়—যদিও তাতে একটু দেরি হয়।”
এই সতর্কতা কেবল তত্ত্ব নয়—চর্চার বিষয়। কিরকুকনাউ তাই দ্রুত প্রতিবেদন প্রকাশের চেয়ে নির্ভুলতাকে অগ্রাধিকার দেয়। আইএসের হামলা ও অপহরণের ছয় বছর পর ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করার সময় বার্তাকক্ষটি ‘পুনরুদ্ধার কার্মকাণ্ডগুলো’ সঠিকভাবে নথিভুক্ত করেছে এবং যাচাই না করা দাবিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেনি।
সম্প্রদায়ভিত্তিক সূত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে এবং নতুন তথ্য আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেদনগুলো হালনাগাদ করার মাধ্যমে, তারা একটি “ফলো-আপ” বিভাগ তৈরি করেছে, যা চলমান প্রতিবেদনের সময় ঘটনার আপডেট রাখে।
মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায়, যেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস কখনও কখনও বিভ্রান্তিকর তথ্যের সঙ্গে মিশে যেতে পারে, সেখানে এই ধরনের সতর্কতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, বিকৃতির ঝুঁকি এড়াতে প্রস্তুতি, বিস্তারিত গবেষণা এবং অন্যান্য সাংবাদিকদের সঙ্গে সহযোগিতা অপরিহার্য।
“পরিবেশের চাপ যতই থাকুক, সাংবাদিকদের পেশাদার মান বজায় রাখতে হবে,” বলে জোর দেন ওমের।
ভাষা ব্যবহারে সচেতনতা—তবে যেন ‘ভুক্তভোগী’ বয়ান তৈরি না হয়
সাংবাদিকরা প্রায়ই সংঘাতের শিকার হওয়া মানুষগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যা তাদের দুঃখ-যন্ত্রণাকে কমিয়ে দেখায়। দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক রেদওয়ান আহমেদ। তিনি বলেন, এই ধরনের উপস্থাপন প্রায়ই তাদের দৃঢ়তা ও টিকে থাকার শক্তিকে আড়াল করে ফেলে। আহমেদের মতে, মানবিকীকরণের শুরুটা হয় শোনার মধ্য দিয়ে — মাঠে কিংবা সম্পাদনার টেবিলে আগে থেকে ঠিক করে রাখা বয়ান থেকে নয়।
তিনি আরও বলেন, “এটা নির্ভর করে আমরা কোন উক্তিটি বেছে নিচ্ছি, কার কণ্ঠে গল্পটি বলছি, আর কী প্রেক্ষাপট দিচ্ছি তার ওপর।”
আহমেদের মতে, আসল চ্যালেঞ্জ হলো মানুষের পরিচয়কে কেবল তাদের দুঃখ-কষ্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখা। বরং তাদের আকাঙ্ক্ষা, মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার লড়াই—এসবকেও গল্পের অংশ করা জরুরি। “এর মানে হলো ভাষা ব্যবহারে সচেতন হওয়া: নাটকীয়তার বদলে মর্যাদাকে, আর অসহায়ত্বের বদলে স্বক্ষমতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া,” তিনি বলেন।] আহমেদ মনে করেন, মানবিকভাবে উপস্থাপন করা মানে সাফাই গাওয়া নয় —বরং কারও জীবন ও অভিজ্ঞতার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরা।
‘ট্রায়াঙ্গুলেশন’—তথ্যকে একাধিক উৎস দিয়ে মিলিয়ে দেখুন
যাচাইয়ের শুরুটা কোনো উক্তি বা নথি থেকে নয়, বরং সরাসরি শোনা এবং প্রেক্ষাপট বোঝার মাধ্যমে হয়, ব্যাখ্যা করেন আহমেদ। তিনি যোগ করেন, “একজন সাংবাদিক হিসেবে এটা বুঝতে হবে যে, কারও সাক্ষ্য বা বক্তব্য অনেক সময় ভয়ের কারণে, ভুল বোঝাবুঝি থেকে, কিংবা বৃহৎ ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট না বোঝার কারণে বিকৃত হতে পারে।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ট্রায়াঙ্গুলেশন রিপোর্টিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মানে হলো বিভিন্নভাবে অনুসন্ধানমূলক প্রশ্ন করা, দাবি বা তথ্য বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট পক্ষের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা, গবেষকদের পরামর্শ নেওয়া, এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রমাণ পর্যালোচনা করা।
তিনি মনে করেন, “আমি শিখেছি কোনো কিছুকে সরাসরি সত্য হিসেবে ধরে নেওয়া উচিৎ নয়, কিন্তু প্রচলিত প্রমাণ না থাকায় কোনো দাবিকেও বাতিল করব না। যে সমাজে সত্য নিয়মিত দমন করা হয়, সেখানে কখনও কখনও ফিসফিস শব্দ বা কোনো কিছুর অনুপস্থিতি অনুসন্ধান করাটা জরুরি।”
প্রতিবেদন লেখার সময় আহমেদ কারও ব্যক্তিগত তথ্য তাদের অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করেন না। মানুষের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে তিনি এনক্রিপ্টেড মেসেজিং ব্যবহার করেন এবং কথা বলার সময় রেকর্ড ব্যবহার করেন না। এভাবে তিনি সেই সোর্সদের সুরক্ষিত রাখেন। কেননা, তথ্য কখনও কখনও তাদের স্বাধীনতা বা জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। “জাতিগত বা ধর্মীয় সহিংসতায় বিভক্ত সমাজে সোর্সদের নিরাপদ রাখা শুধু প্রযুক্তিগত কাজ নয়—এটি নৈতিক দায়িত্ব,” তিনি বলেন।
অনেক রোহিঙ্গার জীবনে প্রতিশোধের ঝুঁকিও রয়েছে। শুধুমাত্র রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নয়, হুমকি হয়ে আসতে পারে শরণার্থী শিবিরের শক্তিশালী গোষ্ঠী থেকেও, অনেকেই যেখানে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। আহমেদ বলেন, “অনেক সময় আমি আমার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করতে ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করেছি। যেন প্রতিবেদন প্রকাশের পর মানুষগুলো বিপদে না পড়ে। তার আগেই যেন নিরাপদ কোনো জায়গায় সরে যেতে পারে। অসাবধানতাবশত কাউকে সামনে আনার পরিবর্তে অনেক সময় প্রতিবেদনের পুরো ফোকাস পরিবর্তন করেছি।”
বার্তাকক্ষ থেকেই শুরু হোক নিরাপত্তা পরিকল্পনা
নারী সাংবাদিকরা যুদ্ধ ও সংকটের গল্পগুলোতে নিয়ে আসতে পারেন অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি। তবে এসব দায়িত্ব পালনের সময় তারা লিঙ্গভিত্তিক বিশেষ ঝুঁকির মুখেও পড়েন, যা এই কাজের বিপদ আরও বাড়িয়ে তোলে।
প্রিয়দর্শিনী সেনের মতে, নিরাপত্তা ও সতর্কতা নিয়ে চিন্তার বিষয়টি কেবল যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়—এর শুরু হওয়া উচিত বার্তাকক্ষ থেকেই, বিশেষ করে সংঘাতপূর্ণ এলাকার নারী সাংবাদিকদের জন্য।
সেন—ভারতের একজন স্বাধীন সাংবাদিক এবং ধর্ম বিষয়ক আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংস্থার সদস্য। তিনি প্রধানত ধর্ম ও জাতিগত সংঘাতের সমাধানমূলক দিক নিয়ে প্রতিবেদন করেন। সেন নিজে দেখেছেন কিভাবে নারী সাংবাদিকরা যুদ্ধ ও সংকট বিষয়ক প্রতিবেদনে অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি যোগ করতে পারেন। কিন্তু লিঙ্গ-বিষয়ক ঝুঁকি এই কাজগুলোকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে।
তিনি বলেন, “সাংবাদিকদের নিরাপত্তার শুরুটা হয় বার্তাকক্ষ থেকেই— বিশেষ করে যে নারী সাংবাদিকরা যুদ্ধ-সংঘাত নিয়ে কাজ করেন।” তার মতে, সুরক্ষা কেবল হেলমেট বা যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে গিয়ে কীভাবে প্রতিবেদন করবেন, সে বিষয়ক প্রশিক্ষণ নেওয়া নয়; বরং নেটওয়ার্ক তৈরি যা জীবনরেখার মতো কাজ করে। যার মানে হতে পারে, বার্তাকক্ষের পক্ষ থেকে এমন একজন সম্পাদকের ওপর দায়িত্ব দেওয়া, যে সার্বকক্ষণিক সাংবাদিকের অবস্থান মনিটর করেন। এর বাইরে, জরুরি যোগাযোগের একটি তালিকা থাকা উচিত, কিছু ঘটলে যারা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেন।
সেন বিশ্বাস করেন, প্রতিদিনের সময়সীমা ও চাপের মধ্যে কাজ করা নারী সাংবাদিকদের জন্য নিরাপত্তামূলক এই ব্যবস্থাটি হতে পারে দুর্বলতা ও সুরক্ষার মধ্যকার মূল পার্থক্য।
সহযোগিতা করুন
অস্থির ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে একজন প্রতিবেদকের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার কেবল নোটবুক বা রেকর্ডার নয়, বরং সম্পর্ক। প্রিয়দর্শিনী সেনের মতে, সোর্সরা কেবল তথ্যদাতা নন—তারা এক সূক্ষ্ম বিশ্বাস বিনিময়ের অংশীদার।
সেন ব্যাখ্যা করেন, এসব সম্পর্ককে কেবল লেনদেনভিত্তিক হিসেবে দেখলে বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয় এবং ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়, বিশেষ করে সংঘাত-বিভক্ত সম্প্রদায়ে কাজ করার ক্ষেত্রে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংঘাতের পর সীমান্তজুড়ে শান্তির পথে যাত্রা করা এক পুরোহিতের গল্প নিয়ে কাজ করার সময় তার স্থানীয় ফিক্সার সংস্কৃতি-ভিত্তিক বিভাজন দূর করতে সহায়তা করেছিলেন—যার ফলে স্থানীয়রা তাদের অভিজ্ঞতা খোলামেলা ভাগ করে নিতে পেরেছিলেন।
সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সচেতন থাকা—দায়িত্বশীল প্রতিবেদন তৈরির জন্য অত্যন্ত জরুরি চর্চা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে কাজ করা কখনোই সহজ নয়।
প্রান্তিক একটি জাতিগোষ্ঠীর অবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির সময় তাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন যে তাকে দেখে তারা দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ সেনের পোশাক এমন এক জাতিগোষ্ঠীর পরিচায়ক ছিল, যাদের সঙ্গে ওই সম্প্রদায়ের সম্পর্ক ছিল টানাপোড়েনপূর্ণ। এতে তিনি বুঝতে পারেন, পারস্পরিক আস্থা তৈরিতে সংস্কৃতিগত প্রতীক বা চিহ্ন কতটা প্রভাব ফেলতে পারে ।
পরে তার ফিক্সার শান্তভাবে তাদের কাছে সেনের উদ্দেশ্য ও পটভূমি ব্যাখ্যা করেন। এতে ভুল বোঝাবুঝি কেটে যায়, এবং স্থানীয়রা খোলামেলা কথা বলতে শুরু করে। এই অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে—সংস্কৃতিগত সংবেদনশীলতা সংঘাতপূর্ণ এলাকায় কাজ করা সাংবাদিকদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
তবে সহযোগিতা এখানেই থেমে থাকে না। সাংবাদিকদের উচিত তারা যে পরিবেশ ও সম্প্রদায় নিয়ে কাজ করছেন, তা ভালোভাবে বোঝা। সেন উৎসাহ দেন স্থানীয় সাংবাদিক ও ফিক্সারদের সঙ্গে অংশীদারিত্বে কাজ করতে—বিশেষ করে যখন প্রতিবেদক নিজে সেই সম্প্রদায়ের ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ের সঙ্গে এক নন। এ ধরনের সহযোগিতা অনেক বাধা কমায়, সন্দেহ দূর করে এবং কথোপকথনের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করে। সেন বলেন, “এতে মানুষ আরও খোলামেলা ভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে গভীরভাবে কথোপকথনে যুক্ত হতে পারে।”
আবদুলবাসিদ দানসোহো একজন নাইজেরিয়ার ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, যিনি মানবাধিকার, সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, স্বাস্থ্য এবং জবাবদিহিতার সংযোগস্থলে ঘটে যাওয়া ঘটনার সত্য উন্মোচন এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তার লেখা হামঅ্যাঙ্গল মিডিয়া এবং কানেমপ্রেস-এ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ২০২৩ সালে হামঅ্যাঙ্গল মিডিয়ার মিডিয়া ও জবাবদিহিতা বিভাগের ফেলো ছিলেন এবং ২০২৪ সালে আফ্রিকা ডিজিজ প্রিভেনশন, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এড্রাপ)-এর সাংবাদিকতা ফেলো ছিলেন। ২০২৩ সালে তিনি ওলে সয়িঙ্কা সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম সম্মেলনের একজন প্রতিনিধি ছিলেন।