স্টোরি পাওয়ার জন্য সাংবাদিক কি আদৌ মিথ্যা বলতে পারেন?
সংবাদমাধ্যমের প্রতি আস্থার সংকটের এই কালে সাংবাদিকদের এমন কোনো পদ্ধতিতে সংবাদ সংগ্রহ করা উচিত নয়, যা তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে। সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে মিথ্যা তথ্য ও অপতথ্য এখন সবখানে। সংবাদে মানুষের আস্থা থাকা জরুরি, যেন আমরা গল্প ও সঠিক তথ্যের মধ্যে ফারাক করতে পারি। এটি ছাড়া গণতন্ত্রকে ভুগতে হয়।
“আন্ডারকভার রিপোর্টিং, ডিসেপশন অ্যান্ড বিট্রেয়াল ইন জার্নালিজম” শীর্ষক নতুন বইয়ে আমরা প্রশ্ন রেখেছি, সাংবাদিকদের জন্য ছলচাতুরি কখনও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হতে পারে কি না। অন্যভাবে বলা যায়, স্টোরি পেতে উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে মিথ্যা বলা আদৌ ঠিক কিনা?
আমাদের মতে, অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বিষয়টি নৈতিকভাবে ন্যায়সঙ্গত হতে পারে। ছলচাতুরি ও বিশ্বাস ভঙ্গ করা ন্যায়সঙ্গত কিনা, তা যাচাই করতে আমরা সাংবাদিকদের (ও পাঠকদের) জন্য একটি ছয় পয়েন্টের চেকলিস্ট তৈরি করেছি।
সাংবাদিকতায় হরহামেশা যে নৈতিক সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে হয়, সেগুলোর একটি ছলচাতুরি। এর বিস্তার ভুল-উপস্থাপন থেকে শুরু করে ছদ্মবেশে সাংবাদিকতা পর্যন্ত বিস্তৃত।
আসলে, এটি এতই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে অনেকে যুক্তি দেন এটি সাংবাদিকদের কাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। যেমন: প্রয়াত মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক জ্যানেট ম্যালকম তাঁর বিখ্যাত বই “দ্য জার্নালিস্ট অ্যান্ড দ্য মার্ডারার”-এর শুরুর অনুচ্ছেদে বলেছেন:
অতি নির্বোধ বা অতি আত্মকেন্দ্রিক না হলে সাংবাদিকমাত্রই জানেন যে তিনি যা করছেন তা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। তিনি এক ধরনের প্রবঞ্চক যিনি মানুষের দম্ভ, অজ্ঞতা বা একাকীত্বের সুযোগ নেন, তাদের আস্থা অর্জন করেন এবং তারপর অবলীলায় তাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করেন।
ম্যালকম যখন নিজের যুক্তিকে অনেক দূর টেনে নিয়ে গেছেন, আমরা তখন এমন অনেক কেস স্টাডি হাজির করেছি যেগুলো শুধু সমসাময়িক সাংবাদিকতায় ছলচাতুরির চর্চার বিস্তারই নয়, বরং তার প্রকটতাও তুলে ধরে।
হাই-প্রোফাইল আন্ডারকভার অভিযান বা ছলচাতুরির তিনটি কেস স্টাডি এখানে দেওয়া হল।
বিশ্বব্যাপী আট কোটি ৭০ লাখ ব্যবহারকারী থেকে ফেসবুকের সংগৃহীত ডেটার ব্যবহার নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে ক্রেতা সেজে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকায় যাওয়ার ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে৷ ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র সহ বেশ কয়েকটি দেশে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে এই ডেটা ব্যবহার করা হয়েছিল।
এমন আরেকটি ঘটনা হল যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনে আল জাজিরার অনুপ্রবেশের ঘটনা। তারপর ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় রাজনৈতিক দল ওয়ান নেশন পার্টির ক্ষেত্রে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল।
তৃতীয় ঘটনাটি হল ব্রিটেনের হাজার হাজার নিরাপরাধ মানুষের মোবাইল ফোন হ্যাক করে রুপার্ট মারডকের নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড পত্রিকার প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গ। গত শতাব্দীতে ব্রিটেনে সাংবাদিকদের নৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার এটিই সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নজির।
নামকরা সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার পর্যালোচনা এবং দুই খ্যাতিমান মার্কিন সাংবাদিক ও পন্ডিত বিল কোভাক ও টম রোজেনস্টিভেলের কাজের ভিত্তিতে, আমরা ছদ্মবেশ ধারণ ও ফাঁদে ফেলাসহ আন্ডারকভার কৌশল ব্যবহারের নৈতিক যথার্থতা মূল্যায়নের ছয় পয়েন্টের একটি কাঠামো দাঁড় করিয়েছি।
এই কাঠামো দিয়ে যাচাই করে আমরা সিদ্ধান্তে এসেছি যে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার বিরুদ্ধে সাংবাদিকসুলভ অভিযান নৈতিকভাবে ন্যায়সঙ্গতই ছিল। এটি জনসাধারণের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সত্য প্রকাশ করেছিল; প্রকাশ না পেলে যা আমরা জানতাম না। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা সার্বভৌম দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছিল, যা ছিল সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য সরাসরি হুমকি।
তবে আমরা আরও দেখতে পাই যে এনআরএ এবং ওয়ান নেশন নিয়ে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডের সাংবাদিকতা; কিংবা স্টোরি তৈরির জন্য তারকা এবং নিহত স্কুল ছাত্রী মিলি ডাওলারের মত সাধারণ মানুষের ফোন হ্যাকিং কখনো ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না।
আমাদের কাঠামোটি ছয়টি প্রশ্ন নিয়ে:
১. তথ্যটি কি জনস্বার্থের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা ছলচাতুরির ন্যায্যতা প্রমাণ করে?
২. অন্যান্য পদ্ধতি কি বিবেচনা করা হয়েছিল, আর ছলচাতুরিই কি স্টোরি পাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল?
৩. ছলচাতুরির বিষয়টি কি পাঠকশ্রোতার সামনে খোলাসা করা হয়েছিল এবং এর কারণগুলো কি বিস্তারিত জানানো হয়েছিল?
৪. জনস্বার্থ পরিপন্থী কাজে ছলচাতুরির উদ্দিষ্ট ব্যক্তির সম্পৃক্ততা সন্দেহ করার মত যুক্তিসঙ্গত কারণ কি ছিল?
৫. অভিযানটি কি এমন কোনো ঝুঁকি যাচাই কৌশল মেনে করা হয়েছিল, যাতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক তদন্ত বাধাগ্রস্ত না হয়?
৬. জনস্বার্থের জন্য “যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ” ধরে নেওয়ার আগে, সেই পরীক্ষায় কি ক্ষতি বা অপকর্মের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন হয়েছিল?
ছলচাতুরি ও বিশ্বাসভঙ্গের অন্যান্য দিকগুলো দেখতে আমরা আরও একটি কেস স্টাডি বিবেচনা করি।
প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডকে “হাইব্রিড সাংবাদিকতা” নামে চালিয়ে দেয়াটা উদ্বেগের বিষয়। ঠিক এখানেই এমনভাবে বিজ্ঞাপন হাজির করা হয় যে তা সংবাদ থেকে আলাদা করা কঠিন হয়ে যায়।
“ব্র্যান্ডেড কন্টেন্ট,” “স্পন্সর্ড কন্টেন্ট” বা “নেটিভ অ্যাডভার্টাইজিং” এর মতো বিভিন্ন নামে এ ধরনের সাংবাদিকতা চলে। অতি সম্প্রতি আরেকটি চল শুরু হয়েছে: “আমাদের অংশীদারদের কাছ থেকে আসা।” স্বনামধন্য প্ল্যাটফর্মগুলোতে ব্যবহৃত টাইপোগ্রাফি খবরের বিষয়বস্তু থেকে বিজ্ঞাপন আলাদা করে, তবে অখ্যাত প্ল্যাটফর্মগুলোতে একটি থেকে অন্যটি আলাদা করা কঠিন।
সাংবাদিকেরাও প্রতিদিন বিভিন্ন প্রতারণামূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন। এর মধ্যে রয়েছে রিপোর্ট করতে গিয়ে নিজেকে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় না দেয়া; কারো সঙ্গে প্রেমের ভান করে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা; গুরুত্বপূর্ণ সোর্সের স্বার্থ রক্ষা করতে অসত্য তথ্য প্রকাশে রাজি হওয়া; এবং বিনা অনুমতিতে মাইক্রোফোন বা ক্যামেরা চালু রেখে কাউকে অপ্রত্যাশিতভাবে বিব্রত করা।
এই কেস স্টাডিগুলোতে দেখা যায়, সাংবাদিকতায় ছলচাতুরি ও বিশ্বাসভঙ্গ অনেক ধরনের হয়ে থাকে এবং সেগুলোকে কেন্দ্র করে নৈতিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অতটা সহজ নয়। তবে সাংবাদিকতায় এসবের চর্চা স্বাভাবিক নয়। সেগুলো ন্যায়সঙ্গত কিনা তা অবশ্যই নিবিড়ভাবে যাচাই করা উচিত, কারণ গণমাধ্যমের ওপর জনমানুষের আস্থা ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
এই নিবন্ধ প্রথম প্রকাশিত হয় দ্য কনভার্সেশনের ওয়েবসাইটে। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
আরও পড়ুন
আন্ডারকভার রিপোর্টিং: আমি যেভাবে কসাই হলাম
নারীবাদী অনুসন্ধানে যেভাবে উঠে এলো গর্ভপাত বিরোধী মিথ্যাচার
আন্দ্রে কারসন লা ট্রোব ইউনিভার্সিটির রাজনীতি, গণমাধ্যম ও দর্শন বিভাগের রাজনৈতিক যোগাযোগের অধ্যাপক। তিনি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, গণতন্ত্রে গণামাধ্যমের ভূমিকা, রাজনৈতিক যোগাযোগ, এবং রাজনীতি ও জেন্ডার নিয়ে গবেষণা করেন।
ডেনিস মুলার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর অ্যাডভান্সিং জার্নালিজমের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো। এছাড়া তিনি আরএমআইটি ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা পদ্ধতি শেখাতেন এবং বর্তমানে কমিউনিকেশন ল সেন্টারে সক্রিয় সাংবাদিকদেরকে মানহানি বিষয়ক আইনের পাঠ দেন।