

নির্বাসিত লোকেদের ওপর রাষ্ট্রের হামলা: ওয়াশিংটন পোস্টের অনুসন্ধানী সিরিজ “দমন নীতির দীর্ঘ হাত” থেকে আমরা যা শিখতে পারি
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
সম্পাদকের নোট: এ লেখাটি ইউএস ডেমোক্রেসি ডে ও ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষ্যে একযোগে প্রকাশিত হলো। গণতন্ত্রের কার্যকারিতা এবং গণতন্ত্রের জন্য হুমকির বিষয়গুলো সংবাদমাধ্যম কীভাবে তুলে ধরে তাই উপস্থাপিত হয়েছে এই লেখায়। বিস্তারিত জানতে usdemocracyday.org এই সাইটটি দেখুন।
ভিন্ন মতের জন্য দেশ থেকে নির্বাসিত কিংবা দলত্যাগ করে বিদেশে নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছেন — এমন লোকেদের ওপর আমরা প্রবাসেও হামলার খবর শুনি। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিই এ কাজ রাশিয়া ও এর দূর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার কীর্তি।
গত বছর কানাডায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক শিখ কর্মীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অভিযোগ ওঠে ভারত সরকারের এজেন্টরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। মর্মান্তিক এ ঘটনাটি থেকে আমরা বুঝি, এখন আর শুধু রাশিয়াই এককভাবে এমন কাণ্ড ঘটাচ্ছে না।
ফ্রিডম হাউজের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন এক দশকে ৪৪টি দেশের সরকারকে শনাক্ত করে। এই দেশগুলো নিজ দেশের গন্ডির বাইরে গিয়ে আক্রমণ এবং নির্বাসিতদের হয়রানি করেছে। এছাড়া তুরস্ক থেকে থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত যেসব দেশে নির্বাসিত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে সে দেশগুলোর প্রসঙ্গও উঠে আসে। যা অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং মনোযোগের দাবিদার।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: “আন্তর্জাতিক দমন-পীড়ন এখন আর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং কয়েক ডজন দেশের জন্য বিষয়টা খুব স্বাভাবিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজ, যাঁরা চায় বিদেশের মাটিতে গিয়েও নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে।”
এ ধরনের ঘটনা নিয়ে গভীর অনুসন্ধান চালানো সহজ নয়। শারীরিক আক্রমণ থেকে শুরু করে স্পাইওয়্যার হামলা কিংবা ভিন্ন মতাবলম্বীদের পাসপোর্ট ভুয়া এই নোটিশ পাঠিয়ে হয়রানির মতো ইস্যুগুলো নিয়ে অনুসন্ধান চালানো কয়েকটি কারণে চ্যালেঞ্জিং। এই ধরনের ঘটনার তদন্তও কঠিন কয়েকটি কারণে। প্রবাসী বা নির্বাসিত মানুষ যারা নির্যাতন বা নিপীড়নের শিকার হয়ে নিজ দেশ থেকে পালিয়েছে, তারা আতঙ্কে থাকে। ধরে নেয় তাদের আবারও নিশানা করা হতে পারে। অন্যদিকে, যে দেশগুলো এই নির্বাসিত মানুষদের আশ্রয় দেয়, তারা অনেক সময় সেখানে ঘটে যাওয়া অপরাধগুলোর জন্য বিদেশি সরকারকে সরাসারি দোষারোপ করতে চায় না। কারণ এতে কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হতে পারে। তাই অনেক সময় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের কাঁধে বর্তায়।
এক বছর আগে ওয়াশিংটন পোস্টের আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী দলটি সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা এ বিষয়গুলো নিয়ে অনুসন্ধান চালাবে। রিপ্রশন’স লং আর্ম নামের সিরিজ প্রতিবেদনের মাধ্যমে দলটি এ বিষয়গুলো তুলে ধরতে থাকেন।
এপ্রিলে প্রকাশিত এ সিরিজ প্রতিবেদনের প্রথম কিস্তিতে স্থান পেয়েছে ভারতের গুপ্তচর সংস্থা ‘র’ (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং) এর সম্পৃক্ততা। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে তারা ভারতীয় এক ভিন্নমতাবলম্বীকে হত্যায় একজন ভাড়াটে খুনি নিয়োগ দিয়েছিল। বলা হয়েছিল, ওই ভিন্নমতাবলম্বীকে নিউইয়র্কে তার নতুন বাড়িতে ঢুকে হত্যা করতে।
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এই ধারাবাহিকের দ্বিতীয় কিস্তি।“চীন কীভাবে আমেরিকার একটি শহরে দমনমূলক নীতিকে প্রসারিত করেছে” — নামের ওই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি)র সমর্থক গোষ্ঠী এবং চীনা কূটনীতিকেরা কীভাবে চীনের প্রধানমন্ত্রী শি জিনপিংয়ের সান ফ্রান্সিসকো সফর উপলক্ষে প্রতিবাদী কন্ঠগুলোকে দমন করেছে। গত নভেম্বরে শির ওই সফর অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রতিবেদনটি আরও বলছে যে, চীনের মানবাধিকার কর্মীদের ওপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একই কায়দায় দমন-পীড়ন চলছে। তাছাড়া এই অনুসন্ধানে আমেরিকার রাস্তায় প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলার ভিডিও দেখানো হয়, যা দেশটির জনগণের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা ছিল। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট অবাধ সমাবেশের অধিকার আছে।

ওয়াশিংটন পোস্টের “দমন নীতির দীর্ঘ হাত” শিরোনামের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় কিস্তিতে আরো দেখানো হয় যে, সান ফ্রান্সিসকো সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শি জিনপিংয়ের বিরুদ্ধে হওয়া প্রতিবাদ ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। ছবি: স্ক্রিনশট, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট
লং-আর্ম স্পটলাইট এরপর নজর দেয় ইরানের দিকে
জিআইজেএনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান বিভাগের জ্যেষ্ঠ সম্পাদক পিটার ফিন জানান তাদের সিরিজটি আরও দীর্ঘ হবে। তিনি বলেন গত সপ্তাহে প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে ইরান কীভাবে “সহিংসতা ঘটাতে পশ্চিমা অপরাধী চক্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।”
ধারাবাহিকের প্রথম দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের কোনোটিই হুইসেলব্লোয়ারের দেওয়া তথ্য বা সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে করা হয়নি। আর অনুসন্ধান পদ্ধতিও ছিল ভিন্ন। সময় নিয়ে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে দুটি প্রতিবেদন সাজানো হয়েছে। ভারতের গল্পটি ছিল সূত্র-নির্ভর, যেখানে তিনটি মহাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সূত্রগুলো কাজ করেছে। ফিন বলেন, এই প্রকল্পের সূচনা ঘটে যখন দলটি ভাবছিল যে কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ হত্যাচেষ্টার অভিযোগপত্রে একজন প্রধান ষড়যন্ত্রকারীকে শুধুমাত্র “সিসি-১” হিসেবে উল্লেখ করেছিল। পরে তাঁরা আবিষ্কার করেন নামহীন ওই ব্যক্তি মূলত ভারত সরকারের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ছিলেন। অন্যদিকে, চীনের গল্পটি ছিল প্রযুক্তি-নির্ভর। যেখানে উই চ্যাট চ্যানেল থেকে প্রাপ্ত সূত্র এবং শি জিনপিংয়ের সাম্প্রতিক মার্কিন সফরের সময় চার দিনের সহিংস প্রতিবাদ থেকে সংগৃহীত ২১ ঘণ্টার ভিডিও ফুটেজের ফরেনসিক বিশ্লেষণ ছিল।

পিটার ফিন, ওয়াশিংটন পোস্টের আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী দলের জ্যেষ্ঠ সম্পাদক। ছবি: বিল ও’লিয়ারি, ওয়াশিংটন পোস্ট
“এই সিরিজের জন্য, আমরা প্রতিটি গল্পকে আলাদা করতে চেয়েছিলাম। তাই শুধু ‘দেশ X, দেশ Y এই ন্যাক্বারজনক কাজগুলো করছে’ বলে সরকারের কাজগুলো হুবহু তুলে ধরার পরিবর্তে আমরা চেয়েছিলাম প্রতিটি গল্প যেন আলাদা এবং মৌলিক মনে হয়,” ফিন ব্যাখ্যা করেন।
তিনি আরো বলেন, “আমার ছয়জন অভিজ্ঞ প্রতিবেদকের একটি দল আছে, তবে আমি বিভিন্ন দলের সহযোগিতা নেওয়ার চেষ্টা করেছি। গ্রেগ মিলার গোয়েন্দা গোষ্ঠীগুলো নিয়ে কাজ করেন। গেরি শিহ নয়া দিল্লিতে আছেন। তাঁর কাছে সেখানকার সূত্র রয়েছে। এলেন নাকাশিমা আছেন ওয়াশিংটনে। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। চীনের অনুসন্ধানটি ছিল আন্তর্জাতিক দলের সমন্বয়ে তৈরি। শিবানি মাহতানি এবং কেট ব্রাউন; তাঁরা দুজনেই দুটি দেশের জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিবেদন করেন। আমাদের হয়ে কাজ করেছেন ভিজ্যুয়াল ফরেনসিক টিমের মেগ কেলি; এবং ওপেন সোর্স রিপোর্টিং বিশেষজ্ঞ ক্রিস দেগানপুর।”
রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত প্রবাসী গোষ্ঠীগুলোকে চিহ্নিত করা
চীনের অনুসন্ধান থেকে পাওয়া তথ্যগুলো ছিল এ রকম: “সবচেয়ে বেশি সহিংসতা উস্কে দিয়েছিল প্রো-চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) কর্মীরা, যা ভিডিওতে নিশ্চিত হয়েছে। শি জিনপিং বিরোধী প্রতিবাদকারীদের উপর পতাকার লাঠি এবং রাসায়নিক স্প্রে দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছিল, তাদের উপুর্যপরি লাথি-ঘুষি মারা হয়। তাদের মুখমন্ডলে ছোড়া হয় মুঠো মুঠো বালু। লস অ্যাঞ্জেলসের চীনা কনস্যুলেট সমর্থকদের হোটেল এবং খাবারের খরচ বহন করেছিল, যাতে তারা এই সহিংস কার্যক্রমে অংশ নিতে উৎসাহিত হয়।”
সিঙ্গাপুরের সাংবাদিক শিবানি মাহতানি ৩৫টি চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) সমর্থক গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে কাজ করেন। এই গোষ্ঠীগুলোর সদস্যরাই পাল্টা-প্রতিবাদে অংশ নেন। এদের অনেকেরই ইউনাইটেড ফ্রন্ট ওয়ার্ক ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। এটি মূলত সিসিপির একটি শাখা, চীন সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বিদেশে নাগরিক গোষ্ঠীগুলোকে সংগঠিত করা তাদের উদ্দেশ্য।
জিআইজেএনকে মাহতানি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইউনাইটেড ফ্রন্টের গঠন ও কার্যক্রমের আসল চেহারা উন্মোচন করা ছিল অনুসন্ধানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
“এরা আড়ালে থেকে কাজ করে … এবং নিজেদের লুকিয়ে রাখতে যারপরনাই চেষ্টা করে। যেমন, তারা বিভিন্ন নামের আশ্রয় নেয় ” তিনি বলেন। মাহতানি আরও বলেন, “গত বছর সান ফ্রান্সিসকোতে আমরা অনেকগুলো ভিজ্যুয়াল পেয়েছিলাম। বিশেষ করে ভিডিওগুলো থেকে অনুসন্ধান শুরু করতে পেরেছিলাম।”
পুরানো সূত্র এবং নতুন ধারণাগুলো কিভাবে ফরেনসিক প্রমাণের দিকে পরিচালিত করে
মাহতানি এবং তার সহকর্মীরা যে রিপোর্টিং পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন, সেগুলো অন্যান্যদের জন্য আন্তর্জাতিক দমন-পীড়নমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধানের মূল্যবান পাঠ।
সরকারের নিয়োগ করা বেসরকারি নিরাপত্তাকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা: বিদেশী সরকারগুলোর পক্ষে দেশের বাইরে বড় অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার সংস্থান করা কঠিন। তাই কনস্যুলেটগুলো প্রায়ই স্থানীয় নিরাপত্তা কর্মীদের নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়। এই স্থানীয় নিরাপত্তাকর্মীরা সাংবাদিকদের প্রয়োজনীয় সূত্র হতে পারেন। সিঙ্গাপুর এবং ক্যালিফোর্নিয়ার মধ্যে ১৫ ঘণ্টার ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও, মাহতানি ফোনে তাদের মধ্যে ৬০ জন বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। এদের চীনা কূটনীতিকরা সিসিপিপন্থী অর্থাৎ পাল্টা-প্রতিবাদকারীদের “রক্ষা” করতে নিয়োগ দিয়েছিল। এরা ছিল এই অনুসন্ধানের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী — এদের মাধ্যমেই প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা এবং তাদের প্রতি কি কি নির্দেশনা ছিল তা বেরিয়ে আসে। “রক্ষক” নয়, বরং তাদের ব্যবহার করা হয়েছিল পেশিশক্তি প্রদর্শনের জন্য।

শিবানি মাহতানি, ওয়াশিংটন পোস্টের সিঙ্গাপুর ভিত্তিক আন্তর্জাতিক তদন্ত সংবাদদাতা। ছবি: বিল ও’লিয়ারি, ওয়াশিংটন পোস্ট
“আমাদের জন্য, এটা ছিল বিরাট এক অগ্রগতি । আপনি সমস্ত ভিডিও দেখতে পারেন, তবে ঘটনাস্থলে থাকা নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি যখন আপনাকে জানাবে ওখানে সত্যিই কিছু একটা গণ্ডগোল আছে – এবং বারবার তাদের প্রতি নির্দেশ পাল্টেছে – এটা যে কী মারাত্মক!” তিনি আরও বলেন, “এই লোকদের বেশিরভাগই ছিল আমেরিকান এবং তাদের বন্দুকও ছিল ভাড়া করা। আমার ধারণা তারা কনস্যুলেটের এই কাজ নেওয়ার সময় সত্যিই জানত না… যে এখানে একটা রাজনীতি আছে।”
নির্বাসিত উত্সের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখা। যদিও বেশিরভাগ সমন্বয়ের প্রমাণ WeChat মেসেজিং প্ল্যাটফর্মে ছিল, মাহতানির তখনও সেই প্রমাণ হাতে পাওয়ার জন্য জন্য মানব উৎসের প্রয়োজন ছিল । কারণ বেশিরভাগ কথোপকথনই ছিল ব্যক্তিগত । মাহতানি হংকং এ দীর্ঘদিন কাজের সূত্রে গণতন্ত্রপন্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তাঁরা ২০১৯ সালে হংকং এ চীনা সরকারের দমন অভিযানের পর নির্বাসনে চলে যান। কিন্তু মাহতানির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল। আর এ সম্পর্কই ছিল ভেতরকার খবর ও ভিডিও সংগ্রহের মূল চাবিকাঠি।
বহু বছর পরে, এই লোকদের অনেকেই শি’র সান ফ্রান্সিসকো সফরের প্রতিবাদে হাজির হন।
“সান ফ্রান্সিসকোয় সেই দিনগুলিতে তাদের কি অভিজ্ঞতা হয়েছে সেসব খবর আমরা পাচ্ছিলাম। ওই সময়ের মারাত্মক কিছু ভিডিওও আমাদের হাতে আসে,” তিনি বলছিলেন। “দুর্ভাগ্যবশত, অনেক উইচ্যাট চ্যানেল আমাদের কাছে বন্ধ ছিল। তাই ওই গ্রুপের সদস্যরা স্ক্রিনশট নিয়ে আমাদের কাছে পাঠায়। সে কারণে আমাদের ওই সোর্সদের প্রয়োজন ছিল।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা প্রধান যে জিনিসটির উপর নির্ভর করেছিলাম তা হল ভিডিও। এই চার দিনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সবচেয়ে সহিংস ছিল যারা তাদের আমরা ভিডিও থেকে শনাক্ত করেছিলাম। উপরন্তু, আমরা চীনা কূটনীতিকদের শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছি, যা ছিল আমাদের জন্য বড় অর্জন।”
অভিবাসীদের কর ফাইল খোঁজাখুঁজি : “প্রথম, আমরা FARA (ইউএস ফরেন এজেন্ট রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট) ব্যবহার করেছি এটা নিশ্চিত হতে যে এদের কোনোটিই বিদেশি এজেন্ট হিসেবে নিবন্ধিত হয়নি,” তিনি বলছিলেন। “কিন্তু, ডাটাবেসের জন্য আমরা একমাত্র যে জিনিসের ওপর নির্ভর করতে পারি তা হলো কর ফাইল। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা গোষ্ঠীগুলোর কর ফাইলের খোঁজ পাই। এই চীনা প্রবাসী সংস্থাগুলো ছিল 501(c)3 তালিকাভুক্ত। এই ফাইলগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারি এই সংস্থাগুলো কত বড়, টাকার পরিমাণ এবং পেছনের লোকগুলো কারা। কাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করব, সে বিষয়টিও আমরা বুঝতে পারছিলাম।”
“লোকেরা অনলাইনে কতটুকু প্রকাশ করবে, কতটা বলবে তা অবমূল্যায়ন করবেন না। কারণ, কেউ এসব বিষয় নাড়াচাড়া করবে এমন ধারণাও তারা করে না,” — শিবানি মাহতানি, সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্টার
অনুমোদিত ফেসিয়াল রিকগনিশন টুল ব্যবহার করা — এবং সাবধানে যাচাই করা —ফিন জানান, শক্তিশালী এবং বিতর্কিত রিভার্স ইমেজ টুল PimEyes মুখের সাথে মেলে এমন ছবি ইন্টারনেট থেকে খুঁজে বের করে। পোস্ট রিপোর্টাররা এই টুল ব্যবহারের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন নেন। কিন্তু নিশ্চিত হতে তাঁরা বহু যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে যান ও নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি কঠোরভাবে অনুসরণ করেন। তিনি যোগ করেন, এই টুলটি চীনকে নিয়ে করা অনুসন্ধানে পরিচয় যাচাইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
“PimEyes একটি স্ট্যান্ডার্ড পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে গেছে, এবং আমরা এটিকে আমাদের অনুসন্ধানে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন নিই। তবে আমরা যে শুধু এই টুলটির ওপরই নির্ভর করেছি, তা নয়,” তিনি বলেন।
বরং, আমরা বলতে পারি যে, PimEyes এ ক্ষেত্রে আমাদের একটা পথ দেখিয়েছিল। যার ভিত্তিতে আমরা খোঁজখবর করে নিশ্চিত হতে সক্ষম হই। এই ধরনের যে কোনো প্রযুক্তির অ্যালগরিদম বলতে পারে: ‘আমরা বিশ্বাস করি এটা মিস্টার এক্স,’ কিন্তু তার মানে এই নয় যে এটাই মিস্টার এক্স। এটা শুধুমাত্র একটি সূচনা। আমাদের নিজেদেরই মিস্টার এক্সের এবং তার বন্ধুদের কাছে যেতে হবে, অথবা অপ্রতিরোধ্য ভিজ্যুয়াল এবং ওপেন সোর্সে নিশ্চিত হতে হবে যে ইনিই মিস্টার এক্স।”
দলের বাইরের বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা। অনুসন্ধানী দলটি পোস্টেরই জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক রিপোর্টার কেট ক্যাডেলের সাহায্য নেয়। কারণ তিনি ছিলেন মান্দারিন ভাষায় খুবই সাবলীল। চীনের রাষ্ট্রীয় মিডিয়া এবং সিসিপি-পন্থী গোষ্ঠীগুলির ভাষ্য বুঝতে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। মাহতানি বলেন, এত বিপুল সংখ্যক ভিডিও ক্লিপ আমাদের হাতে ছিল যে নিখুঁতভাবে কোনো ব্যক্তিকে অনুসরণ করতে ডিজিটাল স্ক্র্যাপিং এর প্রয়োজন পড়ে। এই কাজে আমাদের সাহায্য করেন প্রযুক্তিবিদ সহকর্মী ক্রিস দেহানপুর। তিনি নিজেই একটি টুল উদ্ভাবন করেন শুধুমাত্র এই প্রতিবেদনের জন্য। ফিন আরও বলেন, ৬ জানুয়ারী, ২০২১-এ ইউএস ক্যাপিটল দাঙ্গা এবং গাজায় অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী প্রকল্পে যে কৌশল ব্যবহার হয়, পোস্টের ভিজ্যুয়াল ফরেনসিক দলের একজন সদস্যও এই প্রতিবেদনের জন্য একই কৌশল ব্যবহার করেন।

পোস্টের রিপ্রেশনের লং আর্ম সিরিজের সর্বশেষটি প্রকাশ করেছে কিভাবে ইরান সরকার পশ্চিমের অপরাধী গোষ্ঠীর সাথে অপারেশন চালাতে অংশীদারিত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ছবি: স্ক্রিনশট, ওয়াশিংটন পোস্ট, রব ডবি
দেশের সীমান্তের বাইরে দমনপীড়নে গভীর- গোপনে কি কি কাজ চলছে সে সম্পর্কে তাদের মিত্ররা অনেক সময়ই অবহিত থাকে না এই অনুসন্ধানে মাহতানি আরেকটি প্রয়োজনীয় নীতির কথা বলেন। তিনি বলেন, “অনলাইনে মানুষ কতটা প্রকাশ করবে এবং তারা কতটা বলবে তা কখনও অবমূল্যায়ন করবেন না। কারণ তারা ভাবেন না যে কেউ তাদের অনুসরণ করছে।” অনলাইনে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি পন্থী দলগুলো অত্যধিক তথ্য শেয়ার করছিল। এসব তথ্য থেকেই অনুসন্ধানী দলটি নিশ্চিত হয় যে, চীনা কনস্যুলেট অনেক বিক্ষোভ-বিরোধীদের থাকা-খাওয়ার জন্য অর্থায়ন করেছিল। যাদের পরে সহিংস কর্মকাণ্ডে দেখা গেছে।
“এই ক্ষেত্রে, আমরা নিশ্চিত হয়েছিলাম WeChat থেকে – এবং অদ্ভুতভাবে, তাদের প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে তারা অর্থায়ন নিয়ে গলা উঁচু করে কথা বলছিল। তাদের লাজলজ্জার কোনো বালাই ছিল না।”
তিনি আরও বলেন: “এই ধরনের গোষ্ঠীগুলোকে দেখাতে হবে যে তারা যে দেশে রয়েছে সেদেশের নিয়মকানুন অনুসরণ করছে-… তবে তাদের চীনা সরকারকেও দেখাতে হয় যে তারা কিছু করছে; আসলে তারা মাঠে তাদের সক্রিয়তা দেখিয়ে যোগ্যতা এবং ক্ষমতা প্রমাণ করতে চেয়েছিল।”
প্রভাব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে ফিন বলেন: “এর প্রভাব পরিমাপ করা খুব কঠিন। ভারত সরকার কি উত্তর আমেরিকায় আবার এই চেষ্টা করবে? আমি মনে করি সম্ভবত ‘না’। এবং শুধুমাত্র এই কারণেই নয় যে এটি পোস্ট এবং অন্যান্য জায়গা থেকে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে, বরং এটিকে টেনে নেওয়ার মতো দক্ষতার অভাব ছিল বড় কারণ। তারা তাদের কোন লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। যদি কিছু তারা অর্জন করে থাকে, তা তাদের উদ্দেশ্যের উল্টো কিছু। ”
পোস্টের এই প্রতিবেদনটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার একটি নতুন দিকের কথা বলে। আর এ ধরনের সাংবাদিকতার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। যেমন এ ধরনের প্রতিবেদনে এমন সব অপরাধ বেরিয়ে আসে, যা সরকারগুলো প্রকাশ করতে চায় না। আবার একইসাথে অপরাধ যেন আর না ঘটে তাও প্রতিরোধ করে এই প্রতিবেদনগুলো।
“জনসাধারণ যাচাই-বাছাই ও জবাবদিহিতা চাইলে এসব কর্মকান্ড প্রতিরোধের মুখে পড়ে…” বলেন ফিন। “কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী লোকজনকে চীনের পক্ষে সংগঠিত করা হচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিন্নমতাবলম্বীদের কেন দমনের চেষ্টা চলছে। আমরা যে ভিত্তির ওপর কাজ শুরু করেছিলাম তা হলো,’ঠিক আছে, আমরা শুনেছি যে চীন এটি করছে এবং তার নিকটবর্তী এলাকায়’ – কিন্তু এ কথাও সত্য যে একটি বড় মার্কিন শহরে তারা ভিন্নমত দমনের চেষ্টা করেছে এই খবরে আমরা আহত হই – [প্রাক্তন পোস্ট সম্পাদক] বেন ব্র্যাডলিকে উদ্ধৃত করে বলি, এটাই ছিল ”হোলি শিট ফ্যাক্টর।”
রোয়ান ফিলপ জিআইজেএন-এর সিনিয়র রিপোর্টার। তিনি পূর্বে দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসের প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন। একজন বিদেশী সংবাদদাতা হিসেবে তিনি বিশ্বের দুই ডজনেরও বেশি দেশের সংবাদ, রাজনীতি, দুর্নীতি এবং সংঘাতের বিষয়ে রিপোর্ট করেছেন।