Image: Shutterstock
গত তিন বছরে সাংবাদিকেরা যেভাবে কোভিড-১৯ মহামারির প্রতিটি দিক অনুসন্ধান করেছেন
মানুষের শরীরে প্রথম কোভিড-১৯ সংক্রমণ সনাক্ত হওয়ার তিন বছরে বিশ্বের ওয়াচডগ সাংবাদিকেরা আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন ও ভয়াবহ এই অনুসন্ধানী বিষয় নিয়ে কাজ করে গেছেন। গোটা সময় জুড়ে এই মহামারি অন্তত ৬৬ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়েছে, বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি করেছে, সাপ্লাই চেইনে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা ওলটপালট করে দিয়েছে।
সরকারগুলোর জন্যে একটি রিয়েল-টাইম পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায় এই মহামারি, যা দেখিয়ে দিয়েছে তারা এই সংকট সামাল দিতে পেরেছে, কি পারেনি। এটি অপরাধীদের দুর্নীতি, বিভ্রান্তিকর প্রচারণা ও নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার নতুন সুযোগ তৈরি করে দেয়। লকডাউন, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও সংক্রমণের ঝুঁকি সহ রিপোর্টিংয়ে বেশ চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও সাংবাদিকেরা দৃঢ়তার সঙ্গে এসব হুমকি নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন এবং কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেছেন। জেনেভা-ভিত্তিক অলাভজনক সংগঠন প্রেস এম্বলেম ক্যাম্পেইনের বৈশ্বিক জরিপ অনুযায়ী, ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত (যত দিন তারা ডেটা সংগ্রহ করেছে) ৯৫টি দেশের অন্তত ১,১৯৪ জন গণমাধ্যম কর্মী কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
রোগের প্রাদুর্ভাব ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের ঘাটতি থেকে শুরু করে কোভিড-১৯ বিষয়ক অপতথ্য, চিকিৎসা কেলেঙ্কারি, ব্যাপক হারে সংক্রমণ, লকডাউন, টিকা কর্মসূচির উদ্বোধন ও ভাইরাসের উৎস অনুসন্ধান পর্যন্ত অনেক বিষয় নিয়ে বার্তাকক্ষগুলো তাদের কভারেজে অসাধারণ তৎপরতা দেখিয়েছে। কয়েকশ’ দুর্দান্ত অনুসন্ধান থেকে দশটি বাছাই করা আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। সাংবাদিকদের প্রতিবেদনের সৃজনশীলতা, অঞ্চলের ভিন্নতা এবং কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর বৈচিত্র্য বিবেচনায় নিয়ে মহামারি বিষয়ক উল্লেখযোগ্য অনুসন্ধানগুলো থেকে আমাদের করা সংক্ষিপ্ত তালিকা নিচে তুলে ধরা হয়েছে।
ভ্যাকুনাগেট
২০২১ সালে সাধারণ মানুষের নাগালে টিকা আসার অনেক আগেই, পেরুর অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি গোপনে টিকা নিচ্ছিলেন। এটি উন্মোচন করেছে “ভ্যাকুনাগেট” কেলেঙ্কারি নামে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের একটি প্রচেষ্টা, যার কারণে দেশটির বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, প্রশাসক ও কর্মকর্তাকে পদত্যাগ করতে হয়। পেরুতে এই কভারেজের নেতৃত্বে ছিল, অলাভজনক বার্তাকক্ষ সালুদ কন লুপা। তাদের প্রতিবেদনে উঠে আসে, কীভাবে পেরুর তৎকালীন প্রেসিডেন্টসহ ৪৮৭ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি ঔষধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের পাঠানো “সৌজন্যমূলক” ৩,২০০ ডোজ টিকার সুবিধা নিয়েছিলেন। ক্লিনিকাল ট্রায়াল ডেটাবেস ও স্বাস্থ্য খাতের সোর্সদের সঙ্গে সখ্যতা কাজে লাগিয়ে রিপোর্টিং দলটি তাদের ইন্টারেক্টিভ ডেটাবেসে সুবিধাভোগীদের মধ্যকার যোগসাজশ যেমন তুলে ধরেছে, তেমনি দেখিয়েছে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির চুক্তি অনুমোদনের সঙ্গে এদের কেউ কেউ জড়িত ছিলেন।
সালুদ কন লুপা যখন কেলেঙ্কারির গভীরে অনুসন্ধানে ব্যস্ত, তখন অনুসন্ধানী সংগঠন ওহো পুবলিকো অনুসন্ধানের জাল আরও বিস্তৃত করার পথ বেছে নেয়। তারা বিদেশি ঔষধ কোম্পানির কাছ থেকে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন সরকার সম্ভাব্য দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দু “সৌজন্যমূলক” টিকা পেয়েছে কি না, তা নিয়ে অনুসন্ধান করে। অনুসন্ধানী দলটি আবিষ্কার করে যে তিনটি চীনা টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান চিলি, পেরু ও আর্জেন্টিনায় অন্তত ১৩,৫০০ অতিরিক্ত ডোজ পাঠিয়েছিল। পরে জিআইজেএনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ওহো পুবলিকোর রিপোর্টার আর্নেস্তো কার্বাল – কাস্টমস রেজিস্ট্রি ও সাপ্লাই চেইন ট্র্যাকিং টুল সহ দলটির ব্যবহার করা বিভিন্ন ডেটাবেস সম্পর্কে বিশদভাবে তুলে ধরেন৷
মিয়ানমারের হারানো অর্থ
সম্পূর্ণ স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোতে কোভিড-১৯ সংকট নিয়ে ওয়াচডগ রিপোর্ট করা যতটা জরুরি, ততটাই কঠিন। তবুও দমনপীড়নের শিকার এই দেশগুলোতে সাংবাদিকেরা ইরানের গণকবর থেকে শুরু করে রাশিয়ায় কোভিড-১৯-এ আক্রান্তদের মৃত্যু গোপন করা পর্যন্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উন্মোচন করেছেন। ২০২২ সোপা অ্যাওয়ার্ডে (দ্য সোসাইটি অব পাবলিশার্স ইন এশিয়া), ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল তাদের অব আননোন অরিজিন শীর্ষক অনুসন্ধানের জন্য পাবলিক সার্ভিস বিভাগে জয়ী হয়েছে। এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে চীনা সরকার কীভাবে ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞদের তদন্তে বাধা দিয়েছে। ইতিমধ্যে মিয়ানমারের হারানো অর্থ নিয়ে দ্য ডিপ্লোম্যাটের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভাইরাস মোকাবেলায় মিয়ানমার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ৩৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পেয়েছে এবং সামরিক অভ্যুত্থানে সরকার উৎখাতের কয়েক দিন আগে এই তহবিল এসেছে। প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে, দেশটিতে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও পরবর্তী সময়ে এই তহবিল শেষ হয়ে গেছে, আর নয় মাসে মাত্র ৮.৫% নাগরিক টিকা পেয়েছে।
ভারতের কোভিড-১৯ বিপর্যয়ে মোদি সরকারের ব্যর্থতার দায়
ওয়াচডগ সংবাদমাধ্যমগুলোর মনোযোগের মূল বিষয় ছিল সরকারের তৎপরতায় ঘাটতি। ভারতের প্রথম সারির লং-ফর্ম ম্যাগাজিন দ্য ক্যারাভানের এই গভীর অনুসন্ধানে ২০২১ সালে দেশটিকে এলোমেলো করে দেয়া কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতীয় সরকারের তৎপরতা খতিয়ে দেখেছেন রিপোর্টার চাহাত রানা। তাঁর রিপোর্টিং কেবল অক্সিজেন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম সরবরাহে ভয়াবহ ঘাটতিসহ অনাকাঙ্খিত যোগাযোগ ব্যবস্থা, ডেটা ও বিতরণ ব্যবস্থার ব্যর্থতাই তুলে ধরেনি বরং এমন অনেক মৃত্যুর ঘটনা সামনে এনেছে যা সহজেই এড়ানো যেত।
কোভিড-১৯ কালে ভ্রমণবাবদ অর্থ আদায়
পশ্চিম আফ্রিকার আন্তঃসীমান্ত অনুসন্ধানী প্রকল্প সেনোজো এর দুই পর্বের স্টোরিতে আফ্রিকার দুই সরকারের জালিয়াতি প্রকাশ্যে এসেছে। এর মধ্যে ছিল আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ ও কোয়ারেন্টিন ফি আদায় এবং দেশে প্রবেশকালে কখনো কখনো অপ্রয়োজনীয় কোভিড পরীক্ষা করানো। প্রথাগত ও আন্ডারকভার দু’ধরনের রিপোর্টিং কৌশল কাজে লাগিয়ে দলটি দেখিয়েছে, নাইজেরিয়া ও ঘানার সরকার কীভাবে মহামারির অজুহাত দেখিয়ে এসব বিমান যাত্রীদের হয়রানি করেছে। অথচ পশ্চিম আফ্রিকার অন্যান্য অনেক দেশই টিকাপ্রাপ্ত ভ্রমণকারীদের জন্য দেশে প্রবেশকালে বাধ্যতামূলক পরীক্ষার নীতি পরিহার করেছে। দলটি দেখেছে যে পিসিআর পরীক্ষায় স্বাভাবিক হারের দুই থেকে তিনগুণ বেশি অর্থ নেওয়ার পাশাপাশি কিছু যাত্রীর কাছ থেকে কোয়ারেন্টিন ফি ও “চিকিৎসা” বাবদ প্রতিদিন ৯০ মার্কিন ডলার নেয়া হয়েছিল, অথচ এই সেবা কখনও দেয়া হয়নি। একেকটি কেস স্টাডি ধরে সেনোজো দেখিয়েছে, নাইজেরিয়া ও ঘানায় ভ্রমণকারীদের কীভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল – তারা যে সংক্রমিত নন তা প্রমাণে ভ্রমণ প্রতি অতিরিক্ত অর্থ গুণতে হত।
জিম্বাবুয়ে সরকার যেভাবে দু’সপ্তাহ বয়সী কোম্পানিকে দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়েছে
মহামারির গোটা সময়জুড়ে ঔষধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের গোলমেলে চুক্তিতে সন্দেহজনক বা অযোগ্য ঠিকাদারদের সম্পৃক্ততা চোখে পড়েছে। আর অনুসন্ধানী স্টোরিগুলোর কারণে অনেক সময় এই চুক্তিগুলো আটকে গিয়েছে বা পর্দার আড়ালে থাকা কর্মকর্তারা চাকরিচ্যুত হয়েছেন। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীবহুল দরিদ্র দেশগুলোতে এ ধরনের অনুসন্ধানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। জিম্বাবুয়েতে কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট চুক্তিগুলো নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধানের ফলে একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বরখাস্ত ও গ্রেপ্তার হয়েছেন, এবং অনৈতিক ব্যয়-বরাদ্দ বাতিল হয়েছে। তবে দেশটিতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদেরও হয়রানি ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জিমলাইভডটকম-এর একটি প্রতিবেদনে রিপোর্টার মদুদুজি মাথুথু দেখিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট পরিবারের ঘনিষ্ঠ দু’সপ্তাহ বয়সী একটি প্রতিষ্ঠান “চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের” ২০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে ২ মিলিয়ন ডলার অগ্রিম পেয়েছে। স্টোরিতে মূল্যস্ফীতির বিশদ বিবরণ এবং জিম্বাবুয়ের সরকারি ক্রয় নিয়ন্ত্রকের তালিকায় কোম্পানিটির নাম না থাকার তথ্য তুলে ধরা হয়। এদিকে, জিম্বাবুয়ের চিকিৎসা সরঞ্জাম বিষয়ক চুক্তিগুলোর একটিতে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির দাবির স্বপক্ষে নথি প্রকাশের পর পরই পদকপ্রাপ্ত অনুসন্ধানী রিপোর্টার হোপওয়েল চিনওনোকে হয়রানি ও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
কারাগার
মহামারির শুরুর দিকের সময় নিয়ে নির্মিত এই ভয়াবহ তথ্যচিত্রে প্রোপাবলিকার অনুসন্ধানী রিপোর্টার সেথ ওয়েসলার যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া রাজ্যের একটি গোপন কারাগারে অনিবন্ধিত অভিবাসীদের দুর্বিষহ পরিস্থিতি এবং কোভিডের ঝুঁকিগুলো তুলে ধরেছেন। এই তথ্যচিত্র যুক্তরাষ্ট্রে ২০২১ ডাবল এক্সপোজার ফিল্ম ফেস্টিভালে দেখানো হয়। বিতাড়িত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা এই মানুষগুলোর না-জানা জগতে প্রবেশের জন্য ওয়েসলার যে সৃষ্টিশীল কৌশল অবলম্বন করেছিলেন, সেটিই তিনি উৎসবে বর্ণনা করেন। প্রতি মিনিটে ২৫ সেন্ট খরচ করে তিনি একটি ওয়েবক্যাম অ্যাপ দিয়ে বন্দী ও কারাগারের দৃশ্য ধারণ করেছিলেন। তিনি টাকা যোগাড় করে, সেই ওয়েবক্যামে কয়েকশ ঘন্টার সাক্ষাৎকার ও ফুটেজ রেকর্ড করেন, যার মধ্যে সংক্রমণের ভয়াবহ ঝুঁকিতে ফেলার প্রতিবাদে বন্দীদের অনশন ধর্মঘটের ঘটনাও ছিল।
গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোতে কোভিড-১৯ মহামারি ঘিরে মিথ্যা প্রচারণার উৎস
অনেক স্টোরিই চিকিৎসা কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে সংক্রমণ ছড়ানোর ষড়যন্ত্র পর্যন্ত কোভিড নিয়ে ছড়ানো ভুল তথ্য চিহ্নিত করেছে এবং ভুল প্রমাণ করেছে; তবে খুব কম স্টোরিই করোনা ভাইরাস নিয়ে বিভ্রান্তিকর প্রচারণার নাটের-গুরুদের সনাক্ত করতে পেরেছে। ফ্রান্স টুয়েন্টি ফোরের দ্য অবজারভারস-এর রিপোর্টার আলেকজান্দ্রে ক্যাপ্রনের এই স্টোরি, ফেসবুকে পশ্চিম আফ্রিকা ও পশ্চিম ইউরোপের হাজার হাজার মানুষকে লক্ষ্য করে পরিচালিত একটি সমন্বিত বিভ্রান্তিকর প্রচারণা উন্মোচন করেছে। বিশেষ করে, তিনি পাঁচটি ভুয়া ফেসবুক নিউজ ফিড পেজ খুঁজে পেয়েছেন, যেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্সের বৃহৎ কঙ্গোলিয় প্রবাসীদের মধ্যে রাজনৈতিক অসন্তোষ কাজে লাগানো। ক্যাপ্রন দুটি প্রচারণার এডমিনদের সনাক্ত করেছেন এবং তাদেরই একজন, ২০ বছর বয়সী এক কঙ্গোলিয় কলেজ ছাত্রের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। ছেলেটির সরল স্বীকারোক্তি থেকে – যেমন “ফলোয়ার পেতেই আমরা স্টোরি করি” – উঠে আসে যে কোভিড নিয়ে বিভ্রান্তিকর প্রচারণার নেপথ্যে কেবল রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তি, আদর্শিক ট্রল ও বাণিজ্যিক প্রতারকেরাই ছিলেন না, বরং আলোচনায় থাকার লোভে প্রযুক্তি-দক্ষ তরুণেরাও এতে অংশ নিয়েছিল। জিআইজেএনের এই লেখায় ক্যাপ্রন তাঁর ব্যবহৃত টুলগুলো তুলে ধরেছেন, যার মধ্যে রয়েছে হোক্সি, হু পোস্টেড হোয়াট এবং ফেসবুকের ট্রান্সপারেন্সি বক্স৷
সম্মুখসারির মার্কিন স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে নকল মাস্ক সরবরাহ
২০২০ সালে, বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকেরা সমস্যা, ক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতি ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম নিয়ে কেলেঙ্কারি উন্মোচনে বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন। এই প্রচেষ্টাগুলোর সেরা কয়েকটি ছিল অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের রিপোর্টিং জুটি মার্থা মেন্ডোজা ও জুলিয়েট লিন্ডারম্যানের। ২০২০ সালের মার্চে তাঁরা চমকে ওঠার মত তথ্য তুলে ধরেন: মহামারির জরুরি অবস্থা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ আগের বছরের চেয়ে কমে গেছে, যা সম্মুখসারির চিকিৎসা কর্মীদের সংকটে ফেলেছে। এই কাজে তারা আমদানি-রপ্তানি বিষয়ক বাণিজ্যিক ডেটাবেস, ইউএস ফেডারেল প্রকিউরমেন্ট ডেটা সিস্টেম এবং নার্স ইউনিয়ন ও মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সোর্স ব্যবহার করেন। মে মাসে তাঁরা গ্লোবাল রিপোর্টিং সেন্টারের সঙ্গে একটি পুরস্কারজয়ী যৌথ উদ্যোগের অংশ হিসেবে আরও কিছু ভয়ঙ্কর বিষয় সামনে আনেন: মার্কিন হাসপাতালগুলোতে আমদানিকৃত বিপুল সংখ্যক এন৯৫ মেডিকেল গ্রেড মাস্ক, লাখ লাখ গাউন, গ্লাভস ও অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী নকল ছিল, যা “জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।” মেন্ডোজা জিআইজেএনকে বলেছিলেন, স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে “ইয়ার-লুপ টানতে” দেখে তাঁর মাথায় এই স্টোরির চিন্তা আসে। কারণ, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছিলেন যে মেডিকেল গ্রেড মাস্কে ইয়ার-লুপ থাকার মানে হতে পারে, মাস্কগুলো নকল এবং তাদের সুরক্ষা নিম্ন মানের।
লকডাউনে অবরুদ্ধ
অনেক সরকার মহামারির লকডাউনের আড়ালে নিবর্তনমূলক নতুন আইন প্রণয়ন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়ন বা জনসাধারণের স্বাধীনতায় রাশ টেনেছে। যেমন; দক্ষিণ আফ্রিকায় ভিউফাইন্ডারের হাতে প্রমাণ এসেছে, সম্ভবত দেশব্যাপী লকডাউনের প্রথম দিনেই পুলিশি আক্রমণে পেট্রাস মিগেলস নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেন, অথচ কর্তৃপক্ষের দাবি ছিল “প্রাকৃতিক কারণে” এই মৃত্যু। তার মৃত্যু ছিল দেশজুড়ে লকডাউন বাস্তবায়নে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের নমুনা মাত্র, যা দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে ঝুঁকির মুখে থাকা মানুষগুলোই মহামারির আশঙ্কাজনক পরিসংখ্যানের ভার বইছে। আল জাজিরার ১০১ ইস্ট প্রোগ্রামের আরেকটি অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, মালয়েশিয়ায় অভিবাসী শ্রমিকদের কীভাবে হয়রানি ও অবরুদ্ধ করা হয়েছিল এবং সে দেশের লকডাউন কর্মকৌশলের অংশ হিসেবে গুরুতর সংক্রমণের ঝুঁকিতে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। এই স্টোরিটি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ ও জেনোফোবিয়া এবং আল জাজিরার অফিসে অভিযানের পর মালয়েশিয়ায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিবেশ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।
অপরাধের প্রসার: মহামারি থেকে মাফিয়া, গ্যাংস্টার ও প্রতারকদের মুনাফা
২০২১ সালে বইটি লিখেছেন সংগঠিত অপরাধ গবেষক টিউজডে রেইতানো ও মার্ক শ। বিশ্বজুড়ে অপরাধীরা চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট অপকর্ম ও সাইবার অপরাধ থেকে শুরু করে সাপ্লাই চেইন বিষয়ক দুর্নীতি ও মাদক পাচারের নতুন রুট তৈরিতে কীভাবে মহামারিকে কাজে লাগিয়েছে, সেটিই এখানে উঠে এসেছে। মহামারি পরবর্তী বিশ্বে একই ধরনের সংকটের মুখে এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলোর সন্ধানে নিয়োজিত সাংবাদিকদের জন্য বইটি একটি চিন্তার খোরাক ও সমৃদ্ধ রিসোর্স। তাঁদের সুনিপুণ গবেষণায় উঠে আসে, জাতীয় জরুরী অবস্থায় সরকারি দীর্ঘসূত্রিতার সুযোগ নিয়ে অপরাধী চক্রগুলো কীভাবে সেবা ও বিতরণ ব্যবস্থার ফাঁকগুলোতে ঢুকে পড়ে এবং এই সুযোগে তদন্ত, বিচার, এমনকি সমালোচনা থেকেও রেহাই পেয়ে যায়।
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমস পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন। বিদেশ প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের ২৪টির বেশি দেশে সংবাদ, রাজনীতি, দুর্নীতি ও সংঘাত নিয়ে রিপোর্ট করেছেন। এছাড়া তিনি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও আফ্রিকার সংবাদমাধ্যমে অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।