Image: Screenshot, Goldsmith Prize
কল্যাণ তহবিলের টাকা নিয়ে নয়ছয় যেভাবে উন্মোচিত হলো এক পুরস্কারজয়ী অনুসন্ধানে
সম্পাদকের নোট: এই নিবন্ধটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় ২০২৩ গোল্ডস্মিথ পুরস্কারজয়ী একটি অনুসন্ধান নিয়ে। “জাতীয়, আঞ্চলিক বা স্থানীয় পর্যায়ে জননীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী” যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিবেদনের জন্য প্রতি বছর এই পুরস্কার দেওয়া হয়।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে দুটি বড় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার জিতে নিয়ে মিসিসিপি টুডের তারকা প্রতিবেদক আনা উলফ এখন বিশ্বের যে কোনো সংবাদপত্রের জন্য আরাধ্য হয়ে উঠেছেন। কিন্তু ওয়াশিংটন রাজ্যে জন্ম নেওয়া এবং গোল্ডস্মিথ পুরস্কারের সর্বকনিষ্ঠ যুগ্মবিজয়ী এই সাংবাদিকের আপাতত বর্তমান ঠিকানা ছেড়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই।
“মিসিসিপির বর্ণনা দেওয়া কঠিন। উইলিয়াম ফকনার বলেছেন, বাকি বিশ্বকে বোঝার জন্য আপনার মিসিসিপির মতো অঞ্চলকে বুঝতে হবে। আমেরিকায় যা চলছে, এটি তার নমুনামাত্র। আমি এর অগ্রভাগে থাকতে চাই। আর থাকতে চাই মাঠ পর্যায়ে” – জিআইজেএনকে বলেন এই সাংবাদিক।
নিঃসন্দেহে তাঁর পাঁচ-পর্বের অনুসন্ধানী ধারাবাহিক দ্য ব্যাকচ্যানেল দেশজুড়ে সাড়া ফেলেছে, যেটি এই ২০২৩ সালে গোল্ডস্মিথ পুরস্কার জিতেছে। ২০২২ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত এই বিস্ফোরক অনুসন্ধান মিসিসিপির অকার্যকর কল্যাণ তহবিল ব্যবস্থার দুর্নীতি উন্মোচন করেছে। এই দুর্নীতির কারণে ব্যাপক দারিদ্র্য মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া লাখ লাখ ডলারের সুফল থেকে দরিদ্রতম এই মার্কিন রাজ্য বঞ্চিত হয়েছে। এটিই দেশটির ইতিহাসে নথিভুক্ত সবচেয়ে বড় তহবিল তছরূপের ঘটনা।
ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী হিসেবে মিসিসিপি
রাজ্য সরকারের মানব সম্পদ বিভাগের একজন সোর্স থেকে মিসিসিপির প্রাক্তন গভর্নর ফিল ব্রায়ান্টের কার্যালয়ের ভয়াবহ কিছু টেক্সট মেসেজ হাতে পান উলফ। এর ভিত্তিতেই তিনি তাঁর প্রতিবেদনে শক্তিশালী সাক্ষ্যপ্রমাণ দাঁড় করান এবং স্বজনপ্রীতি ও জবরদস্তির জাল উন্মোচন করেন। এই জালে ব্রায়ান্টের সঙ্গে জাতীয় রাগবি দলের সাবেক অধিনায়ক ব্রেট ফাভরের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততাও ধরা পড়েছে।
উলফ হলেন মিসিসিপির প্রথম, স্বনিয়োজিত দারিদ্র্য বিষয়ক রিপোর্টার। এই কেলেঙ্কারি উন্মোচনের মাধ্যমে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর সামনে এনেছেন। প্রশ্নগুলো হলো: পরিবারগুলোকে দারিদ্র্য মুক্ত করতে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল কীভাবে ব্যয় করা হচ্ছে? আর ব্যয় বিষয়ক এই সিদ্ধান্তগুলো দরিদ্রদের সহায়তায় রাষ্ট্রের দর্শন সম্পর্কে কী বার্তা দেয়?
উদ্ভট নীতি ও জাতিগত সমস্যায় জর্জরিত ম্যাগনোলিয়া অঙ্গরাজ্যের প্রসঙ্গ টেনে উলফ বলেন, “মানুষ মিসিসিপিকে বিচ্ছিন্ন অঙ্গরাজ্য মনে করে৷” উলফ জোর দিয়ে বলেন, কিন্তু যে সমস্যগুলো মিসিসিপিকে আক্রান্ত করছে, সেগুলো দেশটিতে মোটেই নতুন কিছু নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের একটি খণ্ডচিত্র মাত্র।
তিনি বলেন, “মিসিসিপিকে অনেক সময় অবজ্ঞা করা হলেও সম্প্রতি সর্বোচ্চ আদালতের একটি রায়ে এই রাজ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দেশজুড়ে প্রজনন অধিকার বাস্তবায়নে এই রায়ের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। গত বছর রাজ্যের বাইরের বড় স্টোরিগুলোর একটি হলো জ্যাকসনের পানি সংকট, আর পুরানো শহরের পুরানো অবকাঠামোর সমস্যা গোটা দেশেই বিদ্যমান।”
তিনি আরও বলেন, “আপনি অন্য শহরগুলোর দিকেও নজর দিতে পারেন, দেখবেন, আমাদের সমস্যাগুলো সেখানেও প্রকট হয়ে উঠেছে।”
উলফ এক দশকের বেশি সময় আগে সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় ওয়াশিংটনের টাকোমা ছেড়ে, সারা দেশ ঘুরে, মিসিসিপির রাজধানী জ্যাকসনে চলে আসেন এবং আর কখনও ছেড়ে যাননি। এই নতুন আবাসস্থলের প্রতি তাঁর মায়া স্পষ্ট।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “জ্যাকসন বেশ ছোট শহর।” হল অ্যান্ড মলস্ নামে শহরের অনন্য বিচিত্র এক পানশালায় তিনি একসময় খাবার পরিবেশন করতেন। কোনো এক শুক্রবার রাতে সেখানেই উলফ ও তাঁর এক বন্ধু শহরের বৈচিত্র্য নিয়ে আলোচনা করছিলেন এবং শহরের একটি গৌরবময় মুহূর্ত ভাগাভাগি করছিলেন।
উলফ বলেন, “আমাদের সামষ্টিক সমস্যাগুলো এধরনের একেকটি মুহুর্তে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। আমারও মনে হয় যেন আমরা সবাই একসঙ্গে কিছু একটার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এতকিছুর পরও আমরা সুখ খুঁজে পাই। জ্যাকসন আমার কাছে এটাই।”
বিচিত্র পরিসংখ্যান, হদিস না পাওয়া অর্থ?
জ্যাকসনের দৈনিক পত্রিকা ক্লারিওন লেজারে স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে উলফ রাজ্যের দরিদ্রদের জীবনসংগ্রাম সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পেয়েছিলেন। সেখানে থাকার সময়েই তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বংশ পরম্পরায় দারিদ্র্য কীভাবে এই জনগোষ্ঠীকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে; জীবনমানের বিভিন্ন মানদণ্ডে এই রাজ্য ধারাবহিকভাবে সর্বনিম্ন অবস্থানে পড়ে থাকে, আর এখনতো দেশটির মধ্যে এই রাজ্যে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি। ২০১৮ সালে অলাভজনক সংবাদ সাইট মিসিসিপি টুডেতে যোগদানের সময় থেকেই তিনি দারিদ্র্য বিট নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, “আমার বিশ্বাস, আমার প্রকাশনাটি স্বতন্ত্র। কারণ আমাদের প্রতিদিন পত্রিকার পাতা ভরতে হয় না, আমরা অনলাইনে থাকি। আর তাই অন্যদের মতো একই ধরনের সীমাবদ্ধতার আমাদের নেই।” উলফ আরও বলেন, বাস্তব মানসম্মত কাজের সক্ষমতার দিক থেকে কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা স্টোরির পেছনে ছোটার মতো ব্যান্ডউইথ থাকাটাই যুগান্তকারী কোনো কাজের জন্য যথেষ্ট।
উলফের সর্বশেষ অনুসন্ধানে একটি বিস্ময়কর পরিসংখ্যান উঠে এসেছে। ক্লারিওন লেজারে কাজ করার সময় তিনি এ সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি দেখতে পান, কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত একটি জনকল্যাণ কর্মসূচিতে নগদ সহায়তার যত আবেদন পড়েছে তার ২% এরও কম রাজ্য সরকার অনুমোদন করছে। তাই উলফ ভাবলেন, প্রতি বছর ওয়াশিংটন থেকে আসা বাকি প্রায় নয় কোটি মার্কিন ডলার কোথায় যাচ্ছে?
গায়েব হওয়া এই টাকা কার পকেটে যাচ্ছে আর কী কাজে লাগানো হচ্ছে, তা খুঁজে বের করতে তিনি সরকারি নথির জন্য একের পর এক আবেদন জানিয়ে গেছেন। প্রত্যুত্তরে তিনি একের পর এক বাধার শিকার হয়েছেন।
অবশেষে তিনি আবিষ্কার করেন, পুরো বিষয়টি ছিল, “দারিদ্র্যপীড়িত মানুষগুলোর পেছনে বিনিয়োগ না করে বরং নিজেদের রাজনৈতিক মিত্রদের পেছনে অর্থ ঢালতে রাজ্যের পক্ষে এক ধরনের সমন্বিত প্রয়াস।”
স্টোরি নিয়ে লেগে থাকা
অনুসন্ধানী স্টোরিটিতে ফিরে গিয়ে উলফ বলেন, সবচেয়ে বড় শিক্ষার একটি হলো নিজের মনের কথা শোনা।
তিনি বলেন, “শুরুতে এক পর্যায়ে সত্যিই আমি খুব সহজ এই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞাসা করছিলাম। তবে প্রাদেশিক সংস্থাগুলোর কাছে মনে হয়েছিল যেন আমি তাদের কাছে পুরো পৃথিবী চাইছি।” ক্রমাগত তিনি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিলেন, আর তার পাওয়া উত্তরের অনেকগুলোই এসেছিল রাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে এবং সেগুলো ছিল দুর্ভেদ্য আইনী ভাষায় লেখা। “সবকিছু মিলিয়ে কর্মসূচির মৌলিক বিষয়গুলো জানাও আমার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।”
উলফ হিসাব করে দেখেছেন, সর্বসাকুল্যে, স্টোরিটি অনুসন্ধানে তিন বছরে, তিনি প্রায় ৩,০০০ ঘন্টা ব্যয় করেছেন। পুরো সময় জুড়ে তিনি কল্যাণ সংস্থায় সোর্স তৈরি করেছেন আর অনুসন্ধান চালিয়ে গেছেন।
উলফ যে প্রাদেশিক কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলছিলেন, তিনি গভর্নর সম্পর্কে একটি তথ্য দেন যা তাঁকে নিয়ে যায় প্রাদেশিক নিরীক্ষকের কাছে। সেখান থেকেই ২০২০ সালে স্টোরিটি নতুন মোড় নেয়। তারপর স্বল্প সময়ের মধ্যে তছরূপের অভিযোগে বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হন, এবং তাদের মধ্যে প্রাদেশিক কল্যাণ সংস্থার সাবেক পরিচালকও ছিলেন।
উলফ জানতেন যে এই গল্পের পরতে পরতে আরও অনেক কিছুই লুকিয়ে আছে। তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, স্টোরিটির দিকে যারা নজর রাখছিলেন তাদের অনেকেই চাইছিলেন… প্রকল্পটিতে সাবেক গভর্নরের ভূমিকা খতিয়ে দেখা হোক।”
উলফের গোপন সোর্স থেকে পাওয়া হাজার হাজার টেক্সট মেসেজ প্রমাণ করে, ২০২০ সালে চাকুরি থেকে ইস্তফা দেওয়া ব্রায়ান্টের হাত ধরে কেলেঙ্কারিটি শুরু হয়। গভর্নরের যোগাযোগের এই সরকারি রেকর্ডগুলো (তথ্য অধিকার আইনে আবেদন সত্ত্বেও যা উলফকে দেওয়া হচ্ছিল না) পরে সাংবাদিকসুলভ জ্যাকপট হিসেবে আবির্ভূত হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল থেকে ৭ কোটি ৭০ লক্ষ মার্কিন ডলারের বেশি অর্থ ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহারে ব্রায়ান্টের সংশ্লিষ্টতার শক্তিশালী প্রমাণ প্রকাশ্যে আনে এই রেকর্ডগুলো।
সুদূরপ্রসারী প্রভাব
উলফের প্রতিবেদন প্রকাশের পর মিসিসিপি ও রাজ্যের বাইরে রীতিমত শকওয়েভ তৈরি হয়। প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের নিরীক্ষকেরা বর্তমানে সম্ভাব্য দুর্নীতির একের পর এক খোসা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। আর এই ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ একজন বিখ্যাত প্রাক্তন পেশাদার খেলোয়াড়ের সংশ্লিষ্টতা থাকায় কল্যাণ তহবিল ও দারিদ্র্য নিয়ে তাঁর অনুসন্ধানটি স্পোর্টস চ্যানেল ইএসপিএন-এর মতো জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতেও সাড়া ফেলে।
ধারাবাহিকটি প্রকাশের ঠিক আগে ব্রায়ান্ট যখন জানতে পারেন যে তার টেক্সট মেসেজ উলফের হাতে, তখন তিনি সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হন। ভাবটা এমন ছিল যেন তিনি “তার আত্মবিশ্বাসী চাহনি” দিয়ে উলফকে কাবু করে ফেলবেন এবং “অভিযোগের হাত থেকে” রেহাই পেয়ে যাবেন। সাক্ষাৎকারটি তিন ঘন্টা স্থায়ী হয়েছিল। উলফ বলেন, ব্রায়ান্টের দাবিগুলো তার নিজের টেক্সট মেসেজের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল।
ব্রায়ান্ট উলফকে বলেছিলেন, “আমার কি এসবের কয়েকটি ধরা উচিত ছিল? অবশ্যই। আমি কি কোনো ভুল করেছি? না। আমি গভর্নর ছিলাম। যদি ধরতে পারতাম, ভালো হত। যখনই চোখে পড়েছে, আমি প্রাদেশিক নিরীক্ষককে ডেকেছিলাম। (এখনও কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তারা তদন্ত করছেন, আর ব্রায়ান্টের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়নি।)
উলফের আশা, এই কেলেঙ্কারি থেকে পাওয়া শিক্ষা কাজে লাগিয়ে মিসিসিপির জনসাধারণের জন্য কীভাবে অর্থ ব্যয় করা যায়, তা নিয়ে আরও ভাল সিদ্ধান্ত আসবে।
উলফ বলেন, “এই প্রকল্পের সময়কাল ছিল চার বছর, আর ঘটনাটির ক্রীড়নকেরা সম্ভবত এখন কারাগারে আছেন। তবে লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল জননীতি, যা জনগণের চাহিদাকে অবমূল্যায়ন করেছে, অথচ তাদের জন্যই ছিল এই প্রকল্প৷ আর সেই মানুষগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েই প্রকল্পটির সংস্কার হতে হবে।”
আরও পড়ুন
#নোটবুকগেট: হাও নাইজেরিয়া’স ডেটাফাইট এক্সপোজড করাপশন ইন গভর্নমেন্ট কন্ট্যাক্টস
টিপস ফর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার্স ফ্রম উইনারস অব দ্য গোল্ডস্মিথ প্রাইজ
হাও এ জার্নালিস্ট গট ৮০,০০০ ইন্সটাগ্রামারস ইন্টারেস্টেড ইন প্রোকিউরমেন্ট ইন কাজাখস্তান
সারাহ কারাকস একজন বার্লিনভিত্তিক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি ইউরোপিয়ান জার্নালিজম অবজারভেটরির ফেলো। তাঁর লেখাপত্র প্রকাশিত হয়েছে সিএনএন, ডের স্পিগেল, দ্য নিউ স্টেটসম্যান ও সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে।