ইন্টারনেট বিজ্ঞাপনের পিছনে কে? অনলাইন বিজ্ঞাপন অনুসন্ধানের কৌশল
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
আপনি কী কখনও ভেবেছেন, বিভিন্ন ওয়েবসাইট কিংবা অ্যাপে আপনার সামনে যে বিজ্ঞাপনগুলো আসে, এর নেপথ্যে কে আছে? প্রোপাবলিকার প্রতিবেদক ক্রেগ সিলভারম্যান এ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অনুসন্ধানের কিছু উপায়ও বাতলে দিয়েছেন।
শুধুমাত্র এ বছরে (২০২৩ সালে), ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের ওপর সিলভারম্যানের করা অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ডানপন্থী ওয়েবসাইটগুলোতে ভুয়া তারকা সেলিব্রিটিদের দিয়ে প্রচারণা চালানো এবং নিজস্ব বিজ্ঞাপন নীতি লঙ্ঘন করার পরও সেখান থেকে গুগলের রাজস্ব সংগ্রহের তথ্য।
বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট বিজ্ঞাপনের আয় ২০২৬ সাল নাগাদ ৭২৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর পূর্বাভাস রয়েছে। এভাবে প্রচুর পরিমাণ অর্থের হাত-বদল হচ্ছে যা বোঝা কঠিন কিংবা বলা যায় ইচ্ছাকৃতভাবেই গোটা ব্যাপারটাকে ঘোলাটে রাখা হয়েছে। ১৩তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে (#জিআইজেসি২৩) সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে সিলভারম্যান বলেন, ডিজিটাল বিজ্ঞাপনগুলো মূলত জালিয়াতি, কেলেঙ্কারি, অপচয় আর প্রতারণায় ভরা। “এদিকে নজর দেওয়া জরুরী।” তিনি আরো বলেন “ব্যবস্থাটাই এমনভাবে নকশা করা যেন মানুষ তার অর্থ এবং সেটি কোথায় খরচ হবে তা লুকোনোর সুযোগ করে দেয়, যা উচিত নয়।”
ডিজিটাল বিজ্ঞাপন সম্পর্কে জানুন
বিভিন্ন ধরনের অনলাইন বিজ্ঞাপন এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যবসায়িক সম্পর্ক নিয়ে বোঝাপড়া তৈরিটা হতে পারে একটি ভাল সূচনা বিন্দু। ওয়েবসাইটগুলোতে ব্যানার বিজ্ঞাপন কিংবা কোনো সংবাদ সাইটের কোনো নিবন্ধের মধ্যে থাকা প্রচারণাটি একটি ভালো প্রোগ্রাম্যাটিক বিজ্ঞাপন (প্রোগ্রাম্যাটিক অ্যাড) হতে পারে। এ ধরনের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে, ব্র্যান্ডগুলো কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রকাশনাতে প্রদর্শিত হওয়ার পরিবর্তে সরাসরি দর্শকদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে৷
প্রোগ্রাম্যাটিক বিজ্ঞাপন বিক্রয় হয় মিলিসেকেন্ড হিসেবে, এর অর্থ বিজ্ঞাপন কোথায় প্রদর্শিত হবে সে সম্পর্কে ব্র্যান্ডগুলোর কোনো ধারণা নাও থাকতে পারে। “যদি আপনি ভালো পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন তবে হাজার হাজার অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে প্রচারণা চালাতে পারেন,” তিনি ব্যাখ্যা করেন। গল্পের শুরুটা হতে পারে অপ্রচলিত বা বিতর্কিত কোনো প্লাটফর্মে কোনো ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন থেকে।
নেটিভ বা কনটেন্ট বিজ্ঞাপনগুলো প্রায়ই ট্যাবুলা বা আউটব্রেইনের মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্লিকবেইট কনটেন্ট হিসেবে পরিবেশিত হয়, যা অনলাইনে কোনো নিবন্ধের শেষে বিজ্ঞাপন হিসেবে আসে। এ বিজ্ঞাপনগুলোর ক্ষেত্রে, যখন কোনো ওয়েবসাইট ব্যবহারকারী এটাতে ক্লিক করেন তখনই অর্থ যোগ হয়।
একটি পৃষ্ঠায় একটি বিজ্ঞাপন দেখার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আপনি বেশ ভালো পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন, সিলভারম্যান বলেন। ডিসপ্লে অ্যাড বিজ্ঞাপনে সাধারণত ত্রিভুজ আকৃতির অ্যাডচয়েজ মার্ক বা একটি তথ্য আইকন থাকে, এর মাধ্যমে আপনি দেখতে পারেন বিজ্ঞাপনটি কোন নেটওয়ার্ক বা প্ল্যাটফর্মের। নেটিভ বিজ্ঞাপন সাধারণত লোগো প্রদর্শন করবে, যার মাধ্যমে আপনি জেনে যাবেন বিজ্ঞাপনটির সঙ্গে কোন প্ল্যাটফর্মটি জড়িত।
সরাসরি বিজ্ঞাপন (যে বিজ্ঞাপনগুলো সরাসরি একটি ব্র্যান্ড থেকে আসে) এবং অ্যাফিলিয়েট বিজ্ঞাপন (যেখানে তৃতীয় পক্ষ এটি বিক্রয় বা প্রচার করার লিঙ্কে ক্লিক করার জন্য কমিশন পায়) শনাক্তের জন্য বিজ্ঞাপনের ওপর কার্সর রাখুন এবং লিঙ্ক করা ইউআরএল দেখুন। এটি আপনাকে প্রোগ্রামেটিক বিজ্ঞাপন শনাক্ত করতেও সাহায্য করবে, যেমন এটি ইউআরএল-এ গুগল লেখা দেখানো।
অ্যাফিলিয়েটস সম্পর্কে জানুন
মিথ্যা স্বাস্থ্য পণ্য ও সেবাসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে প্রতারণা চলছে অ্যাফিলিয়েট বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে, সিলভারম্যান ব্যাখ্যা করেন। প্রতিটি অ্যাফিলিয়েটের একটি আইডি নম্বর থাকে, যা সাধারণত অ্যাফিলিয়েট বিজ্ঞাপনের লিঙ্কে দেখানো হয়— কখনও কখনও আপনি সরাসরি বিজ্ঞাপনের ইউআরএলও এটি দেখতে পারেন, যার মানে কোনো অ্যাফিলিয়েট বা সহযোগীর মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে। এটি আপনাকে কোনো চুক্তি বা কেলেঙ্কারিতে জড়িত সহযোগীদের ট্র্যাক করতে সাহায্য করবে।
ভুয়া স্বাস্থ্যসেবা বা ক্রিপ্টো স্কিমের বিজ্ঞাপনসহ অ্যাফিলিয়েট বিপণনকারীদের কাছে অফার করা বিভিন্ন পণ্য দেখতে সাংবাদিকরা অ্যাফব্যাংক (Affbank) বা ক্লিকব্যাংক (ClickBank) ব্যবহার করতে পারেন।
অ্যাডস.টিএক্সটি-এ প্রবেশ করুন
মেটা, গুগল এবং টিকটকের বিজ্ঞাপন লাইব্রেরিগুলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য একটি ভাণ্ডার।
অ্যাডস.টিএক্সটি হচ্ছে একটি টেক্সট ফাইল যা প্রকাশকরা তাদের সার্ভারে রাখেন এবং এতে পণ্য বা পরিষেবা বিক্রির জন্য অনুমোদিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তালিকা থাকে। এটি এই খাতের একটি নিজস্ব ও স্বেচ্ছামূলক মানদণ্ড। অ্যাডস.টিএক্সটি ব্যবহার করে না এমন সাইটগুলোর সঙ্গে গুগলের মতো বিজ্ঞাপন প্ল্যাটফর্মের কাজ করার কথা নয়।
ওয়েবসাইটের ডোমেন নামের সঙ্গে “অ্যাডস.টিএক্সটি” যোগ করে যা পাওয়া যেতে পারে। একজন প্রকাশকের অ্যাডস.টিএক্সটি ফাইল তার সঙ্গে বিজ্ঞাপনদাতার সম্পর্কের প্রকৃতির সম্পর্কে বিশদ বিবরণ তুলে ধরে, উদাহরণস্বরূপ তারা সরাসরি বিজ্ঞাপনদাতা কিনা বা অন্য কারো হয়ে বিজ্ঞাপন পুনরায় বিক্রি করছে কিনা আপনি এ ধরনের তথ্য জানতে পারবেন। কেননা বিজ্ঞাপন চেইনের এই লিঙ্কগুলোর প্রতিটির নিজস্ব আইডি থাকবে।
বিজ্ঞাপন নেটওয়ার্কেরও তাদের নিজস্ব বিজ্ঞাপনদাতাদের তালিকা প্রকাশের কথা, যা তাদের অ্যাডস.টিএক্সটি ফাইলে প্রকাশিত প্রকাশকদের তালিকাভুক্তদের সঙ্গে মেলে। যদি এই দুটি তালিকার মধ্যে অমিল থাকে তবে তা একটি সূত্র হতে পারে, সিলভারম্যান বলেন। যেমন, স্ক্যামাররা বিজ্ঞাপন নেটওয়ার্কে গার্ডিয়ান এবং ফিনান্সিয়াল টাইমস হওয়ার ভান করে প্রকাশকদের কাছ থেকে বিজ্ঞাপনের রাজস্ব চুরি করেছে।
ওয়েল-নোন সাইটটি অ্যাডস.টেক্সট ডেটাকে সরল ও কাঠামোগতভাবে উপস্থাপন করে এবং ফ্রি অ্যাকাউন্টসহ সাংবাদিকদের বিক্রেতা ও বিজ্ঞাপনদাতা আইডি ও অন্যান্য বিজ্ঞাপন ডেটা অনুসন্ধানের সুযোগ দেয়। কোনো প্রকাশক বা বিজ্ঞাপনদাতা অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে কোন অ্যাপ বা অন্যান্য সাইটের সঙ্গে কাজ করছে তা ম্যাপ করার একটি ভাল উপায়। “এটি তাদের ব্যবসায়িক মডেলের একটি উন্মুক্ত দরজা,” বলেন সিলভারম্যান, যিনি তার কর্মশালায় ওয়েল-নোন কীভাবে আরো ভালোভাবে ব্যবহার করা যায় তা বিভিন্ন উদাহরণসহ তুলে ধরেন।
বিজ্ঞাপন প্ল্যাটফর্মের নীতিগুলো পড়ুন
সিলভারম্যান বলেন, মেটা, গুগল ও টিকটকের বিজ্ঞাপনের নিয়মগুলো সম্পর্কে জানার পর তা আপনাকে অপ্রদর্শিত বিজ্ঞাপনগুলো সনাক্ত করতে সহায়তা করবে। উদাহরণস্বরূপ, গুগলের নির্দিষ্ট কনটেন্ট সম্পর্কে নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে, যেমন তারা জলবায়ু, স্বাস্থ্য এবং নির্বাচন সম্পর্কিত মিথ্যা দাবি সম্পর্কিত আধেয়তে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করে না।
বিজ্ঞাপন প্ল্যাটফর্মের নীতি লঙ্ঘনের ওপর ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রোপাবলিকা, যার মধ্যে রয়েছে কোভিড-১৯ সম্পর্কিত মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করা ওয়েবসাইটগুলোর বিজ্ঞাপন থেকে পাওয়া আয় সম্পর্কিত ঘটনাও।
বিজ্ঞাপন লাইব্রেরিগুলো দেখুন
মেটা, গুগল এবং টিকটকের বিজ্ঞাপন লাইব্রেরিগুলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য তথ্যের ভান্ডার। এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রদর্শিত বিজ্ঞাপনগুলো মূলত অনুসন্ধানযোগ্য ডেটাবেস। প্ল্যাটফর্মের স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিশ্রুতি মেনে চলার জন্য বিজ্ঞাপনগুলো দীর্ঘ সময়ের জন্য আর্কাইভ হতে পারে- কিছু ক্ষেত্রে সাত বছর পর্যন্ত- লাইব্রেরিতে টার্গেটিং ডেটা পাওয়া যেতে পারে।
একটি প্রচারণা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য বিজ্ঞাপনগুলো বিজ্ঞাপন লাইব্রেরি থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। “আপনাকে পদ্ধতিগতভাবে এই লাইব্রেরিগুলো দেখতে হবে এবং অনুসন্ধান চালাতে হবে,” সুপারিশ করেন সিলভারম্যান। “একটি বিজ্ঞাপন মাত্র একদিনের জন্য চলতে পারে।”
মেটার বিজ্ঞাপন লাইব্রেরি আপনাকে দেশ ও বিজ্ঞাপন বিভাগ (যেমন রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন) অনুসারে বিজ্ঞাপনগুলো ফিল্টার করতে এবং কীওয়ার্ড ধরে অনুসন্ধান করতে দেয়। অনুসন্ধানটি ইনস্টাগ্রাম এবং ফেসবুক বিজ্ঞাপন উভয় ক্ষেত্রেই কাজ করে। গুগলের বিজ্ঞাপন লাইব্রেরি কীওয়ার্ড অনুসন্ধানের অনুমতি দেয় না, তবে চিত্র, পাঠ্য ও ভিডিও বিজ্ঞাপনের ফলাফল প্রদান করবে। ফলাফল যাচাইকৃত বিজ্ঞাপনদাতাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে, এটি একটি স্বেচ্ছামূলক প্রক্রিয়া। সিলভারম্যান বলেন, “সন্দেহজনক কোনো বিজ্ঞাপনদাতা এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে চাইবে না। তাই এটি লাইব্রেরিতেও প্রদর্শিত হবে না।
টিকটকের নীতি অনুসারে তারা রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন গ্রহণ করে না, তবে প্রভাবশালীরা বার্তা প্রচারের জন্য রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করার ঘটনা ঘটেছে। এর বিজ্ঞাপন ডেটাবেসে কীওয়ার্ড দিয়ে অনুসন্ধান করা যায়। প্ল্যাটফর্মটি বিপণনকারীদের জন্য দরকারী বিভিন্ন টুলও সরবরাহ করে যা সাংবাদিকরা দেশ বা বিষয় অনুসারে প্রবণতা বা জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনগুলো দেখতে ব্যবহার করতে পারেন।
আরও কিছু টুল
- অ্যাডবিট: এটি ওয়েবসাইটে (সীমিত ফ্রি সংস্করণ) চালানো বিজ্ঞাপনগুলো দেখতে সাহায্য করে। দ্রষ্টব্য: এটিতে মার্কিন এবং পশ্চিমা পক্ষপাত আছে।
- ব্ল্যাকলাইট: মার্কআপের এই টুল একটি ওয়েবসাইটে চলমান বিজ্ঞাপন ট্র্যাকিং দেখাতে পারে।
- ক্রেগ সিলভারম্যানের নিউজলেটার
- অ্যাডঅ্যানালিটিকস.আইও এবং চেকমাইঅ্যাডস.ওআরজি: গবেষণা ওয়েবসাইট অ্যানালিটিক্স এবং অ্যাডভোকেসি সাইট চেকমাইঅ্যাডস ডিজিটাল বিজ্ঞাপন নিয়ে নিজেরাই অনুসন্ধান করে এবং টুল ও ডেটার সন্ধান দেয়।