জিআইজেসি২৫ সম্মেলনের একটি সেশনে বক্তারা। ছবি: আলিয়া আবদুল আজিজ আলহাজরি
কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে নিরাপদ রাখতে পাঁচ পরামর্শ
বিশ্বে স্বৈরশাসন বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে ঝুঁকে পড়া রাষ্ট্রের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্রমশ হুমকির মুখে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতেও নিরাপদে রিপোর্টিং চালিয়ে যাওয়ার উপায় আছে বলে মত দিয়েছেন অভিজ্ঞ রিপোর্টার আর সম্পাদকেরা।
হাঙ্গেরি ও তিউনিশিয়া থেকে শুরু করে ভারত ও এল সালভাদর—গত এক দশকে বহু দেশেই গণতন্ত্রের অবক্ষয় হয়েছে। ফলে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণের সংখ্যা বেড়েছে। বেআইনি মামলা, কর কর্তৃপক্ষের হয়রানি, অপবাদ ছড়ানো—সব মিলিয়ে চাপ বাড়ছে ক্রমশ। ১৪তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে (জিআইজেসি২৫) “দ্য অথরিটারিয়ান শিফট: ইনভেস্টিগেটিং অ্যামিডস্ট আ ডিক্লাইন ইন ডেমোক্রাসি” শিরোনামের এক সেশনে চারজন সাংবাদিক ব্যাখ্যা করেছেন, এমন পরিস্থিতিতে টিকে থাকা ও লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য তারা কোন কৌশলগুলো ব্যবহার করেন।
সালভাদরের লেখক ও নৃবিজ্ঞানী হুয়ান হোসে মার্তিনেস দ’অবুইসঁ বলেন, “এটা এক ধরনের ইঁদুর-বিড়াল খেলা, যেখানে সাংবাদিকরা ক্রমাগত একনায়কতন্ত্রকে ছাপিয়ে যেতে এবং এর হাত থেকে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করে। আমরা সবসময় এই খেলায় জিতি না, কিন্তু খেলাটা চালিয়ে যেতেই হয়।” হুয়ান হোসে একাধারে ইনসাইট ক্রাইম প্ল্যাটফর্মের একজন কনট্রিবিউটরও।
জিআইজেসি২৫-এর ওই আলোচনা থেকে এখানে পাঁচটি পরামর্শ তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে যেসব দেশে গণতন্ত্র হুমকির মুখে, সেসব দেশে থেকে কীভাবে আপনি আপনার অনুসন্ধান চালিয়ে যাবেন—এবং কারাগারে ঢোকা এড়াবেন—তার কিছু উপায় বাতলে দেওয়া হয়েছে।
১. প্রমাণের সাহায্যে নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন
একটি অতিজরুরী পরামর্শ যেটির পুনরাবৃত্তি করা উচিত, তা হচ্ছে আপনার প্রতিটি দাবিকে নথি ও তথ্য দিয়ে সমর্থন করুন এবং সবকিছু যাচাই করুন, বলেন আলোচকরা। এটি যে কোনো আদালতকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে আপনাকে সাহায্য করবে এবং আপনার সুনাম রক্ষা করবে।
তবে এই পরামর্শটির ক্ষেত্রে ধরে নেয়া হয় যে, আপনি যেখানে থেকে রিপোর্টিং বা প্রকাশনা করছেন সেখানে বিচারব্যবস্থা কার্যকর আছে। তবু এমন পরিস্থিতিতেও, অকাট্য প্রমাণের সঙ্গে শক্তিশালী অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করা আপনাকে সুরক্ষা দেবে।
“আমরা তথ্যের ভিত্তিতে সিস্টেমকে তুলে ধরতে লড়াই করি,” বলেন তিউনিশিয়ার বার্তাকক্ষ ইনকিফাদা-এর প্রকাশনা পরিচালক মালেক খাদ্রাউই।
২. নিজেকে এবং আপনার সোর্সকে সুরক্ষিত করুন
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—নিজেকে এবং আপনার সোর্সকে সুরক্ষা দেওয়া। এটি একক কোনো নিয়ম অনুসরণ করে করা সম্ভব নয়—প্রতিটি স্থানীয় প্রেক্ষাপটে সামঞ্জস্য করে কৌশল বদলাতে হবে, বলেন মার্তিনেস দ’অবুইসঁ। প্রতিটি সোর্সকে আলাদা করে বিবেচনা করুন এবং সে অনুযায়ী কৌশল পরিবর্তন করুন। মনে রাখবেন, পেগাসাস স্পাইওয়্যারের মতো নজরদারি টুল আপনার ফোনে প্রভাব ফেলতে পারে। তাই নিরাপদ মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার করলেও কী তথ্য আদানপ্রদান করছেন সে বিষয়ে সতর্ক থাকুন।
নিজেকে সুরক্ষিত রাখার বিষয়ে সাংবাদিকদের সচেতন থাকা উচিত। কেননা আক্রমণ বিভিন্ন দিক থেকে আসতে পারে। বক্তারা বলেন, স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোতে বা যেখানে গণতন্ত্রের অবনতি ঘটছে, সেখানে সাংবাদিকদের হয়রানি করার জন্য কর নিরীক্ষা, প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা এবং কুৎসা বা অপবাদ ছড়ানো সাধারণ ঘটনা।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেশের ভেতর থেকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না, কারণ এতে জেল বা শারীরিক আক্রমণের ঝুঁকি থাকতে পারে। প্রয়োজন হলে, জেল বা শারীরিক হুমকি এড়াতে নির্বাসনে থেকে কাজ করার কথা ভাবতে পারেন, বলেন মার্তিনেস দ’অবুইসঁ।
“আমি সহ— এল সালভাদরে সাংবাদিকদের ৯০ শতাংশই নির্বাসিত,” বলেন তিনি।
৩. মিথ্য তথ্যের মোকাবিলা করুন কৌশলের সঙ্গে
বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে মিথ্যা তথ্য প্রচারের ঘটনা ঘটছে। কিছু প্রেক্ষাপটে, সমন্বিত মিথ্যা তথ্য প্রচারের নেপথ্যের নেটওয়ার্কগুলো খুঁজে বের করা সহায়ক হতে পারে, বলেন ইনকিফাদা’র খাদ্রাউই। এটি শাসকতন্ত্রের কাজের ধরন এবং সম্ভাব্য সংযোগ উদঘাটনে সাহায্য করে।
ইনকিফাদা দল মিথ্য তথ্য প্রচার করা বিষয়ক আগের একটি অনুসন্ধানের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এমন অ্যাকাউন্টগুলোর ওয়েবপেজ স্ক্র্যাপ করেছিল যে অ্যাকাউন্টগুলো দেখতে প্রায় একই রকম বা অভিন্ন ছিল। তারপর তাদের মালিকানা খুঁজে বের করা, স্প্রেডশিট তৈরি করা এবং নতুন পেজ ও সংযোগগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়, যাতে সমন্বিত মিথ্যা তথ্য প্রচার বিষয়ক কর্মকাণ্ডগুলো কীভাবে করা হয়, তা দেখানো যায়।
“উত্তম সমাধান হলো লড়াই করা, জোরালো প্রমাণ হাজির করা আর অনুসন্ধান চালানো,” তিনি বলেন।
অন্য ক্ষেত্রে, সরাসরি মিথ্যা তথ্য প্রচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রায় অসম্ভব, বলেন স্বাধীন নিউজ আউটলেট ডিরেক্ট৩৬-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক আন্দ্রাস পেতো। তিনি বলেন, উদাহরণ হিসেবে হাঙ্গেরির কথা বলা যায়—সেখানে রাশিয়ান মিথ্যা তথ্য প্রচার সরকারি বক্তব্যের সঙ্গে হুবহু মিলে গিয়েছিল, তাই এর জবাব দেওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। ডিরেক্ট৩৬ দল তাই সরাসরি মিথ্যা তথ্য নিয়ে পাল্টা প্রতিবেদন করার বদলে সঠিক তথ্য প্রকাশ করাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়।
“আপনার বাড়ির পানির লাইন থেকে যখন দূষিত পানি বের হয়, কিন্তু সরবরাহ লাইনের পাইপের ওপর আপনার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তখন সত্যিই আপনি পানির দূষণ দূর করতে পারবেন না,” পেতো বলেন। “তবে আপনি যেটা করতে পারেন তা হলো লাইনে বেশি পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি প্রবাহিত করা এবং সমস্যা কিছুটা কমানো।”
কখনও কখনও সাংবাদিকরা বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা, সরাসরি মিথ্যা তথ্য ও অপপ্রচার বিষয়ক প্রচারণার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন।
নির্বাচন, দুর্নীতি এবং কাঠামোগত নিপীড়ন নিয়ে প্রতিবেদন তৈরিতে অভিজ্ঞ অনুসন্ধানী সাংবাদিক পুনম আগরওয়াল। তিনি বলেন—এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো কৌশল হলো প্রলুব্ধ না হওয়া। ট্রলকারীরা প্রতিক্রিয়া খুঁজে, তাই সরাসরি যুক্ত হওয়া এড়িয়ে চলা উচিত এবং তারা তাদের নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত। হয়রানি কিছু দিন স্থায়ী হতে পারে, কিন্তু ট্রলকারীদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া কেবল তাদের প্রচারণাকে উদ্দীপ্ত করবে।
সতর্ক করে তিনি বলেন, “তারা সাংবাদিকের মনোযোগ কাড়তে চায়। ভুলবেন না, তাদের বেতন দেওয়া হয়েছে। তাই তারা কিন্তু মূলত তাদের কাজ করছে। তাদের এই কর্মকাণ্ডের বিপরীতে আপনি যত কম যোগাযোগ করবেন, তত আপনার মানসিক শান্তি বজায় থাকবে।”
৪. আপনার আর্থিক উৎসগুলো বৈচিত্র্যপূর্ণ করুন
সরকারগুলোর জন্য বার্তাকক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগের সবচেয়ে সহজ উপায় হলো তাদের আর্থিক সংস্থান, আয় বা আয়ের টেকসই উৎসগুলোর বিপরীতে হুমকি তৈরি করা। হাঙ্গেরিতে যেমন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান ঐতিহ্যবাহী গণমাধ্যমগুলোর দখলে নিয়েছেন, বলেন ডিরেক্ট৩৬-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা পেতো।
আপনি যতটা সম্ভব বিজ্ঞাপন থেকে বা অন্য কোনো উৎসের ওপর নির্ভরশীল না হওয়ার চেষ্টা করুন, যা সরকার দ্বারা সীমিত করা হতে পারে। পেতো বলেন, ডিরেক্ট৩৬-এর ক্ষেত্রে, একটি সদস্য মডেল কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। সদস্যদের কাছ থেকেই আউটলেটটির আয়ের ৭৫ শতাংশের বেশি আসে।
ইনকিফাদা’র খাদ্রাউইও এই ধারণাকে সমর্থন করেছেন। বার্তাকক্ষের ওপর চাপ কমাতে তিনি এবং তার সহকর্মীরা তিউনিশিয়ার বাইরে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। যা নির্বাসিত সাংবাদিকদের সহায়তা করতে পারে এবং তিউনিশিয়ার প্রবাসী সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আর্থিক সমর্থন সংগ্রহ করতে পারে।
৫. সহযোগিতা করুন, সহযোগিতা করুন, সহযোগিতা করুন
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সময়সাপেক্ষ হতে পারে—তবু এটি অবশ্যই মূল্যবান, ব্যাখ্যা করেন খাদ্রাউই। আন্তর্জাতিক বার্তাকক্ষগুলো হুমকির মুখে আপনাকে সহায়তা করতে পারে এবং ঝুঁকি ভাগ করতে সাহায্য করে। আপনার নিজের দেশে যদি প্রকাশনা করাটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়, তবে বিদেশী অংশীদারদের কাছে দেওয়ার বিষয়টা বিবেচনা করতে পারেন। “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো গল্পটি পৌঁছে দেওয়া,” তিনি বলেন।
নিজেকে এবং আপনার কাজকে সুরক্ষিত রাখতে, অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা এবং নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত থাকাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। “যদি কখনও প্রয়োজন পড়ে, তারা আপনাকে বাঁচাতে পারে,” তিনি যোগ করেন।