নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোসেফ স্টিগলিৎজ (ডানে)। ছবি: জাহিদ হাসান।
সাংবাদিকদের আর্থিক ব্যবস্থার যে খাতগুলো নিয়ে অনুসন্ধান করতে বললেন এই নোবেলজয়ী
বিশ্বের দক্ষিণ অংশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ-সম্পদকে সুরক্ষা দেওয়া পশ্চিমা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান আর এজন্য তাদের সহায়ক নিয়মগুলো নিয়ে গভীর অনুসন্ধানের জন্য সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী জোসেফ ই স্টিগলিৎজ।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার অধ্যাপক শিলা করোনেলের পরিচালনায় ১৪তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সের (জিআইজেসি২৫) গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় স্টিগলিৎজ বর্ণনা করেন, কীভাবে কিছু খারাপ চরিত্রের ব্যক্তিরা নিয়ম, অর্থনৈতিক মডেল এবং বৈষম্যের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ভুল ধারণাকে কাজে লাগিয়ে সুবিধা পান।
মালয়েশিয়া ও মোজাম্বিকের সাম্প্রতিক দুর্নীতিকাণ্ডে বড় ব্যাংকগুলোর ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন তিনি। নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “দেশগুলোর ওপর দুর্নীতির দায় চাপানো সহজ, কিন্তু যখন অর্থ চুরি করা হয়, তখন সেগুলো কোথাও না কোথাও তো রাখতে হয়—যেমন ধনী দেশে। এই তথাকথিত নির্ভরযোগ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোই আসলে দুর্নীতিকে সহজ করে দিচ্ছে। অথচ এর জন্য সামান্যতম শাস্তির বাইরে তাদের আর তেমন কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। আমাদের এমন একটি বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো আছে, যা মালয়েশিয়া ও মোজাম্বিকের মতো জায়গা থেকে অর্থ সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেয়। সেগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে সাদা করার পথ খুলে দেয়। কর স্বর্গ কেবল শুধু অফশোর নয়— লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, ফ্লোরিডার মতো জায়গাতেও এই ব্যবস্থা আছে। অনশোরেও একইভাবে এটা হচ্ছে।”
স্টিগলিৎজ, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ। তিনি আরও বলেন: “নিয়ন্ত্রকদের শেখার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। একসময় আমরা বলতাম—ব্যাংকগুলো এত বড় বা এত সংযুক্ত যে তাদের ধ্বসে পড়ার সুযোগ নেই। কিন্তু আমার মনে হয়, এই বড় ব্যাংকগুলো সম্ভবত এতটাই বিশাল যে সেগুলো পরিচালনা করাটাই কঠিন। বড় ব্যাংক ও হিসাবরক্ষক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে তাদের সব শাখা-প্রশাখায় কী ঘটছে তা বোঝা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।”
তিনি আরো বলেন, পশ্চিমা নীতিমালা ও নিয়মকানুনের ওপর নতুন করে নজর দেওয়া জরুরি। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন— ১৯৯০-এর দশকের গুরুত্বপূর্ণ কিছু আর্থিক সিদ্ধান্তের জের ধরে বর্তমান অলিগার্ক শ্রেণি ও ইউক্রেন যুদ্ধের যোগসূত্র বের করা সম্ভব।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “রাশিয়ার বাজারভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরের ব্যর্থ চেষ্টাই আমাদের পুতিন আর ইউক্রেন যুদ্ধের দিকে নিয়ে গেছে। এর জন্য আমি দায় দিই আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) ও যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগকে। এর সবই নিয়ম-কানুনের কারণে ঘটেছে। তাদের কী কী ভুল ছিল? তারা বলেছিল, ‘চলো একটা বাজারভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলি — শক থেরাপি — এবং সব নিয়ন্ত্রণ তুলে দিই; মূলধন রাশিয়া থেকে সারা বিশ্বের মধ্যে অবাধে প্রবাহিত হোক।’ তারা ভেবেছিল, ব্যক্তির কাছে সম্পদ তৈরির সুযোগ আসলে, তারা রাশিয়াতে ভালো নিয়ম তৈরির জন্য উৎসাহিত হবে।
কিন্তু আমি তখনই বলেছিলাম: ‘ওরা সবাই তাদের অর্থ পশ্চিমে নিয়ে যাবে, যেখানে তা নিরাপদ, আর রাশিয়ার ভেতরে তারা চুরি-লুট চালিয়েই যাবে।’
স্টিগলিৎজ উল্লেখ করেন, সিক্রেসি জুরিসডিকশন—যেসব জায়গায় বড় ধরনের দুর্নীতির অর্থ লুকিয়ে রাখা হয়, যেমন কেইম্যান আইল্যান্ডস ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস—এসবের অস্তিত্ব থাকাটা জরুরি নয়। তিনি বলেন, সাংবাদিকদের প্রশ্ন করা উচিত কেন এগুলোকে আজও আগের মতো চলতে দেওয়া হচ্ছে। স্টিগলিৎজ বলেন, “যদি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ঘোষণা করে যে তাদের ব্যাংকগুলো এসব গোপন কর স্বর্গগুলোর (ট্যাক্স হ্যাভেন) সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখতে পারবে না, তাহলে এগুলো একেবারেই হারিয়ে যাবে।” তিনি ইঙ্গিত দেন—এই পরিবর্তন আনতে সাংবাদিকরাও ভূমিকা রাখতে পারে।
তার মতে, সাংবাদিকদের এমন সব আধুনিক প্রথাকেও চ্যালেঞ্জ করা উচিত, যেগুলো আমরা স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছি। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন: “আমার কাছে এটি খুবই অগ্রহণযোগ্য ও লজ্জাজনক যে সরকারি কর্মকর্তারা তাদের সরকারি বিবৃতি বা ঘোষণা প্রচারের জন্য এক্স (টুইটার) ব্যবহার করেন। এর জন্য অবশ্যই সরকারি মাধ্যম থাকা উচিত। আমরা যদি দাবি করতাম যে সব সরকারি ঘোষণা সরকারি কোনো প্ল্যাটফর্মেই প্রকাশ করতে হবে, তাহলে আমরা নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে সহায়তা করতাম—যা বিদ্যমান বাণিজ্যিক প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রভাব কমিয়ে দিত, যেগুলোর দুর্নীতি ও ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে আমরা ভালোভাবেই জানি।”
স্বাধীন গণমাধ্যম ও জনস্বার্থ
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে মেধাস্বত্বের ব্যাপক চুরি স্বাধীন গণমাধ্যমের ব্যবসায়িক মডেলকে ধ্বংস করে দিয়েছে—এবং একই ধরনের আরও ভয়াবহ চুরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ঘটলে যে সামান্য আয়ের উৎস এখনো টিকে আছে, সেটাও প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এই লুট থামাতে সম্ভাব্য সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। শেষ পর্যন্ত তিনি যুক্তি দেন—যেহেতু অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা অপরিহার্য জনস্বার্থমূলক সম্পদ— তাই, সাংবাদিকতার জন্য জনসমর্থনের ব্যবস্থা তৈরি করা প্রয়োজন।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, “অর্থনীতির স্বভাবই এমন যে, এটি জনস্বার্থমূলক কোনো কাজে ব্যক্তিগত খাতের অর্থায়নের ওপর নির্ভর করতে পারে না। আর যদি আমাদের কাছে উন্নত জবাবদিহিতা ও সুশাসন থাকে, সেক্ষেত্রে সবাই উপকৃত হবে। গবেষণার জন্য আমরা সরকারি সমর্থন দিয়ে থাকি। ট্রাম্পের আগের সময়ে আমরা এমন কিছু স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলাম, যারা ন্যায়সঙ্গত ও কার্যকর উপায়ে তহবিল বরাদ্দ করত — অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও ঠিক একইভাবে তা করা যেতে পারে।”
স্টিগলিৎজ প্রস্তাব করেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা যখন জটিল বা অপরিচিত আর্থিক বিষয় নিয়ে কাজ করেন তখন ব্যবসা বিটের সহকর্মীদের প্রশ্ন করার পরিবর্তে ব্যাকগ্রাউন্ড সোর্স হিসেবে অর্থনীতিবিদদের ব্যবহার করুন। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, কেননা তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের বিটে করপোরেট বয়ানের প্রভাবের মধ্যে “আটকে” থাকতে পারেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, ২০২৩ সালে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতনের ঘটনায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা নতুন ও শক্তিশালী অন্তর্দৃষ্টি তুলে ধরেছিলেন।
তিনি বলেন, “আমরা একটি বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পতন দেখেছি: যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক স্টার্টআপকে অর্থায়ন করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একক ব্যাংক।” তিনি ব্যাখ্যা করেন, “এখানে অনুসন্ধানী রিপোর্টিং দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রথমত, তারা দেখিয়েছে যে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক কোম্পানির আমানত নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে লিপ্ত ছিল। আমাদের অধিকাংশ মানুষদের হাতে ওতটা সময় নেই যে তারা গিয়ে খোঁজ নেবে ব্যাংকটি তার অর্থ দিয়ে আসলে করছেটা কী। কিন্তু অনুসন্ধানী রিপোর্টাররা বিষয়টি খতিয়ে দেখেছেন। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি তারা করেছিল, সেটি হলো প্রশ্ন তোলা—নিয়ন্ত্রক কাঠামো বা নিয়ন্ত্রকের পরিচালনায় কোনো সমস্যা আছে কি না? তারা জানতে পেরেছিলেন, হ্যাঁ: সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক ওই নিয়ন্ত্রক সংস্থার বোর্ডে ছিল, যাদের মূলত সিলিকন ভ্যালি ব্যাংককে তদারকি করার কথা।
তবে তিনি এটা বলে সতর্ক করেছেন যে, কর্পোরেট প্রচারণা বা “ভাড়াটে পুঁজিবাদের প্রচলিত বয়ান” বারবার পুনরাবৃত্তি করে গণমাধ্যমও ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
তিনি বলেন, “আপনি শুনবেন: ‘যুক্তরাষ্ট্র উদ্ভাবন করে; চীন নকল করে; ইউরোপ নিয়মকানুন তৈরি করে’—এটি ইউরোপের সমালোচনা করতে গিয়ে বলা হয়। সম্ভবত ভালো হবে যদি আমরা ভাবি ‘যুক্তরাষ্ট্র শোষণ করে’—এবং ইউরোপকে এভাবে দেখা—তারা নিশ্চিত করতে চায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমগ্র সমাজের উপকারে কাজ করছে।”
শিলা করোনেল তাকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট গল্পের ধারণা দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে, স্টিগলিৎজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বিষয়গুলো প্রস্তাব করেন: “এখন চীন ও কেইম্যান আইল্যান্ডসের মধ্যে নানা কর্মকান্ড চলছে, এবং দক্ষিণ এশিয়ায়, মরিশাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এবং আমার সন্দেহ, এখানে কিছু ঘটছে। ভারত থেকে অর্থ মরিশাসে যাচ্ছে এবং আবার ভারতে ফিরে আসছে। এই ঘুরে আসার কারণটা কী?”
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএন এর গ্লোবাল রিপোর্টার এবং ইমপ্যাক্ট এডিটর। দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসের প্রাক্তন প্রধান প্রতিবেদক, তিনি বিশ্বের দুই ডজনেরও বেশি দেশের সংবাদ, রাজনীতি, দুর্নীতি এবং সংঘাতের বিষয়ে রিপোর্ট করেছেন এবং যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আফ্রিকার নিউজরুমগুলির অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
