র্যাপলার সিইও ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মারিয়া রেসা জিআইজেসি২৫-এ বক্তব্য দিচ্ছেন। ছবি: সুজান লি
মিথ্যাচার রোধ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় “প্রয়োজন তুমুল সহযোগিতা”- জিআইজেএন সম্মেলনে নোবেলজয়ী মারিয়া রেসা
আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:
২০২১ সালে শান্তিতে নোবেলজয়ী এবং পথপ্রদর্শক অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম হিসেবে খ্যাত র্যাপলারের সহপ্রতিষ্ঠাতা মারিয়া রেসা মালয়েশিয়ায় চলমান ১৪তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সের (জিআইজেসি২৫) উদ্বোধনী বক্তৃতায় শক্তিশালী এক আহবান জানান। তীব্র আক্রমণ বা দমন-পীড়নের সম্মুখীন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সম্প্রদায়কে ‘র্যাডিক্যাল কোল্যাবোরেশন’ বা তুমুল সহযোগীতার ধারণাকে গ্রহণ করার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, সংকট থেকেই প্রভাব বিস্তার ও টিকে থাকার নতুন সুযোগ তৈরি হয়।
স্বৈরাচারের উত্থান, প্রযুক্তিখাতে প্রভাবশালী ওলিগার্কদের দৌরাত্ম্য, গণমাধ্যমের তহবিল ঘিরে স্থবিরতা, আর সাংবাদিকদের ওপর সাইবার ও শারীরিক আক্রমণের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রেসা তার কী-নোট বক্তৃতায় সতর্ক করে বলেন—আর হয়তো মাত্র এক বছরের ব্যবধানে বহু সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা চিরতরে হারিয়ে যাবে।
ফিলিপাইনে তার ওপর চালানো নিপীড়নের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে তিনি তুলে ধরেন, কীভাবে দমন-পীড়নের মুখেও ক্ষমতাধরদের জবাবদিহির মুখোমুখি করার দৃঢ় অঙ্গীকার শেষ পর্যন্ত টেকসই আয়ের পথ তৈরি করতে পারে এবং ন্যায় বিচারের দিকে এগিয়ে নিতে পারে।
“২০১৯ সালে আমার বিরুদ্ধে ১১টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল — আর ঠিক সেই বছরই র্যাপলার লাভজনক হয়,” তিনি বলেন, আর সঙ্গে সঙ্গেই দর্শকেরা জোরালো করতালি দেয়। তিনি স্বীকার করেন, সংবাদকক্ষের নেতাদের একের পর এক গ্রেপ্তার হওয়াটা “ঠিক টেকসই কোনো ব্যবসায়িক মডেল নয়” এবং অন্যদের তা অনুসরণও করা উচিত নয়। তবে তিনি উল্লেখ করেন, র্যাপলারের ঘুরে দাঁড়ানো প্রমাণ করে যে সাহসী সংবাদমাধ্যমকে কেন্দ্র করে পাঠকরা একত্রিত হতে পারেন। পাশাপাশি এটিকে তিনি “সংকটই সুযোগ” — এই ধারণার চূড়ান্ত উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। বিশেষ করে সীমিত সম্পদ ও হয়রানির স্বীকার হওয়া সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য।
ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতের্তের কথা উল্লেখ করে রেসা জানান কেন তিনি এখনো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী। তিনি বলেন, “আমি বলতে চাই কেন আমি আশাবাদী, কেন আমি বিশ্বাস করি আমরা এটা পারবো। কারণ যে মানুষটি আমাকে কারাবন্দি করতে চেয়েছিল এবং র্যাপলার বন্ধ করতে চেয়েছিল—সে-ই এ বছরের মার্চে গ্রেপ্তার হয়েছে। আর এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মুখোমুখি হয়ে হেগে অবস্থান করছে। তাই দেখুন: আপনি যদি নিজের কাজ করে যান এবং একসঙ্গে কাজ করেন, তবে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।”
তবে রেসা গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের সামনে থাকা কয়েকটি অস্তিত্বগত হুমকির কথাও তুলে ধরেন। এ সময় তিনি উল্লেখ করেন, “এটা সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী বছর— শুধু গাজাতেই ২৫০ জন নিহত হয়েছেন।”
নাটকীয় এক মুহূর্তে রেসা সতর্ক করে বলেন, ২০২৬ সাল স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের জন্য হতে পারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর—যেখানে তাদের অধিকার, অংশীদারত্ব এবং নতুন টেকসই মডেলগুলো নিশ্চিত করতে হবে।
“ফিলিপাইন থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য আমাদের সেরা পরামর্শ হলো: আপনার অধিকারগুলো এখনো আছে—তাই এখন থেকে লড়াই শুরু করুন। কারণ ক্রমশ অধিকারগুলো কেড়ে নেওয়া হবে, আর পরে তা ফিরে পাওয়া প্রায় অসম্ভব,” তিনি সতর্ক করেন। যোগ করেন, “তহবিল সরবরাহকারীদের উদ্দেশে বলছি: এই সময়টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি এখন এগিয়ে না আসেন, যদি এই মুহূর্তে সাড়া না দেন, তাহলে আগামী বছর আমরা আরও পিছিয়ে পড়ব। আর আমরা যদি এই কাজগুলো—বিশেষত সহযোগিতা—না করি, তাহলে আমার মনে হয় মাঝারি আকারের সংবাদমাধ্যমগুলো এক বছরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে।”

কীভাবে রাষ্ট্র-সমর্থিত প্রচারযন্ত্র বড় প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোকে ব্যবহার করে তার এবং তার সংবাদমাধ্যমকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল তা ব্যাখ্যা করেন মারিয়া রেসা। জিআইজেএনের জন্য ছবি তুলেছেন সুজান লি, অল্ট স্টুডিও
তথ্য ও গণতন্ত্রের ওপর অ্যালগরিদমের হুমকি
রেসা সতর্ক করেছেন যে প্রযুক্তি অ্যালগরিদমের কারণে সারা বিশ্বের তথ্যকে বিকৃত করার যুদ্ধে ভয়াবহ এবং বিভাজনকারী প্রভাব দেখা দিচ্ছে। এতে ঘৃণা আরও বাড়ে এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়গুলো আরও বেশি প্রান্তিক হয়ে পড়ে।
“তথ্য না থাকলে সত্য পাওয়া যায় না; সত্য না থাকলে বিশ্বাস তৈরি হয় না,” তিনি বলেন। “এই দুটো না থাকলে জলবায়ু সঙ্কটের মতো অস্তিত্বগত সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। গণতন্ত্রও সম্ভব নয়। যেমনটা বলা হয়: ঔপনিবেশিকতা শেষ হয়নি; কেবল অনলাইনে চলে গেছে।
সবাইকে সতর্ক করে রেসা উল্লেখ করেন, বিশ্বজুড়ে লুটতন্ত্র (ক্লেপ্টোক্রেসি- এমন একটি সরকার ব্যবস্থা যেখানে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে দেশের সম্পদ ব্যক্তিগত লাভের জন্য হাতিয়ে নেয়) বাড়ছে। এর কারণ “মিথ্যা খবরকে স্বাভাবিক মনে করানো হচ্ছে।” যা বিকেন্দ্রীভূত ইনফ্লুয়েন্সার নেটওয়ার্কের ফিডব্যাক লুপের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে—অর্থাৎ বিভিন্ন প্রভাবশালী মানুষ একে অন্যকে আরও শক্তিশালী করছে, আর প্ল্যাটফর্মগুলো আবেগপ্রবণ কনটেন্টকে উৎসাহ দিচ্ছে।”
সম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার আগে রেসা বিশ্বজুড়ে হামলার মুখে থাকা সাংবাদিকদের প্রতি সংহতি জানাতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন, যেটি কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস-এর সহযোগিতায় আয়োজিত হয়। সম্মেলন কক্ষে জড়ো হওয়া এক হাজারেরও বেশি অংশগ্রহণকারীর সঙ্গে তিনি একসঙ্গে ছবি তোলেন। এর মাধ্যমে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে তথ্য ও জবাবদিহির পক্ষে লড়ে যাওয়া অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সম্প্রদায়ের কাজকে প্রতীকীভাবে স্বীকৃতি জানান।
আমরা থেমে থাকতে পারি না। এটা তুমুল সহযোগীতার সময়। একই সঙ্গে সৃষ্টিরও সময়।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের শত্রু সরকার নয়। তবে তারা উঠে এসেছে সেই প্রযুক্তির ওপর ভর করে, যা আমাদের সমাজগুলোকে আক্ষরিক অর্থে বিভক্ত ও ছিন্নভিন্ন করেছে। আজ আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রনকারী কোনও প্রযুক্তিই তথ্যভিত্তিক নয়।”

জিআইজেসি সম্মেলনে উপস্থিত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নেতারা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস-এর সঙ্গে একত্রিত হয়ে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকতার প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। জিআইজেএনের জন্য ছবি তুলেছেন সুজান লি, অল্ট স্টুডিও
সাংবাদিক সম্প্রদায়ের প্রতি রেসার আরও কিছু আহবান:
- ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাংবাদিকদের উচিত তাদের সরকারের মানবাধিকার ও প্রেস স্বাধীনতার প্রতিশ্রুত মানগুলো অবিচলভাবে রক্ষা করা। রেসা বলেন, ‘আমি এখানে থাকা ইইউ-এর সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলছি: দৃঢ় থাকুন,এবং আপনাদের দেশের প্রেস স্বাধীনতার ভালো আইনগুলোকে অব্যাহতভাবে রক্ষা করুন।
- নারী সাংবাদিকদের ওপর অনলাইন হয়রানির পরিমান মহামারী আকারে বেড়ে যাওয়া নিয়ে সাংবাদিকদের কাজ করা উচিৎ। যারা এর নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে তাদের নিয়ে অনুসন্ধান ও মুখোশ উন্মোচন করা উচিৎ। রেসা উল্লেখ করেন, ৭৩ শতাংশ নারী সাংবাদিক অনলাইন হেনস্তার শিকার হন, আর ২৫ শতাংশ শারীরিক হুমকির মুখোমুখি হন—যার মধ্যে কিছু শারীরিক আঘাতও রয়েছে।”
- সংবাদকক্ষগুলোর উচিৎ সামাজিক মাধ্যমের পীড়াদায়ক প্রভাব নিয়ে সৎভাবে মূল্যায়ন করা। তিনি প্রশ্ন করেন, “আমরা কতদিন প্রযুক্তি কোম্পানির জন্য বিনামূল্যে কাজ করতে চাই?” বরং, তিনি যোগ করেন, “তারা এমন সমাধান ভাবতে পারে যেখানে জনস্বার্থভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় বা দর্শক ও সাংবাদিকদের সরাসরি সংযুক্ত করা হয়—যেখানে অ্যালগরিদমের মাধ্যমে প্রভাবিত না হয়ে ‘বাস্তব মানুষ বাস্তব মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারে।”
- “সার্ভেইল্যান্স-ফর-প্রফিট” অর্থাৎ যে সব প্রযুক্তি বা কোম্পানি মানুষকে নজরদারি করার মাধ্যমে আয় করছে—এই ধরনের শিল্পকে চ্যালেঞ্জ করুন এবং তাদের মুখোশ উন্মোচনে অনুসন্ধানে নামুন ও তাদের রুখে দিন।
- এমন কোনো কার্যক্রম করা থেকে বিরত থাকুন যা শারীরিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আরও প্রান্তিক করে তুলতে পারে।
এ পর্যায়ে তিনি যোগ করেন, “আমার স্বপ্ন সংবাদমাধ্যমগুলোকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী একটি ফেডারেশন তৈরি করা। আমি বিশ্বাস করি আমরা এটা করতে পারি—এর জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা বা কাঠামো রয়েছে—আমাদের যা করতে হবে তা হলো একত্রিতভাবে কাজ করা যতক্ষণ আমাদের শক্তি আছে। নাহলে আমরা ক্ষয়ে যেতে থাকবো— আমার মনে হয়, আমাদের হাতে মাত্র এক বছরের মতো সময় আছে।”
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সম্প্রদায়ের দৃঢ়তা
মারিয়া রেসার বক্তব্যের আগে সম্মেলনের দুই সহ-আয়োজকের পক্ষ থেকে দুই নেতা গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক এমিলিয়া ডিয়াজ-স্ট্রাক এবং মালয়েশিয়াকিনির সহ-প্রতিষ্ঠাতা প্রেমেশ চন্দ্রন অংশগ্রহণকারীদের স্বাগত জানান।
“আমরা অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত—এশিয়াতে এবারই প্রথম আমরা এই বৈশ্বিক সম্মেলনের আয়োজন করছি,” ডিয়াজ-স্ট্রাক বলেন। তিনি যোগ করেন “আমরা জানি এটি সবার জন্য একটি কঠিন বছর। তবে ১৩৫টি দেশ ও অঞ্চলের ১ হাজার ৫০০-এরও বেশি অংশগ্রহণকারীর উপস্থিতি একটি শক্তিশালী বার্তা দিচ্ছে।”
তিনি উল্লেখ করেন, আফ্রিকা, মেনা এবং লাতিন আমেরিকা থেকে আসা বক্তাদের সংখ্যা আগের তুলনায় দ্বিগুণ এবং এশিয়া থেকে বক্তাদের সংখ্যা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
চন্দ্রন বলেন, “২০১৮ সালে, মালয়েশিয়ায় আমরা ৬০ বছরের মধ্যে প্রথমবার সরকার পরিবর্তন দেখেছি, এবং সেটা সাংবাদিকদের কারণে সম্ভব হয়েছে। এখানে অনেকেই গণ্ডি ভেঙ্গে অগ্রসর হচ্ছেন।”
ডিয়াজ-স্ট্রাক আরও উল্লেখ করেন, “আমরা যে সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি — গণতন্ত্রের পশ্চাদগতি, যুদ্ধ, আরও বেশি সংখ্যক সাংবাদিকদের নির্বাসিত হওয়ার ঘটনা—তবুও আমরা বেঁচে আছি; আমরা অবিচল; এবং আমরা সেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করছি যা সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: ক্ষমতাধরদের জবাবদিহিতে আনা।”

জিআইজেএনের নির্বাহী পরিচালক এমিলিয়া ডিয়াজ-স্ট্রাক (ডানে) এবং মালয়েশিয়াকিনির প্রধান নির্বাহী ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা প্রেমেশ চন্দ্রন ১৪তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে অংশগ্রহণকারীদের স্বাগত জানান। জিআইজেএনের জন্য ছবি তুলেছেন সুজান লি, অল্ট স্টুডিও
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএনের গ্লোবাল রিপোর্টার এবং ইমপ্যাক্ট এডিটর। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসের প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন। বিশ্বজুড়ে দুই ডজনেরও বেশি দেশে সংবাদ, রাজনীতি, দুর্নীতি এবং সংঘাত নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও আফ্রিকার বিভিন্ন বার্তাকক্ষে অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর হিসেবেও কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।
