অলংকরণ: ন্যুক
চীনা ভাষাভাষী বিশ্বে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এক অগ্রদূতের পরামর্শ
তাইওয়ানে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিষয়ক আলোচনায় অনিবার্যভাবে উঠে আসে শেরি লি সুয়েহ-লির নাম। বর্তমানে তিনি দ্য রিপোর্টারের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ও উপপ্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (ডেপুটি সিইও)। দ্য রিপোর্টার পাবলিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত তাইওয়ানের প্রথম অলাভজনক গণমাধ্যম। শেরি লি শুধু পুরস্কারজয়ী অনুসন্ধানী সাংবাদিকই নন, তিনি পাঠক–অর্থায়িত চীনা ভাষাভাষী বিশ্বের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এক অগ্রদূতও।
২৫ বছরেরও বেশি সময়জুড়ে বিস্তৃত কর্মজীবনে লি তার সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু করেছিলেন তাইওয়ানের বিখ্যাত কমনওয়েলথ ম্যাগাজিনের প্রতিবেদক হিসেবে। ধীরে ধীরে তিনি পদোন্নতি পেয়ে ম্যাগাজিনটির উপসম্পাদক ও ভিডিও বিভাগের প্রধান প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি ম্যাগাজিনটির বেইজিং প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেছেন।
২০১৫ সালের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্থান তাইওয়ানের সংবাদজগতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দেয়। অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম তখন ক্লিক ও ট্রেডিংকে অগ্রাধিকার দিতে শুরু করে। এতে সাংবাদিকদের ওপর চাপ বেড়ে যায়, আর গভীর অনুসন্ধানমূলক কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ও অর্থায়ন কমে আসে।
এই পরিবর্তনের ধারা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে লি ও তার সহকর্মীদের একদল টেকসই সাংবাদিকতার নতুন মডেল খুঁজতে শুরু করেন—যা বিজ্ঞাপন ও ট্র্যাফিকের চাহিদা মুক্ত। তারা অনুপ্রাণিত হন বিশ্বের বিভিন্ন অলাভজনক সংবাদমাধ্যমের সাফল্য থেকে, যেমন—যুক্তরাষ্ট্রের প্রোপাবলিকা, জার্মানির কোরেকটিভ, দক্ষিণ কোরিয়ার নিউজথাপা এবং জাপানের ওয়াসেদা ক্রনিকল।
একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন—“আমরা কি ভিন্ন কোনো পথ তৈরি করতে পারি?”—তারা ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে দ্য রিপোর্টার শুরু করেন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে দ্য রিপোর্টারের নেতৃত্বে লি ও তার দল সমাজ ও জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট কঠিন সব বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন এবং একের পর এক প্রভাবশালী অনুসন্ধান প্রকাশ করেছেন।
২০১৬ সালে প্রকাশিত তিন পর্বের অনুসন্ধান “স্লেভস অব দ্য ফার-সি ফিশিং” ছিল দ্য রিপোর্টারের প্রথম আন্তসীমান্ত অনুসন্ধান, যা তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সুনাম প্রতিষ্ঠার মোড়ঘোরানো কাজ হিসেবে পরিচিত। দলটি তাইওয়ানের গভীর সমুদ্রে মৎস্য শিল্পে বিদেশি জেলেদের শ্রম শোষণ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি অনুসন্ধান চালায়। বিস্তৃত সাক্ষাৎকার ও প্রমাণ সংগ্রহের মাধ্যমে তারা শুধু শিল্পটির অন্ধকার দিকই উন্মোচন করেনি, বরং নীতিগত পরিবর্তনেরও সূচনা ঘটায়।
ফলস্বরূপ, ২০১৭ সালের শুরুতে তাইওয়ান সরকার “থ্রি অ্যাক্টস অন ফার-সি ফিশিং” আইন পাস করে এবং অভিবাসী জেলেদের ন্যূনতম মাসিক মজুরি ২০১৬ সালের নির্ধারিত ৩০০ মার্কিন ডলার থেকে ২০২২ সালে বাড়িয়ে ৫৫০ ডলার নির্ধারণ করে।
লি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সামাজিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে গল্প শুরু করতে পারদর্শী—তিনি সবসময় ঘটনাপ্রবাহের গভীরে গিয়ে সমস্যার কাঠামোগত মূল কারণ পর্যন্ত অনুসন্ধান করেন। ২০১৮ সালে প্রকাশিত দ্য রিপোর্টারের ধারাবাহিক প্রতিবেদন “ইউথ ইন দ্য রুইন্স”-এ তিনি ও তার দল উচ্চঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের একশ’র বেশি কিশোর–কিশোরীর সাক্ষাৎকার নেন—যেখানে উঠে আসে প্রতিকূল অবস্থায় তাদের টিকে থাকা ও কাজ করার সংগ্রাম এবং বাস্তবতা। এই প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়, কীভাবে তাইওয়ানের সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা ও শ্রমব্যবস্থা অদৃশ্য ও প্রান্তিক তরুণদের ক্রমশ ব্যর্থ করেছে। প্রতিবেদনটি সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলে এবং তারা বুঝতে পারে তাদের পরিবারগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না।
প্রতিবেদনটি সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর সাড়া ফেলে। পরিবারের অকার্যকারিতা ও ভাঙনের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এমন অনুসন্ধানগুলোর সামাজিক প্রভাবের জন্য পাঠকদের আস্থা ও সমর্থন পেয়েছে দ্য রিপোর্টার। প্রতিষ্ঠার প্রথম মাসে তাদের নিয়মিত মাসিক দাতার সংখ্যা ছিল মাত্র চারজন। আজ, এক দশক পরে, সেই সংখ্যা প্রায় ৮ হাজারে পৌঁছেছে। বিজ্ঞাপন না নেওয়া এবং পেওয়াল না রাখার নীতিতে অটুট থেকে, ২০১৭ সালে জিআইজেএন–এর সদস্য হওয়া দ্য রিপোর্টার চীনা ভাষাভাষীদের নতুন দিশা দেখিয়েছে। পাঠকের সমর্থনই দ্য রিপোর্টারকে জনস্বার্থের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে মনোযোগী হতে উদ্বুদ্ধ করে।
চলতি বছর মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে গ্লোবাল অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সম্মেলনে মূল বক্তা হিসেবে উপস্থিত হবেন লি। সম্মেলনের আগে তাইওয়ানে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বর্তমান অবস্থা, তার কাজের নীতিমালা ও চ্যালেঞ্জ, এবং পেশাগত বার্নআউট মোকাবেলার কৌশল নিয়ে জিআইজেএনের সঙ্গে কথা বলেছেন শেরি লি।

ইন্দোনেশিয়ার সাইট টেম্পোর সঙ্গে যৌথভাবে দ্য রিপোর্টার তাইওয়ানের গভীর সমুদ্রে মৎস্য শিল্পে বিদেশিদের শ্রম শোষণ নিয়ে বহু পর্বের একটি সিরিজ অনুসন্ধান পরিচালনা করে—যা দেশের শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি বিষয়ক আইন পরিবর্তনের সূচনা করে। ছবি: স্ক্রিনশট, দ্য রিপোর্টার
জিআইজেএন: আপনি যত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিয়ে কাজ করেছেন, তার মধ্যে কোনটি আপনার প্রিয় এবং কেন?
শেরি লি: আমার প্রিয় কাজ অবশ্যই “স্লেভস অব দ্য ফার-সি ফিশিং”। আমরা যখন ইন্দোনেশিয়ার মিডিয়া আউটলেট টেম্পোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজটি করেছিলাম- আমাদের অনেক বাধা পেরোতে হয়েছিল। ছিল ভাষা, সংস্কৃতি, এবং পদ্ধতিগত পার্থক্য। আমরা এমন একটি বিষয় নিয়ে গভীরভাবে অনুসন্ধান চালাতে চেয়েছিলাম, যা আমাদের দুই দেশের মধ্যেও বিস্তৃত এবং একাধিক সরকারি সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। দ্য রিপোর্টারের জন্য এটি ছিল আমাদের প্রথম প্রকৃত আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। দলের সব সদস্য, ফ্রন্টলাইন রিপোর্টার থেকে সম্পাদক পর্যন্ত, পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে শিখছিলেন ও মানিয়ে নিচ্ছিলেন। মানব পাচারের ওপর টেম্পোর কাজ আমাদের বিশ্লেষণকে আরও ধারালো করেছে এবং গল্পের সবচেয়ে কার্যকর দিকগুলো চিহ্নিত করতে সাহায্য করেছে।
দীর্ঘ সময় জুড়ে একটি বিষয় অনুসরণ থেকে আসে সন্তুষ্টি। এই কাজ আমাদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মূল্যবোধে দৃঢ় বিশ্বাস তৈরি করে। এই তিন পর্বের প্রত্যেকটি প্রতিবেদনই আমাদের গল্প বলার পরিসর বাড়াতে সহায়তা করেছে। প্রত্যেকে—লেখক, আলোকচিত্রী, ডেটা সাংবাদিক, ডিজাইনার ও প্রকৌশলী—অবিচ্ছিন্ন নিষ্ঠার সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন। শক্তিশালী অনুসন্ধানের পাশাপাশি, আমাদের ওয়েবসাইটে মাল্টিমিডিয়া উপস্থাপনাটি যেন এক ধরনের শিল্পকর্ম। আজও এটি একটি প্রভাবশালী ও প্রতিধ্বনিত কাজ হিসেবে বিদ্যমান।
জিআইজেএন: আপনার দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো কী?
শেরি লি: সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সাংবাদিকদের ওপর চলমান অতিরিক্ত চাপ এবং দীর্ঘমেয়াদি ক্লান্তিকর পরিস্থিতি। অধিকাংশ মিডিয়া সংস্থা এখন ক্লিক বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় আটকে গেছে এবং ট্রেন্ডিং বিষয় অনুসরণ করতে থাকে। যখন তারা বিজ্ঞাপনদাতা বা স্পনসর কন্টেন্টের চাপের মুখোমুখি হয়, তখন তারা প্রথাগত ও নিরপেক্ষ অনুসন্ধানী ভূমিকায় কাজ করতে পারে না। এর ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গভীর অনুসন্ধান করার উদ্যম ও সক্ষমতা নষ্ট হয়।
যেসব বাণিজ্যিক বা অলাভজনক মিডিয়া সংস্থা স্বাধীনতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে, সেখানেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞতা, সোর্স, এবং সময়। কিন্তু বর্তমানে সাংবাদিকদের ঝরে পড়ার হার খুবই বেশি। অনেকে অনলাইন আক্রমণ ও হয়রানির মুখোমুখি হয়ে পেশা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। যদি তরুণ সাংবাদিকরা এই ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে না পারে, আমরা আরও বেশি মেধাবী সাংবাদিকদের হারিয়ে ফেলার মারাত্নক ঝুঁকির মুখোমুখি হব। আমি মনে করি, এটি তাইওয়ানে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সবচেয়ে গভীর এবং জটিল চ্যালেঞ্জ।
জিআইজেএন: অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে আপনার ব্যক্তিগত জীবনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী ছিল?
শেরি লি: সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সেই “ধোয়া ওঠা বন্দুক” বা অকাট্য প্রমাণটি খুঁজে বের করা—যে প্রমাণিত সত্যকে তুলে আনে। আর এটিই একমাত্র উপায়, যার মাধ্যমে কোনো প্রতিবেদন সত্যিকার প্রভাব ফেলতে পারে, সমস্যার মূল জায়গায় আঘাত করতে পারে এবং ক্ষমতার কাঠামোকে কার্যকরভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।
একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক কিন্তু পুলিশ, প্রসিকিউটর বা বিচারক নন। আমাদের লক্ষ্য কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা নয়, বরং সত্য উন্মোচন করা। এর জন্য প্রায়ই আমাদের শক্তিশালী পক্ষের সঙ্গে লড়াই করতে হয় এবং অস্বস্তিকর ও অপ্রিয় “অসুবিধাজনক সত্য” প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু পুলিশ বা প্রসিকিউটরের মতো আমাদের কাছে অনুসন্ধান পরিচালনার জন্য আনুষ্ঠানিক তদন্তের ক্ষমতা নেই।
এই চ্যালেঞ্জগুলো আরও বাড়ছে—বিশেষ করে এমন একটি সময়ে যখন মিডিয়ার ওপর মানুষের আস্থা কমছে। আর আমাদের কাজগুলো প্রায়ই উদ্দেশ্যমূলক হিসেবে দেখা হচ্ছে। ক্ষমতাধারীরা আইনি ব্যবস্থা ও জনমত প্রভাবিত করার জন্য অনেক বেশি অর্থ-সম্পদ ব্যবহার করতে পারে, যা সাংবাদিকদের অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় ফেলে। আমরা প্রায়ই সেই একক প্রমাণের জন্য যন্ত্রণাদায়ক অপেক্ষা সহ্য করি—যেটি হয়তো কখনও পাওয়া যাবে না। তাই যখন কোনো সূত্র হাতে পাবো, তখন তা দ্রুত ও কঠোরভাবে যাচাই করতে হবে। সবসময় নিশ্চিত করতে হবে যে আমরা “কনফার্মেশন বায়াসের” ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি না।
আমার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো যখন কিছুই পাওয়া যায় না, সেই দিনগুলোতে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা ধরে রাখা। ধৈর্য ধরে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাওয়া।
জিআইজেএন: সাক্ষাৎকার নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার সেরা পরামর্শ কী?
শেরি লি: সবাই আলোচনা করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের জায়গা নিয়ে নেবে কিনা। সাংবাদিকতায়, অডিও ট্রান্সক্রিপশন, ডেটা সংগ্রহ, এবং প্রেক্ষাপট বিষয়ক তথ্য পড়ার মতো কাজগুলো করতে এআইকে সত্যিই বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি বহু সাংবাদিককেও দেখেছি এআই ব্যবহার করে সাক্ষাৎকারের খসড়া তৈরি, অডিও ট্রান্সক্রাইব করা, এবং তথ্যের সারসংক্ষেপ তৈরি করতে। এসব টুল নিঃসন্দেহে সময় বাঁচায়, কিন্তু আমি ভাবি: যদি সব কিছু এআইকে দিয়ে দিই, তাহলে সাংবাদিকের মধ্যে যে স্মৃতি ও চিন্তাভাবনার প্রক্রিয়া গড়ে ওঠার কথা, তা ভাসা-ভাসা অগভীর হয়ে যাবে কিনা?
আমি বিশ্বাস করি, আমরা যখন কিছু পড়ি এবং কোনো বিশেষ জার্গন ও প্রেক্ষাপট শিখি, সাক্ষাৎকার নেওয়া ব্যক্তির আন্তরিকতা ও পরিশ্রম অনুভব করতে পারি। এটি কোনো যন্ত্র অনুকরণ করতে পারে না—আপনার চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি, বিস্তারিত ফলোআপ প্রশ্ন, যা অনেক গভীর উত্তর বের করে আনতে পারে।
একইভাবে নিজেই নিজের অডিও শোনাটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি তাদের স্বরের পরিবর্তন, নিশ্বাসের ওঠা-নামা, বা এক মুহূর্তের দ্বিধা শুনতে পাবেন। এই আবেগ ও সূক্ষ্ম ভঙ্গিমা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উৎপন্ন সারাংশে ধরা কঠিন। একটি সাক্ষাৎকার শুধু তথ্য বিনিময় নয়; এটি দুই মানুষের মধ্যে আস্থা গড়ার প্রক্রিয়া।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সহায়তা করতে পারে, কিন্তু কখনও জায়গা নিতে পারে না। আমার বিশ্বাস, সেরা সাক্ষাৎকার আসে নিজের গড়ে তোলা জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে, সঠিক প্রশ্ন করার তীক্ষ্ণ দক্ষতা থেকে, এবং সেই মানবিক সংযোগ থেকে—যা সাক্ষাৎকারগ্রহীতা ও সাক্ষাৎকারদাতার মধ্যে জন্ম নেয়।
জিআইজেএন: অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে আপনার প্রিয় রিপোর্টিং টুল, ডেটাবেস, বা অ্যাপ কোনটি?
শেরি লি: আমাদের দলের সবচেয়ে সাধারণ চর্চা হলো নিজস্ব কোড লেখা, যা দিয়ে আমরা ডেটা স্ক্র্যাপ এবং বিশ্লেষণ করি। সাধারণ ডেটা সংগ্রহের জন্য আমরা চ্যাটজিপিটি এবং জেমিনি ব্যবহারের পরামর্শ দিই। এগুলো প্রাথমিক ডেটা গোছানোর জন্য খুবই সহায়ক। মানচিত্র ও ভূ-স্থানিক তথ্যের জন্য আমরা ওপেন-সোর্স কিউজিআইএস এবং আরকজিআইএস ব্যবহার করি। আরকজিআইএস উপকারী, কারণ এটি এনজিওর জন্য একটি বিনামূল্যের পরিকল্পনা (ফ্রি প্ল্যান) প্রদান করে—যা সীমিত বাজেটের মিডিয়া দলগুলোর জন্য অত্যন্ত কার্যকর একটি বিকল্প।
জিআইজেএন: আপনার কর্মজীবনে সবচেয়ে ভালো পরামর্শ কী পেয়েছেন, এবং একজন আগ্রহী অনুসন্ধানী সাংবাদিককে আপনি কী পরামর্শ দেবেন?
শেরি লি: “লেটার্স টু আ ইয়ং জার্নালিস্ট”-বইয়ের একটি অংশ আমার ভীষণ পছন্দের [কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর স্যামুয়েল জি. ফ্রিডম্যানের ২০০৬ সালে প্রকাশিত বই থেকে নেওয়া]। যখনই আমি হতাশ বা সন্দিহান হই, এই কথাগুলো আমাকে শক্তি ও অনুপ্রেরণা যোগায়:
“আমি আপনাকে ভয় দেখাতে চাই না। বরং আশা করি আপনি চ্যালেঞ্জগুলোকে অনুপ্রেরণা হিসেবেই নিবেন। যখন আমি আপনার বয়সি ছিলাম, তখন সাংবাদিকতার জনপ্রিয়তার কারণে অনেক কপট ব্যক্তিই সুনামের লোভে এই পেশায় আসত। এখন সাংবাদিকতা ততটা জনপ্রিয় না হলেও এর একটি ভালো দিক হলো, এটি পেশার প্রতি অপ্রতিশ্রুতিশীল মানুষদের দূরে রাখে। আপনি যদি সত্যিকারের বিশ্বাসী হন, যদি মনে করেন এটি আপনার জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত, তবে কেউ এবং কিছুই আপনার মন পরিবর্তন করতে পারবে না। সাংবাদিকতার অন্ধকার সময়ে হলেও আপনি আপনার প্রাণশক্তি খুঁজে পাবেন।”
এই কথাগুলো সবসময় আমাকে আমার মূল উদ্দেশ্যে ফিরিয়ে আনে: আমি এই পথ বেছে নিয়েছি কারণ আমি এর অন্তর্নিহিত মূল্যে বিশ্বাস করি, জনপ্রিয়তা বা মর্যাদার জন্য নয়।
যারা অনুসন্ধানী সাংবাদিক হতে চান, আমি বলব: আপনার কৌতূহল ধরে রাখুন এবং মন খোলা রাখুন। কঠিন বিষয়গুলো মোকাবিলা করতে ভয় পাবেন না, এবং লিঙ্গ বা অন্য কোনো লেবেল যেন আপনার সম্ভাবনাকে সীমিত করতে না পারে। আন্তরিকতা, সহনশীলতা এবং দৃঢ় বিশ্বাসই আগামীর পথে আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হবে।
জিআইজেএন: আপনি কোন সাংবাদিককে অনুসরণ করেন বা সম্মান করেন, এবং কেন?
শেরি লি: একজনের নাম বলা অসম্ভব, কারণ এমন অসংখ্য সাংবাদিক আছেন, যারা সত্যিই সম্মাননীয়। মারি কলভিন–এর জীবনী পড়তে গিয়ে আমি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছি; সংঘাতের সামনের সারি থেকে সত্য তুলে ধরার জন্য তার মনোবল ও অটল অঙ্গীকার ছিল সত্যিই অসাধারণ।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের অনুসন্ধানী সাংবাদিক মার্থা মেন্ডোজাকে-ও আমি অত্যন্ত সম্মান করি । জিআইজেএন সম্মেলনে তার উপস্থাপনা আমাকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি মনোযোগী, দৃঢ়সঙ্কল্প। প্রতিনিয়ত নিজ দক্ষতাকে শানিত করেন। সহকর্মীদের সঙ্গে নিজের অনুসন্ধানী কৌশলগুলো ভাগ করে নিতে ভীষণ ইচ্ছুক—সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তিনি বিরল এবং উদার একজন মেন্টর।
আরো বলতে চাই ডায়ান ইয়িংয়ের কথা। তিনি তাইওয়ানের কমনওয়েলথ ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮১ সাল, তাইওয়ানে তখনও মার্শাল ল জারি। তিনি তখন এই প্রকাশনা শুরু করেন। এটি দ্বীপটির প্রথম ম্যাগাজিন যা স্থানীয় বিষয়ের প্রতি গভীর প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে একত্রিত করেছিল। তিনি সবসময় শিখতে ভালোবাসেন। সাংবাদিকতার প্রতি তার গভীর ভালোবাসা আর পরবর্তী প্রজন্মকে শেখানোর নিষ্ঠা গভীরভাবে প্রশংসনীয়।
আহ, মাত্রই খেয়াল করলাম আমি যাদের নাম নিয়েছি তারা তিনজনই নারী সাংবাদিক।
জিআইজেএন: আপনার জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল কী এবং আপনি কী শিক্ষা পেয়েছেন?
শেরি লি: এক অনুসন্ধানে, আমাদের দল মনে করেছিল আমরা আমাদের একজন সূত্রকে গোপন রাখতে যথেষ্ট ব্যবস্থা নিয়েছি। তবুও প্রতিবেদন প্রকাশের পর কয়েকজন সূত্রটি শনাক্ত করতে পারে, যাতে ভীষণ সমস্যা সৃষ্টি হয়।
এই অভিজ্ঞতা ছিল আমাদের বড় ধরনের শিক্ষা: কোনো সূত্র যদি সুরক্ষার শর্তে সম্মত হয়, তারপরও চূড়ান্ত দায়িত্ব আমাদের ওপরই থাকে। যখন পরিস্থিতি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, তখন অতিরিক্ত সতর্কতাও অনেক সময় কম পড়ে যায়। প্রকল্পের নেতৃত্বে থেকে আমি শিখেছি উচ্চঝুঁকিপূর্ণ গল্পের জন্য আমাদের লেখক ও আলোকচিত্র সাংবাদিকদের সঙ্গে আমার বিস্তারিত ও কঠোর ঝুঁকি মূল্যায়ন করতে হয়—বিশেষ করে সম্পাদনার শেষ ধাপে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা প্রকাশনার আগে প্রতিটি বিষয়কে একাধিকবার যাচাই করে ক্রমাগত সতর্ক থাকতে হবে।
জিআইজেএন: আপনি কীভাবে আপনার কাজের মধ্যে বার্নআউট এড়ান?
শেরি লি: নিয়মিত ব্যায়াম, পড়াশোনা এবং সিনেমা দেখার মতো রুটিন ধরে রাখার পরামর্শ দিবো। তাছাড়া আমি সচেতনভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কমানোর চেষ্টা করছি, যাতে বিষাক্ত বিতর্কের সংস্পর্শে কম আসতে হয়।
আমাকে সত্যিকারের এগিয়ে রাখে আমাদের কমিউনিটির প্রতিক্রিয়া। প্রতি মাসে আমাদের দল পাঠক ও সমর্থকদের পাঠানো বার্তাগুলো তুলে ধরেন। যখন শুনি কোনো গল্প বা পডকাস্ট কারো মনকে ছুঁয়েছে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে, বা এমনকি তাদের কোনো কাজে উৎসাহিত করেছে—এটি আমাদের কাজ করার মূল কারণ মনে করিয়ে দেয়। এই সংযোগ ও প্রভাবের অনুভূতিটাই আমার চলার পথের রসদ।
জিআইজেএন: অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় কোন বিষয়গুলো আপনাকে বিরক্ত করে বা ভবিষ্যতে কী পরিবর্তন দেখতে চান?
শেরি লি: এই কাজের অবিরাম গতি কখনও কখনও বেশ একঘেয়ে লাগতে পারে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় পুরোপুরি মনযোগী হওয়া প্রয়োজন, কিন্তু একটি বড় প্রকল্পে মাসের পর মাস সময় ও শক্তি খরচ করার পরও পরবর্তী প্রকল্প শুরুর আগে প্রায়ই বিশ্রামের সময় থাকে না। আমি আশা করি মিডিয়া সংস্থাগুলো সাংবাদিকদের দীর্ঘমেয়াদি চাপ মোকাবিলার বিপরীতে মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য আরও শক্তিশালী ও সহায়ক ব্যবস্থা তৈরি করবে।
আমি চাই সাধারণ মানুষ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ঝুঁকি ও মূল্যগুলো আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করুক। আমি আশা করি এই বোঝাপড়া বাস্তব সহায়তায় রূপান্তরিত হবে—যেমন ওয়েবসাইট পড়া, আর্থিক সমর্থক হওয়া, বা গল্পগুলো ভাগ করে তাদের মানসম্পন্ন মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে উৎসাহিত করা। শেষ পর্যন্ত, এই জনসমর্থনই সেই প্রাণশক্তি যা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার টিকে থাকাকে নিশ্চিত করে।
জোয়ি চি হলেন জিআইজেএন–এর চীনা সম্পাদক এবং ভ্যানকুভার ভিত্তিক একজন সাংবাদিক। তিনি হংকংয়ের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কাজ করেছেন, যেখানে প্রতিবেদক, সম্পাদক এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্বসহ বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেন। তার কাজের মূল আগ্রহের জায়গা হলো চীনা রাজনীতি, সামাজিক সমস্যা এবং শ্রম অধিকার।
অলংকরণ: ন্যুক ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বর্তমানে সিওলের হানইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড আর্ট এডুকেশন বিভাগের ছাত্র এবং একই সঙ্গে ইলাস্ট্রেটর হিসেবে কাজ করছেন। ২০২১ সালে হিডেন প্লেস এ প্রদর্শনীর পর থেকে তিনি বিভিন্ন ইলাস্ট্রেশন প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। তার প্রধান আগ্রহ হলো হ্যান্ড ড্রইং, যা শিল্প জগত নিয়ে তার চিন্তাকে তুলে ধরে।