প্রবেশগম্যতা সেটিংস

অলংকরণ: ন্যুক

লেখাপত্র

বিষয়

রাষ্ট্র-ঘনিষ্ঠ ওলিগার্ক এবং সরকারি অর্থ আত্মসাৎ: এশিয়ায় অবৈধ অর্থপ্রবাহ অনুসন্ধান

আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:

সীমান্ত অতিক্রম করে নিয়মিতভাবেই অবৈধভাবে অর্থপাচার করা হচ্ছে, আর এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ছে এশিয়াতেও। এই অঞ্চলের অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা এমন সব প্রতিবেদন উন্মোচন করেছেন যেখানে অর্থনৈতিক অনিয়মের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। লুটেরা স্বৈরশাসক, নতুন জুয়া কেন্দ্র, এবং চুরি করা অর্থ গোপন রাখার বিশাল নেটওয়ার্কের কর্মকাণ্ডকে সাংবাদিকরা সামনে এনেছেন।

ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহির আওতায় আনা ও দুর্নীতি উন্মোচন করা এই প্রতিবেদনগুলো তৈরি হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা চরম চ্যালেঞ্জের মুখে। যখনই সাংবাদিকরা কোনো অনিয়ম উন্মোচনের সাহস দেখায় তখন সরকার স্থানীয় গণমাধ্যম মালিকানায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করে, আর বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করে দেয়।

এমন সব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বহু অনুসন্ধানী কাজ এশিয়াজুড়ে অর্থ পাচার ও সরকারি দুর্নীতি উন্মোচন করে চলেছে। এসব অনুসন্ধানী প্রকল্পের কোনো কোনোটা আন্ত:সীমান্ত এবং কঠোর তথ্য ও নিরাপত্তা উদ্বিগ্নতার মধ্যেই পরিচালিত হয়। মহাদেশজুড়ে চোখে পড়ছে নানা প্রবণতা: কেউ কেউ দুর্নীতিবাজ স্বৈরশাসক হয়ে নিজ দেশের কোষাগার লুট করছে, আবার সংগঠিত অপরাধচক্রগুলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নতুন এক জুয়ার কেন্দ্র গড়ে তুলছে, যা অর্থ পাচারের জন্য বিশেষভাবে তৈরি। মোটের ওপর, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২৪ সালের করাপশন পারসেপশনস ইনডেক্স (সিপিআই) অনুসারে, “এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের সরকারগুলো এখনো দুর্নীতি দমন সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। বহু বছরের অনড় অবস্থানের পর, ২০২৪ সালে এই অঞ্চলের গড় স্কোর এক পয়েন্ট কমে ৪৪ হয়েছে।”

জিআইজেএন এশিয়ায় অনুসন্ধানী প্রকল্পে যুক্ত কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা তাদের অভিজ্ঞতা ও চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি আন্তসীমান্ত সহযোগিতার গুরুত্ব নিয়েও মতামত জানিয়েছেন।

কিরগিজস্তানে সরকারের দমনপীড়নের মধ্যে সাংবাদিকতা

একসময় মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলোর মধ্যে কিরগিজস্তান ছিল সবচেয়ে গণতান্ত্রিক দেশ। সেখানে হতো প্রকৃত নির্বাচন, ছিল সক্রিয় নাগরিক সমাজ ও প্রাণবন্ত গণমাধ্যম। কিন্তু একজন জনপ্রিয়তাবাদী ও ক্রমেই স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা প্রেসিডেন্টের অধীনে একাধিক স্বাধীন গণমাধ্যম ভয়াবহ চাপে পড়েছে (এর মধ্যে দেশের দুইটি প্রধান অনুসন্ধানী গণমাধ্যম ক্লুপ ও তেমিরোভ লাইভ রয়েছে) কিংবা বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে (যেমন সম্প্রচারমাধ্যম এপ্রিল টিভি)। এছাড়া অনেক সাংবাদিককে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বা নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। যারা এখনো মুক্ত থেকে সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করছেন, তারা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সঙ্গে অংশীদার হয়ে নিজেদের দেশে অবৈধ অর্থ ও দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন।

OCCRP, All the President's Men, Kyrgyzstan

ছবি: স্ক্রিনশট, ওসিসিআরপি

এই সহযোগিতামূলক অনুসন্ধানগুলোর একটি হচ্ছে অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন। এটি বিশ্লেষণ করেছে কীভাবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট সরকারি ব্যয়ের স্বচ্ছতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছেন। একই সঙ্গে একের পর এক ব্যয়বহুল নতুন রাষ্ট্রীয় প্রকল্প চালু করেছেন যা তার সরকারের ক্ষমতা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তৈরি। তেমিরভ লাইভ, ক্লুপ এবং ওসিসিআরপি ১১টি বড় রাষ্ট্রীয় নির্মাণ প্রকল্প পরীক্ষা করেছে। যার মধ্যে রয়েছে একটি বিমানবন্দর, রাষ্ট্রপতির বাসভবন এবং একটি রেললাইন। এবং পাঁচটি কোম্পানিকে শনাক্ত করা হয়েছে, যাদের সঙ্গে এই প্রকল্পগুলোর জন্য চুক্তি হতে পারে। এই পাঁচটি কোম্পানি একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। এবং তাদের মালিক বা পরিচালকরা প্রেসিডেন্ট বা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কর্মকর্তার কিংবা রাষ্ট্রপতির প্রশাসনিক পরিচালকের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। শুধু এই ছয়টি প্রকল্পের আনুমানিক খরচই ১ কোটি ৩৭ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি।

যদিও সাংবাদিকরা কোম্পানি নিবন্ধনের কাগজপত্র এবং জমির রেকর্ড পর্যালোচনা করেছেন কিন্তু সরকারি ক্রয়ের তথ্য এখন আর পাওয়া যায় না। তারা কিছু কোম্পানির মালিক বা পরিচালকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টও বিশ্লেষণ করেছেন, যার মাধ্যমে তাদের এবং প্রশাসনিক পরিচালকের মধ্যে অনেক সম্পর্কের সূত্র বের করা গেছে। এছাড়া, তারা ওই সংস্থার অভ্যন্তরীণ কাজকর্ম সম্পর্কে জানাশোনা একজন ব্যক্তিকে খুঁজে বের করেছেন। এই ব্যক্তিটি দমন-পীড়নের ভয়ের কারণে পরিচয় গোপন রেখে কথা বলেছেন এবং কিছু প্রকল্প কীভাবে পরিচালিত হয় তার অভ্যন্তরীণ তথ্য প্রদান করেছেন। (এই প্রতিবেদন সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রশ্নের জবাবে কিরগিজ প্রেসিডেন্ট বা তার পরিচালকের প্রধান কেউই সাংবাদিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।)

বলোত তেমিরভ, ‍২০২০ সালে যিনি শুরু করেন নিজের একটি অনুসন্ধানী ইউটিউব চ্যানেল। তিনি বলেন, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকদদের ওপর যেভাবে দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে ও স্বচ্ছতার অবনতি ঘটছে তা মোকাবিলায় সৃজনশীল হতে হবে। বিশেষ করে এমন দেশগুলোতে যেখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দ্রুত অবণতি ঘটছে, যেমন কিরগিজস্তান।  বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে তার অনুসন্ধানী কাজ থামানো ও কণ্ঠরোধ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ২০২২ সালে যেমন তেমিরভের কিরগিজ নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয় এবং তাকে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা হয়

তেমিরভ উল্লেখ করেন, “রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বারা পরিচালিত সরকারি ক্রয়ের একটি বিশাল অংশ লুকানো হয়েছে, একই সঙ্গে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের ব্যাপকভাবে নিপীড়ন করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে তথ্য খুঁজে বের করা ও যাচাই ক্রমশ কঠিন হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যখন অনেক সাংবাদিককে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সোর্স এবং অভ্যন্তরীণ তথ্যদাতাদের গুরুত্ব বেড়ে যায়, তেমনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশ্লেষণ এবং সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে তথ্য চেয়ে সরাসরি অনুরোধের কাজগুলোও কঠিন হয়ে পড়ে।”

কিরগিজ অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সঙ্গে ওসিসিআরপির এটাই প্রথম কোনো সহযোগিতামূলক প্রকল্প নয়। ২০১৯ সালে ওসিসিআরপি, ক্লুপ এবং আরএফই/আরএল কিরগিজ সার্ভিস যৌথভাবে একজন ব্যবসায়ীর সম্পদের উৎস অনুসন্ধান করে। কিরগিজস্তানসহ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে এই ব্যক্তির সম্পদ রয়েছে। এই অনুসন্ধানটি কিরগিজস্তানের কাস্টমস সার্ভিসের ব্যাপক দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

ওসিসিআরপি, আরএফই/আরএল উজবেক সার্ভিস ক্লুপ এবং কাজাখস্তানের ভলাস্ট আরও অনুসন্ধান করে দেখেছে কিভাবে একই ব্যবসায়ী ও তার পরিবার কিরগিজস্তান ছাড়িয়ে মধ্য এশিয়ার অন্যান্য দেশে তাদের প্রভাব এবং বিনিয়োগ সম্প্রসারিত করেছে। এর ফলাফল হিসেবে তৈরি হয়েছে দ্য শ্যাডো ইনভেস্টর প্রকল্প—যেখানে দেখানো হয়েছে উজবেক এবং কিরগিজ কর্তৃপক্ষের কিভাবে এই বিনিয়োগগুলোকে স্বাগত জানিয়েছে। যা তাশকন্দের আকাশরেখা বদলে দিয়েছে এবং বিশকেকের নগর উন্নয়নকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে।

এই প্রসঙ্গে সাংবাদিক তেমিরভ বলেন, “ওসিসিআরপি একটি বিশাল নেটওয়ার্ক যা কিরগিজ সাংবাদিকদের দারুণ সব সহায়তা এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করে। ওসিসিআরপির সঙ্গে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রকাশ আমাদের জন্য ঝুঁকি ভাগাভাগি করা এবং বার্তাটি আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ দেয়, যাতে আন্তর্জাতিক পাঠকও কিরগিজস্তানের দুর্নীতির কথা জানতে পারেন।”

কাজাখস্তানের ফাঁস হওয়া চিঠিপত্রে দুর্নীতি উন্মোচিত

শুরুতে আরএফই/আরএল কাজাখ সার্ভিসের সাংবাদিকরা উত্তর-পশ্চিম কাজাখস্তানের বেরেজোভকা গ্রামে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত অবস্থার ওপর একটি রিপোর্ট করতে যায়, কিন্তু পরবর্তীতে তা মোড় নেয় অনুসন্ধানী প্রকল্পে। এটি আইসিআইজে এবং ২৬টি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক গণমাধ্যমকে একত্রিত করে। ভূমিষ্ঠ হয় ক্যাস্পিয়ান ক্যাবলস প্রকল্প। যেটি বিশ্লেষণ করেছে কীভাবে কাজাখস্তানের বিশাল অপরিশোধিত তেলের মজুদ থেকে রাশিয়া হয়ে কৃষ্ণ সাগর পর্যন্ত ৯৩৯ মাইল দীর্ঘ ক্যাস্পিয়ান পাইপলাইন পরিবেশগত ধ্বংস এবং আর্থিক দুর্নীতির কারণ হয়ে উঠেছে।

Asia Focus, ICIJ Caspian Cabals

দুই বছরের দীর্ঘ সময় ধরে এই আন্তঃরাষ্ট্রীয় সাংবাদিক দলের সদস্যরা শত শত সোর্সের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে তেল শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা এবং প্রাক্তন নির্বাহীরা। তারা বিশাল পরিমাণ ফাঁস হওয়া অভ্যন্তরীণ কর্পোরেট নথি, গোপন ইমেইল, চুক্তি, অডিট, জমির রেকর্ড, এবং আদালত ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার দাখিলকৃত নথি পর্যালোচনা করেছেন। অনুসন্ধানটি প্রকাশ করেছে যে, লাভের জন্য পশ্চিমা কোম্পানিগুলো—যারা পাইপলাইনের অংশীদার এবং সরবরাহকারী তিনটি কাজাখ তেল ক্ষেত্র পরিচালনা করে—তারা রাশিয়ান এলিটদের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যবসায় এবং কাজাখস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের ধনী জামাইয়ের আংশিক মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে শত কোটি ডলারের চুক্তি অনুমোদন করেছে।

“আইনি ফাঁকফোকর এবং বিধিনিষেধমূলক প্রথার সুবিধা নিয়ে দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তারা ও তাদের সহযোগীরা নিজেদের সম্পদ লুকানোর ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে উঠেছে” বলে মনে করেন অনলাইন প্রকাশনা ভলাস্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা ভ্যাচেস্লাভ আব্রামভ। প্রকাশনাটি এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ২০১২ সালে যৌথভাবে ভলাস্ট প্রতিষ্ঠার পর থেকে আব্রামভ এটিকে কাজাখস্তানের প্রধান অনুসন্ধানী গণমাধ্যমে পরিণত করেছেন এবং আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী নেটওয়ার্কগুলোর সঙ্গে কাজের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত করেছেন।

“কাজাখস্তানের জমি নিবন্ধন ব্যবস্থা এমন বিধিনিষেধের একটি তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ,” আব্রামভ ব্যাখ্যা করেছেন। “যদি জমি আইনি সত্তার নামে নিবন্ধিত থাকে, সাংবাদিকরা তার মালিকানার তথ্য দেখতে পারেন, তবে  ব্যক্তিগত তথ্য গোপনীয়তা রক্ষা করার অজুহাতের নামে গোপন রাখা হয়। বাস্তবে, যা রিপোর্টারদের জন্য জমির মালিকানা এবং মালিকানার ধরন খুঁজে বের করার কাজগুলোকে কঠিন করে তোলে।”

বর্তমান কাজাখ প্রেসিডেন্ট তার পূর্বসূরি এবং পরামর্শদাতা নুরসুলতান নাজারবায়েভের কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে কোনঠাসা করার দিকে ঝুঁকেছেন। কর্মকর্তাদের সম্পদের তথ্য রেকর্ডের নথি সংগ্রহের মতো জটিলতা কাজাখস্তানের অনুসন্ধানী কাজের জন্য বড় রকমের চ্যালেঞ্জ তৈরি করে এবং ফাঁস হওয়া অভ্যন্তরীণ নথি অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলে।

একটি ফাঁস হওয়া নথিতে এবার প্রকাশ পায় সুইস নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিনমা এবং প্রাইভেট ব্যাংক রেইল ইন্টেসা সানপাওলোর মধ্যে আদান-প্রদান করা চিঠিপত্র। এতে দেখা যায়, ব্যাংকটি স্বৈরশাসক শাসনব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত সন্দেহজনক গ্রাহকদের আকৃষ্ট করছিল। রেইলের গ্রাহকদের তালিকায় ছিলেন কাজাখস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্টের মেয়ে—যিনি ক্ষমতায় থাকার দুই দশকে নিজের ও পরিবারের জন্য বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছিলেন এবং উজবেকিস্তানের দীর্ঘমেয়াদি শাসকের জামাতা। এই অনুসন্ধানটি পরিচালনা করেছে ওসিসিআরপি। এতে উঠে এসেছে, কীভাবে মধ্য এশিয়ার সরকার-ঘনিষ্ঠ অভিজাতরা তাদের দেশের সম্পদ বিদেশি ব্যাংকে পাচার করছিলেন। তবে রেইল ব্যাংক এই ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়। বরং তারা জানায়, “তারা সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পুরোপুরি সহযোগিতা করছে এবং সব ধরনের আইন-কানুন মেনে চলাকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে।”

“আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী নেটওয়ার্কের সঙ্গে সহযোগিতা কাজাখস্তানে স্বাধীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে,” বলেন আরএফই/আরএল কাজাখ সার্ভিসের সাংবাদিক মানাস কাইরটাইয়েভ। তিনি দ্য ক্যাস্পিয়ান ক্যাবালস প্রকল্পে কাজ করেছেন এবং সিফোরএডিএস-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যা একটি অলাভজনক সংস্থা, বিশ্বব্যাপী অবৈধ নেটওয়ার্ক ও দুর্নীতিকে প্রতিহত করাই যার লক্ষ্য। কাইরটাইয়েভ আন্তর্জাতিক মিডিয়া অংশীদারদের আহ্বান জানান, তারা যেন শুরু থেকেই কাজাখ সাংবাদিকদের এসব অনুসন্ধানে সম্পৃক্ত করে।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, “শুরুর দিকে যুক্ত করা হলে আমরা নতুন প্রযুক্তিগত দক্ষতাগুলো আয়ত্ব করার আরও ভালো সুযোগ পাই, যৌথভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচার সহজ হয়, আর এসব অনুসন্ধানে কাজাখস্তানের অভ্যন্তরীণ দৃষ্টিভঙ্গিও প্রতিফলিত হয়।”

বাংলাদেশি অভিজাতদের দুবাইয়ের আবাসন খাতে বিনিয়োগ

২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্রদের নেতৃত্বে হওয়া এক গণঅভ্যুত্থানে দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নতুন রাজনৈতিক পরিবেশে বাংলাদেশের অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যমের সামনে সুযোগ তৈরি হয়েছে—কীভাবে প্রভাবশালী সরকারি ব্যক্তিরা রাষ্ট্রীয় কোষাগার ও ব্যাংকিং খাত লুটপাট করেছেন তা খতিয়ে দেখার। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের একটি শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়, পূর্ববর্তী সরকারের আমলে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার করা হয়েছে। এই লুটপাটের কৌশল মধ্য এশিয়ার স্বৈরশাসকদের সঙ্গে মিলে যায়—অতিরিক্ত কর ছাড়, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো রাষ্ট্রীয় চুক্তি ও কমিশন, আর সন্দেহজনক জমি কেনাবেচা, যা থেকে সুবিধা পেয়েছে শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ কোম্পানি ও ব্যক্তিরা।

 জনগণের টাকা কোথায় গেছে, এ নিয়ে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে—স্বৈরশাসক ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা কীভাবে ফাঁকফোকর ব্যবহার করে নিজেদের দেশ লুট করেছে।

দুবাই ল্যান্ড ডিপার্টমেন্টের নথি ও সি ফোর এ ডি এস (C4ADS)-এর ডেটা ব্যবহার করে—এবং ওসিসিআরপির ২০২৪ সালের দুবাই আনলকড অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে—বাংলাদেশের দ্য ডেইলি স্টার খুঁজে পায়, অন্তত ৪৬১ জন বাংলাদেশি দুবাইয়ে ৯২৯টি সম্পত্তির মালিক, যার মূল্য ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এই সম্পত্তির মালিকদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের কয়েকজন সংসদ সদস্য এবং দেশের কিছু শীর্ষ ব্যবসায়ী। এদের অনেকের বিরুদ্ধে বর্তমানে দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, কোম্পানির আর্থিক কেলেঙ্কারি কিংবা দেশে মিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ না করার অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রীকে নিয়ে করা আল জাজিরার অনুসন্ধানটি সম্প্রতি ডিগ অ্যাওয়ার্ড জিতে নিয়েছে। দ্য গার্ডিয়ান খুঁজে বের করে যে ওই মন্ত্রী—যার সরকারি বেতন বছরে ছিল মাত্র ১৩ হাজার মার্কিন ডলার—যুক্তরাজ্যে ৩৬০টি সম্পত্তির মালিক হয়েছেন, যার মোট মূল্য ৩২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। অথচ এ সম্পত্তির কোনো তথ্যই তিনি বাংলাদেশে কর কর্তৃপক্ষকে জানাননি। বাংলাদেশি গণমাধ্যমে অনুসন্ধানী এই তথ্যগুলো নিয়ে ব্যাপকভাবে সংবাদ প্রকাশিত হলে সরকার যুক্তরাজ্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করে সমর্থ হয় যে, তারা যেন আগের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত সম্পদগুলো ফ্রিজ করে এবং চুরি যাওয়া সরকারি অর্থ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে সহযোগিতা করে। (আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক ভূমিমন্ত্রী দাবি করেন, বিদেশে তার বৈধ ব্যবসা থেকে অর্জিত অর্থ দিয়েই এই সম্পত্তিগুলো কেনা হয়েছে।)

Asia Focus, Al Jazeera, The Minister's Millions

বাংলাদেশের দৈনিক প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদক ফখরুল ইসলাম হারুন বলেন, “বাংলাদেশি সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আরও সহযোগিতা পাওয়া দরকার এবং তারা এমনটা প্রত্যাশাও করেন।”

হারুনের মন্তব্যটি এশিয়া এবং এশিয়ার বাইরের সাংবাদিকদের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন, দ্য মিনিস্টার’স মিলিয়নস এবং দ্য ক্যাস্পিয়ান ক্যাবালস-এর মতো অনুসন্ধানগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরে আর্থিক দুর্নীতি উন্মোচনের মতো বিষয় নিয়ে যৌথভাবে কাজ করলে গল্পগুলো আরও বড় ও শক্তিশালী হয়, যা শেষ পর্যন্ত  বড় ধরনের প্রভাব রাখার পাশাপাশি মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করে। কোনো স্বৈরশাসক যতই বাধা দেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা একসঙ্গে কাজ করলে অর্থের গতিপথ অনুসরণের উপায় খুঁজে নিতে পারেন।


Sher Khashimov - Headshot

শের খাশিমভ তাজিকিস্তানের একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক গবেষক। তিনি মূলত সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ডিজিটাল রাজনীতি, শ্রম অভিবাসন এবং সামাজিক বিষয় নিয়ে পূর্ব ইউরোপ, মধ্য এশিয়া ককেশাস অঞ্চলে কাজ করেন। তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে আল জাজিরা, ফরেন পলিসি, নিউ লাইনস ম্যাগাজিন, কোডা স্টোরি, মেদুজা এবং আরও বিভিন্ন মাধ্যমে।

 

ন্যুক ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বর্তমানে সিওলের হানইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড আর্ট এডুকেশন বিভাগের ছাত্র এবং একই সঙ্গে ইলাস্ট্রেটর হিসেবে কাজ করছেন। ২০২১ সালে হিডেন প্লেস–এ প্রদর্শনীর পর থেকে তিনি বিভিন্ন ইলাস্ট্রেশন প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। তার প্রধান আগ্রহ হলো হ্যান্ড ড্রইং, যা শিল্প জগত নিয়ে তার চিন্তাকে তুলে ধরে।

 

ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে আমাদের লেখা বিনামূল্যে অনলাইন বা প্রিন্টে প্রকাশযোগ্য

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

জিআইজেসি২৫ সাক্ষাৎকার

রিপোর্টারের এআই নিয়ে গল্প থাকে: তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝুঁকি সম্পর্কে বলেছেন এই সাংবাদিক

বার্তাকক্ষগুলো গভীর অনুসন্ধানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়। যাদের দায়বদ্ধ করা দরকার তারা ক্রমশ ধনী আর ক্ষমতাবান হচ্ছে। অনেকে সাংবাদিকতা ছেড়ে প্রযুক্তি কোম্পানির যোগাযোগ দলে যোগ দিচ্ছেন। তাই অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আরও বেশি সৃজনশীল হতে হবে—যাতে সীমিত সম্পদ দিয়েও বেশি কাজ করা যায়।

জিআইজেসি২৫: যে কারণে বিশেষজ্ঞদের আলোচনা সাংবাদিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

৩০০-এর বেশি শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিক, ডেটা গুরু এবং বিশ্বখ্যাত বিশেষজ্ঞরা-বক্তা হিসেবে অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। যাদের মধ্যে প্রায় ১০০ জনই আয়োজক মহাদেশ এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করবেন। তাই ভৌগোলিক বৈচিত্র্য আর বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান-অভিজ্ঞতার মিশেলে জিআইজেসি হতে যাচ্ছে একটি অনন্য আয়োজন।  

অনুসন্ধান পদ্ধতি পরামর্শ ও টুল সংবাদ ও বিশ্লেষণ

বার্তাকক্ষে এআই চ্যাটবট: যেভাবে নিজেদের রিপোর্ট ব্যবহার করে বাড়ানো যায় পাঠকের আস্থা

সোশ্যাল মিডিয়া এখন আর গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে খুব একটা অগ্রাধিকার দিচ্ছে না, তাহলে আপনি কীভাবে আপনার পাঠকের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন? কীভাবে টেকসই ট্রাফিক বজায় রাখবেন এবং পাঠককে আপনার কনটেন্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখবেন?

সংবাদ ও বিশ্লেষণ

ব্রাজিলের ফ্যাক্ট-চেক প্রকল্পের নতুন উদ্যোগ: ভুল তথ্য শনাক্তে লেবেল নয়, গুরুত্ব পাবে উৎস ও কৌশল

ব্রাজিলে যৌথভাবে পরিচালিত ফ্যাক্ট-চেক উদ্যোগ কমপ্রোভা। এটি এখন আর “মিথ্যা,” “বিভ্রান্তিকর,” “ব্যঙ্গাত্মক” বা “প্রমাণিত”—এই ধরনের  শব্দ বা লেবেলগুলো ব্যবহার করছে না। বরং ভুয়া তথ্য মোকাবিলায় তারা আরও কার্যকর ও বড় পরিসরে কাজ করছে।