প্লেনস্পটার এবং পরিবহন পর্যবেক্ষকদের বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আপনার অনুসন্ধানে যেভাবে সহায়তা করতে পারে
পরিবহনের হালচাল নিয়ে আগ্রহী পর্যবেক্ষকেরা প্রায়ই জনপ্রিয় মাধ্যম ও মিডিয়াতে এ বিষয়ে কৌতুক করে থাকেন। এদের মধ্যে কেউ অবসরে যাওয়া প্রকৌশলী, কেউবা নিজেদের শখ পূরণে জোট বেঁধেছেন। এই পর্যবেক্ষকেরা ট্রেন, যুদ্ধবিমান, জাহাজ, কিংবা রকেটের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিয়ে মেতে থাকতে এতটাই ভালোবাসেন যে সব ধরনের পরিস্থিতিতে সেগুলোর ছবি তোলেন এবং অনলাইন ফোরামে যানবাহনের মডেলের সূক্ষ্ম পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করেন। শৌখিন এই যানবাহন পর্যবেক্ষকদের “প্লেনস্পটার” বা “ফোমার” নামেও ডাকা হয়।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নিকার২৫ ডেটা সাংবাদিকতা সম্মেলনে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা বলেন, শৌখিন এই পর্যবেক্ষকেরা খবরের চেয়ে এ সম্পর্কিত প্রযুক্তি নিয়ে বেশি আগ্রহী। তবে নিজ নিজ শখের পেছনে ছোটা এই মানুষগুলো অনেক বেশি কাজের, গণমাধ্যম-বান্ধব ও তথ্যের উৎস হিসেবে কাজ করে থাকেন। বিশেষায়িত ম্যাগাজিনের মতোই তাদের কাছ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য ও পরামর্শ পাওয়া যায়। যদিও তাদের খুব একটা কাজে লাগানো হয় না। সাংবাদিকদের তাই পরিবহন শনাক্ত ও চিহ্নিত করতে এবং অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজনীয় পরিভাষা শিখতে র্যাডিটের মতো অনলাইন ফোরাম এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে ‘সৃজনশীল উপায়ে’ তাদের খুঁজে বের করতে হবে।
গত বছর ক্যারিবিয়ান দ্বীপ টোবাগোতে উল্টে পড়ে তেল ছড়িয়ে দেওয়া একটি জাহাজ শনাক্ত করতে গিয়ে ওপেন সোর্স অনুসন্ধানী সংস্থা বেলিংক্যাটের গবেষকরা প্রথমে বিপাকে পড়েছিলেন। তাদের কাছে কেবল ছিল উল্টো হয়ে থাকা কমলা রঙের জাহাজের কাঠামোর একটি ছবি, যেটি মূলত ছড়িয়ে পড়েছিল সোশ্যাল মিডিয়াতে। নিকার সম্মেলনে বেলিংক্যাট গবেষক লোগান উইলিয়ামস বলেন, তিনি শৌখিন সমুদ্রযানপ্রেমীদের প্রযুক্তিগত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে এই অনুসন্ধানটি চালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
প্রথমত, শিপস্পটিংডটকম (ShipSpotting.com) ফোরামের একজন অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষকের চোখে পড়ে যে, জাহাজের কাঠামোর ওপরের কিছু দাগ আসলে “পিজন হোল” ল্যাডার, যা সাধারণত ইঞ্জিনচালিত কোনো জাহাজে থাকার কথা নয়। কারণ, এ ধরনের জাহাজে নাবিকেরা থাকেন, যাঁরা অন্যদের উঠতে সহায়তা করেন। এই সূত্র ধরে উইলিয়ামস আবিষ্কার করেন এটি আসলে কোনো জাহাজ নয়, বরং ইঞ্জিনবিহীন মালবাহী বার্জ (যা অন্য জাহাজের সাহায্যে টানা হয়)। উইলিয়ামস ব্যাখ্যা করেন, “এ তথ্যটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বার্জগুলোকে অন্যভাবে নিবন্ধন করা হয় এবং এগুলোর অবস্থানসংক্রান্ত তথ্যও কম পাওয়া যায়।”
কিন্তু কীভাবে তিনি বার্জটি টেনে নেওয়া টাগবোটের সন্ধান পেলেন? উইলিয়ামস বিভিন্নভাবে গুগল সার্চ করে তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত, কিন্তু বিস্তারিত তথ্যসমৃদ্ধ ওয়েবসাইট টাগবোটইনফরমেশনডটকম (tugboatinformation.com)-এ টাগবোটটির খোঁজ পান।

টোবাগো উপকূলে ১০ কিলোমিটারজুড়ে তেল ছড়িয়ে দেওয়া উল্টে যাওয়া জাহাজের ছবি—যা পরবর্তী সময়ে বার্জ হিসেবে শনাক্ত হয়। শৌখিন সমুদ্রযানপ্রেমীদের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বেলিংক্যাট অবশেষে জাহাজটির নাম-ঠিকানা সম্পর্কে আরও তথ্য খুঁজে বের করে। (ছবি: স্ক্রিনশট, টোবাগোর প্রধান সচিবের কার্যালয়)
সুইডেনের গোটা মিডিয়ার ডেটা সম্পাদক হেলেনা বেঙ্গটসন জানান,সুইডিশ সাংবাদিক ফ্রেডরিক লরিনের মতো সাংবাদিকরা প্লেনস্পটিং করেন এমন শৌখিন লোকেদের অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা ব্যবহার করে সিআইএর রেনডিশন ফ্লাইট (সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের গোপনে অন্য দেশে সরিয়ে নেওয়া) নিয়ে বৈশ্বিক অনুসন্ধান চালিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, শৌখিন এই পর্যবেক্ষকেরা খুশিমনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন তথ্য দিতে আগ্রহী থাকেন—যেমন কোনো বিমানের লেজ নম্বর, মালিকানা বা ট্র্যাকিং সম্পর্কিত তথ্য। গালফস্ট্রিম ভি রেনডিশন জেট নিয়ে লরিনের অনুসন্ধানে তাঁরা সহায়তা করেছিলেন, যেখানে লেজ নম্বর ছিল N379P।
তবে অপেশাদার এই উৎসগুলো নিয়ে কিছু সমস্যাও রয়েছে বলে সতর্ক করেন হেলেনা বেঙ্গটসন। তিনি বলেন, “এদের কাজের ধারাবাহিকতা নেই, তাঁরা সব তথ্য সংগ্রহ করে না, কখনও কখনও ভুল করেন এবং কিছু ক্ষেত্রে তাঁরা সমাজকর্মীর ভূমিকায়ও অবতীর্ন হতে পারেন।”
শৌখিন পর্যবেক্ষকদের পরিচালিত কিছু ওয়েবসাইটে এ সম্পর্কিত বিভিন্ন খবর প্রকাশ করা হয়। তাঁরা পরিষেবা বিক্রি ও বিজ্ঞাপন থেকে আয় করেন। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, কিছু অভিজ্ঞ কিন্তু অপেশাদার পর্যবেক্ষক “ফ্যানবয়” হতে পারেন, যাঁরা কোনো নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড বা যানবাহনের একটি বিশেষ মডেলকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে পারেন। এছাড়া, তাদের ডেটাবেসে প্রায়ই তথ্য সংগ্রহের সীমাবদ্ধতা বা ব্যবহৃত পদ্ধতি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা থাকে না।
শৌখিন এসব পর্যবেক্ষকদের ইন্টারনেটে হাজারো সাইট ও চ্যাট গ্রুপ রয়েছে। বিগ লোকাল নিউজের ডেটা সাংবাদিক আইরিন ক্যাসাদো সানচেজ পরামর্শ দেন, সাংবাদিকরা র্যাডিটে এ গ্রুপগুলোকে খুঁজে পাবেন কিংবা “log a sighting” বা “forum” এ ধরনের শব্দ দিয়ে গুগলে সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটগুলো খুঁজতে পারেন। তিনি আরো জানান যে, “সোশ্যাল মিডিয়ার এই গ্রুপগুলো সবসময় সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে আমি এভাবে ‘site:facebook.com’ লিখে গুগলে টার্গেটেড সার্চ ব্যবহার করব। যদি দেখি, কেউ র্যাডিট বা ফেসবুকে ট্রেন বা উড়োজাহাজের বিশেষ কোনো প্রসঙ্গে প্রচুর তথ্য শেয়ার করছেন, তাহলে আমি সরাসরি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানার চেষ্টা করব যে, তিনি আর কী জানেন।”
উইলিয়ামস কিছু নির্ভরযোগ্য উদাহরণ তুলে ধরেন—
- বেসামরিকবিমানপর্যবেক্ষণেরজন্য: জেটফটোসডটকম এবং এয়ারলাইনার্সডটনেট
• জাহাজ চলাচল পর্যবেক্ষণের জন্য: বসফরাস অবজারভার এবং শিপস্পটিং ডটকম
• রকেট পর্যবেক্ষণের জন্য: নাসাস্পেসফ্লাইট (যা নাসার সঙ্গে যুক্ত নয়) এবং ল্যাবপ্যাড্রে
• সামরিক বিমান ও স্কোয়াড্রন পর্যবেক্ষণের জন্য: এয়ারফোর্সেস মান্থলি এবং টাইমস অ্যারোস্পেস-এর মতো ম্যাগাজিন।
উইলিয়ামস বলেন, “এই সাইটগুলোর মধ্যে কিছু হয়তো অনেকেরই অজানা; এগুলো সাধারণত এমন ব্যক্তিরা চালান, যাদের শখ হলো বন্দরে গিয়ে জাহাজের ছবি তোলা।” তিনি আরও বলেন, “ইস্তাম্বুলের এক ব্যক্তি, যিনি অনলাইনে ’বসফরাস অবজারভার’ (Bosphorus Observer) নামে পরিচিত—আমরা তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনে কাজ করেছি। তিনি বসফরাস প্রণালী দিয়ে যাওয়া প্রায় সব আকর্ষণীয় জাহাজের ছবি তোলেন। কৃষ্ণসাগরে সামরিক বহর যাওয়া-আসা এবং শস্য পাচারের ক্ষেত্রে বসফরাস প্রণালী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।”
এ প্রসঙ্গে উইলিয়ামস আরও জানান, শৌখিন পর্যবেক্ষকদের গ্রুপগুলোর আরেকটি দারুণ সুবিধা হলো—তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর মূল শব্দ ও পরিভাষা প্রকাশ করে—গভীর অনুসন্ধানের জন্য যা দরকারি হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ইউরোপে পারমাণবিক অস্ত্র সংরক্ষণের বিষয়ে তাঁর এক সহকর্মীর অনুসন্ধানের মূল চাবিকাঠি ছিল অনলাইন চ্যাট ফোরাম থেকে পাওয়া কিছু বিশেষজ্ঞ পরিভাষা। তিনি বলেন, এই ফোরামগুলো থেকে জানা যায় যে, “WS3” মানে “ ওয়েপনস স্টোরেজ অ্যান্ড সিকিউরিটি সিস্টেম” এবং ” PAS” মানে হলো উড়োজাহাজের আশ্রয়কেন্দ্র খুঁজে বের করার মূল শব্দ। (PAS: Protective Aircraft Shelter; হামলা থেকে বাঁচাতে যেখানে সামরিক উড়োজাহাজ রাখা হয়)। এছাড়া, “vault” শব্দটি বোমা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এই পরিভাষাগুলো ব্যবহার করে, বেলিংক্যাট গবেষক ফোকে পোস্টমা সরাসরি এমন তথ্যের সন্ধান পান, যা গুরুতর নিরাপত্তা লঙ্ঘনের প্রমাণ সামনে আনে।

শখের অনুরাগীদের চ্যাট ফোরাম থেকে বেলিংক্যাট গবেষক যখন “WS3” শব্দটির গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারেন, তখন তিনি তাঁর প্রতিবেদনের জন্য আরও উৎস শনাক্ত করতে সক্ষম হন। এর মধ্যে ছিল একটি অনলাইন মানচিত্র, যা ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এবং যাতে নেদারল্যান্ডসের ভলকেল এয়ার বেসে “Hangars with WS3-Vaults” দেখানো হয়েছিল। ছবি: স্ক্রিনশট, বেলিংক্যাট
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। এর আগে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসের প্রধান প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন। একজন বিদেশী সংবাদদাতা হিসেবে তিনি বিশ্বের দুই ডজনেরও বেশি দেশের সংবাদ, রাজনীতি, দুর্নীতি এবং সংঘাতের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।