প্রবেশগম্যতা সেটিংস

লেখাপত্র

২০২০ সালে কেমন হবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার চেহারা?

English

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সম্ভবত এর আগে কখনো এত এত কঠিন সময় পার করেনি। চারিদিকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থান ঘটছে; রাজনৈতিক নেতারা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠিত করছে সামাজিক নিয়ন্ত্রন, বদলে দিচ্ছেন রাজনীতির ভাষ্যটাকেই। তার সাথে আছে সংবাদমাধ্যমের টিকে থাকার সংগ্রাম, এবং সাংবাদিকদের সাথে হওয়া অপরাধের বিচারহীনতা। সামনের বাধাগুলো কঠিন, আর সমাধানের পথটাও আমাদেরই তৈরি করে নিতে হবে।

২০২০ সাল তাহলে কেমন যাবে? জিআইজেএন থেকে আমরা এই প্রশ্ন রেখেছি সাংবাদিকতা জগতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে। আমরা জানতে চেয়েছি – অনুসন্ধানী ও ডেটা সাংবাদিকতায় নতুন কী আসবে, চ্যালেঞ্জগুলো কোথায়, আর নতুন কোন কোন কৌশল বা দক্ষতা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

জাফর আব্বাস (পাকিস্তান)

সম্পাদক, ডন

স্থানীয় ও বৈশ্বিক প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে সাংবাদিকদের কাছে গোপন তথ্য ফাঁস করার প্রবণতা বাড়বে, কিন্তু এর সবই হবে অনলাইনে। যিনি তথ্য ফাঁস করছেন তিনি যদি নাম-পরিচয় গোপন না-ও করেন, তবুও তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

এটি বেশ গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হতে যাচ্ছে। কারণ একদিকে তথ্য ফাঁসের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ থাকবে এবং স্টোরিটা নিয়ে কখন আরো বিস্তারিত অনুসন্ধান দরকার, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়াও কঠিন হয়ে পড়বে। সোর্সের দেওয়া তথ্য কতখানি বিশ্বাস করা যায়, তা নিয়েও থাকবে দ্বিধা। অন্যদিকে, অনলাইনের চরিত্রই এমন যে, মূলধারার সাংবাদিকরা যদি সেই তথ্য উপেক্ষাও করেন, অন্যরা তা ঠিকই লুফে নেবে। সাংবাদিকরা নৈতিকতার যে পুরোনো রীতিনীতি অনুসরণ করেন, সেগুলো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে। প্রযুক্তি ও সংস্কৃতিতে আসা পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার মত, নতুন নৈতিক মানদণ্ড প্রয়োজন হয়ে পড়বে।

আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো, কর্তৃত্ববাদী ধ্যান-ধারণার ক্রমবর্ধমান প্রভাব – যা শুধু উন্নয়নশীল বা উঠতি গণতন্ত্র নয়, কিছু উন্নত দেশেও দেখা যাচ্ছে। ডানপন্থী উগ্রজাতীয়তাবাদীরা এরই মধ্যে মুক্তচিন্তা ও সমালোচনাধর্মী সাংবাদিকতাকে বাধা হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। সম্মিলিতভাবে এবং প্রয়োজনে জোর করে দমানো না গেলে – এই প্রবণতা সাংবাদিকতাকে আরো বাধাগ্রস্ত করবে।

শিলা অ্যালেচি (ইতালি)

এশিয়া ডেস্ক প্রধান, ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস্ (আইসিআইজে)

হংকং থেকে ভারত, লেবানন থেকে চিলি; মানুষ রাস্তায় নেমেছে গণতন্ত্র ও উন্নত জীবনযাপনের দাবি নিয়ে।

২০২০ সালে, একই ভূমিকা পালন করতে হবে গোটা বিশ্বের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের। একজোট হয়ে কাজ করে তুলে আনতে হবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। উন্মোচন করতে হবে সেসব ব্যবস্থা, যা বৈষম্য ও বিভক্তি বাড়িয়ে তুলছে। ২০১৯ সালে আমরা এমন উদাহরণ দেখেছি মেক্সিকো, ফিলিপাইন ও মাল্টায়। তাদের এই রিপোর্টিং ভবিষ্যতে আরো বৈষম্য-অন্যায় উন্মোচন করবে।

একটি চ্যালেঞ্জ হলো: অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা ব্যক্তিগতভাবে হুমকির শিকার হচ্ছেন আগের চেয়ে বেশি, জড়িয়ে পড়ছেন ব্যয়বহুল মামলায়। তাদেরকে দমনমূলক আইন ও পরিকল্পিত মিথ্যা প্রচারণা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তাই প্রতিবেদন এবং অনুসন্ধানের ফলাফলকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার আরো ভালো পথ খুঁজে বের করতে হবে।

সাধারণ মানুষ এবং গণমাধ্যমের মধ্যে এক ধরণের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা এই সুযোগকে তাদের স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছেন। বিশ্বের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কাজ হবে পাঠকের সাথে সম্পর্ক আরো নিবিড় করার নতুন কৌশল নিয়ে ভাবা, যাতে এই দূরত্ব ঘোচে।

ইং চ্যান (হংকং)

মিডিয়া কনসালটেন্ট ও স্ট্যাটেজিস্ট

চীনের জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের ওপর নির্যাতনই হোক, তাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড অথবা অস্ট্রেলিয়া-আজারবাইজানের মতো দেশে রাজনীতিতে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) প্রভাব বিস্তার – ২০১৯ সালে চীনা সাংবাদিকরা নিজ দেশের বাইরে থেকে এমন অনেক বিষয়ের গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করেছেন। এভাবে তাদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ছড়িয়ে পড়েছে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে। এসব অনুসন্ধানে তারা ব্যবহার করেছেন স্যাটেলাইট ছবি, ডিজিটাল ফরেনসিকস এবং বিগ ডেটা বিশ্লেষণের মত আধুনিক প্রযুক্তি। ২০১৯ সালে, আমরা অনেক হুইসেলব্লোয়ারদের আবির্ভাব দেখেছি, যারা গুরুত্বপূর্ণ সব অভ্যন্তরীণ নথিপত্র তুলে দিয়েছে সংবাদমাধ্যমের হাতে। ২০২০ সালেও এমন অনেক তথ্য ফাঁস হবে, এবং প্রযুক্তি নির্ভর ও বৈচিত্র্যময় অনুসন্ধানের ধারা বজায় থাকবে।

শি জিনপিংয়ের সময়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি, দেশটির গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরো কঠোর করেছে। একই সঙ্গে অন্যান্য দেশগুলোর রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ক্রমেই প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এসব কারণে চীন নিয়ে রিপোর্টিংয়ের জন্য চীনের বাইরে থেকে অনেক সংবাদমাধ্যম এগিয়ে আসবে। বিকাশ ঘটবে “চায়না ওয়াচার্স” এবং নতুন প্রজন্মের লেখকদের, যারা বয়সে তরুন  এবং চীনা সংস্কৃতি ও ভাষা সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন। চীনকে নিয়ে খবর প্রকাশের বেলায় মূলধারার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের পক্ষপাত ও বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব নিয়ে তারা আগেও সমালোচনা করেছেন। সামনে তাদের এই ভূমিকা আরো জোরদার হবে।

চীনের ভেতরে প্রচলিত ধারার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হয়তো স্তব্ধ হয়ে পড়েছে, কিন্তু অনেক নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিক নিশ্চিতভাবেই লেখালেখি ও পডকাস্টের মাধ্যমে নানা অনিয়মের ঘটনা নতুনভাবে তুলে আনার চেষ্টা করে যাবেন।

রেগনাল্ড চুয়া (যুক্তরাষ্ট্র)

চিফ অপারেটিং অফিসার, রয়টার্স এডিটোরিয়াল

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা মেশিন লার্নিং দ্রুতই ডেটা সাংবাদিকতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠছে। সামনে পাঠকদের বোঝাতে হবে –  এটি কিভাবে কাজ করে, আমরা কিভাবে প্রতিবেদনে সিদ্ধান্ত দিচ্ছি বা উপসংহার টানছি, এবং কেন অ্যালগরিদমের ওপর ভরসা রাখা যেতে পারে। এরপরেও অবশ্য পুরোপুরি বোঝানো কঠিন হবে।

বেশিরভাগ পাঠকের পরিসংখ্যানে খুব একটা আগ্রহ নেই। তারা প্রতিবেদন তখনই পছন্দ করেন, যখন পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণটি তাৎপর্যপূর্ণ হয়। মেশিন লার্নিংয়ের বিশ্লেষণে আমাদের যত আস্থা, পাঠকও যেন ততটাই আস্থাশীল হন, তা নিশ্চিত করার জন্য সংখ্যাকে বোধগম্য করে তুলতে হবে। দুঃখের বিষয়, আমরা এখনো সেই বোঝাপড়া ও ভাষা তৈরি করতে পারিনি। এই কাজটি হবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ডেটা সাংবাদিকতা ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে।

রাওয়ান দামেন (জর্ডান)

নির্বাহী পরিচালক, আরব রিপোটার্স ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আরিজ)

২০২০ সালে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা ডিজিটাল হুমকি, হয়রানি এবং ডিপ-ফেক ভিডিওর মত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন বেশি। ভাইরাস, ম্যালওয়্যার এবং ফিশিং হবে নিত্যদিনের সঙ্গী। আগামীতে এসব সমস্যা মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে সম্পাদনার মাধ্যমে বদলে দেওয়া ভুয়া ভিডিও সনাক্ত করতে পারাটাও জরুরি হয়ে দাঁড়াবে।

২০২০ সালে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা অর্জন করতে হবে সাংবাদিকদের। অনলাইনে শেখা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাকে নিত্যদিনের কাজ বানিয়ে ফেলতে হবে। আমরা চিন্তা করতাম যে, ডাক্তারদেরই সারা জীবন পড়াশোনা করে যেতে হয়। কিন্তু সাংবাদিকরাও তার বাইরে নয়। আমি যখন ২০ বছর আগে সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করি, তখন ছিল টেলিভিশনের রাজত্ব। আর এখনকার দিনে আপনি যদি ডেভেলপার, ডিজাইনারদের সঙ্গে কিভাবে কাজ করতে হয়, তা না জানেন, তাহলে টিকে থাকতে পারবেন না। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নিজেকে সেভাবে তৈরি করতে না পারলে সেকেলে হয়ে পড়বেন।

আমর আল ইরাকি (মিশর) 

সহ-প্রতিষ্ঠাতা, ইনফোটাইমস ও আরব ডেটা জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক

২০২০ সালে, সাংবাদিকরা অনেক ডেটাভিত্তিক প্রতিবেদন তৈরি করবেন। এই কাজে চিরাচরিত পরিসংখ্যানের পাশাপাশি, তারা ব্যবহার করবেন টুইট, ছবি ও বিভিন্ন নথিপত্র থেকে পাওয়া তথ্য। এখন রিপোর্টাররা ডেটা নিয়ে কাজ করছেন বেশি। সামনে প্রথাগত সরকারী-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাইরেও অন্য অনেক উৎস থেকে ডেটা সংগ্রহের ‍সুযোগ বাড়বে।

নিজ নিজ ডেটা যোগ করে, রিপোর্টাররা মুক্ত ডেটাসেট তৈরির ক্ষেত্রেও অবদান রাখতে পারেন। এতে শেষপর্যন্ত সেসব অঞ্চলের মানুষই উপকৃত হবে, যাদের সাধারণভাবে এমন ডেটা বা তথ্যে অধিকার সীমিত।

হেঙ্ক ফন এস (নেদারল্যান্ডস)

প্রশিক্ষক, ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স

২০১৯ সালে ওপেন সোর্স ইনটেলিজেন্স (ওসিন্ট) নিয়ে (বেলিংক্যাটের অনুসন্ধান) নির্মিত তথ্যচিত্র জিতেছে এমি পুরস্কার। মনে হচ্ছে, সাংবাদিকতা যেন জেগে উঠেছে।

আমার মনে হয় ২০২০ সালে গণমাধ্যমগুলো ওসিন্টকে কাজে লাগাবে। এরিমধ্যে এনজিও, আইনী প্রতিষ্ঠান, পুলিশ ও কোম্পানিগুলো এর ব্যবহার শুরু করেছে নিত্যদিনের তথ্য সংগ্রহের কাজে। বিনামূল্যে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলো ফিল্টার করার মাধ্যমে তারা ডেটা থেকে স্টোরি খুঁজে পাচ্ছে।

এবছর, ওসিন্টের পেছনে বিনিয়োগ করবে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও এনবিসি নিউজ। একই কাজ করবে বাজফিড ও প্রোপাবলিকা। নিউ ইয়র্ক টাইমসও ওপেন সোর্স ভিত্তিক ভিজ্যুয়াল গবেষণা চালিয়ে যাবে। জিআইজেএনের মতো ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট-চেকিং নেটওয়ার্কও তাদের বৈশ্বিক সম্মেলনগুলোতে এই বিষয়ে আলাদা সেশন আয়োজন করবে।

সোশ্যাল মিডিয়া ও ওয়েব থেকে ফিল্টার করে তথ্য বের করে আনার কাজটি আপনি যতটা বুদ্ধিদীপ্ত উপায়ে এবং কম খরচে করতে পারবেন – আপনার রিপোর্টিংও ততটাই কার্যকর হবে। ২০২০ সালে, কোনো সম্পাদকই বিষয়টি অগ্রাহ্য করতে পারবেন না।

গুস্তাভো গোরিতি (পেরু)

প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, আইডিএল-রিপোর্তোরেস

লাতিন আমেরিকায় (হয়তো বৈশ্বিকভাবেও) কর্পোরেট জালিয়াত ও লুটেরা রাজনীতিবিদদের যোগসাজশে হওয়া দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান আরো বড়েবে। লাভা হাতো অনুসন্ধান থেকে পাওয়া শিক্ষা সাংবাদিকদের জন্য, সামনের দিনেও অনেক উপকারী হবে। এই ঘটনা সাংবাদিকদের বিপুল জনসমর্থন এনে দিয়েছে। সামনেও এই ধরণের অনুসন্ধানে সাংবাদিকদের জোটগুলোর ভূমিকা বড় হয়ে উঠবে।

সংগঠিত ও সহিংস অপরাধ নির্মমভাবে প্রভাব ফেলছে লাতিন আমেরিকার লাখো মানুষের জীবন ও ভাগ্যের ওপর। তার অনেক কিছুই অপ্রকাশিত থেকে যায়; যা প্রকাশ হয়, তার একটা বড় অংশও অসম্পূর্ণ বলা চলে। এটা সম্ভবত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে।

গোটা ল্যাটিন আমেরিকায় গোঁড়া ধর্মভিত্তিক শাসন ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রভাব আরো বাড়বে। তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি আরো মজবুত হবে। চার্চের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্কের যে সীমারেখা – তাকে ক্রমেই মুছে দেবে উগ্রডানপন্থী বার্তার বিস্তার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা অপরাধেও জড়িয়ে পড়বে। এই হুমকি সামাল দিতে দরকার হবে সেরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জোট বেঁধে কাজ করা।

পেশা সংক্রান্ত যে সমস্যাগুলো থেকেই যাবে, তার মধ্যে আছে: নিরাপত্তা, টেকসই ব্যবসা, ভুয়া তথ্য ও ‍গুণগত মান।

জেনিফার ল্যাফ্লার (যুক্তরাষ্ট্র)

ডেটা এডিটর, ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং ওয়ার্কশপ, আমেরিকান ইউনিভার্সিটি

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে কিছু প্রেরণাদায়ক অগ্রগতি আমরা দেখেছি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। আইসিআইজের চায়না কেবলস প্রজেক্ট তুলে এনেছে চীনের বন্দী শিবিরের পরিস্থিতি। ড্রোন ইমেজের সঙ্গে মানচিত্র ও ডেটার মিশেল ঘটিয়ে রয়টার্স দেখিয়েছে বর্ষা মৌসুমে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলো কতটা অরক্ষিত অবস্থায় থাকছে।

গত কয়েক বছরে গুরুত্বপূর্ণ যেসব অনুসন্ধান দেখেছি, তাতে অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল সহযোগিতা। এই ধরনের সহযোগিতামূলক সাংবাদিকতাকে আরো উদ্বুদ্ধ করার মতো টুলও আমরা দেখছি। পানামা পেপার্সের মতো অনুসন্ধানে সহযোগিতাই ছিল প্রধান বিষয়। আর আইসিআইজে-র মেরিনা ওয়াকার সম্প্রতি লিখেছেন, অর্থ পাচার সনাক্ত করার ক্ষেত্রে কিভাবে প্রযুক্তি কাজে লাগানো যায়।

প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে দারুন সব অগ্রগতি আমরা দেখছি। একই সঙ্গে এটাও দেখা দরকার যে, অন্যরা কিভাবে এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছেন। গবেষক, আইনপ্রণেতা থেকে শুরু করে নিউজরুম পর্যন্ত, সবাই এখন মনোযোগ দিচ্ছে অ্যালগরিদমিক জবাবদিহিতার দিকে। তারা দেখতে চাইছেন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ডেটার এমন কোনো ব্যবহার করছে কিনা, যা মানুষের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। আমাদের মধ্যে আরো অনেককে এই “অ্যালগরিদমিক জবাবদিহিতার” বিষয়টি বুঝতে হবে। কারণ স্থানীয় পুলিশ বিভাগ থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানি; সবাই তাদের কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য ডেটা ব্যবহার করছে।

২০২০ সালে বেশ কয়েকটি দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে প্রযুক্তি বড় ভূমিকা রাখবে। নির্বাচনের খবর সংগ্রহে রিপোর্টারদের সহায়তা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে মেশিন লানিংয়ের প্রয়োগ ঘটানোর চিন্তা করছেন অনেকেই। কিছু কৌশল হয়তো অন্য দেশেও কাজে লাগানো যাবে।

জলবায়ু পরিবর্তন, দাবানল ও অন্যান্য ‍গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত ইস্যু কাভারের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যেখানে ডেটা পাওয়া যায় না,  এমন পরিস্থিতিতে ডেটা তৈরি করাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে । সৃজনশীল নিউজরুমগুলো নিজেদের মতো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে অথবা স্যাটেলাইট থেকে তথ্য নিচ্ছে। ২০২০ সালে জলবায়ু ইস্যু কাভারের জন্য টিপশিটের একটি তালিকা বানিয়েছে সোসাইটি অব এনভারনমেন্টাল জার্নালিস্টস।

ভালো অনুসন্ধান করার ক্ষেত্রে এই টুলগুলো আমাদের কাজে লাগবে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, নিউজরুমের বাইরে গিয়ে বিশেষজ্ঞ এবং প্রতিবেদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

জন-অ্যালান নামু (কেনিয়া)

সহ-প্রতিষ্ঠাতা, আফ্রিকা আনসেন্সরড

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অস্থিরতা বাড়তে পারে পূর্ব আফ্রিকায়, যার প্রভাব পড়তে পারে কৃষিতে। আমার মতে, এই বিষয়টি নজরে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সংক্রান্ত রিপোর্টিং রিসোর্সগুলো হয়ে উঠবে গুরুত্বপূর্ণ। আমার ধারণা, সময়ের সাথে সাথে কোনো বিষয়ের বিস্তৃতি ও প্রভাব কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, তা বোঝানোর জন্য ২০২০ সালে বড় কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ব্যবহার করা হবে জিও-ম্যাপিং ও টাইম-সিরিজ ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন।

আগামী  ‍দুই বছর এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যা এখন থেকেই সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে সামনে টেনে এনেছে। একে দেখতে হবে রিপোর্টিংয়ের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে। তানজানিয়ার মতো দেশগুলোতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হুমকি ও হামলার ঘটনা বাড়ছে। এর বাইরে স্বাধীন মতপ্রকাশ ও তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধাও সাংবাদিকদের কাজে প্রভাব ফেলবে। রাজনৈতিক প্রচারণায় আরো অনেক অভিনব কৌশল ব্যবহার করা হবে বলে আমি ধারণা করছি। কারণ ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার মতো সংগঠন নিশ্চয়ই আরো আছে। আর পূর্ব আফ্রিকা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক প্রচারণায় ডেটা মাইনিং ব্যবহারের অন্যতম পরীক্ষা-ক্ষেত্র।

এসব বাধা মোকাবিলায় আমাদের যে কৌশল-দক্ষতা প্রয়োজন, তা  নতুন বা উদ্ভাবনী কিছু নয়। কিভাবে মানুষের অভিজ্ঞতার গল্পগুলো আরো ভালোভাবে বলা যায়, সেদিকেই আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।

পল রাদু (রোমানিয়া)

নির্বাহী পরিচালক, অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট

২০২০ সালের সাংবাদিকতায় যা আসতে যাচ্ছে, তার অনেক কিছুই আমাদের চারপাশে ছড়ানো আছে। আর আমার কাছে ভবিষ্যৎটা বেশ উজ্জ্বলই মনে হচ্ছে। অবশ্য তার ওপরে একটি বড় কালো ছায়াও আছে।

আমার বিশ্বাস, ২০২০ সালে আন্তসীমান্ত সহযোগিতা আরো বাড়বে। ছোট-বড়; নানা অনুসন্ধানের জন্য সাংবাদিকরা একজোট হবেন আরো বেশি করে। গত বছর আইসিআইজে  এবং ওসিসিআরপি যেসব উদাহরণ হাজির করেছে, সেরকম প্রয়াস দেখা যাবে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও মহাদেশীয় পর্যায়ে। আমার আরো মনে হয়, এই জোটবদ্ধ কাজগুলো করার ক্ষেত্রে নতুন নতুন টুলের সহায়তা পাওয়া যাবে, যা এখন বিকাশমান অবস্থায় আছে। এই সহায়তা পাওয়া যাবে ডেটা বিশ্লেষণ ও সুরক্ষিত যোগাযোগ; দুই ক্ষেত্রেই।

এই জাতীয় জোটবদ্ধ অনুসন্ধান থেকে সাফল্যের পাশাপাশি হুমকিও আসবে। সাংবাদিকরা দুর্ভাগ্যবশত নজরে পড়বেন খারাপ মানুষদের ভাড়া করা আইনি প্রতিষ্ঠানের, অসাধু জনসংযোগ কোম্পানির, এবং রাষ্ট্র ও সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের।

আমি আশা করি, বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী দলগুলো নিজেদের ডিজিটাল ও শারীরিক নিরাপত্তার জন্য আরো উদ্যোগ নেবেন। আর তাদের ওপর আসা হুমকি সাংবাদিকদের মধ্যে সংহতি আরো বাড়িয়ে তুলবে।

মারিয়া তেরেসা রন্দেরোস (কলম্বিয়া)

পরিচালক, ল্যাটিন আমেরিকান সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (ক্লিপ)

সত্যি কাহিনী ভালোভাবে বলতে পারাটা এবছর সাংবাদিকদের জন্য হবে বড় চ্যালেঞ্জ। পাঠকের সামনে এখন অনেক তথ্য। আর সেই তথ্যের ভারে তারা হয়ে পড়েন দ্বিধাবিভক্ত। তাই পাঠকদের জন্য চাই স্পষ্টতা। এজন্য তিনটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে:

১. বিভিন্ন দেশ, গণমাধ্যমে কাজ করা সাংবাদিক ও বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সহযোগিতা। জোটবদ্ধতাই পারে জটিল কোনো বৈশ্বিক ইস্যুকে সহজভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

২. গুরুত্বপূর্ণ সময়ে (নির্বাচন, সামাজিক আন্দোলন, জনসম্পৃক্ততা আছে এমন বড় কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ) ভুয়া তথ্যের নেটওয়ার্কগুলোর ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি, এবং জনপরিসরে বিভ্রান্তি ছড়ানো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর তৎপরতা সবার সামনে উন্মোচন করা।

৩. হাতের কাছে থাকা বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা উন্মোচনের জন্য নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানানো। তারা সাংবাদিকদের সাহায্য করতে পারেন – নিরাপদ মাধ্যমে নথিপত্র দিয়ে, নিজেদের অভিজ্ঞতা জানিয়ে, অথবা সঠিক তথ্য ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে। শুধু নিশ্চিত হতে হবে, তাদের যেন কোনো গোপন উদ্দেশ্য না থাকে।

এই তিনটি উপায়ে তথ্য উন্মোচন, সংগ্রহ ও তা গুছিয়ে রাখার পথকে সুগম করবে, এবং  নতুন প্রতিবেদনের উপাদান যোগাবে। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে সরেজমিন রিপোর্টিং ও জুতোর তলা ক্ষয় করা সোর্সভিত্তিক সাংবাদিকতার সেই চিরাচরিত পদ্ধতি।

বিশেষজ্ঞদের এই মতামতগুলো এক জায়গায় করেছেন জিআইজেএন প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর ইউনিস অউ

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

প্রতিবেদন প্রকাশ বণ্টন ও প্রচার

সাংবাদিকতায় আস্থা ধরে রাখতে ভ্রাম্যমান অনুসন্ধানী বার্তাকক্ষ কীভাবে কাজ করছে

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে ভ্রাম্যমান অনুসন্ধানী বার্তাকক্ষ। উত্তর মেসিডোনিয়ায় এমন একটি বার্তাকক্ষ স্থানীয় বাসিন্দাদের আস্থা অর্জন করেছে। তাঁরাই বার্তাকক্ষে ছুটে যাচ্ছেন সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে। সম্পৃক্ত হচ্ছেন নিজেরাও।

Toxic Waste Pollution Factory Bank

পরিবেশ ধ্বংসের পেছনে বিনিয়োগ করছে কারা-বিনিয়োগকারীদের খোঁজ করবেন যেভাবে : দ্বিতীয় পর্ব

ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি করছে বা দূষণে ভূমিকা রাখছে—সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের এমন অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা বা প্রণোদনা দেওয়া হয়ে থাকে। লক্ষ্য, নিজ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা ও যেসব দেশে তাঁরা বিনিয়োগ করছে সেসব দেশের টেকসই উন্নয়ন। অনেক সময় খনিজ উত্তোলন ও বন উজাড় করার কাজেও বিনিয়োগ করে থাকে তারা। আর প্রচারণা চালায় উন্নয়ন বিনিয়োগ বলে। এই নিবন্ধটি পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকদের জন্য অবশ্যপাঠ্য।

জিআইজেসি২৫ ওয়েবসাইট এবং গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সের তারিখ ঘোষণা করেছে জিআইজেএন

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বৃহত্তম আসর বসছে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে। সম্মেলনের তারিখসহ, অংশগ্রহণের খুঁটিনাটি থাকল এই প্রতিবেদনে। এবারই প্রথম এই সম্মেলন এশিয়ায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আর জিআইজেএন এ যাত্রায় সঙ্গে পেয়েছে মালয়েশিয়ার স্বাধীন সংবাদপত্র মালয়েশিয়াকিনিকে।