প্রবেশগম্যতা সেটিংস

লেখাপত্র

বিষয়

সাংবাদিকতায় অর্থ সাহায্যের যত সমস্যা

আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:

সাংবাদিকতায় অর্থ সাহায্য

ছবি: পিক্সাবে

নিম্ন আয়ের অনেক দেশে সংবাদপত্রের পাতা দেখে প্রায়ই মনে হয় তারা সমাজের ওপর প্রভাব ফেলা প্রধান ইস্যুগুলো নিয়ে যতটা না রিপোর্ট করছে, তার চেয়ে অনেক বেশি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর প্রচার-প্রচারণার উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক দল বিশেষজ্ঞের বৈঠক, হাসপাতাল স্থাপনের পরিকল্পনা, নতুন কূপ বসানো। নিছক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির কপি-পেস্ট; তাতে নেই ঘটনার প্রেক্ষাপট, দ্বিতীয় সূত্রের ব্যবহার, অথবা নতুন কোনো দৃষ্টিভঙ্গি। যেসব নাগরিক বুঝতে চান  চারপাশে আসলে কী ঘটছে, তাদের জন্যে নেই কোনো অন্তদৃষ্টি।

এই ধরনের সাংবাদিকতাকে খুবই খেলো ও একঘেঁয়ে মনে হতে পারে, এবং আসলেও তাই। কিন্তু এ জন্য শুধু সাংবাদিকদের দোষ দিলে হবে না। কারণ অনেক উদীয়মান গণতন্ত্রের দেশে, জনস্বার্থ-কেন্দ্রিক সাংবাদিকতার জন্য অর্থনৈতিক ভিত খুঁজে পেতে হিমসিম খেতে হয়।

তদুপরি, চলমান মহামারিজনিত মন্দা যখন স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ক্ষতকে আরো গভীর করে তোলার হুমকি দিচ্ছে, তখন দাতাগোষ্ঠী ভেবে পাচ্ছে না, গণমাধ্যম ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে, তারা কী করতে কী করবে। অথচ, ভুয়া তথ্যের যে সুনামির তোড়ে গণতন্ত্র ভেসে যেতে বসেছে, তা ঠেকানোর জন্য সর্বশেষ বাঁধ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে শুধু জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকতা।

আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর তৈরি করা অন্যায্য প্রতিযোগিতায় জর্জরিত যে বাজার, সেখানে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকা মুশকিল, এমনকি আর্থিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী হলেও। কপালের ফের, বেশিরভাগ উদীয়মান গণতন্ত্রের দেশে এই আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী হলো, উন্নয়ন সংস্থাগুলো।

এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার। সমস্যা সংকুল উদীয়মান বাজারগুলোতে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের জন্য প্রাণ-সঞ্চারি শক্তি হয়ে উঠেতে পারে এই দাতা অর্থায়ন। এবং যেসব তথ্য সমাজে পরিবর্তনের আনার জন্য জরুরি, তাদের ছড়িয়ে দিতে উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে আরো অনেক ভালোভাবে সাহায্য করতে পারে স্বাধীন গণমাধ্যম।

ক্ষতিকর প্রভাব

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে উন্নয়ন সংস্থার সম্পর্ক কেমন হবে তা পূণর্বিবেচনা করা, এখন অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি জরুরি। এবং মিথস্ক্রিয়ার একটি উন্নততর পথও খুঁজে বের করা প্রয়োজন।

উন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে সাংবাদিক-নিউজমেকার সম্পর্কের পার্থক্যটা, আপনাকে স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে গণমাধ্যমের ওপর উন্নয়ন সংস্থার টাকার ক্ষতিকর প্রভাব বুঝতে সাহায্য করবে।

সুস্থ-স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পরিবেশে, কোনো সংগঠন (ধরা যাক কোনো দাতব্য সংগঠন) যদি কোনো ইস্যুতে মিডিয়া কাভারেজ পেতে চায়, তাহলে হয় তারা সরাসরি সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে, প্রেস রিলিজ পাঠায় বা সংবাদ সম্মেলন করে। এরপর সাংবাদিক তার রিপোর্টিং দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বিষয়টির সত্যতা যাচাই করেন এবং পাঠক-দর্শকের চাহিদা মূল্যায়ন করে সেটি প্রকাশ করেন। ইস্যুটি পাঠকের কাছে ভালোমতো তুলে ধরার জন্য যেসব পরিপ্রেক্ষিত ও পূর্বপ্রসঙ্গের বর্ণনা দরকার, সেগুলোও প্রতিবেদনে যোগ করা হয়। সাংবাদিকদের এসব ফিল্টার এড়াতে চাইলে, দাতব্য সংগঠনটি অবশ্য তাদের কন্টেন্ট সংবাদমাধ্যমে প্রচার করতে পারে বিজ্ঞাপন হিসেবে। এই দুই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা রক্ষা হয় এবং পাঠক-দর্শকের কাছেও পরিস্কার হয়, কন্টেন্টটি কে তৈরি করেছে।

তবে অনেক নিম্নআয়ের দেশে, বাস্তবে কাজগুলো হয় ভিন্নভাবে। বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম সাংবাদিকদের খুবই অল্প বেতন দেয় বা একেবারেই দেয় না। ফলে যাদের সম্পর্কে লিখছেন, তাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার মাধ্যমেই সাংবাদিকরা আয় করেন। এই ধারার চর্চা এতোটাই বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, অনেকেই (যার মধ্যে দাতব্য সংগঠনের কর্মীরাও পড়েন) এটিকে ঘুষ হিসেবে বিবেচনাও করেন না। “ঘুষ” শব্দটির ব্যবহার অবশ্য কখনোই হয় না। এই ধরনের অর্থ প্রদানকে বলা হয় যাতায়াতের “খরচ” বা ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণের “ভাতা”।

উন্নয়ন সংস্থাগুলো স্থানীয় সাংবাদিকদের বিদেশযাত্রার সুযোগ দিয়েও হাত করে রাখে। যেখানে তাদের যাতায়াতের “খরচ” বহন করা হয় ঘোলাটে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, এবং এটি করা হয় অনুকূল মিডিয়া কাভারেজের জন্য। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সব সাংবাদিকই জানেন যে, এই অর্থপ্রাপ্তির বিনিময়ে তাদেরকে কোনো রকম সাংবাদিকসুলভ দ্বিধা-সংশয় ছাড়াই ইতিবাচক কাভারেজ দিতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, এই প্রক্রিয়ায় যে প্রতিবেদনটি তৈরি হয়, তা আসলে রূপ নেয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। সেটি হয়ে যায় নিস্প্রভ, যেখানে একটিই মাত্র সোর্স থাকে। কোনো তথ্য যাচাই হয় না। কোনো বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি থাকে না। এবং এমন কোনো বাস্তব-ঘনিষ্ঠ কেস স্টাডি থাকে না, যা থেকে পাঠক গল্পটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে।

যে পথ বিচক্ষণতার

এমন পরিস্থিতিতে আসলে কেউই জয়ী হতে পারে না। পাঠকের চাহিদা বিবেচনায় যে বিষয়গুলো সবচে জরুরি মনে হয়, সেগুলো নিয়ে কাজ করার মতো অর্থ ও স্বাধীনতা থাকে না সাংবাদিকের। ফলে প্রতিবেদনটিও এতো একঘেঁয়ে হয়ে পড়ে যে, সেই ইস্যুতে উন্নয়ন সংস্থারও কোনো সংযুক্তি গড়ে ওঠে না পাঠক-দর্শকের সঙ্গে। সংবাদমাধ্যমেরও সেখান থেকে কোনো আয় থাকে না, যা দিয়ে তারা নতুন কোনো উদ্ভাবনী চিন্তায় বিনিয়োগ করবে বা ভালো সাংবাদিকতা করবে। যে ইস্যুগুলো সমাজে সত্যিকারের প্রভাব ফেলছে, সেগুলো সম্পর্কে ভারসাম্যপূর্ণ কোনো তথ্য পায় না পাঠক-দর্শকও।

এই ভাঙাচোরা ব্যবস্থার পরোক্ষ প্রভাবগুলোও অনেক গভীর। এখানে সাংবাদিকতা ব্যবহৃত হয় স্বার্থান্বেষী মহলের অপতথ্য ছড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে। সাংবাদিকদের কাজও আর বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে, অথবা নেতৃত্বকে জবাবদিহি করার উপকারী টুল হিসেবে বিবেচিত হয় না। স্বাধীন, মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা করার জন্য সাংবাদিকদের কোনো আর্থিক প্রণোদনা থাকে না। সাংবাদিকতা পেশাটি হয়ে ওঠে বেশি বেতন বা মর্যাদাপূর্ণ চাকরিতে যাওয়ার সিঁড়ি। হতাশাজনকভাবে প্রায়ই সেই জায়গাটি হয় উন্নয়ন সংস্থা। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের শীর্ষ সাংবাদিকরা প্রায়ই পাড়ি জমান অন্যান্য উন্নয়নখাতের চাকরিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ শিক্ষার্থীরাও সাংবাদিকতায় আসেন না। এবং প্রভাব তৈরির মতো রিপোর্টিং দক্ষতা শেখার জন্য পর্যাপ্ত সময়ও এখানে বিনিয়োগ করেন না। এটি এমন এক দুষ্টচক্র যেখানে সেই ধরনের সাংবাদিকতা কখনোই দেখা যায় না, যা গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির জন্য অপরিহার্য।

ভেঙে পড়া এই ব্যবস্থাকে সারিয়ে তোলা সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ভালো দিক হলো, সম্পর্কের এই ধরনটাকে পূনর্বিবেচনা করা গেলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের জন্য অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। উন্নয়ন সংস্থা ও দাতাগোষ্ঠীর অর্থ থেকে সংবাদমাধ্যমের অনেক মুনাফা আসতে পারে, যা এখনো অধরা থেকে গেছে। ওইসিডি-র (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দাতাগোষ্ঠীর আনুষ্ঠানিক বিনিয়োগ ছিল ১৫০ বিলিয়ন ডলার, যা সাব-সাহারান আফ্রিকান দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপির প্রায় ১০ ভাগেরও বেশি। এমনকি, লাইবেরিয়া ও আফগানিস্তানের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ক্ষেত্রে, দাতাগোষ্ঠীর ব্যয় সেখানকার পুরো স্থানীয় অর্থনীতির সমান।

এই বিশালাকায় আর্থিক ক্ষেত্রটি সংবাদমাধ্যমের জন্য হতে পারে বিজ্ঞাপন ও স্পন্সরশিপের বড় উৎস। দুঃখজনকভাবে, নিম্নআয়ের দেশগুলোতে উন্নয়ন সংস্থার এই ব্যয় খুব কমই যায় বিজ্ঞাপনের দিকে। বরং, তারা এমন এক দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়িক মডেলকে পুষ্ট করে, যার কারণে ভালো সাংবাদিকতা নিরুৎসাহিত এবং বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (গণমাধ্যমের উন্নয়নে যত টাকা আসে, তা মোট অর্থসাহায্যের মাত্র ০.৩ শতাংশ। অথচ এই খাতের জন্য আসা অর্থের লক্ষ্য থাকে স্বাধীন ও বৈচিত্র্যপূর্ণ গণমাধ্যম কাঠামোকে শক্তিশালী করা, যা উঁচুমানের সাংবাদিকতার নিশ্চয়তা দেবে।)

সমাধান যেখানে

পরিস্থিতি বদলানোর জন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে এমন নীতি গ্রহণ করতে হবে, যা ভালো সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করে। দ্বিতীয় পদক্ষেপ: দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো সংবাদমাধ্যমের জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ করবে বিজ্ঞাপন, অনুদান বা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে, যেখানে তারা সংবাদমাধ্যমকে একটি গুরুত্বপূর্ণ টুল হিসেবে বিবেচনা করবে নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য। এটি সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে।

কিছু উন্নয়ন সংস্থা এরই মধ্যে এই সঠিক পথে যাত্রা শুরু করেছে। তারা খুব সতর্কভাবে বেছে নিচ্ছে, কোন ধরনের সংবাদমাধ্যমকে সমর্থন দেবে। এক্ষেত্রে তারা প্রাধান্য দিচ্ছে সেসব প্রতিষ্ঠানকে, যারা স্বাধীন আয় নির্ভর ব্যবসায়িক মডেল তৈরি করেছে। নাইজেরিয়ার প্রিমিয়াম টাইমস, ঘানার জয় এফএম, বা লাইবেরিয়ার ফ্রন্ট পেজ আফ্রিকা-র মতো বার্তাকক্ষগুলো টাকার বিনিময়ে কাজের মডেল প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা সাংবাদিকদের উপযুক্ত বেতন দেয় এবং অন্য জায়গা থেকে টাকা নিতে দেয় না। ফল ঠিক তেমনটাই হয়েছে, যা যেকোনো সুস্থ গণমাধ্যম বাজারে হওয়ার কথা। তারা প্রভাব ফেলার মতো জনস্বার্থ সাংবাদিকতা করতে পারছে, যা নেতৃত্বকে জবাবদিহি করে, সাধারণ মানুষকে অবহিত করে, এবং সাংবাদিকতার উঁচু মাণদণ্ড প্রতিষ্ঠা করে।

উন্নয়ন সংস্থা  ও বার্তাকক্ষের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ তৈরি করছে নতুন ধরনের কিছু অলাভজনক প্রতিষ্ঠানও। দাতাদের অনুদান নিয়ে কাজ করার মতো অবস্থা বাণিজ্যিক বার্তাকক্ষে থাকে না। আর দাতারাও অর্থ বরাদ্দ দিতে চায় শুধু অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকে। এমনই একটি বার্তাকক্ষ ভেকিসিসা। তারা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রভাবশালী গণমাধ্যম মেইল অ্যান্ড গার্ডিয়ানের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। জার্মান উন্নয়ন সংস্থা, জিআইজেড-এর সহায়তায় অলাভজনক এই বার্তাকক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়।  তারা কাজ করে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে। ২০১৫ সাল থেকে তাদের আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। পুরোপুরি স্বাধীন সংগঠন হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রায় সবগুলো প্রধান সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জোট বেঁধে কাজ করে ভেকিসিসা। নাইজেরিয়ার প্রিমিয়ার টাইমসের সঙ্গে সংযুক্ত অলাভজনক অনুসন্ধানী কেন্দ্রের স্বাস্থ্য বিষয়ক রিপোর্টিংয়েও আর্থিক সহায়তা দেয় গেটস ফাউন্ডেশন।

২০১০ সালে, লাইবেরিয়ার সম্পাদক রডনি সিয়েকে সঙ্গে নিয়ে আমি প্রতিষ্ঠা করি অলাভজনক সংবাদমাধ্যম, নিউ ন্যারেটিভস (এনএন)। এখানেও উন্নয়ন সংস্থাগুলোই অর্থায়ন করেছিল। নিউ ন্যারেটিভ, ঠিক প্রকাশক হিসেবে কাজ করে না। এটি অন্যান্য স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে না। বরং, আমরা দাতাদের কাছ থেকে পাওয়া অনুদানের অর্থ ব্যবস্থাপনা করি। স্থানীয় স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জোট বেঁধে তাদের সাহায্য করি, যেন তারা ভালো ও স্বাধীন সাংবাদিকতা করতে পারে। এই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এমন নানা বিষয় (নারী ও শিশু অধিকার, তেল ও খনিজ, বনবিভাগ, ‍ভূমি অধিকার, পরিবেশ, বিচারব্যবস্থা) নিয়ে কাজের জন্য বিস্তৃত ক্ষেত্র থেকে আর্থিক অনুদান যোগাড় করে এনএন। তবে আমরা কোথা থেকে অনুদান গ্রহণ করব, তার-ও কিছু নিয়মকানুন আছে, যা যে কোনো ভালো সংবাদমাধ্যমেরই থাকে। এবং আমাদের সম্পাদকীয় কর্মকাণ্ডে দাতাদের কোনো হস্তক্ষেপ থাকে না। স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য, প্রতিটি প্রতিবেদনেই আমরা পাঠক-দর্শককে জানিয়ে দিই, এর অর্থায়ন কোথা থেকে হয়েছে। সঙ্গে এও বলা থাকে, প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। জোটভুক্ত বার্তাকক্ষগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আমরাই সিদ্ধান্ত নেই, কোন বিষয় কিভাবে কাভার করা হবে।

এভাবে, রিপোর্টিং ও সম্পাদনার যাবতীয় ব্যয় পরিশোধ করে নিউ ন্যারেটিভ, যা বার্তাকক্ষের উন্নয়নেও অবদান রাখে। এভাবে তারা স্বাধীন সাংবাদিকতার চর্চা জারি রাখতে পারে, যা তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা, পাঠক ও মুনাফা বাড়ায়। এনএন এমন বেশ কিছু স্বাধীন সাংবাদিকের সঙ্গে কাজ করেছে, যারা ১০ বছরের মতো দীর্ঘ সময় ধরে স্বাধীনভাবে কাজ করে গেছেন নিজ দেশের মানুষের জন্য। সাহসী, স্বাধীন এসব সাংবাদিকরা পাঠকদের কাছ থেকে ভূয়সী প্রশংসা পান তাদের কাজের জন্য। এখন তারা-ই তৈরি করে দিচ্ছেন সাংবাদিকতার নতুন মানদণ্ড, মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনছেন সাংবাদিকতায়।

এভাবে দাতা প্রতিষ্ঠানও তাদের কাজের ক্ষেত্র নিয়ে এমন আকর্ষণীয় ও  নির্ভরযোগ্য কাভারেজ পায়, যা সত্যিকারের প্রভাব তৈরি করতে পারে। আমাদের কাভারেজে যখন সরকার ক্ষুব্ধ হয়, তখন দাতারাও চাপের মুখে পড়েন। কিন্তু এখন পর্যন্ত, তাদের কথা ভেবে আমরা একটি প্রতিবেদনও সরিয়ে নেই নি। দাতারাও বোঝেন যে, এই স্বাধীনতাই আমাদের রিপোর্টিংকে এতো বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে, এবং কাঙ্ক্ষিত প্রভাব তৈরির ক্ষেত্রে এটিই সবচে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

যেখানে সবাই জয়ী

দাতাগোষ্ঠীর অর্থায়নে রিপোর্টিংয়ের অনেক যৌক্তিক সমালোচনা আছে। এটি একটি দেশের সত্যিকারের ইস্যুগুলো পাশে রেখে দাতাদের প্রাধান্য অনুযায়ী খবর তৈরির ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করতে পারে, এবং দাতাগোষ্ঠীদের স্বার্থে এমন বিষয়কে কাভারেজ দিতে পারে, যা আদতে সংশয় নিয়ে দেখা উচিৎ ছিল। কিন্তু সংবাদ বাণিজ্যে এ ধরনের কিছু সমঝোতার বিষয় বরাবরই আছে। সাংবাদিকতার জন্য স্বাধীনভাবে অর্থ আসবে এবং আমাদের কোনো সমঝোতা করতে হবে না- এমন স্বর্ণালী সময় যতদিন না আসে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের আমাদের উচিৎ: সাংবাদিকতার শত্রুদের বেশি বাড়তে না দেওয়া। দাতাদের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রেখে যদি অনুদান নির্ভর সাংবাদিকতা করা যায়, তাহলেই আমরা উন্নয়ন সংস্থাগুলোর তৈরি করা দূষিত পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতে পারব।

যে দু’টি পদক্ষেপ এখনই নেয়া জরুরি

১. উদীয়মান গণতন্ত্রগুলোতে উন্নয়ন সংস্থা কিভাবে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কাজ করবে, তার একটি নীতিমালা তৈরি করতে হবে। যে নীতিমালায়:

ক. মিডিয়া কাভারেজের জন্য অর্থ প্রদানে (নানা রকম ভাতা ও যাতায়াতের খরচ) উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে নিরুৎসাহিত করা হবে।

খ. বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য সংবাদমাধ্যমকে অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রেও উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে নিরুৎসাহিত করা হবে, যদি না সেখানে স্পষ্টভাবে লিখে দেওয়া হয়: “পেইড-ফর-কন্টেন্ট” বা “স্পন্সরড কন্টেন্ট”।

গ. উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে উৎসাহিত করা হবে যেন তারা কাজের ক্ষেত্রে, স্বাধীন ব্যবসায়িক মডেল গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, এমন স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে প্রাধান্য দেয়। স্বাধীন সংবাদমাধ্যম চিহ্নিত করা হবে যা দেখে, তার মধ্যে থাকবে: মৌলিক রিপোর্টিং, যে রিপোর্টিংয়ে বেশ কয়েকটি সোর্সের উল্লেখ থাকবে এবং যেখানে বেশ কয়েক পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি উঠে আসবে, যে রিপোর্টিংয়ে কোনো গল্প ফুটিয়ে তোলার জন্য সত্যিকারের মানুষের কথা থাকবে, যেখানে  রিপোর্টিং ও প্রযুক্তি ব্যবহারে নতুনত্ব থাকবে, মুনাফার উৎস হবে পাঠক-দর্শকরা, এবং যেখানে থাকবেন সাংবাদিকতার কঠোর মানদণ্ড ধরে রাখা একজন সম্পাদক।

ঘ. উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে উৎসাহিত করা হবে যেন তারা, সৎ বিজ্ঞাপনের জন্য স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে অর্থ প্রদান করে।

ঙ. উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে উৎসাহিত করা হবে যেন তারা, সাংবাদিকদের বিদেশ সফর ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছ ও যাচাইবাছাইমূলক আবেদন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়।

চ. উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে উৎসাহিত করা হবে যেন তারা, মধ্যস্থতাকারী কোনো অলাভজনক সংগঠন বা সরাসরি কোনো বার্তাকক্ষকে রিপোর্টিং অনুদান প্রদান করে। তবে এজন্য এমন নীতিমালা তৈরি করতে হবে যেন সম্পাদকীয় স্বাধীনতা বজায় থাকে।

ছ. উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে উৎসাহিত করা হবে যেন তারা স্থানীয় কোনো শীর্ষ সাংবাদিককে নিয়োগ দেওয়ার আগে দ্বিতীয়বার চিন্তা করে যে, সেই সাংবাদিক কি তাদের জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দেশের সেবা করতে পারবেন বেশি, নাকি  স্বাধীন সাংবাদিক হিসেবে?

২. নিম্নআয়ের দেশে, যেসব উন্নয়ন সংস্থা সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতে চায়, তাদের সহায়তার জন্য একটি স্পন্সরড কন্টেন্ট এজেন্সি (এসসিএ) প্রতিষ্ঠা করা উচিৎ। এই এসসিএ, পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী আকর্ষণীয় ও উঁচুমানের কন্টেন্ট তৈরির জন্য স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কাজ করবে। পাঠকের কাছে পুরোপুরি স্বচ্ছ থাকার জন্য এ ধরনের কন্টেন্টে অবশ্যই বলে দেওয়া উচিৎ এটি “স্পন্সরড” বা “বিজ্ঞপ্তি”। যদি উদাহরণ হিসেবে ইউনিসেফের টিকাদান কর্মসূচির কথা ধরা হয়, তাহলে এক্ষেত্রে প্রচারণামূলক কন্টেন্ট তৈরির জন্যে ইউনিসেফের সাথে কাজ করবে এসসিএ; এবং এরপর সেগুলো স্থানীয় ভাষা অনুযায়ী প্রচারিত হবে সংবাদমাধ্যম ও ইনফ্লুয়েন্সারদের সঙ্গে জোট বেঁধে। এভাবে সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য স্বাধীন আয়ের একটি ক্ষেত্র তৈরি হবে। একই সঙ্গে উন্নয়ন সংস্থাগুলোও তাদের প্রচার চালাতে পারবে প্রভাব তৈরি করার মতো নির্ভুল বার্তার মাধ্যমে। সেই বার্তা নির্ভরযোগ্য স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের মধ্য দিয়ে পৌঁছাবে অনেক বড় পরিসরের পাঠক-দর্শকের কাছে। এমন একটি এজেন্সি গঠনের ক্ষেত্রে শুরুতে হয়তো কিছু বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এটি স্বাবলম্বীও হয়ে উঠবে।

ভঙ্গুর দেশগুলোর জন্য এই তথ্য-পরিবেশ কতটা হুমকি হয়ে উঠছে, তা স্পষ্টই বোঝা যায়। আবার দূষিত এই পরিবেশের মধ্যে থেকে গণমাধ্যম ব্যবসাকে সাহায্য করতে চাওয়ার চেষ্টাও খুব বেশি কাজে লাগে না। উন্নয়ন সংস্থা ও স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের মধ্যে এই বাজে সম্পর্কটি ঠিক করতে পারলে, আমরা মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা ও গণতন্ত্র বিকাশের জন্য সহায়ক শক্তিগুলোকে আরো শক্তিশালী করতে পারব।

আরো পড়ুন

টিপস ফর ডোনারস

ডোনারস “বিগ বেট” অন নাইজেরিয়ান অ্যান্টি-করাপশন কুড বি গেম-চেঞ্জার

দ্য ব্যালান্সিং অ্যাক্ট অব ডোনার-ফান্ডেড জার্নালিজম: এ কেস স্টাডি ফ্রম সাউথ আফ্রিকা

লেখাটি গত ২৭ জানুয়ারি, ২০২১ তারিখে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ডয়েচে ভেলে অ্যাকাডেমির ওয়েবসাইটে। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।


প্রু ক্লার্ক একজন সাংবাদিক ও গণমাধ্যম উন্নয়ন কর্মী। তাঁর রিপোর্টিং ও লেখাপত্র প্রকাশিত হয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ফরেন পলিসি ও বিবিসি-তে। প্রু, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান নিউ ন্যারেটিভের সহপ্রতিষ্ঠাতা। এটি জিআইজেএন-এর একটি সদস্য সংগঠন, যারা আফ্রিকায় স্বাধীন সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম উন্নয়নে সহায়তা দেয়। তিনি জুডিথ নেইলসন ইন্সটিটিউট ফর জার্নালিজমের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী হিসেবে কাজ করেছেন। এবং পালন করেছেন সিটি ইউনিভার্সিটির নিউমার্ক গ্রাজুয়েট স্কুল অব জার্নালিজমের ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্টিং প্রোগ্রামের পরিচালকের দায়িত্ব।

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

Studio, headphones, microphone, podcast

সংবাদ ও বিশ্লেষণ

ঘুরে আসুন ২০২৩ সালের বাছাই করা অনুসন্ধানী পডকাস্টের জগত থেকে

নানাবিধ সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে প্রকাশিত হয়েছে সাড়া জাগানো কিছু অনুসন্ধানী পডকাস্ট। এখানে তেমনই কিছু বাছাই করা পডকাস্ট তুলে এনেছে জিআইজেএনের বৈশ্বিক দল।

সংবাদ ও বিশ্লেষণ সম্পাদকের বাছাই

চিংড়ি চোরাচালান, হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ড, তামাক শিল্পের ক্ষতিকর প্রভাব: চীন, হংকং ও তাইওয়ানের ২০২৩ সালের সেরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

অনেক বাধাবিপত্তি ও চ্যালেঞ্জের মুখেও চীন, হংকং ও তাইওয়ান থেকে ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে প্রভাব তৈরির মতো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। এমনই কিছু প্রতিবেদন জায়গা করে নিয়েছে জিআইজেএনের সম্পাদকের বাছাইয়ে।

InterNation international journalism network

সংবাদ ও বিশ্লেষণ

ইন্টারনেশন: (সম্ভবত) বিশ্বের প্রথম অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নেটওয়ার্ক

প্রায় ৪০ বছর আগে, গড়ে উঠেছিল অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের (সম্ভবত) প্রথম আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেশন। পড়ুন, এটির নেপথ্যের কাহিনী।

সংবাদ ও বিশ্লেষণ

জিআইজেএনের দুই দশক

জিআইজেএনের বর্ষপূর্তি। কুড়ি বছর আগে কয়েকটি অলাভজনক সংগঠন বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী ও ডেটা সাংবাদিকতার সমর্থনে একটি নেটওয়ার্ক গঠনের লক্ষ্যে একাট্টা হয়েছিল৷ সেটি ছিল ২০০৩ সালে, কোপেনহেগেনে আয়োজিত দ্বিতীয় গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্স। তারপর থেকে, আপনাদের সবার সহযোগিতায় আমাদের প্রসারে আমরা নিজেরাই বিস্মিত হয়েছি।