

সম্পাদকীয় সংকটে সৃষ্ট অস্থিরতার মধ্যেও যেভাবে এগোতে হবে
গত জুন মাসের ঘটনা। স্কুলের ফি বাড়ানোর ফলে পরিবারের বাড়তি খরচ প্রসঙ্গে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন প্রত্যাহার করে নেয় যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্র টেলিগ্রাফ। প্রতিবেদনে এক ব্যাংকারের গল্প তুলে ধরা হয়েছিল। পত্রিকাটি দাবি করে, সোর্স তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আরেকটি মিডিয়া আউটলেট প্রেস গেজেট ওই প্রতিবেদনটি নিয়ে বিশ্লেষণের সময় তাদের লেখার মধ্যে আগে প্রকাশিত অন্য একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের লিংক যুক্ত করে। যেখানে দেখানো হয়েছে কিভাবে কিছু প্রতারক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে ভুয়া ‘থট-লিডার’ বা চিন্তাবিদদের প্রোফাইল তৈরি করছে—যা উদ্বেগজনক।
ব্যাপকহারে ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে, আর গণমাধ্যমের ওপর আস্থা ইতিহাসের সবচেয়ে নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে—এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে সেই আস্থা পুনরুদ্ধার করা যায়, তা নিয়ে অনেক কিছু লেখা হয়েছে, আলোচনা হয়েছে, গবেষণাও হয়েছে। কিন্তু যখন একটি নৈতিক সংকট ঘিরে ঝড় ওঠে, তখন সেই ঝড় সামাল দেওয়ার বিষয়ে খুব কমই আলোচনা হয়।
“আমরা দুর্ঘটনা, হামলা, বিদ্যুৎ বিভ্রাট ইত্যাদির জন্য প্রচুর প্রশিক্ষণ দিই। অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, সম্পাদকীয় সংকটের কথা চিন্তা করে কখনও কোনো প্রস্তুতি নেই না।” —” বলেন নরওয়ের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম এনআরকের মহাপরিচালক ভিবেক ফুর্স্ট হাউগেন।
এনআরকের ইতিহাসে প্রথম নারী মহাপরিচালক হিসেবে ২০২২ সালে দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই ফুর্স্ট হাউগেন একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। যার চূড়ান্ত রূপ হিসেবে তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে একটি মহাসংকট। যা তার ভাষায়, “পেশাগত জীবনে আমি যতগুলো ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি, তার মধ্যে এটি ছিল সবকটির ওপরে।”
২০২৩ সালের নভেম্বরে এনআরকে সমস্যাগ্রস্ত একটি পরিবারকে নিয়ে সিরিজ তথ্যচিত্র সম্প্রচার করে। যেখানে তারা ৩০ বছর আগের একটি অপরাধের ঘটনা উল্লেখ করতে ভুলে যায়। বিষয়টি জনমনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। শেষ পর্যন্ত তারা সিরিজটি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
“এই সিরিজের একাধিক প্রতিবেদনে নৈতিক ভুল ও তথ্যের ঘাটতি ছিল। যা আমাদের সাংবাদিকতার মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ভুলটি যেহেতু অত্যন্ত গুরুতর ও যন্ত্রণাদায়ক ছিল, তাই আমরা ভীষণ সততার সঙ্গে ও গভীরভাবে তথ্যচিত্রগুলো পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেই।”
যদিও সম্পাদনাগত ভুল বা ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘটনা একেবারে অস্বাভাবিক নয়—সংবাদমাধ্যম ও সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই এসব ভুল সংশোধন করে। এমনকি প্রতিবেদন প্রত্যাহার করতেও বাধ্য হয়, যদি তা সংবাদের নৈতিক মানদণ্ড পূরণ না করে। কিন্তু ফুর্স্ট হাউগেন লক্ষ্য করেন, খুব কম প্রতিষ্ঠানই এই জায়গা থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে চিন্তা করে। অর্থাৎ, কীভাবে এসব সংকটগুলো আগে-ভাগে চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধ করা যায়, সে বিষয়ে একটি কাঠামোগত পদ্ধতি অনুসরণের কথা চিন্তা করে না।
“এই ধরনের সংকটগুলোর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আমরা এগুলোকে সংজ্ঞায়িত করেছি এমন এক ধরনের সংকট হিসেবে, যখন কোনো সম্পাদকীয় বা প্রকাশকের সিদ্ধান্তের কারণে সংবাদপত্রের আস্থা ও সুনাম হুমকির মুখে পড়ে, এটি তখনই সৃষ্টি হয়। এই সংকটগুলো নিঃশব্দে ধীরে ধীরে আমাদের ঘিরে ধরে।”
২০২৪ সালের মে মাসে ক্রাকোভে অনুষ্ঠিত ৭৬তম ওয়ার্ল্ড নিউজ মিডিয়া কংগ্রেসে ফুর্স্ট হাউগেন নিজের অভিজ্ঞতা এবং এনআরকে কীভাবে এসব সংকট মোকাবিলায় কার্যকর সমাধান বাস্তবায়ন করছে, তা অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে ভাগ করে নেন।
ভুলের পর ভুল
“আমার মনে হচ্ছিল আমরা যত বেশি তথ্য বের করছি, সংকটটা ততই গভীর হচ্ছে,” ব্যাখ্যা করেন ফুর্স্ট হাউগেন। তিনি আরো বলেন, “কিন্তু সিরিজটি প্রত্যাহারের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমাদের যেসব তথ্য দরকার ছিল, তা সংগ্রহ করতে সময় লেগে যায়।”
- গুরুতর সম্পাদনাগত ত্রুটি, সংবাদের নৈতিক ভুল ও তথ্য গোপন
• প্রতিক্রিয়া জানাতে দেরি করা
• সম্পূর্ণ তথ্য বুঝে সঠিক পদক্ষেপ নিতে সময়ক্ষেপন
• অভ্যন্তরীণ পর্যাপ্ত সহায়তার অভাব

ছবি: এনআরকের সৌজন্যে
“সবচেয়ে কষ্টদায়ক ছিল এই ব্যাপারটা যে আমি ওই সিরিজটা সম্পর্কে, তার পেছনে কী ঘটেছিল, সে বিষয়ে যথেষ্ট জানতাম না। আমি যখন প্রথম শুনি যে এই সিরিজটি প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, তখন আমি তা সম্পর্কে আরেকটু বিস্তারিত জানতে চাইনি। যা চাওয়া উচিত ছিল। আমি জানতাম আমাদের কিছু সহকর্মী খুব চাপের মধ্যে আছে। তারা আমার কাছ থেকে নিঃশর্ত সমর্থন চাইছে। কিন্তু আমি সেটা দিতে পারিনি—কারণ আমার কাছে তখন যথেষ্ট তথ্য ছিল না।” বলেন তিনি।
প্রতিক্রিয়ার ঝড়
“এটা আমার পেশাগত জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে এক নম্বরে থাকবে,” বলেন ফুর্স্ট হাউগেন। তিনি আরো জানান, “সংকটের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে ওই তথ্যচিত্রটি এবং কীভাবে আমরা কাজটি করেছি—তা নিয়ে ১০০টিরও বেশি মিডিয়ার কাছে থেকে প্রশ্নের সম্মুখীন হই। আমাদের ওপর মিডিয়ার চাপ ছিলম ভীষণ তীব্র। প্রথম ধাপে একবার আমাদের সমালোচনা করা হয়। পরে আবার সমালোচনার মুখে পড়ি এই কারণে যে, আমরা বিষয়টি মোকাবিলা করতে বড্ড দেরি করে ফেলেছি বা আমাদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া সমালোচনার জবাব দিতে অনেক বেশি সময় নিয়েছি।”
এই অভিজ্ঞতাটিও শেষ পর্যন্ত কাজে লেগেছে, যোগ করেন তিনি।
আরো বলেন, “আমরা এখান থেকে যেটা শিখেছি, তা হলো—সবচেয়ে বড় ভুল হলো ভুল করা নয়; সবচেয়ে বড় ভুল হলো সেই ভুল থেকে কিছু না শেখা, এবং পুনরায় একই ভুল করা। আমরা ভবিষ্যতেও ভুল করব, কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমরা একই ভুল দ্বিতীয়বার করব না।”
সমাধানের পথ
একটি খোলামেলা এবং সৎ পর্যালোচনা (পোস্টমর্টেম অ্যাসেসমেন্ট) করা জরুরী। ঠিক কোথায় কোন ভুল হয়েছে তা সবার সঙ্গে বিস্তারিতভাবে ভাগাভাগি করে নেওয়া। কাউকে দোষারোপ করার জন্য নয়, বরং শেখার সুযোগ তৈরির উদ্দেশ্যে। ভুলগুলো চিহ্নিত করে তা সংশোধনের লক্ষ্যে চারটি কার্যনির্বাহী দল গঠন করা হয়। যারা উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে কিছু সুপারিশ দেয়। তাদের বেশিরভাগ প্রস্তাবনাই পরে বাস্তবায়ন করা হয়।
চারটি দলের সদস্যরা মিলে “রেড ট্রেইল” নামে একটি নির্দেশিকা তৈরি করে। যেখানে কিছু দরকারি নির্দেশিকা আর টুল রয়েছে—যা সাংবাদিকদের সম্পাদকীয় মানদণ্ড ধরে রাখতে সাহায্য করে। যেমন, একটি চেকলিস্ট রয়েছে—যার মাধ্যমে সাংবাদিকরা ঠিক করতে পারবেন যে, এই রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে তাদের “রেড ট্রেইল” পদ্ধতি মেনে চলা উচিত হবে কিনা।

ছবি: এনআরকের সৌজন্যে
গৃহীত পদক্ষেপ
-
- সম্পাদকীয় কাঠামোর মধ্যে দায়িত্ব ও ভূমিকা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করতে পদ-পদবি পুনর্গঠন করা হয়েছে।
- প্রতিষ্ঠানজুড়ে সংবাদপত্রের নীতি নৈতিকতা নিয়ে সচেতনতা জোরদার করা হয়েছে: প্রেস এথিকস ইউনিটের সক্ষমতা দ্বিগুণ করা হয়েছে—একজনের জায়গায় এখন দুজন। সংবাদপত্রের নীতি নৈতিকতাকে আমরা আমাদের চারটি অগ্রাধিকারের মধ্যে একটি হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করেছি। ২০২৫ সাল থেকে যা আমাদের সব কার্যক্রমের মধ্যে যুক্ত থাকবে—কোর্স ও প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা থেকে শুরু করে মিটিংয়ের আলোচ্যসূচি বা অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড পর্যন্ত।”
- ভিতরের উদ্বেগ বা সংকট যেন সময়মতো ধরা পড়ে এবং সেগুলো সঠিকভাবে সামলানো যায়, সে জন্য নতুন কিছু নিয়ম চালু করা হয়েছে।
- ছোট বা প্রাথমিক পর্যায়ের সংকট চিহ্নিত করার জন্য একটি নতুন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। প্রতীকীভাবে বললে এটি মূলত ‘কমলা বোতাম’ চাপার মতো কাজ করে। এভাবে বড় ধরনের সমস্যা হওয়ার আগেই তা শনাক্ত করার মাধ্যমে প্রতিরোধ যায়। যাতে “রেড ট্রেইল”-এর ‘লাল বোতাম’ চাপার মতো পরিস্থিতি না আসে।
- সম্পাদকীয় সংকট মোকাবিলার জন্য দায়িত্বরত দলটি তাদের পরিকল্পনাগুলো আরো উন্নত করেছে। এখন সংকট দেখা দিলে পরিস্থিতি অনুযায়ী দ্রুত সংশ্লিষ্ট পেশাদার ও ব্যবস্থাপকদের সাহায্য নেওয়া যাবে।
যতটা যন্ত্রনাদায়ক ছিল, ততটাই এই অভিজ্ঞতাটা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে গেছে—এ কারণে ফুর্স্ট হাউগেন তার উপস্থাপনাটি শেষ করেন পুরো মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির উদ্দেশে একটি আহ্বান জানিয়ে। তিনি বলেন, সবাই যেন এমন খোলামেলা মূল্যায়ন আর আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করে।
মূল লেখাটি ডব্লিউএএন-আইএফআরএ (ওয়ার-ইফরা)-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। তাদের অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হয়েছে। শৈলী ও স্বচ্ছতার জন্য লেখাটি সামান্য সম্পাদনা করা হয়েছে।
লুসিন্ডা জর্ডান একজন স্বাধীন মিডিয়া পরামর্শক। যার সব ধরনের গণমাধ্যম এবং প্রকাশনা প্ল্যাটফর্মে—প্রিন্ট, ডিজিটাল, চলচ্চিত্র ও সম্প্রচার—কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিরিশ বছরের মিডিয়া ক্যারিয়ারে তিনি বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন—যেমন নিউজরুমের ড্যাশ সাব, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক থেকে শুরু করে লেখক ও কোচ পর্যন্ত। বর্তমানে তিনি ফ্রিল্যান্স লেখক, সম্পাদক, পরামর্শক এবং কোচ হিসেবে কাজ করেন। পাশাপাশি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও এজেন্সিতে পূর্ণাঙ্গ মিডিয়া ও যোগাযোগ সেবা প্রদান করেন। লুসিন্ডা নিয়মিত ডব্লিউএএন-আইএফআরএ ওয়ার্ল্ড এডিটর্স ফোরামের জন্য লেখালেখি করেন। মিডিয়া সাক্ষরতা ও উন্নয়নের প্রবল পক্ষপাতী হিসেবে তিনি গণমাধ্যমে কাজ করতে আগ্রহী তরুণ এবং উদ্যোক্তাদের জন্য বিভিন্ন মেন্টরশিপ, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচীতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।