কে, কোথায় এবং কখন – অনুসন্ধানের অনলাইন পদ্ধতি
সম্পাদকের নোট: ভেরিফিকেশন হ্যান্ডবুক ফর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং হলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় ইউজার-জেনারেটেড কন্টেন্ট (ইউজিসি) এবং উন্মুক্ত উৎসের তথ্য ব্যবহার করে অনলাইন অনুসন্ধান এবং গবেষণার একটি নতুন নির্দেশিকা। প্রকাশ করেছে নেদারল্যান্ড ভিত্তিক জিআইজেএন সদস্য ইউরোপিয়ান জার্নালিজম সেন্টার। ম্যানুয়ালে ১০টি অধ্যায় রয়েছে, যা বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যায়। ইন্টারনেট অনুসন্ধান বিশেষজ্ঞ হেঙ্ক ফন এস-এর লেখা দ্বিতীয় অধ্যায়টি এখানে পুনঃপ্রকাশ করতে পেরে আমরা আনন্দিত।
অনলাইন গবেষণা প্রথাগত অনুসন্ধানী সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক এবং ছাত্রদের জন্য বরাবরই একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ ইন্টারনেটের তথ্য ভুয়া, পক্ষপাতদুষ্ট, অসম্পূর্ণ, কিংবা এর সবগুলোই হতে পারে।
অফলাইনেরও একই অবস্থা। পক্ষাপাতমুক্ত মানুষ কিংবা সম্পূর্ণ সৎ সরকার – অনুসন্ধানের এমন আদর্শ পরিস্থিতি কোথাও পাবেন না। তাই ডিজিটাল হোক বা না হোক, আপনি সঠিক প্রশ্ন করছেন কিনা শেষপর্যন্ত তারওপরই নির্ভর করবে – উত্তর পাবেন, কী পাবেন না। সাংবাদিকতার সবচে বড় তিনটি প্রশ্ন হলো- কে, কোথায় এবং কখন। অনলাইনে এই তিন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার কিছু টুল ও পরামর্শ থাকবে এই লেখায়।
১. কে?
চলুন আমরা গুগলে শেল অয়েল কোম্পানির সিইও বেন ভ্যান বার্ডেনের ব্যাকগ্রাউন্ড প্রোফাইল করি।
ক. তথ্য এবং মতামত খুঁজুন
মাত্র দুই বর্ণের শব্দ “is” আপনার কাঙ্খিত বিষয় সম্পর্কে মতামত এবং তথ্য তুলে আনবে। একই নামে অনেক ব্যক্তি থাকতে পারে। তাই বিভ্রান্তি এড়াতে ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানের নাম কিংবা আপনার জানা অন্য কোন তথ্য এর সাথে যোগ করুন। গুগলকে বলুন, দুই শব্দের অবস্থান যেন একে অন্যের থেকে খুব দূরে না হয়।
AROUND() শব্দটি অবশ্যই বড় হাতের অক্ষরে লিখতে হবে। এটি আপনার দেয়া দুটি টার্মের মধ্যকার শব্দের সর্বাধিক দুরত্ব নির্ধারণ করে।
খ. অন্যেরা কি বলে?
এই অনুসন্ধানটি গুগলকে জিজ্ঞাসা করছে “শেল কোম্পানির নিজস্ব ডকুমেন্ট বাদ দিয়ে আমাকে শুধু সিইওর নামসহ পিডিএফ ডকুমেন্ট বা নথিগুলো দেখাও।” এটি কোম্পানি নয়, বরং আপনার বিষয়বস্তু বা ব্যক্তি সম্পর্কে ডকুমেন্ট খুঁজবে। এর মাধ্যমে আপনি ঐ ব্যক্তি বা বিষয় সম্পর্কে তার বিরোধী, প্রতিযোগী কিংবা ভিন্নমতের মানুষেরা কী ভাবছেন তা জানতে পারবেন। আপনি যদি খুব খুঁতখুঁতে হয়ে থাকেন, তবে এই পন্থা অবলম্বন করুন।
inurl:pdf “ben van beurden” –site:shell.*
তাহলে আপনি এমন কিছু পিডিএফ পাবেন, যা সাধারণ ফাইল টাইপ সার্চে আসে না।
গ. অফিসিয়াল ডেটাবেজ
ওপরের সার্চ অপশন দিয়ে সেই ব্যক্তির ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী সরকারি নথির জন্য অনুসন্ধান করুন। এটি যুক্তরাজ্য (gov.uk), অস্ট্রেলিয়া (.gov.au ), চীন (.gov.cn) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ (.gov) বিশ্বের সব সরকারি ওয়েবসাইটে অনুসন্ধান চালায়। যদি কোনো দেশে .gov ওয়েব সাইট না থাকে, সেক্ষেত্রে সাইট: অপারেটরে স্থানীয় শব্দ ব্যবহার করুন। উদাহরণ স্বরূপ, site: bund.de (জার্মানি) অথবা site:overheid.nl (নেদারল্যান্ডস)।
এই অনুসন্ধানে আমরা খুঁজে পাই, লন্ডনে ভ্যান বার্ডেনের বাড়ির পরিকল্পনার একটি অনুমতিপত্র। এখান থেকে তার পুরো ঠিকানা এবং অন্যান্য তথ্য পাওয়া যায়।
ঘ. জাতিসংঘ
আপনি এখন জাতিসংঘের কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে সার্চ করছেন। এই উদাহরণে আমরা দেখতে পাই, “আন্তর্জাতিক কেমিক্যাল ব্যবস্থাপনার কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি” শীর্ষক একটি পেপারে শেলের সিইওর নাম উঠে আসছে। আমরা যখন এই সার্চটি করি তখন তার পুরো নাম, পাসপোর্ট নম্বর এবং তার স্ত্রীর নামও খুঁজে পাই। চমৎকার!
ঙ. বৈচিত্র্য খুঁজুন
এই ফর্মুলায় আপনি একটি নামে বিভিন্ন বানানের ব্যবহার আছে, এমন সব ফলাফল পেতে পারেন। ওপরের সার্চ টার্মের অর্থ হচ্ছে, আপনি “শেল“ শব্দ আছে এমন সব ডকুমেন্ট গ্রহণ করবেন কিন্তু নামের প্রথম অংশ হিসেবে “বেন” থাকলে তা বাদ দিবেন। এভাবে সার্চ দিয়ে দেখা যায়, বার্নারডাস ভ্যান বার্ডেন নামেও তাকে সম্বোধন করা হচ্ছে। (আপনার ডট [.] দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, কেননা গুগল পয়েন্টস উপেক্ষা করবে)। এখন এই নতুন নামে ক খ গ ঘ ধাপগুলো আবার করুন।
২.কোথায়
ক. টপসিতে ছবি অনুসন্ধান করুন
টুইটারে অন্যদের পোস্ট করা ছবি দেখে এবং তাঁর উল্লেখ করা সময় বিশ্লেষণ করে আপনার সাবজেক্ট কোথায় কোথায় ছিলেন, সেটা খোঁজার জন্য আপনি www.topsy.com ওয়েবসাইটটি ব্যবহার করতে পারেন। আপনি যদি নির্দিষ্ট সময়কাল নিয়ে গবেষণা করতে চান, তবে টাইম মেন্যুতে গিয়ে “সুনির্দিষ্ট ব্যাপ্তি” দিয়ে, তারপর খুঁজুন।
খ. ইকোসেক ব্যবহার করুন
ইকোসেকের মাধ্যমে আপনি বিনামূল্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনুসন্ধান চালাতে পারেন। এই উদাহরণে, আমি সেখানে শেল সদরদপ্তরের ঠিকানা (১) দিয়েছি, যারা সেখানে কাজ করছে (৩) এমন কর্মীদের সাম্প্রতিক পোস্ট (২) খুঁজে পাওয়ার আশায়।
গ. গুগল ইমেজে ফটো সার্চ ব্যবহার করুন
আপনি আপনার সাবজেক্ট সম্পর্কে যা জানেন তার সব একটি শক্তিশালী বাক্যে আনুন। নিচের উদাহরণে, আমি @মুহাজিরিশাম নামের একজন জিহাদিকে খুঁজছি, তবে @মুহাজিরিশাম০১ নামের টুইটার অ্যাকাউন্ট নয়। আমি শুধুমাত্র ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ২৯ সেপ্টম্বর ২০১৪ সালের মধ্যে টুইটারে তার দেওয়া ছবিগুলো দেখতে চাই।
৩. কখন
ক. তারিখ অনুসন্ধান
আমরা বেশির ভাগ গবেষণাই আজকের তারিখে নয়, বরং অতীতের উপর করে থাকি। আপনার সার্চ ইঞ্জিনকে সেই ভাবে নির্দেশনা দিন। অতীতে চলে যান।
চলুন, কেমি-প্যাক নামের ডাচ একটি রাসায়নিক প্লান্টে অগ্নিকান্ডের ঘটনা অনুসন্ধান করি। আগুনের ঘটনাটি ঘটে ২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি। ধরুন, প্লান্টে বিপজ্জনক রাসায়ানিক ছিলো কিনা সে বিষয়ে আপনি অনুসন্ধান করতে চান। তাহলে images.google.com এ যান, আর লিখুন কেমি-প্যাক এবং ২০১১-এর জানুয়ারির ঠিক আগে সার্চ করুন। এর রেজাল্টে আপনি একটি যুব ফায়ার ডিপার্টমেন্টের শত শত ছবি দেখতে পাবেন, যারা ঘটনাটি ঘটার কয়েক দিন আগে কোম্পানিটি পরিদর্শন করেছিলেন। কয়েকটি ছবিতে আপনি দেখতে পাবেন ব্যারেলের উপর রাসায়ানিকের নাম লেখা আছে। এর মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করতে পারি প্লান্টে আগুন লাগার আগে সেখানে কী ধরনের রাসায়নিক মজুদ ছিল।
খ. আর্কাইভ.ওআরজি-তে পুরোনো ডেটা খুঁজুন
কিছু কিছু ওয়েব সাইট প্রায়ই খুঁজে পাওয়া যায়না। তবে archive.org ব্যবহার করে সেগুলো পেতে পারেন। এটি তখনই কাজ করবে, যদি আপনি কাঙ্খিত ওয়েবসাইটের ইউআরএল জানেন। সমস্যা হলো লিঙ্কগুলো প্রায়ই হারিয়ে যায়। তাহলে আপনি আপাতদৃষ্টিতে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সেই ইউআরএল কিভাবে খুঁজে পাবেন?
ধরে নেয়া যাক আমরা লানা ক্লার্কসন নামে মৃত একজন অভিনেত্রীর হোম পেজটি খুঁজে বের করতে চাই।
প্রথম পদক্ষেপ: একটি ইনডেক্স খুঁজে বের করুন
হারানো পেজটির একটি উৎস খুঁজে বের করুন। এক্ষেত্রে আমরা তার উইকিপিডিয়া পেইজটি ব্যবহার করতে পারি।
দ্বিতীয় পদক্ষেপ: ইনডেক্সটি টাইম মেশিনে রাখুন
আর্কাইভ.ওআরজি এই ওয়েব ঠিকানায় যান এবং তার উইকিপিডিয়া পেইজের ইউআরএল http://en.wikipedia.org/wiki/Lana_Clarkson -এ প্রবেশ করুন। এর সবচেয়ে পুরোনো যে সংস্করণ পাওয়া যায়, সেটি ২০০৪ সালের ১০ মার্চের। সেখানে বলা হচ্ছে হোম পেইজটির ঠিকানা ছিল http://www.lanaclarkson.com
তৃতীয় পদক্ষেপ: মূল ওয়েবসাইট খুঁজুন
এখন লিঙ্কটি আর্কাইভ.ওআরজি এই ওয়েব ঠিকানায় লিখুন। তবে ইউআরএল-এ একটি ব্যাক স্ল্যাশ এবং একটি তারকা চিহ্ন যোগ করুন: https://web.archive.org/web/*/http://www.lanaclarkson.com/*
সকল নথিভুক্ত লিঙ্কই এখন দৃশ্যমান। দুর্ভাগ্যবশত, এক্ষেত্রে আপনি তেমন কোন তথ্য পাবেন না। কেননা, ক্লার্কসন তার মৃত্যুর পরেই বিখ্যাত হয়েছিলেন। ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে নামকরা সঙ্গীত প্রযোজক ফিল স্পেক্টর তাকে গুলি করে হত্যা করেন।
হেঙ্ক ভ্যান এস জন্ম নিয়েছেন নেদারল্যান্ডে। তিনি ইন্টারনেট গবেষণা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মাল্টিমিডিয়া/ক্রস মিডিয়া বিষয়ে পড়ান। এই অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক সারা ইউরোপ ঘুরে ইন্টারনেট রিসার্চ ওয়ার্কশপ করিয়েছেন। তাঁর বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে “ফ্যাক্ট-চেকিং দ্য ওয়েব”(সিএসআই ইন্টারনেট) এবং হ্যান্ডবুক ডেটা জার্নালিজম। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ওয়েব রিসার্চ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ বক্তা।