প্রবেশগম্যতা সেটিংস

Illustration: Moshtari Hilal

লেখাপত্র

বিষয়

ভাষার বিড়ম্বনা: ইংরেজি যেভাবে বদলে দিচ্ছে বিশ্ব সংবাদের ন্যারেটিভ

আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:

হোস্টরাইটার এমন একটি নেটওয়ার্ক যারা, আন্তসীমান্ত অনুসন্ধানে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করতে সাংবাদিকদের সহযোগিতা করে। সম্প্রতি তারা বিশ্বজোড়া সহকর্মীদের কাছ থেকে লেখা আহবান করে।  বিষয়বস্তু ছিল: সাংবাদিকতাকে আরো বৈচিত্র্যপূর্ণ করার উপায় ও যত বাধা। সেই লেখাগুলোরই সংকলন  “আনবায়াস দ্য নিউজ: হোয়াই ডাইভার্সিটি ম্যাটার্স ফর জার্নালিজম।” হামবুর্গে অনুষ্ঠিত একাদশ গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে বইটি উন্মোচিত হয়। সংকলনটির প্রথম নিবন্ধ লিখেছেন জিআইজেএনের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, তানিয়া প্যাম্পালোনি, যার শিরোনাম ছিল, “ওয়াচ ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ।” এই লেখাটি সেখান থেকে নেয়া। 

হলরুম ভর্তি দর্শক সবাই ভাবছিলেন তারা কৌতুকটি ধরতে পেরেছেন। ২০১৯ সালের অস্কারে সেরা ছবি হিসেবে ব্ল্যাক প্যানথারের  নাম ঘোষণা করতে গিয়ে ট্রেভর নোয়াহ যখন বলেন, তিনি বড় হয়েছেন কল্পনার দেশ ওয়াকানাদায়, তখন দর্শকদের মধ্যে হাসির রোল।

নোয়াহ বলছিলেন, তার গ্রামের ওপর দিয়ে, চাল্লা (ব্ল্যাক প্যানথার ছবির প্রধান চরিত্র) যখন উড়ে যাচ্ছিলো তখন তার মনে পড়ে যায় আফ্রিকার খোসা ভাষায় প্রচলিত একটি বিখ্যাত প্রবাদ: “আবায়াজি উকুবা নদিয়াখোকা।” সেখানে কথাটির ইংরেজি অর্থও ব্যাখ্যা করেন দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেয়া এই কৌতুকাভিনেতা, “আমরা একসাথে লড়লে শক্তিশালী, আর আলাদা হলেই দুর্বল।”

হলভরা দর্শক যখন প্রবাদের গভীরতা নিয়ে চিন্তায় মগ্ন, তখন হেসে রীতিমত গড়াগড়ি খাচ্ছেন হাজারো মাইল দূরে আফ্রিকার খোসা-ভাষী অঞ্চলের টিভি দর্শকরা। নোয়াহ যে আসলে খোসা ভাষায় গোটা হলিউডকে এক হাত নিয়ে নিয়েছেন, সেটা শুধু এই আফ্রিকানরাই ধরতে পেরেছেন। কথাটির সঠিক অনুবাদ জানতে চান? “এই সাদা লোকগুলো জানে না, আমি মিথ্যা বলছি।”

ইংরেজি-বলা পশ্চিম-কেন্দ্রিক বিশ্বের এই খোঁচাটা পাওনা ছিল। অন্তত দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও যন্ত্রণার একটা জবাব তো দেয়া গেল। “দানব, গুন্ডা, চোর: যেভাবে গোটা বিশ্বকে দখল করে নিচ্ছে ইংরেজি ভাষা” – এই শিরোনামে গার্ডিয়ানে লেখা নিবন্ধে লেখক জ্যাকব মিকানোস্কি দারুণভাবে বিষয়টিকে তুলে এনেছেন। তিনি বলেছেন, কোরিয়ায় শিশুদের জিহ্বার টিস্যু কেটে ফেলা (শুদ্ধ উচ্চারণে ইংরেজি বলার জন্য) থেকে শুরু করে ইউরোপীয় উপন্যাসের “বাস্টার্ডাইজেশন” (বাংলা করলে দাঁড়ায়- জারজীকরণ, যার অর্থ নিম্নমানের অনুবাদ) পর্যন্ত সবকিছুর গোড়ায় রয়েছে এই “পঁচা, আন্তর্জাতিক ভাষা।”

আমার বাবার কথাই ধরুন। উত্তর আফ্রিকা থেকে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে। তিনি, তাঁর ইতালিতে জন্ম নেওয়া বাবা-মার সাথে কথা বলতেন ইতালিয় ভাষায়। স্কুলে কথা বলতেন ফরাসিতে। আরবী বলতেন যখন তিউনিসিয়ার রাস্তায় বেড়ে উঠেছেন। কিন্তু এই ভাষাগুলোর একটিও তিনি নিজের সন্তানদের বলতে দিতেন না। তিনি চাননি আমাদের কথায় কোনো আঞ্চলিক টান থাকুক। তাঁর ভয় ছিল আমেরিকার স্কুল আর অভিবাসী-বিরূপ সড়কে, এই আঞ্চলিক টান আমাদের সমস্যায় ফেলবে।

এবার আসি আমার কন্যা-সন্তানের প্রসঙ্গে। সে বড় হয়েছে জোহানেসবার্গে এবং পাঠ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে “জুলু,” দক্ষিণ আফ্রিকার ১১টি সরকারি ভাষার একটি। দেশটির অনেক অধিবাসী এই ভাষায় কথা বলেন। ছয় বছর ধরে সে শিখছে, কিন্তু কারো সাথে এই ভাষায় কথা বলেনি। অবশ্য এজন্য তার লা-পরোয়া কৈশোরোত্তীর্ণ জীবন, অথবা ঘরে ইংরেজি-বলা পরিবেশকে আমি পুরোপুরি দোষ দিই না। জোহানেসবার্গে তার খেলার মাঠের বন্ধুরাও ইংরেজিতেই কথা বলে। আমার এক জুলু-ভাষী সাংবাদিক বন্ধুকেও দ্বিধা ছাড়া বলতে শুনেছি, তার সন্তান ইংরেজি ছাড়া কোনো ভাষাই বলতে পারে না। বর্ণবিরোধ শেষ হওয়ার ২৫ বছর পরে এসেও, সবুজে ছাওয়া সাবেক “শ্বেতপ্রধান” এলাকার স্কুলগুলোতে, আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলাকে “ব্রাত্য” বলেই ধরে নেয়া হয়।

যেখানেই থাকি বা কাজ করি না কেন, সাংবাদিক হিসেবে আমার অন্যতম দায়িত্ব হলো যে কোন বিষয়কে যতটা বিশদ ও গভীরভাবে সম্ভব তুলে ধরা। কিন্তু এটাও সত্য, আমার ভেতরে একটি নির্দিষ্ট ভাষার প্রতি যে পক্ষপাত গাঁথা রয়েছে, তা-ও সমস্যার অন্যতম অংশ। সাধারণ সংবাদ-প্রতিবেদন থেকে শুরু করে সাংবাদিকতার শিক্ষা পর্যন্ত বৈশ্বিক যে ন্যারেটিভ, তাকেও বদলে দিতে পারে এই পক্ষপাত।

ভাষার শক্তি

কাই চ্যান হলেন ইনসিড ইনোভেশন অ্যান্ড পলিসি ইনিশিয়েটিভের সম্মানিত ফেলো। কোন ভাষার কত ক্ষমতা, সেটি মাপতে তিনি তৈরি করেছেন পাওয়ার ল্যাংগুয়েজ ইনডেক্স। তাতে বলা হচ্ছে, বিশ্বে এখনো যে ৬০০০ ভাষা টিকে আছে, এদের মধ্যে মাত্র ১৫টি ভাষাতেই অর্ধেক মানুষ কথা বলেন। চ্যান দেখতে চেয়েছিলেন কোন ভাষার প্রভাব ও বিস্তার কতটা। এজন্য তিনি ভাষাকে মূল্যায়ন করার একটি ব্যবস্থা দাঁড় করান। সেখানে ২০টি নির্দেশক আছে, যেমন: আয়তন, জিডিপি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কূটনৈতিক প্রভাব, এবং ইন্টারনেট কনটেন্ট।

২০১৬ সালের সেই বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ভাষা ইংরেজি; তার পরেই রয়েছে ম্যান্ডারিন, ফরাসি, স্প্যানিশ, আরবী এবং রুশ। ভেবে নিতে পারেন, এত বড় একটা বিশ্ব, আর সেখানে চীনের মত বড় জনসংখ্যার দেশ – হিসাব তো এমন হবেই। কিন্তু বিষয়টি ঠিক এরকম নয়। চ্যানের ডেটায় এমন অনেক দিক আছে যা নিছক জনসংখ্যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।  তিনি দেখান, বিশ্বের অনেক দেশেই ইংরেজি কার্যত দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে প্রচলিত, যা একে ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রযুক্তি, শিক্ষা, পর্যটন এবং অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংবাদেরও বৈশ্বিক ভাষায় পরিণত করেছে।

একই কথা প্রযোজ্য গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের বেলায়, যেখানে আমি ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে কাজ করছি। আমাদের ভার্চুয়াল সদর দপ্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হলেও, বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আমাদের আঞ্চলিক সম্পাদকরা আটটি ভাষায় নিয়মিত স্টোরি দিচ্ছেন এবং সোশ্যাল মিডিয়া ফিড পরিচালনা করছেন। আমরা প্রায় এক ডজন ভাষা শেয়ার করি, কিন্তু একে অপরের সাথে কথা বলি মূলত ইংরেজিতে।

লি গুয়ো এবং ক্রিস জে. ভার্গো নামের দুই গবেষক,  ২০১৫ সালে বিশ্বের ৬৭টি দেশের ৪,৭০৮টি উৎস থেকে আসা প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ধনী দেশগুলো তাদের সংবাদ দিয়ে বিশ্বের বেশিরভাগ মনোযোগ যেমন কেড়ে নিয়েছে, তেমনি তারাই নির্ধারণ করে দিয়েছে অন্য দেশগুলো বিশ্বকে কিভাবে দেখবে।

আমার সহকর্মী, জিআইজেএনের বাংলা সম্পাদক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী মনে করেন, ইংরেজি ভাষার এই বৈশ্বিক ন্যারেটিভ তৈরির ক্ষমতা বেশ প্রবল।

“বাংলাদেশের প্রধান ১০টি সংবাদপত্রের কথা যদি বিবেচনায় নেন, তাদের মধ্যে দু’টি বাংলা দৈনিক পাবেন যাদের সার্কুলেশন পাঁচ লাখেরও বেশি। আর ডেইলি স্টারের- সার্কুলেশন মাত্র ৫০ হাজার। কিন্তু এটি একটি ইংরেজি পত্রিকা – তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে বাকি বিশ্বের যে ন্যারেটিভ তা অনেকাংশে ডেইলি স্টারই নিয়ন্ত্রণ করে,” বলেন তিনি। “যখন ফ্রান্সে কোনো বড় ঘটনা ঘটে, কি হচ্ছে তা আমরা জানার চেষ্টা করবো সেখানকার ইংরেজি সংবাদমাধ্যম থেকে। বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে আমরা সিএনএন, বিবিসি, আল জাজিরা, ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমস বা গার্ডিয়ান নিয়ে আচ্ছন্ন থাকি। এভাবেই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোও তাদের নিজস্ব ন্যারেটিভ চাপিয়ে দিতে পারে।”

চিত্র: মোশতারি হেলাল

যা হারায় ভাষান্তরে

ইংরেজি ভাষা এবং পশ্চিমা ন্যারেটিভের বিস্তার বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু এটাও সত্য, বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে বেশিরভাগ মানুষের পেশাদারিত্বের ঝুলিতে ইংরেজি-দক্ষতা অনুপস্থিত। এটিই এত বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়, যার কারণে তারা অনেক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন, শিকার হন বৈষম্যের।

“বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে কথা বলা হোক, কোলাবরেশন, প্রযুক্তি ব্যবহার অথবা সোর্সের সাথে যোগাযোগ – আপনার ইংরেজি জানা লাগবেই,” বলেন চৌধুরী। “ তা না হলে নতুন কিছু জানা, টুলের ব্যবহার শেখা, এমনকি ভালো গাইড পাওয়াও আপনার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে; সাংবাদিকতায় যেসব বই পড়তে উৎসাহিত করা হয়, তাদের বেশিরভাগও ইংরেজিতে।”

ইংরেজিতে মানুষের এমন ‍দুর্বলতার কারণে রাশিয়ার কর্মকর্তারা বেশ ”উল্লসিত” থাকেন – একথা বলেছেন জিআইজেএনের রুশ-ভাষা সম্পাদক ওলগা সিমানোভিচ। “এর মানে হচ্ছে, রাশিয়ার সরকারি সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের তৈরি গল্প, অনায়াসে মানুষের মনে প্রবেশ করিয়ে দিতে পারে। এজন্য তাদের চীনের মত ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তৈরি করতে হয় না, যদিও তারা সেই কাজেও হাত দিয়েছে।”

ভাষার এই যে প্রতাপ, তার আরেকটি দিক আছে: আপনার স্টোরি কোনো স্টোরি-ই না, যতক্ষণ না তা ইংরেজিতে প্রকাশিত হচ্ছে। রুশ সাংবাদিক বেন নিমো এবং এরিক টোলার এখানে তাদের সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের বিখ্যাত সেই ট্রল ফ্যাক্টরি নিয়ে তারা রিপোর্ট করেছিলেন ২০১৩ সালে। তখনও প্রতিষ্ঠানটি শুধু রাশিয়ার ভেতরের জনমতকেই প্রভাবিত করছিল। কিন্তু কেউ আমলে আনেনি। সেই প্রতিষ্ঠানই যখন মার্কিন নির্বাচনকে প্রভাবিত করলো, তখন তাদের নিয়ে করা রিপোর্ট হৈচৈ ফেললো। (মোদ্দা কথা হলো: রাশিয়ায় যা ঘটে তা রাশিয়াতেই থেকে যায়, যদি তা রুশ ভাষায় হয়; অথবা যতক্ষণ না, আমেরিকার সাথে তার কোনো সম্পর্ক থাকে।)

অবশ্য উত্তর গোলার্ধ্বের বাইরের কোনো স্টোরিকে স্বীকৃতি না দেয়া যে সব সময় ভাষার কারণে, তা নয়। সাংবাদিকতার অধ্যাপক জে রোসেন সম্প্রতি তুলে ধরেছেন, গুপ্তা ভাইদের কেলেংকারি নিয়ে সবার আগে রিপোর্ট করা দক্ষিণ আফ্রিকান গণমাধ্যম, ডেইলি ম্যাভেরিক ও আমাবুনগানে-কে কোনো স্বীকৃতি না দিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস কিভাবে সেই খবর প্রকাশ করেছে। আবার এই গুপ্তালিকস যখন দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার পেলো, তখন সেই রিপোর্টে কাজ করা অনেক স্থানীয় সাংবাদিককে আমলেই আনা হয়নি।

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের পর দেশটির খোসা ভাষার সংবাদপত্র ইলিসোলিজোয়ি ইসিখোসা-র সম্পাদক উনাথি কোনডিলে বলেন, যাদের শোনার কথা তারাও আসলে, সাধারণ মানুষের ভাষায় বেরুনো পত্রিকার কথা শোনে না।

“আমাদের কাছে,” কোনডিলে লিখেছেন, “এসব পুরস্কার সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়, কারণ এর বিচারকরা ইংরেজি ও আফ্রিকান ছাড়া আর কোনো কিছুই বিচার করতে পারেন না। এর ফলে স্থানীয় ভাষার পত্রিকাগুলোকে একাধিক পুরস্কার জিততেও খুব একটা দেখা যায় না। তাই এদের গুরুত্ব দিয়ে কী লাভ?”

কোনডিলের এই যন্ত্রণাকে সূদূর ঢাকায় বসেও অনুভব করেন চৌধুরী। আন্তর্জাতিক সম্মেলন বা ফেলোশিপের জন্য সাংবাদিকদের সাধারণত ইংরেজিতে আবেদন করতে হয়; এমনকি জিআইজেএনের বিশ্ব সম্মেলনেও, যা কিনা মূলত ইংরেজি এবং আয়োজক দেশের ভাষাতেই সঞ্চালিত হয়।

“আপনি তাদের আবেদন পড়লেন, আর ভাবলেন, এই লোক তো বেশ ভালো ইংরেজি লেখে,” বলেন তিনি। “কিন্তু আরেকজন সাংবাদিকও একই ফেলোশিপের জন্য আবেদন করেছেন, হয়তো তিনি আরো ভালো সাংবাদিক, কিন্তু ইংরেজি লেখায় দক্ষ নন।”

এর ফলাফল সহজেই অনুমান করা যায়: আপনি যদি ভিন্ন ভাষার কোনো সাংবাদিকের ইংরেজিতে করা আবেদন পড়েন, কিন্তু তার সীমাবদ্ধতাকে আমলে না নেন, তাহলে চিন্তা করে দেখুন তো – সেই ফেলোশিপ, পুরস্কার বা সুযোগ কার কপালে জুটবে?

ইংরেজিরও রকমফের

এই বৃহত্তর দৃশ্যপটের বাইরে, ইংরেজি ভাষার প্রভাবের কিছু খুঁটিনাটি দিকও আছে।  যেমন, আপনি কিভাবে রিপোর্ট করেন, কার সাথে এবং কিভাবে কথা বলেন, কী প্রশ্ন করেন, এবং যেমনটা আমার সাবেক সহকর্মী দক্ষিণ আফ্রিকার ইংরেজি দৈনিক মেইল অ্যান্ড গার্ডিয়ানের সিনিয়র এডিটর কোয়ানিলে সোসিবো মনে করিয়ে দিয়েছেন – আপনি বিদেশী ভাষায় লেখা প্রতিবেদনে কী কী শব্দ ব্যবহার করেন, বিশেষ করে এমন ক্ষেত্রে যেখানে দেশী কোনো বক্তা বিদেশী ভাষায় কথা বলেছেন এবং আরেকজন দেশী ব্যক্তি তা অনুবাদ করেছেন।

“আমার বিচারে, ইংরেজিরও রকমফের আছে, আর আমি মনে করি লেখকদেরও তা নিজ ভাষায় প্রকাশের বেলায় কিছুটা এদিক-ওদিক সরে আসার স্বাধীনতা থাকা উচিত,”  বলেন সোসিবো। “পাঠকদের জন্যেও তা উপভোগের সুযোগ থাকা উচিত। অনেকেই এক ভাষায় কথা বলার সময় অন্য ভাষার বাক্য ব্যবহার করেন, কিন্তু লেখার সময় সাংবাদিকদের সেই বক্তব্য দুই ভাষায় ব্যবহারের স্বাধীনতা থাকে না। এর ফলে অনুবাদই শেষ পর্যন্ত বক্তার বক্তব্য নিয়ন্ত্রণ করে।” মুশকিল হলো, এমন অনেক প্রবাদ বা বাক্য আছে, যা অনুবাদে ঠিক উঠে আসেনা।

লেখনীতে একজন লেখকের নিজস্ব বলার ধরণ এবং স্টাইলের যে গুরুত্ব, তা আমি শিখেছি লস এঞ্জেলেসে গ্রেগ ক্রিস্টারের সাথে কাজ করতে গিয়ে। তিনি সেসময় বাজ ম্যাগাজিনের ডেপুটি এডিটর ছিলেন। আর আমি ছিলাম মাত্র কুড়ি পেরুনো এক কর্মী মাত্র।

আমার নাছোড়বান্দা সেই এডিটর, কাগজে লেখা প্রতিবেদনগুলোতে দাগ দিয়ে দিয়ে সম্পাদনা করতেন। কখনো কখনো তার সম্পাদনা করা রিপোর্টে কিছু যোগ করারও অনুমতি চাইতাম। গুরুর কাছ থেকে আমি এভোবেই শিখেছি। সেই কাগজ ধরে তিনি আমাকে শেখাতেন, কারো স্টোরি থেকে একটু এদিক-ওদিক সরিয়ে, তাতে কিছুটা যোগ করে নিয়ে – কিভাবে আরো ভালো, গভীর ও শক্তিশালী প্রতিবেদন তৈরি করা যায়, এবং একই সাথে লেখকের বলার নিজস্ব ধরণও পুরোপুরি অটুট রাখা যায়। তিনি আমাকে বলতেন, “কখনো দৈনিক পত্রিকায় কাজ করবে না, তারা তোমার লেখার হাত নষ্ট করে দেবে।”

ম্যাগাজিনের ব্যবসা ক্রমেই শুকিয়ে যাচ্ছিলো। আর আমিও বাধ্য হলাম নিষিদ্ধ সেই জগতে কাজ নিতে। কিন্তু আমি আমার লেখনী নষ্ট হতে দিইনি; বরং সেই সম্পাদক হতে চেয়েছি, যিনি অন্যের লেখাকে আরো উন্নত করেনI আর তা করতে গিয়ে, আমি শোনার চেষ্টা করি লেখক যা বলতে চান, অনুধাবনের চেষ্টা করি ছন্দ, বোঝার চেষ্টা করি ভাষান্তরের পেছনে লুকোনো ভাবটাকে।

এই বিষয় নিয়ে আমাদের সবারই চিন্তাভাবনা করা উচিত। ইংরেজি ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক এডগার ডব্লিউ স্নাইডার বিশ্বে ইংরেজি ভাষার প্রচলিত ধরণ নিয়ে এক গবেষণায় বলেছেন, নতুন নতুন স্থানীয় ভাষা-রূপ আবির্ভাবের কারণে ইংরেজিকে আর “একক সত্ত্বা” হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, বরং একে দেখতে হবে এমন একটি গুচ্ছ বা সেট হিসেবে যা “পরস্পর সম্পর্কিত, কাঠামোগতভাবে (ওভারল্যাপ করা) জড়িয়ে যাওয়া, কিন্তু একই সাথে স্বতন্ত্র। একে দেখতে হবে, ‘গ্লোকালাইজেশন’ (বৈশ্বিক পণ্যের স্থানীয়করণ) প্রক্রিয়ার মৌলিক ফল হিসেবে, যার বিচ্ছিন্নভাবে স্থানীয় প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভরশীল।”

যাই হোক, হরেক রকমের ইংরেজিতে ভরা লস এঞ্জেলেস, আমার শেখার জন্য দারুন জায়গা ছিল।

অরণ্যে রোদন

ইংরেজির এই প্রভাব ও প্রতাপ থেকে কোন মুক্তি আছে বলে আমার মনে হয় না। মিকানোস্কি যেমন বলেছেন, “এর প্রতিবাদ করা অরণ্যে রোদনের মতই।” স্থানীয় ভাষার সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরী, কিন্তু একটি অভিন্ন বৈশ্বিক ভাষার যে ধারণা, তারও কোনো সহজ সমাধান নেই। অবশ্য অভিন্ন ভাষা, সিরির (অ্যাপলের বুদ্ধিমান অ্যাসিসট্যান্ট) চেয়ে ভালো, যতক্ষণ না সেই সিরি নিজের গুগল অনুবাদ দক্ষতা শানিয়ে নিয়ে, আমাদের কথাগুলো বলে দিতে পারছে।

তাহলে, ইংরেজির এই প্রভাবকে সামাল দেয়ার জন্য আমাদের কী করার আছে? বেশি করে শুনুন। ভালো করে শুনুন। পর্যবেক্ষণ করুন। প্রেক্ষাপটের সাথে মিলিয়ে নিন। বেশি বেশি প্রশ্ন করুন। সম্মান দিন। ধীরস্থির হোন। মাঠে প্রচুর সময় দিন। আর মনে রাখুন ইংরেজিরও রকমফের আছে। কিন্তু যা সবচেয়ে জরুরি: আমাদের ভাষাটাকেও সব সময় নজরদারিতে রাখুন, ঠিক যেভাবে আমরাও বুঝতে শিখছি – শুধু ভাষার কারণে পাওয়া বাড়তি সুবিধাটাকে সামলে রাখার দরকার আছে।


তানিয়া প্যাম্পালোনি জিআইজেএন-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। তিনি মেইল অ্যান্ড  গার্ডিয়ান পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক, ম্যাভেরিক ম্যাগাজিনের (বর্তমানে ডেইলি ম্যভারিক) ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এবং আফ্রিকায় কার্যক্রম প্রসারের শুরু থেকে দ্য কনভারসেশন আফ্রিকার হেড অব স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ অ্যান্ড অডিয়েন্স ডেভেলপমেন্ট পদে কাজ করেছেন। আই ওয়ান্ট টু গো হোম ফরেভার: স্টোরিজ অব বিকামিং অ্যান্ড বিলঙ্গিং ইন সাউথ আফ্রিকাস গ্রেট মেট্রোপলিস (উইটস প্রেস, ২০১৮) বইয়ের সহ-সম্পাদক ছিলেন তানিয়া। কন্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করেছেন সাউদার্ন আফ্রিকান মাকরেকিং: ১৫০ ইয়ারস অব ইনভেস্টিগেটিং জার্নালিজম হুইচ শেপড দ্য রিজিওন (জাকানা, ২০১৮) ও প্রকাশিতব্য আনবায়াস দ্য নিউজ (হোস্টরাইটার, ২০১৯) বইয়ে।

ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে আমাদের লেখা বিনামূল্যে অনলাইন বা প্রিন্টে প্রকাশযোগ্য

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

সংবাদ ও বিশ্লেষণ

মেক্সিকো থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল থেকে ফিলিপাইন : জিআইজেএনের অনুসন্ধানী বইয়ের তাকে

ঐতিহাসিক ভুলভ্রান্তি, করপোরেট লুকোছাপা আর অসদাদচরণ – যা লুকিয়ে রাখাই ক্ষমতাবানদের কাজ তার উদ্ঘাটন নিয়ে লেখা বই এবার জায়গা পেয়েছে জিআইজেএনের বইয়ের তাকে।

আইনি সুরক্ষা ও জরুরি সহায়তা সংবাদ ও বিশ্লেষণ

হয়রানিমূলক মামলার বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে বার্তাকক্ষের পাশে দাঁড়াচ্ছে রিপোর্টার্স শিল্ড

অনেকটা শূন্য থেকেই গত বছর যাত্রা শুরু করা রিপোর্টার্স শিল্ড বিশ্বেজুড়ে সংবাদমাধ্যমগুলোর পাশে আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা নিয়ে দাঁড়িয়েছে। অলাভজনক সংস্থাটি স্ট্র্যাটেজিক ল-স্যুটস অ্যাগেইনস্ট পাবলিক পার্টিসিপেশন—সংক্ষেপে স্ল্যাপের (জনস্বার্থ বিরোধী কৌশলগত মামলা) বিপরীতে আর্থিক ও প্রয়োজনীয় সমর্থন দিয়ে থাকে। স্ল্যাপ মূলত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিকে নিরুৎসাহিত আর অনুসন্ধানী বার্তাকক্ষকে ধ্বংসের হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ করা হয় ।

IJF24 Reframing Visual Journalism AI Deepfake

পদ্ধতি পরামর্শ ও টুল সংবাদ ও বিশ্লেষণ

ডিপফেকের যুগে ভিজ্যুয়াল সাংবাদিকতা: সত্য যাচাই ও আস্থা অর্জন

ভিজ্যুয়াল সাংবাদিকতা এখন তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এগুলো হলো সিন্থেটিক কনটেন্টের “উত্তাল সমুদ্রে” মৌলিক বিষয়বস্তু শনাক্ত; জনগণের আস্থা ধরে রাখা; এবং “প্রকৃত ছবি” দিয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

environmental spill ocean liquid natural gas terminal

পরামর্শ ও টুল সংবাদ ও বিশ্লেষণ

কীভাবে খুঁজবেন, পরিবেশের ক্ষতির পেছনে কে বা কারা জড়িত?

পরিবেশ সম্পর্কিত যে কোন অবৈধ কাজের সঙ্গে অনেক বেশি আর্থিক সংশ্লেষ থাকে। আর তা উন্মোচনের জন্য নিবিড়ভাবে জানতে হয় বিভিন্ন অঞ্চল, আর সেখানকার আইন কানুন, গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরিতে কিছু কৌশল সাংবাদিকদের সাহায্য করতে পারে।