Satellite imagery of Xinjiang.
স্যাটেলাইট ছবি এখন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সত্যানুসন্ধান থেকে শুরু করে, কোনো নির্দিষ্ট পরিস্থিতির প্রভাব অনুধাবন বা অবস্থার নিখুঁত বিবরণ জানতে, হরহামেশাই এর ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। সংঘাতপ্রবণ এলাকায় মানবাধিকার লঙ্ঘন বা চলমান ঘটনাবলীর প্রকৃত ও সঠিক চিত্র তুলে আনার ক্ষেত্রেও স্যাটেলাইট ছবি কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের কাছে গিয়ে রিপোর্টাররা তাদের গল্প তুলে আনেন।
কিন্তু সহিংসতা বা রাজনৈতিক কারণে অনেক এলাকাই “সাংবাদিকদের জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ।” সেখানে বাইরের কারো প্রবেশাধিকার নেই। এমন অঞ্চল থেকে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের নির্ভরযোগ্য বিকল্প, স্যাটেলাইট ছবি।
উত্তর কোরিয়ার কোথায় কোথায় বিদ্যুৎ সংযোগ আছে কিংবা রোহিঙ্গাদের যত আবাসস্থল গুঁড়িয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী – চমৎকার এই দু’টি প্রতিবেদনই জন্ম দিয়েছে স্যাটেলাইট ছবি।
১৯৯৫ সালে প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ার স্রেব্রেনিসায় সংঘটিত গণহত্যার প্রমাণ দিয়েছিল নিচের ছবিটি।
বোতসওয়ানার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়ান খামা, তার ব্যক্তিগত বাড়িতে গোপনে প্লেন উঠানামার জায়গা তৈরি করেছিলেন। ২০০৭ সালে এই ঘটনা প্রকাশ পেয়েছিল শুধুমাত্র স্যাটেলাইট ছবির কল্যাণে।
জিম্বাবুয়ের একসময়ের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ছিলেন রবার্ট মুগাবে। তিনিই পরবর্তীতে স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে আবির্ভূত হন এবং ২০১৭ সালে ঐতিহাসিক এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেওয়া হয়।
নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, “ব্লু-রুফ” নামে পরিচিত সেই আলিশান বাড়ি, যেখানে মুগাবেকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। ছবিটি তোলা হয় ডিজিটালগ্লোবের ওয়ার্ল্ডভিউ-২ স্যাটেলাইট থেকে।
ইরান অনেকদিন ধরেই গোপনে পরমাণু অস্ত্র বানানোর চেষ্টা করছিল। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার রুখতে দেশটির সাথে একটি চুক্তি করেন। কিন্তু, আর্থ ইমেজিং কোম্পানি প্ল্যানেটের তোলা ছবিতে ইরানের পরামানু রকেট তৈরির স্থাপনা দেখে সে সময় সবাই হতবাক হন।
চীন সরকার জিনজিয়াং প্রদেশের হাজার হাজার উইঘুর মুসলিমকে যেসব বন্দীশিবিরে আটকে রাখে, তার ছবিও উঠে এসেছে স্যাটেলাইট ছবিতে। এই বন্দীশিবিরগুলোকে তারা বলে “পুনঃশিক্ষা ক্যাম্প”। নিচে তেমনই একটি ক্যাম্পের ছবি।
ডিজিটালগ্লোবের স্যাটেলাইট ছবি বাংলাদেশে রোহিঙ্গা প্রবেশের ব্যাপকতা তুলে ধরেছে।
অনেকদিন ধরে সহিংসতার চরমে থাকা সিরিয়ায় আইএসের প্রভাব সম্পর্কে ধারণা দিতে পেরেছে স্যাটেলাইট ছবি। দেশটির আর্থিক এবং ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত আলেপ্পোতে ধ্বংসের ভয়াবহতা, বিধ্বস্ত হয়ে পড়া তৃতীয় বৃহত্তম শহর হোম এবং সংঘাতে বিলীন হয়ে যাওয়া বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন – এমন সব কিছুই উঠে এসেছে ছবিতে।
কৌশলগত কারণে মধ্য এশিয়ায় আফগানিস্তানের অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং সেখানে প্রায় ৩ দশক ধরে রক্তপাত-লড়াই চলছে। কোপার্নিকাসের স্যাটেলাইট দেশটিতে সংঘাতের কারণে মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছে এবং জাতিসংঘের গোচরে এনেছে।
স্যটেলাইট ছবি-ই তুলে এনেছে, দক্ষিণ সুদানে সহিংসতার ঝুঁকিতে থাকা উদ্বাস্তুদের কঠিন জীবন। ডিজিটালগ্লোবের ছবি সাহায্য করেছে সেখানকার খাদ্যসংকটের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে। দারফুর অঞ্চলে স্যাটেলাইট ছবির মাধ্যমে দেখা গেছে সেখানে গ্রামের পর গ্রাম কীভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।
২০১৪ সালে ডিজিটালগ্লোব ৫টি স্যাটেলাইট ছবি প্রকাশ করে যেখানে দেখা গেছে, ইউক্রেনের সীমানায় কীভাবে রাশিয়ান সৈন্য ভারি অস্ত্রসজ্জিত হয়ে ঢুকে পড়ছে। এর আগে ইউক্রেনে অনুপ্রবেশের বিষয়টি অস্বীকার করে আসছিল ক্রেমলিন। কিন্তু এসব ছবি ন্যাটোর হাতে পড়ার পর, তারা ক্রেমলিনের দাবিকে প্রশ্ন করতে সক্ষম হয়।
২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়া আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ও পরামাণু অস্ত্র তৈরির কর্মসূচিতে বড় ধরণের অগ্রগতির ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণা গোটা বিশ্বের জন্যই একরকম ধাক্কা হয়ে আসে।
উপরের ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, পিয়ংসং-এর সেই কারখানা যেখানে হোয়ানসং-১৫ আইসিবিএম তৈরি হচ্ছে বলে ধারণা করা হয়। ছবিটি নভেম্বরের ২১ তারিখে ডিজিটালগ্লোব ওয়ার্ল্ডভিউ-২ স্যাটেলাইট থেকে তোলা।
কেবল সংঘাতপ্রবণ এলাকা বা যুদ্ধক্ষেত্রই নয়, স্যাটেলাইট ছবি প্রাকৃতিক দূর্যোগের মত বিষয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায়ও কাজে আসে।
গুজব, ইচ্ছাকৃত বিভ্রান্তি কিংবা শোনাকথা থেকে নিরেট তথ্যকে বের করে আনার ক্ষেত্রেও স্যাটেলাইট ছবি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখতে পারে।
অতীতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের মূলত অজস্র তথ্য এবং সোর্সের উপর নির্ভর করতে হত। শুধু তাই নয়, সেই সব তথ্যের ‘ফসল’ থেকে অপ্রয়োজনীয় ‘তুষ’ সরিয়ে সত্য-মিথ্য যাচাইয়ের দুঃসাধ্য কাজটিও করতে হত তাদেরই।
এমন পরিস্থিতিতে স্যাটেলাইট ছবি সাংবাদিকদের জন্য নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে। আর পারে তথ্য দিয়ে জনমানুষের ক্ষমতায়ন করার পুরানো স্লোগানকে জাগিয়ে তুলতে।
এই লেখা প্রথম প্রকাশিত হয় জিওস্পেশিয়াল ওয়ার্ল্ডে। এখানে অনুমতি নিয়ে পুনঃপ্রকাশ করা হয়েছে।
আদিত্য চতুর্বেদী, জিওস্পেশিয়াল ওয়ার্ল্ডের অ্যাসিসটেন্ট এডিটর। তিনি মূলত একজন ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার। তবে ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে তিনি আধুনিক ইতিহাস, সমসাময়িক ঘটনাবলী, ভূ-রাজনীতি এবং ভ্রমন নিয়ে লেখালেখি করেন।