শিশু ইনফ্লুয়েন্সাররা বিপজ্জনক ঝুঁকিতে, নিউ ইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধান
সতর্কতা: এ নিবন্ধে শিশুদের যৌন নির্যাতনের বর্ণনা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জেন জি দের ( জেনারেশন জি; যাদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে) অর্ধেকেরও বেশি সুযোগ পেলে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবশালী তারকা হতে চান। এদের মধ্যে অনেকে আবার তাদের কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া অব্দি অপেক্ষাও করতে চান না।
কোম্পানি বা ব্র্যান্ডগুলো তাদের পণ্যের প্রচারে আজকাল ইনফ্লুয়েন্সার বা কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের সঙ্গে চুক্তিতে যাচ্ছে। এ এক লাভজনক বাজার। আর এখানে পণ্য হিসেবে বিক্রি হচ্ছে শিশুদের শৈশবও।
নাচ, মডেলিং কিংবা সুন্দরী প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আগ্রহী এমন কিশোরীরা তো বটেই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবশালী তারকা হিসেবে সাত বছরের কম বয়সী কিংবা কেবল এক পা দুই পা করে হাঁটতে শিখেছে এমন শিশুরাও আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে তাদের দৈনন্দিন ঘটনাপঞ্জিকে।
ইনস্টাগ্রামে ১৩ বছর বয়সের নিচে কারও অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতি নেই। তাই এ ধরনের অনেক অ্যাকাউন্ট শিশুদের মায়েরাই সামলে থাকেন।
দুর্ভাগ্যজনক হলো শিশু সন্তানকে সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে ব্যবহার শুধু খ্যাতি আর সৌভাগ্যই বয়ে আনে না, বরং এর গভীরে আছে বড় বিপদের আশঙ্কা।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের “আ মার্কেটপ্লেস অব গার্ল ইনফ্লুয়েন্সার ম্যানেজড বাই মমস অ্যান্ড স্টকড বাই মেন” নামের মাল্টিমিডিয়া অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি একটি প্রবণতাকে তুলে ধরে।
এই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, অপ্রাপ্তবয়স্ক এ কিশোরীদের ফলোয়ারদের (অনুসরণকারীদের) বড় অংশই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ।
প্রাপ্তবয়স্ক এই পুরুষেরা কখনো মিষ্টি কথা বলে, আবার কখনো বা হুমকি বা ব্ল্যাকমেইলের মতো কৌশল অবলম্বন করে মা – মেয়ে দুজনকেই যৌন উস্কানিমূলক কনটেন্ট সরবরাহ করার জন্য চাপ দিতে থাকে।
আবার কিছু অ্যাকাউন্ট থেকেও সাবস্ক্রিপশন পরিষেবার মাধ্যমে পুরুষ ফলোয়ারদের (অনুসরনকারী) বাড়তি টাকার বিনিময়ে ব্যক্তিগত চ্যাট সেশনে অংশগ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে টাইমসের সাংবাদিক জেনিফার ভ্যালেন্টিনো-ডিভরিস এবং মাইকেল এইচ কেলার ৫ হাজারেরও বেশি ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে ডেটা সংগ্রহ করেছেন। এ অ্যাকাউন্টগুলো মূলত পরিচালনা করেন শিশুদের মায়েরা।
গুগল এবং মাইক্রোসফটের ইমেজ ক্লাসিফিকেশন সফটওয়্যার ব্যবহার করে দ্য টাইমস দেখতে পায়, “ইঙ্গিতপূর্ণ” এবং “যৌন উসকানিমূলক” পোস্টগুলোতে পুরুষ ফলোয়ারদের কাছ থেকে “লাইক” এবং “কমেন্ট” পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
প্রতিবেদকেরা কয়েক মাস ধরে মেসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রাম পর্যালোচনা করেন। তাঁরা দেখতে পান, কিছু পুরুষ ছবি পোষ্ট করেছেন। পাশাপাশি যে মেয়েদের তাঁরা অনুসরণ করে থাকেন তাদের অ্যাকাউন্টে গিয়ে প্রকাশ্যে যৌন বাসনা পূরণের আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন।
এই প্রতিবেদনের আইডিয়া (ধারণা) থেকে শুরু করে কাজে নেমে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন এবং কীভাবে তাঁরা ডেটাগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরার পরিকল্পনা করেছিলেন, তা নিয়ে ভ্যালেন্টিনো-ডিভরিস এবং কেলারের সঙ্গে কথা বলেছে স্টোরিবেঞ্চ।
নিচের সাক্ষাৎকারটি ঈষৎ সংক্ষেপিত। পরিষ্কারভাবে বুঝতে এই সাক্ষাৎকারটি সম্পাদনা করা হয়েছে।
স্টোরিবেঞ্চ: এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরির ধারণাটা কীভাবে পেলেন?
জেনিফার ভ্যালেন্টিনো-ডিভরিস: শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের উপাদানগুলো কীভাবে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ছে তার ওপর একটি সিরিজ প্রতিবেদন তৈরি করছিলেন মাইকেল। এ ধরনের ক্ষতিকর বিষয়গুলোকে নতুনভাবে উপস্থাপনের কথা ভাবছিলাম আমরা।
কাজটি করতে গিয়ে আমি বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং প্লাটফরমে “টুইন ইনফ্লুয়েন্সার” (যারা মাত্র ১৩ বছরে পড়েছে) বা “প্রি-টিন ইনফ্লুয়েন্সার” (যাদের বয়স ৯ থেকে ১২ বছরের মধ্যে) তাদের অ্যাকাউন্টগুলো দেখতে শুরু করি। আমি ঘুণাাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে, এখান থেকে এই ধরনের তথ্য বেরিয়ে আসবে।
আমার সামনে বেশ কিছু অ্যাকাউন্ট ভেসে ওঠে। যেখানে লিওটার্ডস (ব্যালে শিল্পীদেও পরিধেয়) কিংবা মিনি স্কার্ট আর হাই হিল পরা মেয়ে শিশুরা প্রাপ্তবয়স্ক ইনফ্লুয়েন্সারদের মতো করে পোজ দিচ্ছে।
অ্যাকাউন্টগুলোতে অ্যামাজন উইশলিস্ট কিংবা নগদ টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে বলে দেখা যায়। যার অর্থ আপনি আপনার অ্যাকাউন্ট মনিটাইজ করছেন, অর্থাৎ এই অ্যাকাউন্ট থেকে আপনি আয় করতে পারবেন।
ওখানে আরও বলা আছে যে, অ্যাকাউন্টগুলো অভিভাবকেরা চালান। এটা দেখে আমরা যারপরনাই অবাক হই। এটি ছিল কেভিড মহামারি শুরুর আগের ঘটনা। এরপর কিছু সময়ের জন্য আমরা বিরতি নিই। গত বছর থেকে আবার আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে শুরু করি।
স্টোরিবেঞ্চ: গল্পটির ভিজ্যুয়াল উপস্থাপন কিংবা কী ধরনের গ্রাফিক্স ব্যবহার করবেন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত কীভাবে নিয়েছেন?
মাইকেল এইচ কেলার: প্রতিবেদনটিই ছিল ছবি দিয়ে বোঝানোর মতো একটি প্রতিবেদন। তবে সংবেদনশীল ইস্যু হওয়ায় বিষয়টি ভীষণ চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়। যদিও ছবিগুলো ইনস্টাগ্রামে প্রকাশ্যে পোস্ট করা হয়েছে, তারপরও আমরা তা না দেখানোর সিদ্ধান্ত নিই।
ঠিক একইভাবে অভিভাবকদের নামের প্রথম অংশ বা সন্তানদের নাম না ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিই। এক্ষেত্রে আমরা ভেবেছি যে, সবার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বিশেষ করে যখন অপ্রাপ্তবয়স্কদের সম্পৃক্ততা থাকে, সেখানে গোপনীয়তা বজায় রাখার বিষয়টি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
নিবন্ধের ওপরের গ্রাফিকটি বানানো হয়েছে একটি ছবির ওপর ভিত্তি করে। এখানে একটা ছবি আছে এবং এই ছবিকে ঘিরে বেশ কিছু মন্তব্য। এ থেকে আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি, ছবির পরিপ্রেক্ষিতে কী ধরনের মন্তব্য আসে।
সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা শিশুদের ছবিতে পুরুষদের করা অনলাইন মন্তব্যগুলো এই প্রতিবেদনের একটি বড় অংশ।
অন্যান্য গ্রাফিক তৈরির দায়িত্বে ছিলেন টাইমসের গ্রাফিকস ও মাল্টিমিডিয়া সম্পাদক আলিজা আওফ্রিশটিগ এবং সহকারী সম্পাদক রামসে টেলর।
গ্রাফিকগুলো আমাদের কাজের প্রক্রিয়া বোঝাতে দারুন ভূমিকা রাখে। ২১ লাখ পোস্ট থেকে আমরা প্রায় ৩০ লাখ ছবি ডাউনলোড করি। গুগল ও মাইক্রোসফ্ট ক্লাসিফায়ার দিয়ে যাচাই করি যে এগুলো ‘ ইঙ্গিতপূর্ণ ‘ বা ‘ যৌন উসকানিমূলক’ ছবি হিসেবে রেটিং পায় কিনা।
আমরা দেখতে চেয়েছিলাম ঠিক কোন কোন ক্ষেত্রে দুটি ক্লাসিফায়ারই ছবিগুলো যুক্তিসঙ্গত বা গড় সীমার মধ্যে থাকা; অতিরিক্ত বা চরম নয় বলে অনুমান করছে। এরপর বিষয়টি আমরা সফলভাবে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হই। আমরা দেখতে পাই যে, ছবিতে পাওয়া লাইক ও কমেন্টের সঙ্গে এর একটি সম্পর্ক রয়েছে।
বিষয়টিকে বর্ণনামূলক প্রতিবেদন হিসেবে তুলে ধরার গোটা প্রক্রিয়াটাই বেশ দীর্ঘ ও পীড়াদায়ক। রিপোর্টিংয়ে আমরা যখনই এ ধরনের গতিরোধকের সামনে পড়ি, তখন মনে করি, “আচ্ছা, সম্ভবত গল্পটিকে ভিজ্যুয়ালের মাধ্যমে আরও ভালভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। এতে আমরা দুটোই করতে পারি। কারণ গল্পটি ইনস্টাগ্রামে এবং ছবিই প্রতিবেদনটিকে অর্থবহভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে। তবে, এর জন্য আপনাকে বেশ কিছু ধাপ অতিক্রম করতে হবে।”
স্টোরিবেঞ্চ: আপনি যখন প্রতিবেদনটি তৈরি করছিলেন, তখন কী এমন কিছু পেয়েছিলেন যা আপনাকে ভীষণ অবাক করেছিল?
এমকে: প্রাথমিকভাবে আমরা শিশুদের যে অ্যাকাউন্টগুলো পেয়েছিলাম ওগুলো দেখে মনে করেছিলাম যে, “এ অ্যাকাউন্টগুলো অনলাইনে অল্প বয়স্ক শিশুদের যৌনতা সম্পর্কিত। আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা এবার খুঁজে বের করি যে এখানে কী হচ্ছে।”
আমি মনে করি, পরবর্তীতে আমরা যা খুঁজে পেয়েছি তা অনেক বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন দিককে উন্মোচিত করেছে। আমি ঘুণাক্ষরেও আশা করিনি যে ওই পুরুষেরা শিশুদের বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছাবে, তাঁদের ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করবে কিংবা তাদের অভিযুক্ত করার চেষ্টা করবে।
এছাড়া প্রতিবেদনটি আমরা কী পদ্ধতিতে লিখব বা প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে কীভাবে তুলে ধরব সেই চ্যালেঞ্জও ছিল। আমরা বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি অভিভাবকদের ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতাগুলো সম্পর্কে জেনেছি: এ পর্যায়ে শুধুমাত্র একটি গল্পের মাধ্যমে আমরা গভীর সব বিষয়গুলোকে কীভাবে তুলে ধরব?
স্টোরিবেঞ্চ: প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর আপনারা কেমন সাড়া পেয়েছেন?
এমকে: আমাদের পেজের মন্তব্যগুলো পড়ার পাশাপাশি বাইরের লোকেরা প্রতিবেদনটি নিয়ে বলেন যে তাঁরাও এ ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন।
বিশেষ করে আমরা যেসব অভিভাবক কিংবা ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে পারিনি প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর তারা আমাদের এ সম্পর্কে জানান। রিপোর্টিং এর মাধ্যমে আমরা সবসময় ঠিক এ কাজটিই করতে চাই। আমরা এমন বিষয়ের ওপর আলো ফেলতে চেষ্টা করি যা নিয়ে লোকেরা সচরাচর কথা বলতে চায় না।
বিশেষ করে এ ধরনের অনলাইন অপরাধীদের সম্পর্কে যখন কেউ কথা বলে না, তখন তারা পরিস্থিতির সুবিধা ভোগ করে। পর্দার আড়ালে বসে যারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে, আমাদের মৌনতা থেকে তারা অনেক বেশি ফায়দা লোটে।
আমাদের রিপোর্টিং এ আলোচনাগুলোকে উসকে দিতে পারে। আরও বেশি লোককে বিপদ সম্পর্কে সচেতন করতে পারে। এমকি যারা এ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে বন্ধুদের জানাতেও সংকোচ বোধ করে, তাদের বলার জায়গা তৈরি হয়।
তারা বলে, “হ্যাঁ, সত্যিই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তবে দেখুন আপনি কীভাবে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন।” নেতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে ইতিবাচক ফলাফল খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জেভিডি: আমি মনে করি যে,পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ দিকে মোড় নিতে পারে আপনি ভাবতেও পারবেন না। ধরুন আপনার ফলোয়াররা। আপনি হয়তো তাদের মোটেও খারাপ লোক বলে মনে করেন না কিংবা আপনার কাছে কোনো প্রমাণ নেই যে তারা খারাপ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে হাজির হয়েছে।
কিন্তু তারাই কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে আমরা তা তুলে ধরছি। আমি মনে করি, এ ধরনের প্রতিবেদন সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ এতে বুঝতে পারে যে তারা যতটা সতর্ক ছিল, তার চেয়েও বেশি সতর্কতার প্রয়োজন ছিল। পরিস্থিতি আসলে তাদের কল্পনার চেয়েও ভয়াবহ।
এ নিবন্ধটি প্রথমে নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব জার্নালিজমের স্টোরিবেঞ্চ প্রকাশ করে।তাদের অনুমতি নিয়ে লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত হলো।
ইসাবেল (ইসা) মেয়ার্স নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির প্রোফেশনাল জার্নালিজম প্রোগ্রামের একজন স্নাতক শিক্ষার্থী। তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজির পাশাপাশি ফেমিনিস্ট, জেন্ডার অ্যান্ড সেক্সুয়ালিটি স্ট্যাডিজে স্নাতক করেছেন। তিনি ওয়াশিংটনের সিয়াটল থেকে এসেছেন। সম্প্রতি রিপোর্টিং ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করেছেন অলাভজনক বার্তা সংস্থা ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরে।