ধরুন, আপনি একটি লোক-ঠকানো, পরিচয়-লুকোনো কোম্পানির আসল ঠিকানা খুঁজছেন, কিন্তু আপনার হাতে আছে শুধু একটি পোস্ট বক্স নম্বর, যেটি সেই কোম্পানি তার ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করছে। কেমন হয়, যদি খামের ভেতরে একটি জিপিএস ট্র্যাকার পুরে সেই পোস্ট বক্স নম্বরে একটি চিঠি পাঠিয়ে দেন এবং আর নৈতিকতার খাতিরে নিজের বিজনেস কার্ডটিও তাতে জুড়ে দেন? সেই প্রতিষ্ঠানের পেছনে থাকা কর্তাব্যক্তিরা হয়তো চিঠিটি সংগ্রহ করে, কোথাও না কোথাও বসে সেটি খুলতে পারেন। আর আপনি ম্যাপে গিয়ে সেই ট্র্যাকারের কল্যাণে তার সত্যিকারের ঠিকানাটিও খুঁজে পেতে পারেন। বলা যায় না, কার্ড দেখে তিনি আপনাকে হয়তো কলও দিয়ে বসতে পারেন।
এধরনের অভিনব, খাম-পাঠানো পদ্ধতির জন্য সুইডেনের অন্যতম প্রধান অনুসন্ধানী টিভি অনুষ্ঠান মিশন ইনভেস্টিগেট বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছে এবং এসব উদ্ভাবন তাদেরকে অনেক প্রভাব বিস্তারকারী অনুসন্ধানী সিরিজ নির্মাণে সহায়তা করেছে।
সুইডেনের গোথেনবার্গে ১৩তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে (#GIJC23) “উদ্ভাবনী অনুসন্ধানী পদ্ধতি” সেশনে, এসভিটির মিশন ইনভেস্টিগেটের চারজন বর্তমান এবং সাবেক অনুসন্ধানী সাংবাদিক তাদের উদ্ভাবনী পদ্ধতিগুলো নিয়ে কথা বলেছেন যা তাদের অনুসন্ধানে সবচেয়ে বেশি কাজে লেগেছে৷
প্যানেলে অংশ নেন এসভিটির ডেটা রিপোর্টার ও মুদ্রাপাচার গবেষক লিন্ডা কাকুলি, মিশন ইনভেস্টিগেটের সাংবাদিক ও প্রযোজক জোয়াকিম ডিফভাররমার্ক এবং অনুষ্ঠানটির পুরস্কারজয়ী সাংবাদিক অ্যাক্সেল গর্ড হামলেখো যিনি সংগঠিত অপরাধ ও দুর্নীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞও বটে।
যেভাবে জিপিএস ট্র্যাকার ব্যবহার করবেন
২০২১ সালে, মিশন ইনভেস্টিগেট দল জানতে পারে যে দাতব্য সংস্থাগুলো লক্ষ লক্ষ ইউরোর আয় হারাচ্ছে, কারণ অনুদানের খেলনা এবং জামাকাপড় জমা রাখার পুনর্ব্যবহারযোগ্য বিনগুলো নিয়মিতভাবে এবং দক্ষতার সঙ্গে চুরি করা হচ্ছে।
হামলেখো আরো ব্যাখ্যা করে বলেন যে, তাদের “ডার্টি ক্লোথস” অনুসন্ধানটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ পুলিশ চুরিকে কম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করত, এবং এটি জেনে, একটি সংগঠিত গ্যাং নির্ভরযোগ্য অপরাধমূলক আয়ের একটি “ঝুঁকিমুক্ত” ধরন খুঁজে নিয়েছিল।
ব্যয়বহুল জিপিএস ট্র্যাকিং ডিভাইসগুলোও ক্রমশ শক্তিশালী এবং নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠেছে এটি জানার পর, দলটি সাবান আকৃতির ইয়াপজোন ডিভাইসগুলো পোশাক ও পুতুলের মধ্যে বসিয়ে দেয়, এবং সেগুলোকে সুইডেনের আশেপাশের বিভিন্ন ডোনেশন পাত্রে রেখে আসে। এরপর ইয়াপজোন ফোন অ্যাপের মাধ্যমে পণ্যগুলোর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
তারা তাদের প্রাথমিক প্রচেষ্টায় দেখতে পায় যে, পণ্যগুলো কিভাবে স্টকহোমের গুদামঘরে পৌঁছে যাচ্ছে এবং সেখান থেকে বাল্টিক অঞ্চলগুলোতে। তবে চূড়ান্ত গন্তব্য লিথুয়ানিয়াতে পৌঁছানোর কিছু আগে ব্যাটারি ফুরিয়ে যায়।
কাকুলি ব্যাখ্যা করে বলেন , এই ঘটনার মাধ্যমে আমরা যে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটি পেয়েছি তা হচ্ছে ট্র্যাকারগুলো কত ঘন ঘন সংযুক্ত হচ্ছে তার ওপর ব্যাটারির মেয়াদ নির্ভর করে। তাই আমরা যত বেশিবার ট্র্যাকারের মাধ্যমে অবস্থান দেখতে চেষ্টা করবো, তত দ্রুত ব্যাটারির মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে।
কাকুলি বলেন, কৌশলটি হলো আপনার গোপন উদ্দেশ্যের জন্য একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা, হতে পারে ডকুমেন্টারি ভিডিওর জন্য পণ্যের প্রতিটি গতিবিধি অনুসরণ করা বা চূড়ান্ত গন্তব্য আবিষ্কার করা, এবং ডিভাইসের ট্র্যাকিং অ্যাপকে এমনভাবে প্রোগ্রাম করা যা ব্যাটারির মেয়াদ ফুরোনোর আগে আপনাকে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য সম্পর্কে জানাতে সমর্থ হয়। আপনি এক্ষেত্রে অ্যাপের “হিস্ট্রি ভিউ” ফিচার ব্যবহারের মাধ্যমে পূর্বের গতিবিধিগুলো দেখতে পারেন। সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি পরামর্শ দেন যে, ব্যাটারির মেয়াদ বাড়ানোর কৌশলগুলো আয়ত্তে আনতে “আপনার বাচ্চাদের বা এমনকি বাড়িতে আপনার কুকুরের ওপর” পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
ব্যাটারির মেয়াদ বাঁচানোর মাধ্যমে (যেমন সপ্তাহজুড়ে পণ্যগুলো স্টকহোমে অবস্থান করবে এটা জানার পর, ট্র্যাকিং ডিভাইসগুলো ‘স্লিপিং’ মোডে রেখে দেওয়া) দলটি বাল্টিক অঞ্চল জুড়ে সুপারমার্কেট এবং স্টোরগুলোতে পণ্যগুলো ট্রেস করতে সক্ষম হয়েছিল।
যখন মুখোমুখি
মিশন ইনভেস্টিগেট যখন দীর্ঘ সময় ধরে নজরদারি চালাচ্ছিল তখন তারা লিথুয়ানিয়ার কাপড়-চুরি চক্রের একজন সদস্যের মুখোমুখি হয়। তখন অবশ্য সবকিছু ঠিক পরিকল্পনা মতো হয়নি। প্রথমত, মুখোমুখি হওয়ার জন্য ব্যাক-আপ হিসাবে তারা যে দুইজন নিরাপত্তারক্ষীকে নিয়োগ করেছিলেন তারা অভিযুক্ত গ্যাংস্টার হাজির হওয়ার মুহুর্তে সকালের নাস্তার বিরতি নিচ্ছিল, তাই তাদের একাই এটি করতে হয়েছিল। তারা প্রাথমিকভাবে হতাশও হন, কারণ লোকটি কোন উত্তর দেয়নি, বরং অভিশাপ দিয়েছিল।
কিন্তু তারা শেষপর্যন্ত মুখোমুখি সাক্ষাৎকারের ক্লিপটি সম্প্রচার করেন, এবং দেখতে পান যে এটি দ্রুত ইউটিউবে ভাইরাল হয়ে গেছে, কারণ অন্যান্য লিথুয়ানিয়ানরা লোকটির অদ্ভুত, অকথ্য অভিসম্পাতকে হাস্যকর বলে মনে করেছিল। চুরির গুরুতর প্রকৃতি এবং ক্ষতি সামনে আনতে ক্লিপটির জনপ্রিয়তা কাজে দিয়েছিল।
“এটা একটা মিম হয়ে গেল; এমনকি একটি টি-শার্টও,” হামলেখো রসিকতা করে বলেন। “আমরা চুরির রহস্য সমাধান করেছি, কিন্তু সেই ক্লিপের কারণে এটি টেলিভিশনে সত্যিই একটি বড় সাফল্য হয়ে উঠেছে।”
ডিএনএ ডেটাবেসের উদ্ভাবনী প্রয়োগ
যখন অন্যান্য সমুদ্র অঞ্চল থেকে একই প্রজাতির মাছ ধরা বৈধ তখন আপনি কিভাবে খুঁজে বের করবেন যে দোকানগুলো অবৈধ ফিশিং জোন থেকে আহরিত মাছ বিক্রি করছে?
উত্তর আটলান্টিক থেকে ধরা বৈধ কড মাছ বিক্রির দাবি করা দোকানগুলো মূলত বাল্টিক সাগর থেকে অবৈধভাবে ধরা কড বিক্রি করছে। আর এ সত্যকে তুলে ধরা ডিফভারমার্ক জন্য কঠিন ছিল।
ডিফভারমার্ক মাছের মজুদের ডিএনএ পরীক্ষা নিয়ে ডেনমার্কের বিজ্ঞানভিত্তিক একটি প্রতিবেদন পড়েন এবং অসংখ্য প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর ডিএনএ ডেটাবেসের দ্রুত বৃদ্ধি লক্ষ্য করেন। এরপর তিনি একটি অভিনব পদ্ধতি প্রয়োগ করেন।
“মনে আছে, আমি আমার সম্পাদকদের বলেছিলাম: ‘আমি কড মাছের ওপর ডিএনএ-পরীক্ষার চেষ্টা চালাতে চাই!’ কাজটি তখন বোকামো মনে হয়েছিল, কিন্তু তারা রাজি হন এবং পরীক্ষাটি ফলপ্রসু হয়,” তিনি বলেন।
ডিফভারমার্ক ও তার সহকর্মীরা ১৪টি দোকান থেকে কড মাছ ক্রয় করেন এবং সেগুলো পরীক্ষার জন্য একটি বিশেষায়িত ল্যাবে পাঠান। বাল্টিক এবং উত্তর-পূর্ব আটলান্টিকের মাছের স্বতন্ত্র ডিএনএ বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করে, বিশেষজ্ঞরা দলটিকে নিশ্চিত হতে সাহায্য করেন যে, ১৪টি দোকানই বাল্টিক সাগর থেকে অবৈধভাবে ধরা কড বিক্রি করেছে।
ডিফভারমার্ক বলেন, এই অনুসন্ধান অন্যান্য দেশে অবৈধ মাছ আহরণ এবং ভুল লেবেলিং নিয়ে তদন্তে এবং বড় সুপারমার্কেটগুলোর মাছ সংগ্রহের উৎস পরিবর্তনে সহায়তা করেছে।
“ডিএনএ ডেটাবেসের সংখ্যা এত বেড়েছে যে তা এখন বড় ধরনের অনুসন্ধানী সোর্স হয়ে উঠেছে। এটি যে শুধু মাছ নিয়ে এমন নয়; এটি মাংস, ফসল এবং এমনকি মানুষের জন্যেও প্রযোজ্য,” তিনি বলেন। “এবং যদি ডিএনএ পরীক্ষা কাজ না করে, আপনি আইসোটোপ বিশ্লেষণের চেষ্টা করতে পারেন, তবে ডিএনএ পরীক্ষা অনেক সাশ্রয়ী।”
ডিফভারমার্ক বলেন, কোম্পানিটি যখন ইমেইলের মাধ্যমে তাদের অনুসন্ধানের ওপর মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং প্রচলিত ডজিং অনুশীলকে অগ্রাহ্য করে তখন তাদের দলটি ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ে। এরপর, তাদের দলটি একটি ইমেলের মাধ্যমে পাল্টা জবাব হিসেবে জানায় যে, নির্দিষ্ট দিন-ক্ষণে অনুসন্ধানী দলের সব সদস্য কোম্পানির অফিসে হাজির হবে। তিনি বলেন, নিশ্চিতভাবে, এমন পরিস্থিতিতে ওইসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নূন্যতম একজন প্রতিনিধিকে তাদের অনুসন্ধানের ফলাফল শোনার জন্য পাঠানো হবে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্যামেরার সামনেও কথা বলতে রাজি হতে পারে।
কৌশল যখন ফুলের তোড়া প্রেরণ
সংবাদমাধ্যমের ওপর নাখোশ কোনো সোর্সকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি করানোর একটি মজার কৌশল বাতলে দিয়েছেন প্যানেলের উপস্থাপক নিলস হ্যানসন: তাদের কাছে নামহীন একটি ফুলের তোড়া পাঠানো। তিনি এই কৌশলের পুরো কৃতিত্ব দিয়েছেন মিশন ইভেস্টিগেটের রিপোর্টার হেনস রাস্টামকে।
“কৌশলটি শুরু হলো যখন হেনস তার সম্ভাব্য সোর্সকে কল করলেন এবং ইমেইল পাঠালেন – উত্তর মেলেনি,” বলেন হ্যানসন। “পরে তিনি শুনলেন যে তাদের স্টোরির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সোর্স ‘সাংবাদিকদের ঘৃণা’ করেন।” তারপর তিনি একটি নতুন আইডিয়া নিয়ে এলেন: “আমি সেই লোককে নাম-পরিচয় না জানিয়ে একটি ফুলের তোড়া পাঠাবো এবং তাতে শুধু লেখা থাকবে ‘আমাকে কল কর,’ এবং একটি ফোন নম্বর। সেই ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত তাকে কল করেছিলেন এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সোর্স হয়েছিলেন। কৌশলটি কাজ করে, কারণ যে কেউ জানতে চায়: “ফুলগুলো কে পাঠালো?”