

Illustration: Marcelle Louw for GIJN
অধ্যায় ৭: রিপোর্টিংয়ের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা
জিসিসিভুক্ত দেশগুলোতে এমন অল্প কয়েকটি সংবাদমাধ্যমই আছে, যেগুলো স্থানীয়ভাবে নিবন্ধিত ও স্বাধীন । বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই অঞ্চল নিয়ে প্রতিবেদন তাঁরাই করে থাকেন, যাঁরা এই অঞ্চলে থেকে বিদেশি মিডিয়ায় রিপোর্ট করেন, অথবা যাঁরা রিপোর্ট করার জন্য প্রায়ই দেশগুলো ভ্রমণ করেন। দুই ক্ষেত্রেই তথ্য পাওয়া এবং নিরাপত্তার ইস্যুতে সাংবাদিকেরা নানা বাধাবিপত্তির মুখে পড়েন। এই লেখায় অঞ্চলটিতে কাজ করা পাঁচজন সাংবাদিক বলেছেন: দূর থেকে বা মাঠপর্যায়ে গিয়ে বলপূর্বক শ্রম নিয়ে কাজ করার সময় কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা পাশ কাটাবেন কী করে
সেবাস্তিয়ান কাস্তেলিয়ে একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক পর্যাযের বেশ কিছু প্রকাশনায় তিনি রিপোর্টিং করেছেন জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর অর্থনীতি নিয়ে। তাঁর লেখা ১৫টির বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
“কোভিড-১৯ সংকট, অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর কেমন বিধ্বংসী প্রভাব ফেলেছে, তা নিয়ে রিপোর্টিং করা বেশ চ্যালেঞ্জের কাজ। আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশ মাসের পর মাস ধরে তাদের সীমান্ত বন্ধ রেখেছে, কিংবা চলাচল সীমিত করেছে। এমন এক পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবেই মাঠপর্যায়ে গিয়ে ভালো রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। ফলে অভিবাসী শ্রমিকদের অভূতপূর্ব দুর্দশার কথা তুলে আনার জন্য ফোন বা ভিডিও সাক্ষাৎকারের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হন সাংবাদিকেরা।
“উপসাগরীয় অঞ্চলে প্রবেশেএবং তথ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকলেও, সংকটের ভয়াবহতার কারণে অনেক অভিবাসী শ্রমিকই এখন সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন তাঁদের নিজের গল্প শেয়ার করার জন্য বা সাহায্যের আবেদন জানানোর জন্য। তবে এই অঞ্চলের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে আমাদের এসব বক্তব্য যাচাই করতে হবে খুবই সতর্কতার সঙ্গে। কারণ, সৌদি/আরব আমিরাত জোট ও কাতারের মধ্যে ২০১৭ সাল থেকে একটি তথ্যযুদ্ধ চলছে। উপসাগরীয় অঞ্চলে অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশাকে এখন রাজনীতির গুটি বানিয়ে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের এসব তথ্য খুব ভালোমতো যাচাই করতে হয়; কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিমালিকানার কোম্পানিগুলো অবৈধ কিছু করার কথা অস্বীকার করে এবং শ্রমিকদের সাক্ষ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।”
উপসাগরীয় শ্রমবাজারের অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে অভিবাসী শ্রমিকেরা ক্রমাগত যেসব চ্যালেঞ্জ ও হয়রানির মুখে পড়েন, সেগুলো নিয়ে নিয়মিত রিপোর্টিং করাটা সাংবাদিকদের নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়।
সরেজমিন রিপোর্টিংয়ের বিকল্প
পিট প্যাটিনসন জিসিসিভুক্ত দেশগুলোতে বলপূর্বক শ্রম ও মানবাধিকার নিয়ে নিয়মিত রিপোর্টিং করেন যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকার জন্য।
“সবচেয়ে ভালো সময়েও উপসাগরীয় অঞ্চলের অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে রিপোর্টিং করা কঠিন কাজ, কিন্তু কোভিড-১৯ একে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে, এবং তার চেয়েও বড় কথা, অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে তা গুরুত্বপূর্ণও হয়ে উঠেছে। এ ধরনের বিষয় নিয়ে কাজ করতে গেলে মাঠপর্যায়ে রিপোর্টিংয়ের আসলে কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু অসম্ভব না বললেও, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আসলেই কাজটিকে খুবই কঠিন করে তুলেছে। তাহলে, বিকল্প কী?
“একটি উপায় হলো, অভিবাসী শ্রমিক কমিউনিটিতে আপনার সোর্স ব্যবহার করে ফোন বা অনলাইন সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা। আপনি যদি এই অঞ্চলে কিছু সময় ধরে কাজ করে থাকেন, তাহলে আপনার হয়তো প্রাথমিক কাজ শুরু করার মতো যোগাযোগ, নেটওয়ার্ক এরই মধ্যে আছে। যদি তা না থাকে, তাহলে এই অঞ্চলে কাজ করা এনজিওগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। যেমন: মাইগ্র্যান্ট-রাইট ডট ওআরজি।
“আপনি সরাসরি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেও অভিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। তবে এর কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। কীভাবে আপনি অচেনা একজন মানুষের কাছে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবেন, বিশেষভাবে যেখানে এভাবে কথা বলাটা তাঁদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে? এবং একই সঙ্গে, আপনিও কীভাবে তাঁদের বিশ্বাস করবেন এবং তাঁদের বলা কথাগুলো যাচাই করবেন? এর একটি উত্তর হলো: যত বেশি মানুষের সঙ্গে সম্ভব কথা বলা। আপনি যখন এটি করতে শুরু করবেন, তখন মূল ইস্যুগুলো সামনে বেরিয়ে আসতে থাকবে। উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে যে অভিবাসী শ্রমিকেরা সম্প্রতি নিজ দেশে ফিরেছেন, তাঁদের কাছ থেকেও আপনি জেনে নিতে পারেন সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা তুলনামূলক সহজ হবে এবং তাঁরা কথা বলতেও আগ্রহী হবেন।
সোর্সের সুরক্ষা, নারী হিসেবে রিপোর্টিং
রাবিয়া জাফরি, উপসাগরীয় অঞ্চলভিত্তিক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।
“উপসাগরীয় অঞ্চলে (বিশেষভাবে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত) বলপূর্বক শ্রম কাভার করতে গিয়ে আমি যে চ্যালেঞ্জটির মুখে সবচেয়ে বেশি পড়েছি, তা হলো: কীভাবে একই সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন তৈরি করা যায়, এবং সোর্সের সুরক্ষা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত করা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, আমি যাঁদের সঙ্গে কথা বলি, তাঁরা নাম-পরিচয় প্রকাশ করে সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পান। এর কারণও নিশ্চিতভাবে বোঝা যায়। যে প্রকাশনাগুলোর এই অঞ্চল সম্পর্কে একটু জানাশোনা আছে, তারা হয়তো সোর্সের পরিচয় গোপন রেখে প্রতিবেদন প্রকাশে আপত্তি করবে না। কিন্তু আমি এমন কিছু বড় আন্তর্জাতিক প্রকাশনার কথা জানি, যারা এটি করতে দ্বিধা করবে। তারা প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হলে সোর্সের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে বলবে। ফলে আমাকে অনেক সময়ই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন চেপে যেতে হয়। কারণ, আমি জানি, নাম-পরিচয় প্রকাশ করলে আমার সোর্স গুরুতর বিপদে পড়বেন।
“এ ছাড়া নারী হওয়ার কারণে (বিশেষভাবে সৌদি আরবে) আমি অনেক জায়গায় যেতে পারি না। যেমন নির্মাণকাজের জায়গা, পুরুষ শ্রমিকদের থাকার জায়গা, এমনকি কিছু দপ্তরও। এ রকম পরিস্থিতিতে আমার একজন পুরুষ সহকর্মীর সাহায্য প্রয়োজন হয়, যিনি মাঠপর্যায়ে কাজ করবেন আমার চোখ হিসেবে। তবে উল্টো দিকে, নারী হিসেবে আমি এমন কিছু জায়গায় যেতে পারি, যেখানে পুরুষেরা যেতে পারেন না। ফলে সুবিধা-অসুবিধা দুই দিকেই আছে।
“নৈতিকভাবে, প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করি অনেক প্রতিবেদন না লেখার জন্য। আমি জানি, সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যেখানে রাষ্ট্রই দুর্নীতিপরায়ণ, সেখানে প্রায়ই আমাকে এসব প্রতিবেদন পাশে সরিয়ে রাখতে হয়। কারণ, আমি জানি, সেগুলো নিয়ে রিপোর্টিং করতে গেলে বিপদে পড়ে যাব।”
মিথ্যা ভাষ্যকে চ্যালেঞ্জ জানানো
রেজিমন কাটাপ্পান দ্য লেড-এর একজন বিশেষ প্রতিনিধি। তিনি মূলত লেখালেখি করেন অভিবাসন নিয়ে। আগে ওমানে থাকতেন এবং সেখানে কাজ করতেন। কিন্তু অভিবাসন ইস্যুতে রিপোর্টিং করার জন্য তাঁকে সেই দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
“কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে আরব উপসাগরীয় অঞ্চলে অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে রিপোর্টিং করতে গিয়ে আমি যেসব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছি, তেমনটি আমাকে কখনো পড়তে হয়নি এক দশকের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে। কোভিড-১৯ সংক্রমণ ও মহামারি-প্রভাবিত অর্থনৈতিক সংকট অভিবাসী শ্রমিকদের এতটা দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, যেমনটি গত এক শতকে দেখা যায়নি।
“আরব উপসাগরীয় অঞ্চলে দুর্দশার মধ্যে আটকে পড়া অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে আমি প্রায় ৪০টি প্রতিবেদন তৈরি করতে পেরেছি ২০২০ সালের মার্চ থেকে জুলাইয়ের মধ্যে। অভিবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে তাঁদের কথাগুলো শুনতে পারলেও, ভারসাম্যপূর্ণ একটি প্রতিবেদন লেখার জন্য আমাকে অন্য আরও যাঁদের (নিয়োগকারী, উৎস ও গন্তব্যের দেশের কর্তৃপক্ষ, বৈশ্বিক পর্যবেক্ষণকারী গ্রুপ) মন্তব্য নিতে হতো, তাঁরা আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলেন না। এ ছাড়া সঠিক সময়ে এসব গল্প তুলে ধরার তাগিদও একটি বাড়তি চাপ তৈরি করেছিল।
“অভিবাসী শ্রমিকসংশ্লিষ্ট এসব বিষয়ের সঙ্গে যেসব পক্ষ জড়িত ছিল; তারা উপস্থাপন করতে চেয়েছিল “সবকিছু ঠিক আছে”—এমন একটি ছবি। যদিও বাস্তব পরিস্থিতি মোটেও তেমন ছিল না। এবং তারা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে খোলাখুলি কথাও বলতে চায় না।
“ভারতের লোকেরা হয় সত্যিকারের চিত্রটি দেখতে পান না, বা ইচ্ছে করেই না জানার ভান করেন। তাঁদের অভিযোগ: আমি আসল পরিস্থিতিকে অনেক ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখাচ্ছি। কঠিন একটি সত্য তুলে ধরার জন্য আমাকে ফোন , ইমেইল ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ এমনকি এই অভিযোগও করেছেন যে, আমি মিথ্যা বলছি এবং ভারত ও আরব দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক নড়বড়ে করে দেওয়ার চেষ্টা করছি, যদিও আমার হাতে অন-রেকর্ড বক্তব্য আছে।”
তথ্য অবদমনের মুখেও টিকে থাকা
জিসিসি অঞ্চলের এই সাংবাদিক কাজ করেন একটি আন্তর্জাতিক ওয়্যার সার্ভিসে। এই অঞ্চলের সরকারগুলোর কাছ থেকে দমন-পীড়নের ঝুঁকি থাকায় তিনি নাম-পরিচয় প্রকাশ করেননি।
“উপসাগরীয় অঞ্চলে কোভিড-১৯ মহামারির শুরুতে তথ্য সংগ্রহের কাজ খুবই কঠিন হয়ে পড়েছিল, কিন্তু পরে কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায়। এই অঞ্চলের সরকারগুলোর জন্য তাদের বার্তা প্রচার করা বেশ জরুরি হয়ে পড়েছিল। ফলে, তারা কিছুটা উন্মুক্ত ভাব দেখাতে শুরু করে। গোড়ার দিকে, জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোভিড-সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনগুলো আয়োজন করত শুধু স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের জন্য। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হতো না (আরও অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়)। কিন্তু পরবর্তীকালে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের সংবাদ সম্মেলনই বন্ধ ঘোষণা করা হয় সুরক্ষার কারণ দেখিয়ে।
“তথ্য চেপে রাখার অংশ হিসেবে, উপসাগরীয় অঞ্চলের সরকারগুলো অনেক বেশি বেশি জনসংযোগজাতীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে। (বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা সহায়তা পাঠানো, নতুন কোনো ফিল্ড হাসপাতাল বা ভেন্টিলেটর তৈরির কারখানা পরিদর্শন; ইত্যাদি)। এসব সাজানো মুহূর্তও আমাদের জন্য অনেক উপকারী হয়ে ওঠে। কারণ, এখানে তারা সংবাদমাধ্যমকে ছবি তুলতে দেয় এবং নিত্যদিনের আক্রান্ত-মৃত্যুর পরিসংখ্যান ছাড়াও কিছু বাড়তি তথ্য পাওয়া যায়।
“কোভিড-১৯ পরিস্থিতি, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কাভার করার কাজটিও আরও জটিল করে তুলেছে। কোনো ইভেন্ট বা সংবাদ সম্মেলন কাভারের সুযোগ নেই, সামনাসামনি কারও সঙ্গে দেখা করা কিংবা সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ নেই। ফলে বাস্তবে মাঠে সত্যিই কী ঘটে চলেছে, তা বোঝা আমাদের জন্য আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। সোর্সদের সঙ্গে শুধুই ইলেকট্রনিক যোগাযোগের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে।”