প্রবেশগম্যতা সেটিংস

প্যানেল আলোচকরা। ছবি আলিয়া আব্দুল আজিজ আলহাদজরি
প্যানেল আলোচকরা। ছবি আলিয়া আব্দুল আজিজ আলহাদজরি

লেখাপত্র

বিষয়

বৈশ্বিক স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুসন্ধান: করপোরেশনের প্রভাব

আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:

তামাক, অ্যালকোহল, অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবার, আর জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে সৃষ্ট দীর্ঘমেয়াদি রোগে প্রতি বছর লাখো মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। এরপরও এসব বিষয়ের ওপর তৈরি প্রতিবেদনগুলো তুলনামূলকভাবে কম প্রকাশিত হয়।

“প্রতি তিনটি মৃত্যুর মধ্যে একটির জন্য দায়ি চারটি শিল্প,” বলেন আসরা মুস্তুফা, তিনি স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম দ্য এগজামিনেশন-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। দশকের পর দশক ধরে কীভাবে করপোরেট পণ্য ও নীতিগত প্রভাব নীরব সংকট তৈরি করে তা নিয়ে সেশন আলোচনার সময় তিনি এ কথা বলেন।

মালয়েশিয়ায় শুরু হওয়া ১৪তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সের এক প্যানেলে স্বাস্থ্য ও পরিবেশবিষয়ক অভিজ্ঞ সাংবাদিক এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেন, এসব শিল্প বিজ্ঞানকে প্রভাবিত করে, নিয়মকানুনকে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী ব্যবহার করে, আর সাধারণ মানুষের মনে ক্ষতিকর প্রভাববিষয়ক ধারণাকে আড়াল করতে শক্তিশালী জনসংযোগ কৌশল ব্যবহার করে।  আলোচকরা বার্তাকক্ষের চাপ সত্ত্বেও অনুসন্ধান ধরে রাখার কৌশল এবং করপোরেট কৌশলের মূলে প্রবেশের উপায় নিয়ে আলোচনা করেন।  

করপোরেট শক্তির গোপন নকশা

চি ইয়োক লিং গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান থার্ড ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, একক কোনো কোম্পানির পক্ষ থেকে করপোরেট প্রভাব তৈরি করাটা কঠিন। এক্ষেত্রে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সমিতি, জোট এবং ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর জটিল সংযোগগুলো অনুসরণ করতে হয়। তিনি উল্লেখ করেন “বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপনি তাই একক কোনো কোম্পানির সঙ্গে নয়, বরং বিভিন্ন সংগঠন, বিরোধী জোট আর তহবিলদাতাদের সামলাচ্ছেন—যারা এত বড়, এত সংগঠিত যে সহজে চিহ্নিত করা যায় না।”

তিনি বলেন, গত এক দশকে শিল্পখাতের চাপ আরও বেড়েছে, বিশেষ করে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যবিষয়ক নীতিনির্ধারণে, যেখানে বেসরকারি সংস্থা ও শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীভিত্তিক প্রভাবগুলো অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাংবাদিকদের জন্য তাই “বিজ্ঞানকে সহজ করা এবং আইনি কাঠামোকে সহজ করে বোঝানো” জরুরি, যেন জনগণকে সঠিক তথ্য দেওয়া যায়।

কৌশলে বিজ্ঞানকে ব্যবহার , নীতিগত হস্তেক্ষেপ, আর নিয়ম ভাঙার উপায়

ক্ষতিকর পণ্য প্রস্তুতকারক শিল্পগুলো কীভাবে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে—তা ব্যাখ্যা করেন পেরুভিয়ান অনুসন্ধানী গণমাধ্যম সালুদ কন লুপার প্রতিষ্ঠাতা ফাবিওলা তোরেস। 

ফাবিওলা তোরেস। ছবি: আলিয়া আব্দুল আজিজ আলহাদজরি

  • কৌশলে বিজ্ঞানকে ব্যবহার: গবেষককে অর্থায়ন, গবেষণা নিয়ন্ত্রণ, বিশ্বাসযোগ্যতা ক্রয়।
  • নীতিগত হস্তক্ষেপ: লবিং, আইনের ফাঁক তৈরি, নিয়ন্ত্রক সংস্থায় শিল্পের লোক বসানো।
  • ক্ষতিকর পণ্য বিক্রির বাজারজাতকরণ কৌশল: প্রাণঘাতী পণ্যকে ব্যক্তিগত লাইফস্টাইল পছন্দ হিসেবে দেখানো, বা “বাণিজ্যিক স্বাধীনতা”র অজুহাত দেওয়া।

তিনি সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান, বড় বড় করপোরেট খুনিদের নিয়ে কাজ করতে চাইলে এসব স্তরের প্রতিটি বাঁকের দিকে নজর দিতে হয়। “এই ধরনের গল্প নিয়ে কাজ করতে প্রয়োজন নিখুঁত পরিকল্পনা। এগুলো স্বল্পমেয়াদি বিট নয়। এর জন্য মাসের পর মাস, কখনও কখনও প্রয়োজন হয় বছরের পর বছর। এগুলো দিনে দিনে হয় না।”

জীবাশ্ম জ্বালানি, গ্রিনওয়াশিং, আরস্যাক্রিফাইস জোনস

বিবিসি আই ইনভেস্টিগেশনসের সাংবাদিক ওয়েন পিনেল বলেন জীবাশ্ম জ্বালানি শুধু বৈশ্বিক উষ্ণায়নের  মূল চালক নয়—বায়ুদূষণের মূল কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে প্রতি বছর ৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন অকাল মৃত্যুর কারণ।

তিনি জানান, গত এক দশকে গ্রিনওয়াশিং কত দ্রুত বেড়েছে, পিনেল তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অনেক কোম্পানি নিজেদের জলবায়ুবান্ধব দেখাতে বিজ্ঞাপনের খরচ বাড়িয়েছে। আবার “ইএসজি (পরিবেশ, সামাজিক, সুশাসন) হিসাবকে শোভন দেখাতে” তারা সবচেয়ে দূষণ সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠানের সম্পদগুলো শেল কোম্পানিতে সরিয়ে দিয়েছে, যাতে সেসব দূষণের ক্ষেত্রে তাদের নাম না আসে।

সাংবাদিকদের এসব দাবিকে সন্দেহের চোখে দেখতে হবে, তিনি বলেন।

“ওরা যেটাকে ‘সমাধান’ বলে, সে সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজ করুন—সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিলাসবহুল ভবনে কার্বন ক্যাপচার যন্ত্র, ইএসজি দাবি, কিংবা ক্ষতিকর প্রভাবের বিপরীতে এমন ভারসাম্য তৈরির চেষ্টা যেগুলোর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই, বলে সতর্ক করেন তিনি।

তিনি সাংবাদিকদের আরও অনুরোধ করেন “স্যাক্রিফাইস জোনস” এর দিকে নজর দিতে—যে সব গোষ্ঠী জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনের বিষাক্ত প্রভাব বহন করে। “উন্মোচন করার মতো অনেক কিছুই আছে,” তিনি বলেন। ইরাকে নিজের কাজের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, এমন অঞ্চল পৃথিবীর প্রতিটি মহাদেশেই রয়েছে।

ধীরগতির প্রভাব নিয়ে প্রতিবেদন করার চ্যালেঞ্জ

প্যানেল আলোচনার জোর দেওয়া হয় সংবাদকক্ষের কাজের গতি আর ধীরগতির সংকটের সময়সীমার ওপর। দীর্ঘমেয়াদি কোনো রোগের বিকাশের জন্য দশকের বেশি সময় লাগে। করপোরেট কৌশল গড়ে ওঠে বহু বছরের ব্যবধানে। আইন তৈরি হতে আরও বেশি সময় লাগে। এদিকে বার্তাকক্ষকে কাজ করতে হয় প্রতিদিনের ডেডলাইনের চাপ নিয়ে।

“এই গল্পগুলো দৈনিক ঘটনার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো—সম্পাদকদের মনোযোগ পাওয়া। যুদ্ধক্ষেত্রের তাৎক্ষণিক মৃত্যুর খবরে ব্যস্ত সম্পাদকদের কাছে এগুলো জরুরি নাও মনে হতে পারে—যদিও এই রোগে আরও বেশি মানুষ মারা যায়,” বলেন পিনেল।

তোরেস উল্লেখ করেন, কীভাবে তিনি এই ধরনের গল্পগুলোকে টিকিয়ে রাখেন: অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পাশাপাশি রেডিও অনুষ্ঠান, ভিডিও, স্কুলের উপকরণ এবং জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মশালা পরিচালনা করেন, যেন “গল্পটা এক দিনের ব্যবধানে হারিয়ে না যায়।”

সেশনের সময় প্রশ্ন করছেন একজন দর্শক। ছবি: আলিয়া আব্দুল আজিজ আলহাদজরি

কোম্পানিরঅভ্যন্তরেপ্রবেশের উপায়

দ্য এগজামিনেশনের  কৌশলগুলো তুলে ধরে আসরা মুস্তুফা বলেন, তারা ৭০টি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ২৭০টিরও বেশি প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন।
“আমরা একটা মন্ত্র অনুসরণ করি—কোম্পানির অভ্যন্তরে প্রবেশের চেষ্টা করো, অথবা তাদের নিজের দুনিয়ায় পৌঁছাও। বিশেষ করে তখন, যখন তারা এমন সব কৌশল নিয়ে কথা বলে যেগুলোর স্বাস্থ্যগত ক্ষতির মাত্রা ভয়াবহ।”

“কিন্তু কীভাবে?” বলেন তিনি। “শুনতে কঠিন মনে হলেও সহজ উপায় হলো—তারা যেখানে থাকে আপনি সেখানে যান। তাদের সম্মেলনে— যেগুলো তারা স্পনসর করে কিংবা বিনিয়োগকারীদের বোর্ড মিটিংয়ে। কিংবা সংসদের নথি দেখুন, প্রতিষ্ঠানের তথ্য ভান্ডারে চোখ বুলান কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন—যারা গুরুত্বপূর্ণ।”

সাংবাদিকদের তিনি মনে করিয়ে দেন—সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো সেই মানুষরা “যারা আগে ওই প্রতিষ্ঠানে কাজ করত, বা এখনো করে কিন্তু সন্তুষ্ট নয়।”

কোম্পানির “নিজস্ব তথ্য”-এর মধ্যে থেকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায়—প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কারো ভাষণ, দাখিল করা নথি, বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্য—যেগুলোতে তাদের কৌশলগুলো আগেভাগেই ফুটে ওঠে।

“শেষ প্রশ্নটা হচ্ছে— স্বাস্থ্যবিষয়ক যে তথ্যগুলো আপনি দেখছেন, তা দিয়ে মূলত কারা লাভবান হচ্ছে?” উপস্থিত সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন যে ধীরগতির সংকট, বদলে যাওয়া বয়ান, আর তৈরি করা সন্দেহের পেছনে সব সময় কারও না কারো অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকে—আর সেখান থেকেই অনুসন্ধানের রাস্তা তৈরি হয়।

ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে আমাদের লেখা বিনামূল্যে অনলাইন বা প্রিন্টে প্রকাশযোগ্য

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

জিআইজেসি২৫ সাক্ষাৎকার

রিপোর্টারের এআই নিয়ে গল্প থাকে: তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝুঁকি সম্পর্কে বলেছেন এই সাংবাদিক

বার্তাকক্ষগুলো গভীর অনুসন্ধানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়। যাদের দায়বদ্ধ করা দরকার তারা ক্রমশ ধনী আর ক্ষমতাবান হচ্ছে। অনেকে সাংবাদিকতা ছেড়ে প্রযুক্তি কোম্পানির যোগাযোগ দলে যোগ দিচ্ছেন। তাই অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আরও বেশি সৃজনশীল হতে হবে—যাতে সীমিত সম্পদ দিয়েও বেশি কাজ করা যায়।

জিআইজেসি২৫ পুরস্কার

গ্লোবাল শাইনিং লাইট অ্যাওয়ার্ড: অভিবাসন, সংঘবদ্ধ অপরাধ এবং যুদ্ধক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ ৭ প্রতিবেদন

গ্লোবাল শাইনিং লাইট অ্যাওয়ার্ড (জিএসএলএ)-এর চূড়ান্ত তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে ১১টি দেশের ১৩টি সাহসী প্রতিবেদন। নানা হুমকি, চাপ ও অবরুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও উন্নয়নশীল কিংবা রূপান্তরপর্বে থাকা দেশগুলোতে যাঁরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চালিয়ে যান তাদের স্বীকৃতি জানাতে দেওয়া হয় এই পুরস্কার।

জিআইজেসি২৫ পুরস্কার

গ্লোবাল শাইনিং লাইট অ্যাওয়ার্ড: চূড়ান্ত তালিকায় কেন এই ছয় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

এই বিভাগে জায়গা করে নিয়েছে পেরু, লিবিয়া, চিলি, সিরিয়া, ভারত ও মিশরের ছয়টি প্রতিবেদন। যেখানে উঠে এসেছে অভিবাসন, বন্যপ্রাণী পাচার, দুর্নীতি এবং ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার অপব্যবহারসহ নানা বৈচিত্র্যময় বিষয়।