প্রবেশগম্যতা সেটিংস

অলংকরণ: ন্যুক

লেখাপত্র

বিষয়

‘প্রভাব অনেক সময় অদৃশ্য থাকে’: নেপালি সাংবাদিক কুন্দা দীক্ষিতের পেশাগত উত্থান-পতনের গল্প

আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:

আমি যখনই দেশের বাইরে কোনো সম্মেলনে অংশ নিতে যাই, আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেসা করা হয়: “আচ্ছা, আপনি কি কুন্দাকে চেনেন?” আমার উত্তর সবসময় একটাই: “হ্যাঁ, অবশ্যই।”
কুন্দা দীক্ষিত নেপালের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাংবাদিক কণ্ঠগুলোর একজন — তিনি রিপোর্টার, সম্পাদক, লেখক ও অভিজ্ঞ পরামর্শদাতা; শুধু ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষীই নন, বরং তিনি নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু সাংবাদিককে গড়ে তুলেছেন, দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা স্কুল থেকে স্নাতক কুন্দা দীক্ষিত কর্মজীবন শুরু করেন নিউইয়র্কে বিবিসি রেডিওতে। পরে তিনি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ইন্টার প্রেস সার্ভিসের হয়ে এশিয়া-প্যাসিফিক আঞ্চলিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
নিজ দেশে ফিরে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন প্যানোস সাউথ এশিয়া। একাধিক বই লিখেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য “আ পিপল’স ওয়ার” — নেপালের গৃহযুদ্ধের দলিল।  এবং “ডেটলাইন আর্থ: জার্নালিজম অ্যাজ ইফ দ্য প্ল্যানেট ম্যাটার্ড”। বর্তমানে তিনি নেপালি টাইমস পত্রিকার প্রকাশক এবং একই সঙ্গে সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম –নেপাল (সিআইজে-এন)–এর চেয়ারম্যান।

২০১৬ সালে জিআইজেএন কাঠমান্ডুতে দ্বিতীয় আনকাভারিং এশিয়া কনফারেন্স আয়োজন করে। এর অন্যতম মূল সংগঠক ছিলেন দীক্ষিত। কিন্তু সম্মেলন শুরু হওয়ার ঠিক আগে এক জটিল পরিস্থিতিতে তিনি গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় স্ব-নির্বাসনে যান। এই সাক্ষাৎকারে তিনি সেই সময়টিকে সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় বলে বর্ণনা করেছেন।

আজও নেপালে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে এমন পরিস্থিতিতে যখন সরকার ও কর্পোরেট মালিকানা সংবাদমাধ্যমের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। দীক্ষিত বলেন, “রিপোর্টাররা সংবেদনশীল কোনো বিষয়ের খুব কাছাকাছি পৌঁছালে শারীরিক হামলার আশঙ্কাও থাকে, বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে।”

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)–এর তথ্য অনুযায়ী, নেপালের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা গত বছরে ৭৪তম থেকে নেমে চলতি বছর ৯০তম স্থানে চলে গেছে। সম্প্রতি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি ও সরকারবিরোধী আন্দোলনে বহু সাংবাদিকও আক্রান্ত হন। আরএসএফ জানিয়েছে, ওই সময় অন্তত এক ডজনের বেশি সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিক সংগঠনের অফিসে হামলা হয় এবং পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেটের আঘাতে কয়েকজন সাংবাদিক আহত হন।

এদিকে, নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আরএসএফ–এর দক্ষিণ এশিয়া ডেস্কের প্রধান সেলিয়া মেরসিয়ে সতর্ক করে বলেন, “সংকট ও অনিশ্চয়তার সময়ে তথ্য জানার ও জানানোর অধিকার রক্ষা করা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি জরুরি।”

বিক্ষোভ যখন নেপালের পার্লামেন্টের দিকে অগ্রসর হতে থাকে, তখন দীক্ষিত শহরের অন্যপ্রান্তে স্কলারশিপ বিষয়ক একটি সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন। কারফিউ জারির আগেই তিনি বাড়ি ফিরতে সক্ষম হন এবং সংবাদ কভার করা বিষয়ক সমন্বয়ের জন্য এক সম্পাদককে ফোন করেন।
তিনি বলেন, “আমরা তখন পুরো পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিলাম — কী ঘটছে, এরপর কী হতে পারে তা আন্দাজ করছিলাম।”

জিআইজেএন: আপনার এতদিনের কাজের মধ্যে কোন অনুসন্ধানটিকে আপনার কাছে সবচেয়ে প্রিয় এবং কেন?

কুন্দা দীক্ষিত: নেপালি টাইমস-এ আমাদের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অনুসন্ধানটি ছিল একটি গোপন অভিযান, যেখানে আমাদের দুইজন রিপোর্টার কাঠমান্ডুর আন্তর্জাতিক দত্তক চক্রকে উন্মোচন করেছিলেন। এতে কিছু ঝুঁকি ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি সমাজে ভালো প্রভাব ফেলেছিল — যা দেখে তৃপ্তি পেয়েছিলাম।

জিআইজেএন: আপনার দেশ বা অঞ্চলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী?

দীক্ষিত: সবচেয়ে বড় হুমকি আসে প্রতিশোধপরায়ণ রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে, যারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলে, মানহানির মামলা করে, কিংবা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে জেলে পাঠায়। জেলার রিপোর্টাররা বেশি ঝুঁকিতে থাকে, কারণ তারা ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থাকে। প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় অপরাধীরাই অনেক সময় সাংবাদিক হত্যা পর্যন্ত করে থাকে।

জিআইজেএন: একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে আপনার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় কোনটি ছিল?

দীক্ষিত: সবচেয়ে ভয়াবহ সময় ছিল ২০১৬ সালে, যখন আমাদের পত্রিকাকে লক্ষ্যবস্তু বানান নেপালের দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান। আমরা তার নিয়োগ ও বিতর্কিত অবস্থান নিয়ে প্রতিবেদন করেছিলাম। আর তিনি প্রতিশোধ নিতে আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ সাজান। আমাদের কয়েকজন সহকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়, কেউ লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হন, আর আমাকে ছয় মাসের জন্য দেশ ছেড়ে বাইরে থাকতে হয়েছিল—ওই সময়টা আমরা কাঠমান্ডুতে জিআইজেএন কনফারেন্সের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

জিআইজেএন: ভালো সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য আপনার পরামর্শ কী?

দীক্ষিত: প্রথমে বরফ গলান — হালকা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করুন। হুইসেলব্লোয়ারকে আশ্বস্ত করুন যে সে নিরাপদ থাকবে, কোনো প্রতিক্রিয়া বা প্রতিশোধের মুখে পড়বে না। তাকে বোঝান এটা জনস্বার্থে করা হচ্ছে, এখানে আপনার কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই।

জিআইজেএন: অনুসন্ধানে আপনি কোন টুল, ডেটাবেস বা অ্যাপ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন?

দীক্ষিত: না, কোনো অ্যাপ বা কোনো ডিভাইস নয়। শুধু কঠোর, নিরলস পরিশ্রম — কাগজ বা ডিজিটাল সূত্র ধরে এগিয়ে চলা।”

জিআইজেএন: এতদিনের ক্যারিয়ারে আপনি সবচেয়ে ভালো যে পরামর্শ পেয়েছেন, আর নতুন অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে কী বলতে চান?

দীক্ষিত: ধৈর্য ধরুন। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন রাতারাতি তৈরি হয় না। অনুসন্ধান চলার সঙ্গে সঙ্গে গল্প ও চরিত্র বদলে যেতে পারে, তাই নমনীয় হন। “কারো ক্ষতি করবেন না”— নিরপরাধ কারও সুনাম নষ্ট করবেন না। গোপন সূত্র থেকে তথ্য পেলে (যেমন ডিপ থ্রোট ধরনের সূত্র), তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও সচেতন থাকুন।

জিআইজেএন: আপনি কোন সাংবাদিককে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করেন, এবং কেন?

দীক্ষিত: নব্বইয়ের দশকে ম্যানিলায় থাকার সময় ফিলিপিন সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (পিসিআইজে)–এর কাজ আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। নারী নেতৃত্বাধীন সেই দলটি প্রমাণ করেছিল— সাংবাদিকতা কীভাবে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে প্রতিপক্ষের ভূমিকায় থাকতে পারে। ১৯৯৭ সালে কাঠমান্ডুতে ফিরে আমি পিসিআইজের মডেলে সিআইজে–এন প্রতিষ্ঠা করি। পরে দুটি সংগঠনই জিআইজেএনের প্রথম এশীয় সদস্য হয়।

জিআইজেএন: আপনি কখনও বড় কোনো ভুল করেছেন? কী শিখেছেন সেখান থেকে?

দীক্ষিত: অবশ্যই করেছি। একবার আমরা মালয়েশিয়ায় এক মালিকের হাতে নেপালি কর্মীর মার খাওয়ার একটি ভিডিও পাই। যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন করি। কিন্তু পরে দেখা গেল ভিডিওটি আসলে দুইজন নিরাপত্তারক্ষীর মধ্যে মারামারির। এ থেকে আমাদের প্রাপ্ত শিক্ষাটি ছিল খুবই স্পষ্ট — এখন থেকে সবকিছু তিনবার যাচাই করব, বিশেষ করে ‘ডিপফেক’-এর যুগে।

জিআইজেএন: এত চাপের কাজেও আপনি কীভাবে বার্নআউট থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখেন?

দীক্ষিত: কখনও কখনও হতাশ লাগে, যখন দেখি দীর্ঘ পরিশ্রমের পরও কোনো প্রতিবেদন দৃশ্যমান প্রভাব ফেলছে না। কিন্তু আমি শিখেছি, প্রভাব অনেক সময় অদৃশ্যমান থাকে — জনসচেতনতা পরিমাপ করা যায় না, কিন্তু ছোট ছোট পদক্ষেপের মাধ্যমে তা একটি দেশের ইতিহাসের গতিপথ পাল্টাতে পারে। এক ব্যক্তির শক্তিতে বিশ্বাস রাখুন।

জিআইজেএন: অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কোন দিকটি আপনাকে সবচেয়ে হতাশ করে, বা ভবিষ্যতে কী ধরনের পরিবর্তন দেখতে চান?

দীক্ষিত: সবচেয়ে হতাশার বিষয় হলো, এখন সংবাদমাধ্যমগুলো আর্থিক সংকটে ভুগছে — তারা আর রিপোর্টারদের অনুসন্ধানী কাজের জন্য অর্থ ও সময় দিতে পারছে না। পাঠকেরাও ভয়ানকভাবে মনোযোগ হারিয়েছে। এখন চ্যালেঞ্জ হলো পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখার নতুন পদ্ধতি খুঁজে বের করা, যেমন পাঠকনির্ভর আয়ের মডেল তৈরি করা।
আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যেন সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায়িক মডেল ভেঙে না পড়ে, এবং ফেলোশিপ বা বিকল্প অর্থায়নের মাধ্যমে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে টিকিয়ে রাখা যায়।


Rajneesh Bhandariরাজনীশ ভান্ডারি নেপাল ইনভেস্টিগেটিভ মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম নেটওয়ার্ক (এনআইএমজেএন)-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান সম্পাদক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির ওয়াল্টার ক্রনকাইট স্কুল অব জার্নালিজমে ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং বিষয়ে ফুলব্রাইট হিউবার্ট এইচ. হামফ্রে ফেলো ছিলেন। বর্তমানে তিনি এনআইএমজেএনে প্রশিক্ষণ, ইনোভেশন ল্যাব, এবং যৌথ অনুসন্ধানী মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টিং প্রকল্পগুলোর তত্ত্বাবধান করেন। তার কাজ প্রকাশিত হয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, আলজাজিরা ইংলিশসহ আরও বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মাধ্যমে।

 

ন্যুক ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বর্তমানে সিওলের হানইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড আর্ট এডুকেশন বিভাগের ছাত্র এবং একই সঙ্গে ইলাস্ট্রেটর হিসেবে কাজ করছেন। ২০২১ সালে হিডেন প্লেস এ প্রদর্শনীর পর থেকে তিনি বিভিন্ন ইলাস্ট্রেশন প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। তার প্রধান আগ্রহ হলো হ্যান্ড ড্রইং, যা শিল্প জগত নিয়ে তার চিন্তাকে তুলে ধরে।

ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে আমাদের লেখা বিনামূল্যে অনলাইন বা প্রিন্টে প্রকাশযোগ্য

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

এশিয়া ফোকাস

এশিয়ায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা: চ্যালেঞ্জের মধ্যেও প্রতিরোধ, রূপান্তর, সংহতি

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের ২০২৫ সালের বিশ্ব গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক অনুযায়ী, এশিয়ার অধিকাংশ দেশেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা “অত্যন্ত সংকটপূর্ণ” অবস্থায় রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ দশটি দেশের মধ্যে সাতটিই এখন এশিয়ায়: রাশিয়া, ভিয়েতনাম, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, সিরিয়া, চীন এবং উত্তর কোরিয়া।

এশিয়া ফোকাস

রাষ্ট্র-ঘনিষ্ঠ ওলিগার্ক এবং সরকারি অর্থ আত্মসাৎ: এশিয়ায় অবৈধ অর্থপ্রবাহ অনুসন্ধান

সীমান্ত অতিক্রম করে নিয়মিতভাবেই অবৈধভাবে অর্থপাচার করা হচ্ছে, আর এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ছে এশিয়াতেও। এই অঞ্চলের অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা এমন সব প্রতিবেদন উন্মোচন করেছেন যেখানে অর্থনৈতিক অনিয়মের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। লুটেরা স্বৈরশাসক, নতুন জুয়া কেন্দ্র, এবং চুরি করা অর্থ গোপন রাখার বিশাল নেটওয়ার্কের কর্মকাণ্ডকে সাংবাদিকরা সামনে এনেছেন।