Emmanuel Freudenthal.
আমার প্রিয় অনুসন্ধানী টুল: ইমানুয়েল ফ্রয়েডেনথাল
অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা তাদের কাজে কী ধরনের টুল ব্যবহার করেন? বিশ্বের খ্যাতনামা সাংবাদিকদের কাছে ঠিক এই প্রশ্ন রেখেছিল জিআইজেএন। তাদের পছন্দের সেইসব টুলের খবর পাঠকদেরকে জানাতেই জিআইজেএনের এই সিরিজ।
ক্যাপশন: ইমানুয়েল ফ্রয়েডেনথাল
এই সপ্তাহে আমরা কথা বলেছি ইমানুয়য়েল ফ্রয়েডেনথালের সাথে। ফ্রিল্যান্স এই সাংবাদিক থাকেন কেনিয়ার নাইরোবিতে। প্রতিবেদনের কাজে তিনি চষে বেড়িয়েছেন, গোটা আফ্রিকা মহাদেশে। আমাদের সাথে তিনি কথা বলেছেন প্রিয় টুলগুলো নিয়ে। তাতে জিমেইল স্নুজ আর জিপিএস ট্র্যাকসের মত ভার্চুয়াল টুল যেমন আছে, তেমনি আছে প্লেন ট্র্যাকিং এন্টেনা এবং মোটরবাইকের মত যান্ত্রিক টুলের ব্যবহারও।
ফ্রয়েডেনথাল রিপোর্ট করেন ইংরেজী এবং ফরাসী, দুই ভাষাতেই। সংঘাতময় এলাকাতেই তাঁর যাতায়াত বেশি। তিনিই বিশ্বের প্রথম সাংবাদিক, যিনি ক্যামেরুনের একটি ইংরেজীভাষী সশস্ত্র গ্রুপের সাথে সময় কাটিয়েছেন, সেখান থেকে তাদের নিয়ে রিপোর্ট করেছেন। হাজারো দলিলপত্র ঘেঁটে, আফ্রিকার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে তাঁর করা প্রতিবেদনের কারণে, সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডার পুলিশ তদন্তে নামতে বাধ্য হয়েছে।
ফ্রান্সের লে মন্ড পত্রিকার প্রথম পাতায় সম্প্রতি তাঁর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেখানে উঠে আসে, রোগীদের অনুমতি না নিয়েই, তাদের দেহ থেকে নেয়া ইবোলা ভাইরাসের নমুনা কীভাবে পাঠানো হয়েছে বিভিন্ন গোপন গবেষণাগারে। তাঁর আরেকটি আলোচিত রিপোর্ট ছিল ওসিসিআরপির সাথে। সেই রিপোর্টে বেরিয়ে আসে, ক্যামেরুনের প্রেসিডেন্ট পল বিয়া ক্ষমতায় আসার পর থেকে ঠিক কত সময় বিদেশে কাটিয়েছেন এবং তার মধ্যে কত দিন তিনি জেনেভার বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেলে পার করেছেন। বিবিসির তথ্যচিত্র “অ্যানাটমি অফ আ কিলিং” প্রযোজনা করেছেন তিনিই। মর্যাদাপূর্ণ পিবডি পুরস্কার জয়ী এই অনুসন্ধানে ক্যামেরুনের সৈন্যরা কীভাবে নারী ও শিশুদের হত্যা করেছে, তা ওপেন সোর্স তথ্যের সাহায্যে প্রমাণ করা হয়।
চলুন, এবার জেনে নেয়া যাক, কোনগুলো তাঁর প্রিয় অনুসন্ধানী টুল:
জিপিএস ট্র্যাকস
জিপিএস ট্র্যাকসের স্ক্রিনশট।
“আমার ফোনটা সুইস আর্মি নাইফের মত – সেটি দিয়ে আমি কথাবার্তা রেকর্ড করি, ছবি তুলি, দৈনন্দিন কাজের তালিকা তৈরি করি… এমনকি জিপিএস ট্র্যাকস অ্যাপ দিয়ে নিজের অবস্থানও ট্র্যাক করি। যেমন ধরুন, কঙ্গোতে একটি খনির আকার মাপতে গিয়ে আমি অনেক বার জিপিএস ট্র্যাকস ব্যবহার করেছি। ফোনে ট্র্যাকিং মোড চালু করে, আমি খনির ভেতর দিয়ে হাঁটা শুরু করি। এভাবে পুরো খনির মানচিত্র আঁকা হয়ে যায়। ঘরে ফিরেই আমি জানতে পারি খনিটি ঠিক কোন জায়গায় এবং কত বড়।
আরেকটি উদাহরণ: তখন আমি ছিলাম ক্যামেরুনে, দেশটির ইংরেজী ভাষাভাষী এলাকায়। সেখানে একটি সশস্ত্র গ্রুপের সাথে আমি প্রায় এক সপ্তাহ সময় কাটাই। স্বাভাবিকভাবেই, বাড়ী ফিরে (জিপিএস ট্র্যাকের মাধ্যমে) জানা হয়ে যায়, আমি ঠিক কোথায় কোথায় গিয়েছি। সেখানকার কিছু কিছু গ্রামে মাত্র চার-পাঁচটি বাড়ী আছে। গ্রামগুলো এত ছোট যে তাদের নামও মানচিত্রে থাকে না। তাই সেগুলো আবার খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আপনি কোথায় কোথায় গেছেন তা যদি এভাবে রেকর্ড করে রাখেন, তাহলে সেই তথ্য আপনার রিপোর্টে যোগ করতে পারে নতুন মাত্রা।”
হোয়াটসঅ্যাপ ডেস্কটপ
“আমি মানুষের সাথে কথাবার্তা বলার জন্য প্রায়ই হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করি। এজন্য আমার কম্পিউটারে হোয়াটসঅ্যাপের ডেস্কটপ ভার্সন সেটআপ করে নিয়েছি। সহকর্মীদের সাথে কাজ নিয়ে আলোচনার জন্যই হোক বা ক্যামেরুনের জেলে থাকা বন্দীদের সাথে কথা বলা – সারাদিনই কমবেশি ব্যবহার করতে হয় অ্যাপটি।
আফ্রিকান আর্গুমেন্টেসের জন্য তৈরি করা আমার সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনের বিষয় ছিল ক্যামেরুনে ইংরেজী ভাষাভাষীদের ওপর নিপীড়ন। রাজধানী ইয়াউন্দেতে সামরিক বাহিনীর অধীনে থাকা একটি ভবনে প্রায় ১০০ জন মানুষ নির্যাতনের শিকার হন। টানা কয়েকমাস ধরে নির্যাতনের পর, তাদের অনেককেই কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তাদেরই একজন জেল থেকে আমার সাথে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করেন। তাকে আটকের সময় বেশ পেটানো হয়েছিল। ওই ঘটনার একটি ভিডিও থেকে আমি বের করেছিলাম তাকে কোন জায়গায় পেটানো হয়। সেটি বিবিসিতে প্রচারও হয়েছিল। তার জানাশোনা এক ব্যক্তির সাথে আমার পরিচয় ছিল। সেই সূত্র ধরে আমার নম্বর নিয়ে তিনি যোগাযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘হেই, আমি ভিডিওর সেই লোক। আমি এখনো বেঁচে আছি।’ ক্যামেরুন বেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। তাই সেখানকার জেলখানায় কয়েদীরা অনেকসময় চাইলে মোবাইল ফোন যোগাড় করতে পারেন। অবিশ্বাস্য মনে হলেও, তার সাথে দীর্ঘদিন ধরে আমার হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ হয়েছে।
ছবিটি ইমানুয়েল ফ্রয়েডেনথালের ব্যক্তিগত আলাপচারিতার নয় — হোয়াটসঅ্যাপের ওয়েব ভার্সনের একটি নমুনা মাত্র। সৌজন্য: হোয়াটসঅ্যাপ।
এখন কমবেশি সবাই হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে। এটি নিরাপদ, তাই যোগাযোগের জন্য বেশ ভালো। অবশ্য কারো কাছে সিগন্যাল অ্যাপ থাকলে আমি (বাড়তি নিরাপত্তার জন্য) তাতেই যোগাযোগে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। কিন্তু এর ব্যবহার ততটা ব্যাপক নয় বলে, চোখে পড়ে যাওয়ার আশংকা থাকে।”
জিমেইল স্নুজ
জিমেইল স্নুজ। স্ক্রিনশট।
“আমি সবসময়ই জিমেইল স্নুজ ব্যবহার করি। এটি জিমেইলের এমন একটি ফাংশন, যার মাধ্যমে আপনি মেসেজকে (পাঠানো বার্তাসহ) আলাদাভাবে চিহ্নিত করে রাখতে পারবেন। এরফলে আপনার বেঁধে দেয়া সময় পর পর সেই বার্তা ইনবক্সে ফিরে ফিরে আসবে। সেই মেসেজের কথা আপনাকে মনে করিয়ে দেবে।
এটি বেশ কার্যকর, বিশেষ করে এমন পরিস্থিতিতে যখন আপনি কারো মন্তব্য চেয়ে মেইল করেছেন এবং নিশ্চিত নন তারা উত্তর দিবে কিনা। এমন ক্ষেত্রে, আপনি আপনার পাঠানো ইমেইলটিকে চিহ্নিত করে রাখলে, নির্দিষ্ট সময় পর পর সেটি ফিরে আসবে এবং ‘স্নুজ’ উত্তর পাঠানোর জন্য তাদেরকে রিমাইন্ডার দিতে আপনাকে মনে করিয়ে দিবে। এরফলে বিষয়টি ভুলে যাওয়ার ভয় থাকে না। ক্যালেন্ডারেও রিমাইন্ডার সেট করে রাখার প্রয়োজন হয় না। তথ্য অধিকার আইনে কোথাও তথ্য চাইলে আমি স্নুজ সেট করে রাখি। “
মোটরবাইক
“শহর হোক বা গভীর বন – আমি সবখানেই মোটর সাইকেল ব্যবহার করি। বাইক চালানো এমনিতেই আনন্দের। কিন্তু এর বাড়তি সুবিধা হল, কোথাও রিপোর্ট করতে গেলে সহজেই একটু এদিক ওদিক ঘুরে নেয়া যায়। গাড়ীতে এটা সম্ভব নয়। এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে গাড়ী নিয়ে যাওয়া যায় না, এমনকি ফোর হুইল ড্রাইভ থাকলেও। কিন্তু বাইক থাকলে একদম দুর্গম জায়গাতেও যেতে পারবেন, অনায়াসে। এমনকি বাইকটিকে ছোট নৌকায় তুলে নিয়ে আপনি নদীও পার হতে পারবেন।
আরেকটা বড় দিক হল, এতে জ্বালানি তেল লাগে কম এবং ট্যাংক ভর্তি করে নেয়া যায়, যেখানে সেখানে। একেবারে অজানা অচেনা জায়গাতেও দেখবেন, কেউ না কেউ এক-দুই লিটারের বোতলে ভরে তেল বিক্রি করছে। সেই তেল দিয়ে একটা বাইকের ট্যাংক ঠিকই ভরে নেয়া যায়, কিন্তু একটি গাড়ীর ১০০ লিটারের ট্যাংক ভরার মত তেল সবখানে পাওয়া যায় না।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, দুর্গম এলাকার গাড়ীগুলোও হয় ঝরঝরে বা পুরোনো। রাস্তায় সেগুলো বসে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি, মোটর সাইকেলের চেয়ে।”
২০১৩ সালে দক্ষিণ-পশ্চিম ক্যামেরুনের এক বাইক আরোহী। ছবি: ইমানুয়েল ফ্রয়েডেনথাল।
অ্যান্টেনা (এডিএস-বি রিসিভার)
“আকাশে সংঘর্ষ এড়াতে, বলতে গেলে প্রতিটি উড়োজাহাজই নিজের অবস্থান ও পরিচিতি জানিয়ে প্রতিনিয়ত বার্তা পাঠাতে থাকে। সেই বার্তা আপনিও পড়তে পারেন, যদি আপনার কাছে সেই রকম অ্যান্টেনা থাকে। বিষয়টা অনেকটা রেডিও শোনার মতই।
বিশ্বের যত বিমানবন্দর আছে তারা তো বটেই, অনেক সৌখিন অনুসন্ধানীও এমন অ্যান্টেনা রাখেন। আর এই নেটওয়ার্কের বদৌলতে ফ্লাইটরাডার ২৪ এর মত ওয়েবসাইটগুলো রিয়েলটাইমে বিমান ট্র্যাকিংয়ের তথ্য দিতে পারে। কিন্তু এডিএসবি এক্সচেঞ্জ ছাড়া কোনো সাইটের মানচিত্রেই সামরিক এবং ব্যক্তিগত বিমানের অবস্থান দেখানো হয় না। আর সাংবাদিকদের কাছে সেইসব উড়োজাহাজের তথ্যই সবচেয়ে আকর্ষণীয়।
কয়েক বছর আগে সুইস ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ফ্রান্সিস পিলের সাথে পরিচয় হয় – জেনেভা বিমানবন্দরের পাশেই বাড়ী, এমন এক ব্যক্তির। এই ভদ্রলোক বিমানের শব্দ নিয়ে বেশ রাগান্বিত ছিলেন। কোন বিমান কত শব্দ করে, সেটি মাপার জন্য তিনি একটি অ্যান্টেনাও কিনেছিলেন। সেখান থেকেই দারুন একটি আইডিয়া খেলে ফ্রান্সিসের মাথায়। তিনি ওই ভদ্রলোকের অ্যান্টেনা ব্যবহার করে জেনেভায় নামা প্রতিটি বিমান ট্র্যাক করার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, জেনেভা এমন একটি শহর যেখানে বড় ব্যাংক আছে, ভালো হাসপাতাল আছে। আর এসব সেবা নিতে যারা শহরটিতে আসেন, তাদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের স্বৈরশাসকরাও আছেন। আর এখান থেকেই জন্ম নেয় টুইটার বট জিভিএ ডিক্টেটর অ্যালার্ট। কোনো স্বৈরশাসকের প্লেন জেনেভা নামলেই, সেই বট টুইটারে বার্তা দিয়ে বিশ্ববাসীকে জানান দেয়।
প্লেন ট্র্যাকিং সাইট এডিএসবি এক্সচেঞ্জ। (স্ক্রিনশট)
ওসিসিসিআরপির সাথে এক অনুসন্ধানে আমি আর আমার ক্যামেরুনীয় দুই সহকর্মী ফ্রাংক উইলিয়াম বাচু এবং গেইল টিয়াট, পত্রিকার প্রায় ৪০০০ পাতা স্ক্যান করি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল দেখা, ক্যামেরুনের প্রেসিডেন্ট পল বিয়া কত দিন দেশে থাকেন আর কত দিন বিদেশে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসে, ১৯৮২ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি সাড়ে পাঁচ বছর বিদেশে ছিলেন। এর মধ্যে সাড়ে চার বছরই ব্যক্তিগত সফরে। এই অনুসন্ধানে আমরা জিভিএ ডিক্টেটর অ্যালার্ট থেকে তথ্য নিয়েছিলাম। দেখা যায়, পল বিয়া বেশ কয়েকবার জেনেভাও গিয়েছিলেন। আমরা স্টোরিটি প্রকাশ করি ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আমি যতদূর জানি, এর পর থেকে প্রেসিডেন্ট বিদেশ যাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। এখন বেশিরভাগ সময় ক্যামেরুনেই থাকেন।
এই বছর আমি আর ফ্রান্সিস, ওসিসিআরপির সাথে আরেকটি প্রকল্প শুরু করেছি। এখানে আমাদের কাজ হল, আরো অনেক টুইটার বট তৈরি করা, যারা স্বৈরশাসকদের ট্র্যাক করবে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই উদ্যোগটি ফল দেয়া শুরু করবে। এডিএসবি এক্সচেঞ্জে তথ্য পাঠাবে, এমন অ্যান্টেনার সংখ্যা আফ্রিকায় খুবই কম ছিল। অথচ এটিই একমাত্র সাইট যা কোনো তথ্য গোপন করে না। অ্যান্টেনার এই স্বল্পতা, প্রকল্পের শুরুতে আমাদের জন্য বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সমাধানের জন্য, আমি নিজেই কয়েকটি অ্যান্টেনা বসাই। বিষয়টি শুনতে সাধারণ মনে হলেও, আসলে বেশ কঠিন। কারণ অ্যান্টেনাটি বসানোর সবচেয়ে ভালো জায়গা কোনটি, তার আশেপাশে বিদ্যুৎ আছে কিনা, তার দায়িত্বে কে থাকবে – এসব বিষয়ে নিশ্চিত হতে হয়।”
গেইল ফোর জিআইজেএনের সহযোগী সম্পাদক। তিনি এর আগে ফ্রান্স ২৪ চ্যানেলে সামাজিক মাধ্যম থেকে খবর সংগ্রহ এবং তা যাচাইয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি নিউজ ডিপলির সম্পাদক ছিলেন এবং টাইম ম্যাগাজিনে লিখেছেন।