প্রবেশগম্যতা সেটিংস

লেখাপত্র

বিষয়

গণতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান সংকটে নেপাল সেন্টারের ২৫ বছর উদযাপন

আর্টিকেলটি পড়ুন এই ভাষায়:

English

অভিজ্ঞ সাংবাদিক কুন্দা দীক্ষিত বলেন, নেপালের প্রথাগত গণমাধ্যমগুলো কোভিড মহামারির ধাক্কায় আক্রান্ত হয়েছে, যা সামাজিক নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্মের প্রসারের কারণে আগে থেকেই পাঠক সংকোচনে ভুগছিল। ছবি: শাটারস্টক

সম্পাদকের নোট: আমাদের মূল সদস্যদের অন্যতম, সাড়া জাগানো সংগঠন সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম — নেপালের রজত জয়ন্তী উদযাপন করতে পেরে জিআইজেএন গর্বিত।  (১৯৮৯ সালে ফিলিপাইন সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের পথ ধরে) এশিয়ার দ্বিতীয় অলাভজনক অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম হিসেবে যাত্রা শুরু হয় নেপাল সিআইজের। শুরু থেকে তাদের কর্মীরা দেখিয়েছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় গণমাধ্যমের প্রতিকূল পরিবেশে কীভাবে একটি নিরেট অলাভজনক কাঠামো টিকে থাকতে পারে, সামনে এগিয়ে যায় এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। এখানে, নেপাল সিআইজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা অভিজ্ঞ নেপালি সাংবাদিক কুন্ড দীক্ষিত, তাদের সংগ্রামের ২৫ বছরের চিত্র তুলে ধরেছেন।

আজ সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম – নেপালের ২৫তম বার্ষিকীতে কথা বলার সুযোগ পাওয়াটা আমার জন্য সম্মানের।

একদিকে এটি আনন্দের উপলক্ষ্য। আর অন্যদিকে, এটি মনে করিয়ে দেয়, আমরা সবাই কতটা বুড়িয়ে গেছি।  গণমাধ্যমে যাযাবর সময় শেষ করে আমার নেপালে ফিরে আসারও ২৫ বছর পেরিয়েছে।

ফিলিপাইন সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (পিসিআইজে) এর সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা থেকে আমরা নেপালে একইরকম একটি সেন্টার চালু করার উৎসাহ পেয়েছিলাম। বাস্তবে, ১৯৯৭ সালে সিআইজে – নেপাল প্রতিষ্ঠার পর এটিই হয়ে ওঠে এশিয়ার দ্বিতীয় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কেন্দ্র। আমরা নেপালি সাংবাদিকদেরকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নীতি ও চর্চার প্রশিক্ষণ দিতে পিসিআইজের শিলা করোনেলকে নেপালে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রভাব বোঝা যায় যখন সেটি ক্ষমতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্য বলতে পারে এবং যারা ক্ষমতার চর্চা করেন তাদের নাড়িয়ে দিতে পারে। ক্ষমতার অপব্যবহার উন্মোচন করে পিসিআইজে দেশটির প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিল।

সেন্টার অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম – নেপাল হয়ত কোনো প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করেনি, তবে গত ২৫ বছরে এটি ক্রমাগত বিদ্যমান ব্যবস্থাকে নাড়া দিয়েছে, অন্যায় ও অবিচারের ঘটনা প্রকাশ্যে এনেছে এবং ক্ষমতাসীনদের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অনেকটা রাবার ব্যান্ডের মতো; একে কাজে লাগাতে হলে টানতে হবে। একইভাবে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেবল এর সর্বোচ্চ প্রয়োগের মাধ্যমেই সুরক্ষিত হতে পারে।

তাই আমাদের দৈনিক রিপোর্টিং এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। গভীরতাসম্পন্ন কভারেজের জন্য ধৈর্য্য, কঠিন ও বিপজ্জনক কর্মকাণ্ড, সময় ও সম্পদ প্রয়োজন।

কেবল সংবাদ সম্মেলনে যোগদান করলে বা সংবাদ বিবৃতি লিখলেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে না। পক্ষপাতদুষ্ট হলে বা ক্লিকবেইটে নিজেকে সঁপে দিলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ানোকে সমর্থন দেওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের কাজ অপকর্ম উন্মোচন করা। এরপর, দায় আসে গণতন্ত্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর: আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ।

নেপাল ও সারা বিশ্বে – এমনকি বহুত্ববাদ, সহনশীলতা ও আইনের শাসনের দীর্ঘ ঐতিহ্য সমৃদ্ধ দেশগুলোতেও – গণতন্ত্র আজ পিছিয়ে পড়েছে। গণতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভ (আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগ) যখন নড়বড়ে, তখন একটি রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোকে ঠেকা দেওয়ার দায় গিয়ে পড়ে চতুর্থ স্তম্ভের ওপর।

ক্ষমতাসীনেরা যেখানে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় আড়াল করে, গণমাধ্যম সেখনে নিরপেক্ষ ও ন্যায়পরায়ণতায় বলীয়ান হয়ে অন্ধকারে আলো হাতে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে। সাংবাদিকের স্বাধীনতাই কেবল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নয়, বরং আমরা গণমাধ্যমকর্মীরা নাগরিকের তথ্য অধিকারের রক্ষক মাত্র।

২০১৬ সালে কাঠমন্ডুতে জিআইজেএনের আইজেএশিয়া সম্মেলনের একটি অধিবেশন, যেখানে সিআইজে – নেপাল সহ-আয়োজক ছিল। বাম থেকে: উমর চিমা (পাকিস্তান), ইয়াসুওমি সাওয়া (জাপান), রিতু সারিন (ভারত)। ছবি: জিআইজেএন

নেপালে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার চর্চা সহজ নয়। আকারে দেশটি ছোট না হলেও এখানে একটি ছোট অভিজাত শ্রেণী আছে, যেখানে ক্ষমতার কেন্দ্র, ব্যবসা ও গণমাধ্যমের মালিকানা একই কক্ষপথে আবর্তিত হয়। এদের সবাই একে অন্যকে চেনে এবং প্রায়ই তারা একে অন্যের স্বার্থ রক্ষা করে। এ কারণেই নেপালের গণমাধ্যমে প্রশ্ন করার ধারাটি তেমন বিকশিত হয়নি।

সামাজিক নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্মের প্রসারের কারণে পাঠাভ্যাসের সংকোচনে ইতিমধ্যেই ভুগতে থাকা নেপালের প্রথাগত গণমাধ্যম কোভিড মহামারির ধাক্কায়ও আক্রান্ত হয়েছে। সম্প্রতি ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর জ্বালানি ও খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতির ফলে বিজ্ঞাপন ও বিক্রয় থেকে গণমাধ্যমের আয় আরও হ্রাস পেয়েছে।

প্রতিবেশী দেশ ও বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের সংকটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের গণমাধ্যমের ব্যবসায়িক মডেলে ধস নেমেছে – তাও এমন একটি ক্ষণে যখন গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রসারে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রয়োজন অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

নেপালের ব্রডশিট সংবাদপত্র অন্য কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গে নয়, বরং ফেসবুকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর আর টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট নিয়ে ভাবনার অবকাশ নেই, কারণ প্রকৃত আয়ের ক্ষেত্রে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী টিকটক।

বিশ্বের বৃহত্তম ও প্রাচীনতম গণতন্ত্রের দেশগুলোতে আইনের শাসনকে পবিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হত, অথচ ট্রল আর্মি ও বট ফ্যাক্টরি দিয়ে ইন্টারনেট কারসাজির মাধ্যমে জনতুষ্টিবাদী নেতারাই নির্বাচিত হচ্ছেন। জনতুষ্টিবাদ, উগ্র-জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ ও ঘৃণাসূচক বক্তব্য  টোটকা হিসেবে বিস্ফোরকের মতো কাজ করে, আর এগুলোকে ব্যবহার করে এই নেতারা প্রথাগত রাজনীতিতে আস্থাহীন নাগরিকদের দলে ভেড়াতে পারেন।

ট্রাম্প হয়ত হেরে গেছেন, কিন্তু ট্রাম্পবাদ বেঁচে আছে এবং ভালোভাবেই আছে। ফিলিপাইনে, সামাজিক ওয়েব ব্যবহার করে দেশটির প্রেসিডেন্ট বং বং মার্কোসের নির্বাচিত হওয়ার ঘটনায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়েছে।

ভারত নিয়ে যত কম বলা যায় ততই ভালো। নেপালে আমাদের একটি শিক্ষা হলো, আমাদের স্বাধীনতাকে প্রশ্নাতীত মনে না করা। টিকে থাকা অল্প কয়টি স্বাধীন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর একটি এনডিটিভি সম্প্রতি মোদির বিশ্বস্ত সহচর বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি গৌতম আদানির কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছে।

ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার নিয়ে আরও সচেতন হওয়া, আর প্রয়োজনে, ব্যবসায়ের কিছু কৌশল রপ্ত করা ছাড়া প্রথাগত গণমাধ্যমের সামনে কোনো বিকল্প নেই। মূলধারার গণমাধ্যমকে অবিলম্বে মিথ্যা, গুজব ও “অল্টারনেটিভ ফ্যাক্ট” শুধরে নিয়ে ব্যবসায় টিকে থাকতে হবে।

সংবাদমাধ্যমের অবশ্যই ডিজিটাল ভিজ্যুয়াল দক্ষতা থাকতে হবে যেন অনুসন্ধানী স্টোরিগুলো কেবল বলা না হয়, বরং দেখানো যায়। সাংবাদিকতার একটি নতুন ভূমিকা ও দায়িত্ব আছে: ইন্টারনেটে পাওয়া প্রাথমিক, সরাসরি তথ্যের বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা, এবং বিশ্বব্যাপী সন্দেহ ও হতাশা ছড়ানোর এই সময়ে সমাধানও বাতলে দেওয়া।

পুরনো গণমাধ্যম এখনো মরে যায়নি, বরং বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছানো বুনো নিউ মিডিয়ার লাগাম টানতে এটি  আমাদের আগের চেয়ে বেশি প্রয়োজন।

আরও পড়ুন

সাউথ এশিয়া’স প্রেস ফ্রিডম: প্রোপাগান্ডা হ্যাজ লিমিটস

ইনভেস্টিগেটিভ রিসোর্সেস ফর ট্র্যাকিং অথরটারিয়ান থ্রেটস

হাও দে ডিড ইট: ইনভেস্টিগেটিং দ্য ট্রাফিকিং অব গার্লস ফ্রম নেপাল টু দ্য গাল্ফ


Kunda Dixitকুন্ড দীক্ষিত কাঠমান্ডুর সাপ্তাহিক ইংরেজি পত্রিকা নেপালি টাইমসের প্রকাশক। তিনি “ডেটলাইন আর্থ: জার্নালিজম অ্যাজ ইফ দ্য প্ল্যানেট ম্যাটার্ড” শীর্ষক গণমাধ্যম বিষয়ক পাঠ্যবইয়ের লেখক এবং নেপালের গৃহযুদ্ধ নিয়ে রচিত বহুল প্রশংসিত তিন পর্বের একটি ফটোবুক রচনার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি কাঠমান্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতাও পড়ান।

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

টেকসইতা পদ্ধতি

সাংবাদিকতার প্রভাব পরিমাপ — আমরা নতুন যা জানি

সব সংবাদমাধ্যমই চেষ্টা করে তাদের রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে সমাজে প্রভাব তৈরির জন্য। কিন্তু এই প্রভাব পরিমাপ করার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমগুলো ব্যবহার করে একেক ধরনের সূচক। পড়ুন, এ নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণার মাধ্যমে নতুন কী জানা গেছে।

কেস স্টাডি টেকসইতা

সফল অনুসন্ধানী স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠায় ১০ পরামর্শ

ছোট্ট একটি আইডিয়া থেকে সফল একটি অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সময় ও দৃঢ়সংকল্প। এখানে আপনাকে এমন অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে হয়, যেগুলো হয়তো একজন সাংবাদিক হিসেবে আপনি কখনো বিবেচনায় নেননি। পড়ুন, সফল অনুসন্ধানী স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা বিষয়ে কুইন্টো এলিমেন্টো ল্যাবের সহ-প্রতিষ্ঠাতা আলেজান্দ্রা জ্যানিকের এই ১০টি পরামর্শ।

টেকসইতা সংবাদ ও বিশ্লেষণ

‘আমরা আজন্ম ডিজিটাল’: মালয়েশিয়াকিনির সাফল্য নিয়ে প্রেমেশ চন্দ্রন

মালয়েশিয়ার বেশিরভাগ গণমাধ্যম যখন সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন, তখন স্বাধীন সংবাদ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভাব ঘটে মালয়েশিয়াকিনির। অল্প সময়ের মধ্যে তারা হয়ে ওঠে জনপ্রিয়, আস্থাভাজন এবং ব্যবসা-সফল। গ্রাহকদের দেয়া টাকার ওপর ভিত্তি করে তারা গড়ে তোলে একটি স্বাধীন ব্যবসায়িক মডেল। এই যাত্রার নেপথ্যে ছিলেন প্রেমেশ চন্দ্রন। তিনি মালয়েশিয়াকিনির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, যিনি সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন তরুণদের হাতে।

Protest against violence by the Venezuelan government, 2017

কেস স্টাডি টেকসইতা

‘অন্ধকারে আলো জ্বালো’: সঙ্কটাপন্ন ভেনেজুয়েলায় স্বাধীন নিউজ সাইট 

অন্ধকারে আলো ছড়ানোর এই স্বপ্নের শুরুটা হয়েছিল ক্যাফেতে বসে আড্ডা-আলাপের মাধ্যমে। ২০১৫ সালে ভেনেজুয়েলার চরম আর্থিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে যাত্রা শুরু করে ইফেক্তো কোকুইয়ো (ইংরেজি অর্থ- জোনাকির প্রভাব)। প্রথম সপ্তাহেই তারা টুইটারে পেয়েছিল ১৮ হাজার ফলোয়ার। ছয় বছর পর এসে সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ৭,২৪,০০০। পড়ুন তাদের এই বিস্ময়কর যাত্রার গল্প।