

অ্যাপভিত্তিক যুগ শুরুর আগে, সালটা ১৯৯৫। তখন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ আর চ্যাট রুম ছিল অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যম। আর সেই সময়ে গড়ে ওঠা ম্যাচডটকম ছিল প্রথম অনলাইন ডেটিং সাইট। সাইটটির মূল কোম্পানি ম্যাচ গ্রুপ ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এখন বিশ্বের অনলাইন ডেটিং বাজারের অর্ধেক নিয়ন্ত্রণই তাদের হাতে। গ্রুপটির টিন্ডার, বাম্বল, হিঞ্জ, প্ল্যানটিঅবফিশ এবং ওকেকিউপিড প্লাটফর্ম ব্যবহার করে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ খুঁজে ফিরছে তার ভালোবাসা।
ম্যাচ গ্রুপের দাবি তাদের অ্যাপগুলো ৭৫০ মিলিয়ন বার ডাউনলোড হয়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা ও জরিপ সংস্থা ইপসোস পরিচালিত রিলেশনশিপ রিপোর্টের দাবি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ শতাংশ সম্পর্কের শুরুই হয় অনলাইনে। পরিসংখ্যানগুলো একটি গুরুতর প্রশ্ন সামনে আনে; মুনাফা-নির্ভর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মানুষ যখন পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে, তখন এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী হতে পারে? প্রধান এবং তাৎক্ষণিক উদ্বেগ ব্যবহারকারীর নিরাপত্তা—বিশেষ করে সেসব অ্যাপের ক্ষেত্রে, যেগুলো অফলাইনে দেখা-সাক্ষাৎ বা মেলামেশার সুযোগ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি।
চলতি বছর জাতিসংঘ নারীর বিরুদ্ধে অনলাইন আক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে সতর্ক করেছে। এই প্রবণতা অনলাইনের বাইরে অফলাইনেও প্রভাব ফেলতে পারে। ২০২২ সালে, ব্রিগহ্যাম ইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ৩ হাজারেরও বেশি যৌন নির্যাতনের ঘটনা পর্যালোচনা করে তা প্রকাশ করেন। সেখানে দেখা যায়, অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে অপরাধীর সঙ্গে নির্যাতিতের পরিচয়ের ফলে সংঘটিত যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো দ্রুত ঘটে ও বেশি সহিংস হয়।
পুলিৎজার সেন্টার এআই অ্যাকাউন্টেবিলিটি ফেলো এবং দ্য ডেটিং অ্যাপস রিপোর্টিং প্রজেক্ট-এর প্রধান প্রতিবেদক এমিলি এলেনা ডাগডেল বলেন, “গবেষণাটি ভয়ংকর।” ডাগডেল জানান, বিওয়াইইউ’র (ব্রিগহ্যাম ইয়াং ইউনিভার্সিটি) এই গবেষণা থেকেই তাদের ১৮ মাসব্যাপী অনুসন্ধানের সূত্রপাত। যেটির মূল লক্ষ্য ছিল ম্যাচ গ্রুপ কীভাবে ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা রক্ষা করছে, এবং “ডেটিংকে আরও নিরাপদ করার” অঙ্গীকার কতটা বাস্তবায়ন করছে, তা খতিয়ে দেখা।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে, লস অ্যাঞ্জেলেসভিত্তিক সাংবাদিক এমিলি এলেনা ডাগডেল এবং বে অঞ্চলের পয়েন্টার ফেলো হানিশা হারজানি যৌথভাবে প্রকাশ করেন ‘রেইপ আন্ডার র্যাপস: হাউ টিন্ডার, হিঞ্জ অ্যান্ড দেয়ার কর্পোরেট ওনার চোজ প্রফিটস ওভার সেফট ‘ প্রতিবেদন । অনুসন্ধানী এই প্রতিবেদনটি গার্ডিয়ান এবং নাইনটিন্থে (The 19th) প্রকাশিত হয়। ম্যাচ গ্রুপের নিরাপত্তা সুরক্ষা বিভাগ কেন যৌন সহিংসতা-সম্পর্কিত প্রতিবেদনের যথাযথ জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছে এখানে সেই সব অসঙ্গতিগুলো বিশ্লেষণ করা হয়। অনুসন্ধানী এই প্রতিবেদনটি সম্পাদনা করেছেন সাংবাদিক অ্যারন গ্লান্টজ এবং অলাভজনক সংবাদমাধ্যম দ্য মার্কআপের সিসি ওয়েই।
“বিভিন্ন কোম্পানি ও ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠান নিয়ে ভালোভাবে খোঁজখবর নেওয়ার পর তারা আপনাকে যতই আশ্বস্ত করার চেষ্টা করুক তাদের সেবা ব্যবহার করলে আপনি সুরক্ষিত থাকবেন বা সবকিছু ঠিকঠাক চলবে, তারপরও আপনার মনে খানিকটা সংশয় থাকা স্বাভাবিক। অনলাইনে কয়েক দশক ধরে সক্রিয় থাকলে আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে অনলাইন পরিসর নিয়ন্ত্রণ করা মোটেও সহজ কাজ নয়।”— বলেন ডাগডেল।

ম্যাচ-এর ডেটিং অ্যাপগুলোর গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা প্রটোকলের ব্যর্থতা কীভাবে পদ্ধতিগত শোষণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে অনুসন্ধানের মাধ্যমে তা তুলে ধরেছেন হানিশা হারজানি (বাঁয়ে) এবং এমিলি এলেনা ডাগডেল (মাঝে)। অ্যারন গ্লান্টজ প্রতিবেদনটি সম্পাদনায় সহায়তা করেছেন। ছবি: লেখকদের সৌজন্যে
“যেখানে বাস্তবের কোনো বাউন্সার নেই”
অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গোপন নথি অনুসারে কোম্পানিটি ২০১৬ সাল থেকেই তাদের ডেটিং অ্যাপের অসভ্য আচরনকারীদের সম্পর্কে জানতো। এরপরও তারা “লাখ লাখ মানুষকে অন্ধকারে রেখে” দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই বিষয়ে যথাযথ তথ্য প্রকাশ ও সমস্যার সমাধানে আইনপ্রণেতাদের পক্ষ থেকে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চাপ—থাকা সত্ত্বেও তারা তা উপেক্ষা করে।
অনুসন্ধানের শুরু ডেনভারভিত্তিক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ স্টিফেন ম্যাথিউসের মামলা দিয়ে। অ্যাপ হিঞ্জের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে একাধিক নারীকে মাদক দিয়ে নির্যাতন, আক্রমণ ও ধর্ষণের অভিযোগে ২০২৪ সালের অক্টোবরে ম্যাথিউসের ১৫৮ বছরের কারাদণ্ড হয়। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, একাধিক নারী তাকে নিয়ে রিপোর্ট করা সত্ত্বেও ম্যাথিউসকে বারবার ম্যাচ অ্যাপে ফেরত আসতে দিয়েছে। ফলে ম্যাথিউসিও নির্যাতন চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এমনকি পুলিশের কাছে রিপোর্ট করার পরও অ্যাপে তাঁর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। একমাত্র গ্রেপ্তারের পরই কেবল তাকে ম্যাচ অ্যাপে নিষিদ্ধ করা হয়।
ডাগডেল বলেন, ধরুন, আপনি কোনো বারে গিয়েছেন আর সেখানে কেউ একজন আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। বারটেন্ডার বা সেখানে থাকা বাউন্সারকে বিষয়টি জানালে সে অবিলম্বে ওই ব্যক্তিকে বার থেকে বের করে দিবে। কিন্তু অ্যাপগুলোর ক্ষেত্রে তো বাউন্সারদের বিষয়টি খাঁটে না। এখানে তো রক্তমাংসের কোনো বাস্তব বাউন্সার নেই। তাই অসৎ উদ্দেশ্যধারী এই মানুষগুলো আবার ফিরে আসতে পারে।”
ম্যাচ গ্রুপের নিরাপত্তা নীতি অনুযায়ী, কোনো ব্যবহারকারীর আক্রমণাত্বক বা অসদাচারণের জন্য রিপোর্ট করা হলে, তখন ওই ব্যবহারকারীর সাথে সম্পর্কিত সব অ্যাকাউন্টকে তাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে নিষিদ্ধ করা হবে। তাদের তালিকাভুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে: ভাষা ও ছবির জন্য “রেড-ফ্ল্যাগ”, প্রতারণামূলক প্রোফাইল শনাক্তের জন্য স্বয়ংক্রিয় স্ক্যান পদ্ধতি এবং সন্দেহজনক প্রোফাইল ও ব্যবহারকারীদের রিপোর্টের বিপরীতে ম্যানুয়াল পর্যালোচনা।
ব্যবহারকারীরা ইন-অ্যাপ টুলস ব্যবহার করে রিপোর্ট করতে পারেন। অনুসন্ধানী এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যবহারকারীদের পক্ষ থেকে আসা ধর্ষণ ও আক্রমণ বিষয়ক রিপোর্টের তথ্য ২০১৯ সাল থেকে একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেসে সংরক্ষণ করা হয়। কোম্পানি সূত্র বলছে, ২০২২ সাল নাগাদ সেনটিনেল নামে পরিচিত পদ্ধতিটি প্রতি সপ্তাহে শত শত ঘটনা নথিভুক্ত করতে শুরু করে। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে নিজদের কর্মী ও বাইরের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের সামনে একটি প্রেজেন্টেশন দেওয়া হয়। ডেটিং অ্যাপ রিপোর্টিং প্রকল্প ওই প্রেজেন্টেশনটি সংগ্রহ করে। তাতে দেখা যায়, ঠিক কী পরিমাণ তথ্য ব্যবহারকারীদের কাছে প্রকাশ করা উচিত সে বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চিত ছিলেন না।
ব্যবহারকারীদের পক্ষ থেকে রির্পোট করার পর কর্তৃপক্ষ কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে তা জানার জন্য, দলটি প্রতিষ্ঠানটির শতাধিক পৃষ্ঠার গোপন নথি এবং আদালতের রেকর্ড পর্যালোচনা করেছে। ম্যাচ গ্রুপ পাবলিক কোম্পানি হওয়াতে সাংবাদিকেরা এসইসি (সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন)-এ দাখিল করা আনুষ্ঠানিক আর্থিক ও ব্যবসায়িক নথিপত্র এবং বিনিয়োগ রিপোর্টগুলোও দেখার সুযোগ পায়। তাঁরা ডজনখানেক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ও প্রাক্তন কর্মচারী এবং যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া ব্যক্তি।
ম্যাথিউসের বিরুদ্ধে কলোরাডোতে চলমান মামলার ওপর প্রতিবেদন তৈরির পাশাপাশি সমান্তরালে এই অনুসন্ধানটিও চালিয়ে যাওয়া হয়। এমন একাধিক নারীকে খুঁজে বের করা হয়, যাঁরা ম্যাথিউসের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। যদিও তাঁরা সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হননি। অনুসন্ধানী দলের পক্ষ থেকে তাদের সিদ্ধান্তকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করা হয়। তবুও কিছু তথ্য প্রতিবেদনে কলোরাডো-ভিত্তিক প্রতিবেদক স্ট্রিংগার স্টেফানি উলফের সহায়তায় সংগ্রহ করে আদালতের শুনানিতে যুক্ত করা হয়েছে।
“আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ঘটনা ও হামলার অপ্রয়োজনীয় বিবরণ এড়ানো। আমি চাইনি যে এগুলো কাহিনীর মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠুক,” বলেন ডাগডেল। তিনি হারজানির সাথে মিলে আদালতের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীদের গল্প তুলে ধরেন, কিন্তু কোনোভাবেই অসংবেদনশীভাবে উপস্থাপন করেননি।
“আমি চেয়েছিলাম পাঠকরা যেন অন্তত এতটুকু বুঝতে পারেন যে, এই ধরনের ঘটনা কত সহজেই ঘটতে পারে। তাঁরা যেন ওই ভয়টা উপলব্ধি করতে পারেন—যখন কেউ জানেন যে, তাঁর সাথে কী ঘটছে, সেসব কিছুই তিনি মনে রাখতে পারছেন না। এর কারণ তাকে মাদক দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ভুক্তভোগী নারীদের শরীরে যে প্রমাণ ছিল, তা নির্যাতনের ভয়াবহতাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।” ওই নারীদের প্রতিনিধিত্বকারী আইনজীবীরা জানান, ম্যাথিউসকে প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল।
যেসব ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট কোম্পানি তাদের অ্যাকাউন্টগুলো নিষিদ্ধ করছে কিনা—তা বোঝার জন্য সাংবাদিক দলটি একটি অনুসন্ধানমূলক ডেটা-ভিত্তিক পরীক্ষা চালান। দ্য মার্কআপের নাতাশা উজকাটেগুই-লিগেটের সাথে কাজ করে। তাঁরা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ৫০টির বেশি অ্যাকাউন্ট তৈরি করেন। তাঁরা দেখেন, যৌন নির্যাতনের অভিযোগে রিপোর্ট করা অ্যাকাউন্টগুলো সাধারণত দুই দিনের মধ্যে নিষিদ্ধ করা হয় ঠিকই, কিন্তু একই তথ্য ব্যবহার করে বা বায়োতে সামান্য পরিবর্তন এনে নতুন অ্যাকাউন্ট তৈরি করাটা মোটেও কঠিন কিছু নয়। এই প্রক্রিয়ায় তাঁরা এমন কিছু অনলাইন গাইডও খুঁজে পান, যেখানে দেখানো হয়েছে নিষিদ্ধ হওয়ার পর ডেটিং অ্যাপে কীভাবে ফিরে আসা যায়।
যদিও এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানির কাছে এমন প্রযুক্তি ও নিয়মকানুন আছে, যাতে অপরাধীরা আবার সহজে অ্যাপে ফিরতে না পারে। কিন্তু তাদের নিজস্ব গোপন নথিমাফিক প্রতিষ্ঠানটি ইচ্ছে করেই এসব নিয়ম সব অ্যাপে চালু করতে চায়নি। কারণ তারা মনে করে, এতে নিরাপত্তা বাড়লেও ব্যবসার প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে।
ম্যাচ গ্রুপের ভেতরের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কোম্পানির “পরিসংখ্যান ঘিরে অতিরিক্ত মনোযোগ এবং তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা” অনেক সময় হতাশাজনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। একটি সূত্র খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন, নিরাপত্তাখাতে বিনিয়োগের যে প্রতিশ্রুতি ম্যাচ গ্রুপ বারবার দিয়ে আসছে, তা আসলে “নিরাপত্তার নাটক” মাত্র।
ডেটিং অ্যাপস রিপোর্টিং প্রজেক্ট তাদের অনুসন্ধানের বিস্তারিত তথ্যসহ ম্যাচ গ্রুপকে একটি চিঠি পাঠায়। এর জবাবে ম্যাচ গ্রুপ একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দেয়। তারা এই বিষয়টি অস্বীকার করেনি যে, হয়রানির ঘটনা নথিভুক্ত করা সত্ত্বেও তারা সেগুলো জনসাধারণের সাথে ভাগাভাগি করেনি। তবে তারা নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার পক্ষে সাফাই গেয়েছে: “আমরা প্রতিটি অনিয়মের অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করি এবং এ ধরনের আচরণকারীদের অ্যাকাউন্টগুলোকে সতর্কতার সাথে সরিয়ে দিই ও ব্লক করি।” তারা দাবি করে, এই খাতে অর্থাৎ “হয়রানি ঠেকাতে এআই টুল, প্রোফাইল যাচাইয়ের জন্য আইডি ভেরিফিকেশন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে যোগাযোগ করতে বিনিয়োগ” করছে।

রিপোর্টিং দলের হাতে আসে ম্যাচ গ্রুপের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের কিছু দলিল। কর্মীরা যেখানে কোম্পানির প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এসব লক্ষ্যমাত্রা পূরণের চাপ ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। ছবি: স্ক্রিনশট, দ্য মার্কআপ।
সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলো কেন নারীদের কোনো কাজেই আসছে না
ডাগডেল আগে অপরাধবিষয়ক বিট রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতেন। এই অভিজ্ঞতা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে তাকে “ট্রু ক্রাইম ঘরানার” গল্প বলার ধরন এড়িয়ে চলতে সহায়তা করেছে। এর পরিবর্তে তিনি প্রতিবেদনে দেখাতে চেয়েছেন, কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব ফেলে।
“আমি চেয়েছিলাম সবার নজর পড়ুক ও দায় চাপুক সেসব কোম্পানির ওপর, যারা মূলত এই ধরনের পুরুষকে (যারা সহিংসতা চালাচ্ছে) এই কাজগুলো করার অনুমোদন দেয়। অবশ্যই এর মধ্যে সব লিঙ্গের লোকই আছে,” বলনে ডাগডেল।
পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. আলেসিয়া ট্রাঞ্চেসের কাছে গল্প বলার এই পদ্ধতিটি ভালো লেগেছে। তিনি ডিজিটাল মিডিয়া এবং নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি বলেছেন, কীভাবে এই প্রতিবেদনটি “একটি ব্যক্তিগত ঘটনা দিয়ে শুরু হয়ে বৃহত্তর সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছ। বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা হয়নি। ধর্ষণ বিষয়ক প্রচলতি প্রতিবেদন থেকে এটি ভিন্ন। এই প্রতিবেদনটি বরং নারীর প্রতি পুরুষের সহিংসতা সমর্থনকারীদের পদ্ধতিগত বৃহত্তর কাঠামোকে তুলে ধরেছে।”
জিআইজেএনকে ড. ট্রাঞ্চেসে বলেন, “সাংবাদিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যৌন সহিংসতার প্রতিটি ঘটনাকে আলাদা কোনো বিষয় বা সমাজের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে না দেখে নারীর প্রতি পুরুষের নির্যাতনের নির্দিষ্ট ধরন হিসেবে দেখা।”
বার্লিনের ফ্রি ইউনিভার্সিটির মিডিয়া বিষয়ক গবেষক ও সাবেক সাংবাদিক ড. তং-জিন স্মিথ মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে যে বিরোধিতা দেখা যাচ্ছে, তা ডেটিং অ্যাপসে মানুষের আচরণের সাথে সম্পর্কিত।
“আমার দৃষ্টিতে ডেটিং অ্যাপস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেরই একটি বর্ধিত রূপ। একই ধরনের চিন্তা থেকে এসেছে এবং আরও বেশি পণ্য হিসেবে পরিণত করার দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে,” বলেন স্মিথ। তিনি ডিজিটাল অর্থনীতির গভীর সমস্যাগুলো প্রকাশ করতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার গুরুত্বের কথাও বলেন।
“মানুষকে ক্ষমতায়ন করাটা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা যেন জানে তাঁরা কী করছে। যেন তাঁরা বুঝতে পারে যে, অপর প্রান্তে রক্তমাংসের একজন মানুষ রয়েছে। তাই পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সম্মানজনক আচরণ করাটা জরুরি,” ড. স্মিথ বলেন।
স্কুলগুলোতে তিনি মিডিয়া সাক্ষরতার প্রশিক্ষণ দেওয়ার পক্ষে। তাঁর মতে, যাতে তরুণেরা বুঝতে পারে কিভাবে প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতি এবং অ্যাপে-ঠাসা বিশ্বব্যবস্থার সামাজিক চাপ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণকে প্রভাবিত করে নারীর প্রতি সহিংসতাকে আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। তিনি এখানে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর জোর দিয়েছেন, যা সমস্যার সমাধান খোঁজার জন্য প্রয়োজনীয়।
ডেটিং অ্যাপ ব্যবহারকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে সক্ষম হওয়াটা ছিল এই অনুসন্ধানের মূল উদ্দেশ্য। “আমি আশাবাদী যে, আমরা ভবিষ্যতে কিছু বাস্তব ও স্থায়ী পরিবর্তন দেখতে পাব,” বলেন ডাগডেল। আরো জানান তিনি ও তাঁর দল ডেটিং অ্যাপ কোম্পানির কর্মী এবং প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর আক্রান্ত নারীদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এই প্রতিক্রিয়া মার্কিন আইনপ্রণেতাদের পুনরায় আগ্রহী করেছে এবং তাঁরা আশা করছেন যে বাড়তি চাপ হয়তো ম্যাচ গ্রুপের অগ্রাধিকারগুলোকে পরিবর্তন করতে পারবে।
“ন্যায়বিচারের চাকা ঘুরতে সত্যিই খানিকটা সময় নেয়,” আরও যোগ করেন তিনি।
সারা কারাকস বার্লিনে বসবাসকারী একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি ইউরোপিয়ান জার্নালিজম ওবজারভেটরির ফেলো ছিলেন। তাঁর কাজ সিএনএন, ডার শপিগেল, দ্য নিউ স্টেটসম্যান এবং সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে প্রকাশিত হয়েছে।