প্রবেশগম্যতা সেটিংস

অলংকরণ: ন্যুক

লেখাপত্র

বিষয়

এশিয়ায় ডেটা সাংবাদিকতা: বার্তাকক্ষ, তথ্য-উপাত্ত আর গোষ্ঠী সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবা

নিয়ন্ত্রিত ডেটা নীতি, রাজনৈতিক চাপ আর সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও এশিয়া জুড়ে ডেটা সাংবাদিকতা নিয়ে কাজ করছে এমন বার্তাকক্ষগুলো নিজেদের লক্ষ্য নির্ধারণ আর নতুন গল্প বলার উদ্ভাবনী উপায় খুঁজে নিয়েছে। ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং ফিলিপাইনের ডেটা সাংবাদিকতা বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে দেখাচ্ছে, কীভাবে সাংবাদিকরা পরিবর্তনশীল মিডিয়া পরিবেশ এবং সরকার ও কোম্পানিগুলোর ডেটা ব্যবহারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন।

এই অঞ্চলের চ্যালেঞ্জগুলো খুব পরিস্কার: দুর্বল ডেটা ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতার প্রতি রাজনৈতিক বিরোধিতা, অনুদান নির্ভরতা আর বার্তাকক্ষের দুর্বল অবস্থা। কিন্তু গল্প বলার সৃজনশীল পদ্ধতিগুলো—ভিজ্যুয়াল আর্ট থেকে শুরু করে এআই চ্যাটবট এবং প্রশিক্ষণ—শক্তিশালী বার্তা দেয়। এশিয়ার ডেটা সাংবাদিকতা শুধু চার্ট ও ড্যাশবোর্ডে সীমাবদ্ধ নয়; এটি আসলে বার্তাকক্ষ, সম্প্রদায় আর তথ্য-প্রমাণের সম্পর্ককে নতুন করে ভাবার পথ দেখায়।

এই সব সৃজনশীল কাজ আর এর প্রভাবগুলো চলতি বছরের সিগমা অ্যাওয়ার্ডসে বেশ চোখে পড়ে। যেখানে এশিয়ার বেশকিছু সংবাদমাধ্যম সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পায়। এর মধ্যে ছিল মাকারাঙ্গা মিডিয়া, আল জাজিরা, কন্টিনেন্টালিস্ট, রয়টার্স (সিঙ্গাপুর), কমনওয়েলথ ম্যাগাজিন, দ্য রিপোর্টার (তাইওয়ান), ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্যালেস্টিনিয়ান মিডিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার একটি যৌথ প্রকল্প এবং দুবাই আনলকড প্রকল্পে কাজ করা কিছু এশীয় সংবাদমাধ্যম। শেষ পর্যন্ত ২০২৫ সালের পোর্টফোলিও বিজয়ীদের মধ্যে জায়গা করে নেয় সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট—হংকংয়ের গৃহকর্মীদের অদৃশ্য কমিউনিটি এবং তাদের আশ্রয় হিসেবে ব্যবহৃত অবৈধ নির্মাণ নিয়ে করা গ্রাফিক্যাল অনুসন্ধানের জন্য। সিগমা জুরি এটিকে অ্যাখ্যায়িত করেন “একটি অসাধারণ ভিজ্যুয়াল স্টোরি সিরিজ” হিসেবে।

An image from the SCMP's data story about domestic workers in Hong Kong, many of whom live in cramped quarters and endure little privacy. Image: Screenshot

সিগমা অ্যাওয়ার্ডজয়ী এই ডেটা সিরিজে হংকংয়ের গৃহকর্মীদের জীবনচিত্র তুলে ধরা হয়েছে—যেখানে দেখা যায় তারা অনেকেই গাদাগাদি করে ছোট ছোট কক্ষে থাকেন, যেখানে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রাখার সুযোগ একেবারেই সীমিত। ছবি: স্ক্রিনশট

জবাবদিহি আদায়ের জন্য প্রয়োজন ধৈর্য্য

২০১১ সালে, ভারতের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের সময় ব্লুমবার্গ টিভি ইন্ডিয়ার সাবেক প্রধান সম্পাদক গোবিন্দরাজ এথিরাজের হাত ধরে শুরু হয় ইন্ডিয়াস্পেন্ড। শুরু থেকেই  জিআইজেএনের সদস্য প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা। ভারতের প্রথম ডেটা সাংবাদিকতা উদ্যোগ হিসেবে, তাদের সাংবাদিক ও সম্পাদকরা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শাসনব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ, জলবায়ু ও জীবিকা সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণ করছেন—যেখানে তারা শুধু ডেটা কী দেখায় তা নয়, বরং কী গোপন রাখে সেটিও খতিয়ে দেখছেন।

“ডেটা হাতে পাওয়া তার ওপর  নির্ভর করাটা এখনও বড় বাধা। এছাড়া প্রায়ই দেরিতে ডেটা সরবরাহ করা, অসম্পূর্ণ ডেটাসেট, আর পরিবর্তিত পদ্ধতিগত সমস্যার মুখোমুখি  আমরা হই। এর সঙ্গে রয়েছে ডেটা স্বচ্ছতা সীমিত করার নানা বিধিনিষেধ,” বলেন প্রাচি সালভে, ইন্ডিয়াসপেন্ডের রিসার্চ ম্যানেজার।

কিন্তু এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ইন্ডিয়াস্পেন্ড নিয়মিতভাবে তথ্য অধিকার আইনে (আরটিআই) আবেদন করে, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে তথ্য যাচাই করে, এবং এমন ব্যাখ্যামূলক প্রতিবেদন ও ইন্টার‌্যাকটিভ ভিজ্যুয়াল তৈরি করে যেগুলোর মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকরা নিজেরাই এসব তথ্য ব্যবহার করতে পারেন।

এই কঠোর অনুসন্ধান বাস্তব প্রভাব ফেলেছিল। কারখানার নিরাপত্তা নিয়ে তাদের অনুসন্ধানে দেখা যায়, সরকারি তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে নিবন্ধিত কারখানাগুলোতে গড়ে প্রতিদিন তিনজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে (নিচের গ্রাফিকে দেখুন)। এই অনুসন্ধান কেবল আরেকটি মর্মান্তিক পরিসংখ্যানে থেমে যায়নি: ভারতের ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়ে বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে উদ্যোগ নেয়—অর্থাৎ অন্য কারও আবেদন ছাড়াই আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করে—এবং রাজ্য সরকারগুলোর কাছে নোটিশ পাঠায়।

মহামারির সময়, ইন্ডিয়াস্পেন্ড সরকারি জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের তথ্য বিশ্লেষণ করে অতিরিক্ত মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে, তা ভারতের কোভিড-১৯–এর ভয়াবহ প্রভাব নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করে।

উভয় ক্ষেত্রেই মূল বিষয় ছিল শুধু সংখ্যাতত্ত্ব নয়, বরং ধৈর্য, যাচাই-বাছাই এবং গল্পটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা যাতে তা নীতিনির্ধারকদের বাইরেও সাধারণ পাঠকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। “আমরা জটিল পরিভাষা বাদ দিই, সহজবোধ্য তুলনা ব্যবহার করি (‘এক্স রাজ্যে প্রতি দুই শিশুর মধ্যে একজন’—শুধু শতাংশের পরিবর্তে) এবং ইনফোগ্রাফিক, চার্ট ও ইন্টার‌্যাকটিভ ম্যাপের মাধ্যমে জটিল প্যাটার্নগুলোকে সহজবোধ্য করে তুলি,” যোগ করেন প্রাচি সালভে।

নকশার মাধ্যমে ডেটাকে সহজ করে বোঝানো

কন্টিনেন্টালিস্ট-এর পেজগুলো সুন্দর ভিজ্যুয়াল দিয়ে পূর্ণ। যেমন, ‘নেচারের ইউটেনসিলস’ গল্পে দেখানো হয়েছে, শ্রীলঙ্কার সম্প্রদায়গুলো কীভাবে খাবার ও ঐতিহ্যবাহী উপকরণের মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করছে।

কন্টিনেন্টালিস্টের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান পেই ইয়িং লোহ বলেন, “মানুষ প্রায়ই বলে আমাদের সাইটটি দেখতে ‘সুন্দর’,। এর কারণ কিন্তু আমরা এইভাবে নকশা করি বলে নয়। আমাদের লক্ষ্য ‘সহজলভ্যতা’। পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি সাদৃশ্য ও মর্যাদাপূর্ণ উপস্থাপনাও জরুরি। ডেটা ভয় ধরাতে পারে, তবে আমরা চাই মানুষ যেন ডেটাকে স্বাগত জানায়।

প্রতিটি গল্প শুরু হয় কাগজ ও কলম দিয়ে স্কেচ করার মাধ্যমে, পরে কয়েক দফায় এমন মানুষের সঙ্গে যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা করা হয় যারা বিষয়টি আগে জানে না।  এর ফলস্বরূপ তৈরি হয় দীর্ঘস্থায়ী ব্যাখ্যামূলক গল্প—যেমন সিঙ্গাপুরে বাসস্থান বৈষম্য, বালুচিস্তানে জোরপূর্বক গুম, এবং গাজায় সংস্কৃতির বিলুপ্তি— শিরোনাম হারিয়ে গেলেও, যে গল্পগুলোর প্রাসঙ্গিকতা শ্রীলঙ্কার রান্নার গল্পের মতোই দীর্ঘ।

Kontinentalist enforced disappearances in Balochistan

ছবি: স্ক্রিনশট, কন্টিনেন্টালিস্ট

কন্টিনেন্টালিস্টও তাদের সাংবাদিকতার ভূমিকা নতুনভাবে ভাবতে চায়—বিশেষ করে স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোর সঙ্গে সম্পর্কের দিকটি। লোহ ব্যাখ্যা করেন, কখনও কখনও সাংবাদিকতা শোষণমূলক হয়ে ওঠে—“যেখানে আপনি কারও সাক্ষাৎকার নেন, কিন্তু আর কখনও ফিরে যান না।”

‘‘ ‘কমিউনিটি ম্যানিফেস্টো’ তৈরি করে “আমরা সেটি এড়াতে চেয়েছি। এটি নির্দেশনা দেয়—আমরা কীভাবে পাঠক, সহযোগী, অংশীদার এবং বিশেষ করে যেসব গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়গুলোর ওপর রিপোর্ট করি, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলব,” বলেন লোহ। “উদাহরণ হিসেবে বললে, সম্প্রতি আমরা সিঙ্গাপুরের ওরাং লাউট নামের এক আদিবাসী নৌযাত্রী সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করছি। শুধু তাদের নিয়ে গল্প লেখার বদলে, আমরা তাদের নিজস্ব ডেটা সংগ্রহের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করছি। এটাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন—অনেক সময় সবচেয়ে অর্থবহ পদক্ষেপটি আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ নয়, বরং কোনো কমিউনিটিকে নিজের গল্প বলার সক্ষমতা গড়ে তুলতে সহায়তা করা,” বলেন কন্টিনেন্টালিস্ট-এর লোহ।

কন্টিনেন্টালিস্টের ওরাং লাউট সিঙ্গাপুর কোলাবরেশন-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো “ক্ষমতায়ন”। কারণ, এই প্রকল্পটি ডেটা সাংবাদিকতার অর্থকেই নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে—শুধু বাইরের বিশ্বের জন্য কোনো কমিউনিটিকে দৃশ্যমান করা নয়, বরং তাদের নিজেদের ডেটা সংগ্রহ, মালিকানা ও ব্যবহার করার সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করা।

এই প্রতিবেদনে বেলুচিস্তান সংঘাত-সম্পর্কিত নিখোঁজ ব্যক্তিদের নিয়ে গভীরভাবে অনুসন্ধান করে।

সংবাদকক্ষকে মাছ ধরা শেখানো
একটি পুরোনো প্রবাদ আছে—কাউকে মাছ দেওয়ার চেয়ে তাকে মাছ ধরা শেখানোই ভালো। সেই ভাবনা থেকেই ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত পাঞ্চ আপ। ব্যাংককের একটি ডেটা স্টোরিটেলিং স্টুডিও। হাতে-কলমে কাজ করছে ব্যাংকক পোস্টসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে, যাতে তারা ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলিংয়ের দক্ষতা অর্জন করতে পারে।

তিনি আরো বলেন, “শেষ পর্যন্ত আমরা চাই সংবাদমাধ্যমগুলোর নিজেদের দল গড়ে উঠুক। আমরা একা এই কাজ করতে চাই না। আমরা এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চাই, যেখানে মানুষ ডেটার মাধ্যমে যোগাযোগ করবে।”

তাদের প্রকল্পগুলোর পরিসর বেশ বিস্তৃত। যেমন, থাই নাগরিকদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া বোঝাতে সহায়তা করে থেকে শুরু করে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ও বনাঞ্চল হ্রাস বিষয়ে সচেতনতা তৈরি পর্যন্ত। গন ভাইরাল প্রকল্পে পাঞ্চ আপ ব্যাংকক পোস্ট এবং একটি সোশ্যাল-লিসনিং কোম্পানির সঙ্গে মিলে কাজ করে খুঁজে বের করে যে কীভাবে কোভিড-১৯ মহামারি সম্পর্কিত ভুয়া খবর থাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তারা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে যুক্ত করেন, যিনি নেটওয়ার্ক বিশ্লেষণ পরিচালনা করে দেখান কীভাবে গুজব বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে গিয়ে গুচ্ছ আকারে তৈরি হয় এবং রূপান্তরিত হয়।

তবে তাদের মূল উদ্দেশ্য কেবল গল্প বলা নয়। পাঞ্চ আপ এক বছরের দীর্ঘ অংশীদারত্বে গড়ে তোলে। যেখানে তারা থাই পিবিএসসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয় টিমকে ডেভেলপার ও ডিজাইনারদের সঙ্গে কাজ করার প্রশিক্ষণ দেয়। এর লক্ষ্য ছিল এমন দক্ষতা ও পদ্ধতি তৈরি করা, যা সাংবাদিকরা দীর্ঘমেয়াদে নিজেরাই ব্যবহার করতে পারেন। দুয়াংকলাদ ব্যাখ্যা করেন, “আমরা চাই না, একই প্রকল্পের জন্য বারবার আমাদের ভাড়া করতে হোক। আমরা চাই ওপেন ডেটাকে এগিয়ে নিতে, এমন এক সম্প্রদায় গড়ে তুলতে যারা তা নিয়ে কাজ করতে পারে, এবং আমাদের সরে যাওয়ার পরও বার্তাকক্ষগুলো যেন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে পারে।”

এই কারণেই তাদের কাজের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে বুট ক্যাম্প ও ওয়ার্কশপ আয়োজন। দুয়াংকলাদ ব্যাখ্যা করেন, তারা কেবল এককালীন অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন তৈরি করছেন না, বরং প্রচলিত সংবাদকক্ষের ভেতরে ডেটা বোঝাপড়ার সক্ষমতা গড়ে তুলছেন। এটি ধীরগতির হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিবর্তন— এমন এক অঞ্চলে, যেখানে এখনো অনেক সম্পাদক ডেটা সাংবাদিকতাকে মূল দক্ষতা হিসেবে নয়, বরং বিশেষজ্ঞদের কাজ হিসেবে দেখে থাকেন।

থাইল্যান্ডে বনাঞ্চল হ্রাস নিয়ে পাঞ্চ আপের বিশেষ প্রতিবেদনটিতে একটি ইন্টার‌্যাকটিভ উপাদান রয়েছে — এই মানচিত্রে স্থানীয়দের ওপর প্রভাব ফেলা বিভিন্ন মামলা ও অভিযোগের বিস্তারিত দেখানো হয়েছে। ছবি: স্ক্রিনশট

অ্যালগরিদম: যে জবাবদিহির জন্য কেউ অর্থ দিতে চায় না

ইন্ডিয়াস্পেন্ড দেখিয়েছে ধীরে, ধৈর্যের সঙ্গে করা ডেটা-নির্ভর কাজগুলো কতটা শক্তিশালী হতে পারে। তবে অ্যালগরিদম নিয়ে সাংবাদিকতা ডেটা সাংবাদিকতার এক অন্ধ বিন্ধুকেই সামনে আনে। ক্যারেন রেবেলো, রয়টার্স ২০২৫ ফেলো ও বুম লাইভ–এর নির্বাহী সম্পাদক-তিনি স্পষ্টতই বলেন, “অ্যালগরিদমের সামাজিক প্রভাব নিয়ে যে অধিকাংশ ডেটা-ভিত্তিক গবেষণা হয়, সেগুলো অনুদানের অর্থে চলে—প্রধানধারার সংবাদমাধ্যম এতে বিনিয়োগ করছে না।”

রয়টার্স ইনস্টিটিউটের এক গবেষণাপত্রে, যেখানে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন কীভাবে সাংবাদিকরা ভারতে ও তার বাইরেও অ্যালগরিদমকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারেন, রেবেলো লিখেছেন—অ্যালগরিদম প্রভাব ফেলে সব কিছুর ওপর, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ থেকে শুরু করে সমাজের প্রান্তিক ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর ক্রেডিট রেটিং পর্যন্ত। তবে তিনি উল্লেখ করেছেন, এই কাজ মূলত টিকে আছে ফিলানথ্রপি (অনুদানভিত্তিক সহায়তা) ও একাডেমিক অংশীদারত্বের মাধ্যমে, সংবাদমাধ্যমের নিজস্ব তহবিলের ওপর নয়।

অ্যালগরিদম যাচাই (অ্যালগরিদম অডিট) করতে লাগে বিশেষ দক্ষতা, দীর্ঘ সময়, এবং অনেক ক্ষেত্রে আইনি সহায়তা — যা অধিকাংশ বাণিজ্যিক সংবাদমাধ্যমের পক্ষে অগ্রাধিকার দেওয়া সম্ভব নয়, বলেন রেবেলো।

বৈপরিত্যটি স্পষ্ট: অ্যালগরিদম এখন এশিয়ায় বৈষম্যের অন্যতম নির্ধারক শক্তি হয়ে উঠছে, অথচ এই বিষয়ে সাংবাদিকতার নজরদারি মূলত নির্ভর করছে অস্থায়ী ও অনুদান-নির্ভর প্রকল্পের ওপর। রেবেলোর মতে, এর ফলে অ্যালগরিদম-নির্ভর জবাবদিহি সাংবাদিকতা  মৌলিক ও নিয়মিত অনুশীলন হিসেবে গড়ে ওঠার বদলে মাঝে মাঝে করা এক ধরনের উদ্যোগ হিসেবেই থেকে যাবে।

এআই বট যখন নাগরিকদের আলোচনাকে প্ররোচিত করে

ফিলিপাইনে একক ব্যক্তির একটি পরীক্ষা থেকে দেখা যায়, কীভাবে প্রযুক্তি জবাবদিহির বাধা কমাতে পারে। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও মিডিয়া পরামর্শদাতা জেমার্ক টর্ডেসিলা ২০২৫ সালের জাতীয় বাজেটের পুরো তথ্য কাস্টম জিপিটি চ্যাটবট বাজেট বট-এ আপলোড করেছিলেন। নাগরিকরা সাধারণ ভাষায় বটের কাছে প্রশ্ন করতে পারতেন, যেমন: “কেন এই জেলায় এতগুলো বাস্কেটবল কোর্ট আছে? কেন বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যয় এখানে হঠাৎ বেড়েছে?”

টর্ডেসিলা বলেন, যখন তিনি বাজেট বটকে ফেসবুকে পোস্ট করেন, সেটি হাজার হাজারবার শেয়ার হয়। সাধারণ নাগরিক, এনজিও, এবং র‍্যাপলারের মতো আউটলেট এবং পিসিআইজে বটের মাধ্যমে উদ্ভূত অস্বাভাবিকতা খুঁজে বের করে। তিনি বলেন, “এআই ব্যবহার করা সহজ; কিন্তু সেই ডেটা পাওয়া নিয়েই মূল ফাঁক থাকে।” তার টুল ব্যবহার করে সাধারণ মানুষ তাদের অনুসন্ধান অনলাইনে পোস্ট করেছিল, এনজিওগুলো সরকারী দাবি যাচাই করতে টুলটি ব্যবহার করেছিল, এবং সাংবাদিকরা নাগরিকদের শনাক্ত করা অস্বাভাবিকতাগুলো অনুসরণ করেছিল।

তবে এসব পরীক্ষা এবং সফলতার সত্ত্বেও, এশিয়ার ডেটা সাংবাদিকতা এখনো কাঠামোগত কঠোর সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করছে। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ২০১৪ সালে চীনের সাংবাদিকদের ডেটা দক্ষতায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ডেটা জার্নালিজম চায়না প্রতিষ্ঠা করা মা বলেন, সমস্যাটি দক্ষতার অভাব নয়। তিনি বলেন, “সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি সাংবাদিকদের দক্ষতা নয়, বরং পরিবেশ—এশিয়ার অনেক দেশ থেকে ডেটা পাওয়াটা ছিল, এবং সম্ভবত এখনো বড় চ্যালেঞ্জ।”

চীনে সাংবাদিকদের “বিকল্প ডেটা প্র্যাকটিস” ব্যবহার করতে হয়েছে, যেমন স্ক্র্যাপিং, ক্রাউডসোর্সিং বা স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে সরকারি ওপেন ডেটার অভাব পূরণ করা। মা বর্তমানে হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ে এআই ও উদ্ভাবন নিয়ে পড়ান, তবে একটি সতর্কবাণী দিয়ে বলেন: “মানবিক বিশ্লেষণ ও বিচারকে এআই দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায় না। সাংবাদিকরা কেবল এআই-কে জিজ্ঞেস করবেন না, ‘ডেটা থেকে গল্প কী?’ বরং সাংবাদিকরা নিজে গল্প খুঁজবেন, এবং তারপর এআইকে কিছু নোংরা ডেটা কাজের জন্য ব্যবহার করবেন।”

তিনি ম্যাপিং মাকোকো প্রকল্পের উদাহরণ দেন, যেখানে লাগোসের একটি বস্তির লোকদের ড্রোন এবং ওপেন ডেটা ব্যবহার করে নিজেকে মানচিত্রে তুলে ধরার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তার মতে, এশিয়ার ভবিষ্যত নির্ভর করছে আন্তসীমান্ত সহযোগিতার ওপর: “প্রযুক্তি যখন সীমান্ত অতিক্রম করছে, তখন সেই গল্পগুলোর যেগুলো অনুসরণযোগ্য, সেগুলোকে অতিক্রম করা উচিত।”

বড় প্রেক্ষাপট

মুম্বাইয়ের প্রাচি সালভে, অক্সফোর্ড ও মুম্বাইয়ের ক্যারেন রেবেলো, সিঙ্গাপুরের পেই ইয়িং লোহ, ব্যাংককের প্যাচার দুয়াংক্লাদ, মানিলার জেমার্ক টর্ডেসিলা, এবং হংকংয়ের ইয়োলান্ডা জিনক্সিন মা—এদের একত্রিত করা মূল বিষয় হলো সংখ্যা যেন কেবল বিমূর্ত না থেকে জীবন্ত অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়। ওয়াচডগ রিপোর্টিং, ডিজাইন, প্রশিক্ষণ বা পরীক্ষা—যেকোনো মাধ্যমে তারা ডেটাকে জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত করছে।

ইন্ডিয়াসপেন্ডের প্রাচি সালভে’র মতে, নির্ভরযোগ্য রেকর্ডের অভাবের প্রভাব কেবল পরিসংখ্যানেই সীমাবদ্ধ থাকে না। তিনি মনে করেন, “ যখন দেরিতে জনশুমারি হয়, তখন অন্যান্য ডেটাসেটকেও প্রভাবিত করে। খাদ্য নিরাপত্তা আইনের মতো এমন কল্যাণমূলক প্রকল্প থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাদ পড়ে। কারণ সুবিধাভোগীর সংখ্যা জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়।” তিনি যোগ করেন, ডেটা না থাকলে গোটা সম্প্রদায়গুলোই নাই হয়ে যায়।

বুম লাইভের নির্বাহী সম্পাদক ক্যারেন রেবেলো সতর্ক করে বলেন, নতুন অন্ধ বিন্দু তৈরি হচ্ছে। “সামাজিক কল্যাণ প্রকল্পে ব্যবহৃত অ্যালগরিদম—যা ভর্তুকিপ্রাপ্ত খাবার, দৈনিক মজুরি, পেনশন থেকে শুরু করে প্রতিবন্ধী ভাতা পর্যন্ত বিস্তৃত—অন্যায্যভাবে মানুষকে বাদ দিয়েছে, রেশন বঞ্চিত করেছে, মজুরি বিলম্বিত করেছে। এগুলো নিয়ে অনুসন্ধান করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

পাঞ্চ আপ-এর প্যাচার দুয়াংক্লাদ মনে করেন, ফাঁকফোকর শুধু ডেটা প্রাপ্তির মধ্যেই সীমাবন্ধ নয়, দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও নিহিত। তিনি বলেন, “চার্ট দেখে এখনও অনেকেই আতঙ্কিত হতে পারেন। চ্যালেঞ্জ হলো—ডেটাকে দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবে এমনভাবে উপস্থাপন করা যাতে তা হোমওয়ার্কের মতো কঠিন না হয়ে, কথোপকথনের মতো সহজ মনে হয়

তবে আশারও জায়গা আছে। জেমার্ক টর্ডেসিলা বলেন, “যখন নাগরিকরা বাজেটের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারে বা নিজে ডেটাসেট পরীক্ষা করতে পারে, তারা নিছক পাঠক থাকে না; তারা অনুসন্ধানের সহযোগী হয়ে ওঠে।”

কিন্তু ডেটা জার্নালিজম চায়নার ইয়োলান্দা জিনসিন মা মনে করেন, নতুন টুলের সুবিধা গ্রহণের সঙ্গে সতর্কতাও থাকা উচিত। তিনি বলেন, “আমি হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন এআই ও উদ্ভাবন নিয়ে পড়াই, তবে সবাইকে সর্তক করি এই বলে যে—আমরা জোর দেই যে এই টুলগুলো রির্পোটিংকে সহায়তা করবে, রির্পোটিং পরিচালনা করবে না ।”


র‌্যাচেল চিত্রা দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের জন্য, যেমন টেকইনএশিয়া, রয়টার্স, এবং খমের টাইমস। তিনি একজন অর্থনৈতিক বিটের সাংবাদিক, যিনি ডেটা ব্যবহার করে গল্প বলার প্রতি বিশেষ আগ্রহী। তার রয়টার্স ২০২৪ ফেলোশিপে তিনি “কভারিং হেট ক্রাইমস অ্যান্ড ভায়োলেন্স হোয়েন গভার্নমেন্ট সোর্সেস ফেল” শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র লিখেছেন, যেখানে ডেটা সংগ্রহের বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

 

অলংকরণন্যুক ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বর্তমানে সিওলের হানইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড আর্ট এডুকেশন বিভাগের ছাত্র এবং একই সঙ্গে ইলাস্ট্রেটর হিসেবে কাজ করছেন। ২০২১ সালে হিডেন প্লেস এ প্রদর্শনীর পর থেকে তিনি বিভিন্ন ইলাস্ট্রেশন প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। তার প্রধান আগ্রহ হলো হ্যান্ড ড্রইং, যা শিল্প জগত নিয়ে তার চিন্তাকে তুলে ধরে।

ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে আমাদের লেখা বিনামূল্যে অনলাইন বা প্রিন্টে প্রকাশযোগ্য

লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করুন


Material from GIJN’s website is generally available for republication under a Creative Commons Attribution-NonCommercial 4.0 International license. Images usually are published under a different license, so we advise you to use alternatives or contact us regarding permission. Here are our full terms for republication. You must credit the author, link to the original story, and name GIJN as the first publisher. For any queries or to send us a courtesy republication note, write to hello@gijn.org.

পরবর্তী

এশিয়া ফোকাস

অবৈধ বালু উত্তোলন আর তলিয়ে যাওয়া শহর— এশিয়ার গণমাধ্যম যেভাবে পরিবেশ ও জলবায়ু সংকট উন্মোচন করছে

জমি উদ্ধারের প্রক্রিয়ায় “অস্বাভাবিক পরিমাণ বালু ব্যবহৃত হচ্ছে, যা ভয়াবহ পরিবেশগত ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে”— এবং একই সঙ্গে অবৈধ বালু বাণিজ্যে জড়িতরা আন্ত:সীমান্ত অপরাধচক্রকে সহযোগিতা করছে। এশিয়াজুড়ে সাংবাদিকরা এখন জলবায়ু ও পরিবেশকে ধ্বংস করছে এমন আন্তসীমান্ত নির্ভর গল্পগুলোকে তুলে আনছেন— যা তাদের আরও গভীরে গিয়ে ঘটনা ও কারণ অনুসন্ধান এবং পরিবেশ ধ্বংসের নেপথ্যে থাকা শক্তিশালী স্বার্থগোষ্ঠীগুলোর সংযোগ খুঁজে পেতে সহায়তা করছে।

এশিয়া ফোকাস

‘প্রভাব অনেক সময় অদৃশ্য থাকে’: নেপালি সাংবাদিক কুন্দা দীক্ষিতের পেশাগত উত্থান-পতনের গল্প

সবচেয়ে বড় হুমকি আসে প্রতিশোধপরায়ণ রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে, যারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলে, মানহানির মামলা করে, কিংবা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে জেলে পাঠায়। জেলার রিপোর্টাররা বেশি ঝুঁকিতে থাকে, কারণ তারা ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থাকে। প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় অপরাধীরাই অনেক সময় সাংবাদিক হত্যা পর্যন্ত করে থাকে।

এশিয়া ফোকাস

এশিয়ায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা: চ্যালেঞ্জের মধ্যেও প্রতিরোধ, রূপান্তর, সংহতি

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের ২০২৫ সালের বিশ্ব গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক অনুযায়ী, এশিয়ার অধিকাংশ দেশেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা “অত্যন্ত সংকটপূর্ণ” অবস্থায় রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ দশটি দেশের মধ্যে সাতটিই এখন এশিয়ায়: রাশিয়া, ভিয়েতনাম, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, সিরিয়া, চীন এবং উত্তর কোরিয়া।

এশিয়া ফোকাস

রাষ্ট্র-ঘনিষ্ঠ ওলিগার্ক এবং সরকারি অর্থ আত্মসাৎ: এশিয়ায় অবৈধ অর্থপ্রবাহ অনুসন্ধান

সীমান্ত অতিক্রম করে নিয়মিতভাবেই অবৈধভাবে অর্থপাচার করা হচ্ছে, আর এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ছে এশিয়াতেও। এই অঞ্চলের অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা এমন সব প্রতিবেদন উন্মোচন করেছেন যেখানে অর্থনৈতিক অনিয়মের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। লুটেরা স্বৈরশাসক, নতুন জুয়া কেন্দ্র, এবং চুরি করা অর্থ গোপন রাখার বিশাল নেটওয়ার্কের কর্মকাণ্ডকে সাংবাদিকরা সামনে এনেছেন।